<p>২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রাক-বাজেট আলোচনা প্রথা অনুযায়ী বেশ আগেই শুরু করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী মো. শহীদুজ্জামান সরকার গণমাধ্যমকে বলেছেন, আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট হবে প্রায় আট লাখ কোটি টাকার। তিনি আরো জানিয়েছেন, বাজেটে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের প্রতিফলন ঘটবে। ঈদের আগেই বেশ কয়েকটি সেক্টরের প্রতিনিধিরা এনবিআরের মুখোমুখি হয়ে তাদের নিজ নিজ খাতের পক্ষ থেকে মতামত, সুপারিশ, সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব এবং দাবি উত্থাপন করেছেন সরকারের বিবেচনার জন্য।</p> <p>অনেক বছর পর যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় একজন পূর্ণ মন্ত্রী পেয়েছে। এটি ক্রীড়াঙ্গনের জন্য ইতিবাচক প্রাপ্তি। ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের নতুন মন্ত্রী নাজমুল হাসান শুধু দেশের ক্রীড়াঙ্গনে ক্রিকেট বোর্ডের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে জড়িত নন, আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গন তথা ক্রিকেটবিশ্বেও তাঁর ব্যাপক পরিচিতি আছে। পেশাদারি  মানসিকতাসম্পন্ন এই ব্যক্তিত্ব মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই ক্রীড়া সংগঠকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে বলেছেন, দেশের ক্রীড়াচর্চা অগ্রাধিকার নির্ণয় করে পরিচালিত হলে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাবে। তিনি আরো বলেছেন, ক্রীড়াঙ্গনে ব্যক্তির সম্ভাবনা কাজে লাগানোর সুযোগ এখন অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বহুগুণ বেশি। ক্রীড়াঙ্গনে ক্রীড়া সংগঠকদের সম্মিলিতভাবে জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে সচেতনতা এবং উৎসাহ দেখানোটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।</p> <p>এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহ চলছে। দেশের ক্রীড়াঙ্গন থেকে ক্রীড়া সংগঠকরা সম্মিলিতভাবে খেলাধুলা পরিচালনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা, প্রস্তাব, সুপারিশ, প্রয়োজনীয় দাবি উত্থাপন করে এনবিআরের সঙ্গে বসার উদ্যোগ নেননি, যেটি করা উচিত ছিল। বাজেট তৈরির কাজ কিন্তু দ্রুত এগিয়ে চলেছে। ক্রীড়াঙ্গনের বাজেট নিয়ে মাথা ঘামানো, বিভিন্ন ধরনের প্রস্তাব এবং সুপারিশ শুধু মন্ত্রী বা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নয়। মন্ত্রী এবং মন্ত্রণালয় তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব তো পালন করবেই। ক্রীড়াঙ্গনের চালিকাশক্তি হলেন ক্রীড়া সংগঠকরা। ক্রীড়াঙ্গনে বিরাজমান সমস্যার আশু সমাধান, বাস্তবতায় দেশজুড়ে খেলাধুলার চর্চার ক্ষেত্রে অন্তরায়, সচল রাখা এবং এর উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ কী হওয়া উচিত, এটি সবচেয়ে ভালো বোঝেন সংগঠকরা। এ ক্ষেত্রে তাঁদের অভিজ্ঞতা গুরুত্বপূর্ণ। দেশের ক্রীড়াঙ্গনে যাঁরা নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করছেন, প্রত্যক্ষভাবে ক্রীড়াঙ্গনকে নিয়ন্ত্রণ করছেন—এ ক্ষেত্রে খেলার চর্চার বৃহত্তর স্বার্থে তাঁদের এগিয়ে আসা উচিত ছিল। ক্রীড়াঙ্গনে সংগঠকরা কিন্তু জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতার ঊর্ধ্বে নন। ক্রীড়াঙ্গন আস্থা এবং আদর্শের সংকটে সব সময় ভুগছে। আগে চুপচাপ থেকে বাজেট উত্থাপনের পর মিডিয়ায় লম্বা লম্বা কথা বলা স্রেফ ব্যক্তি প্রচার।</p> <p>সমস্যা আছে—এটি অস্বীকার করলে সমস্যার সমাধান আসবে না। জাতি স্বাধীনতা অর্জনের পর পাঁচ দশক পার করে ফেলেছে। এ সময়ের মধ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই বাহাত্তর-তিয়াত্তরের দিনগুলোতে ক্রীড়াঙ্গন ঘিরে যে স্বপ্নের কথা বলেছিলেন—বিভিন্ন ধরনের দুর্বলতার জন্য সেগুলোর অনেকগুলোই বাস্তবায়িত করা সম্ভব হয়নি। ক্রীড়াঙ্গনে অনেক উদ্যোগ এবং নীতি ভালো ছিল না, যার খেসারত এখন দিচ্ছে ক্রীড়াঙ্গন।</p> <p>জাতীয় জীবনে ক্রীড়াঙ্গনের গুরুত্বের কথা বলা হলেও বাজেটে ক্রীড়াঙ্গনে সরকারের বরাদ্দ সব সময় অপ্রতুল। এটি অতীতে বিভিন্ন সময় ক্রীড়ামন্ত্রীরাও অকপটে স্বীকার করেছেন, বিশেষ করে খেলা পরিচালনা, প্রশিক্ষণ ও অনুশীলন, তৃণমূল পর্যায় থেকে নতুন প্রতিভা অন্বেষণ, দেশে ও বিদেশে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার আগে দীর্ঘ সময় ধরে দেশে ও বিদেশে নিরবচ্ছিন্ন অনুশীলন কার্যক্রমে। ক্রীড়াঙ্গনে যে ক্ষেত্রে উপকৃত হবে, সেই উৎপাদনশীল ক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দ কম। এদিকে বাজেটে বড় অঙ্কের বরাদ্দ থাকে নতুন নতুন অবকাঠামো নির্মাণ, যেগুলো আছে সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ এবং কতগুলো চিহ্নিত ক্ষেত্রে।</p> <p>ক্রীড়াঙ্গনে নতুন ক্রীড়া কাঠামো ও স্থাপনার প্রয়োজন হলে অবশ্যই করতে হবে—তবে এ ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে এর যথাযথ ব্যবহার, কার্যকারিতা এবং প্রয়োজনীয়তা যাচাই করেই প্রকল্প অনুমোদন করা উচিত। এ ক্ষেত্রে এখন অভিজ্ঞতা ভালো নয়। জনগণের করের কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে দেশের বিভিন্ন স্থানে কাঠামো ও স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। এর মধ্যে অনেকগুলো ব্যবহৃত না হতে হতে পরিত্যক্ত তালিকায় স্থান পেতে চলেছে। সরকারের ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের জন্য এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ এখন বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এলাকার প্রভাবশালী দলীয় নেতা এবং অন্যরা প্রভাব খাটিয়ে এগুলোর অনুমোদন করিয়ে নিয়েছেন—ব্যক্তি ও সমষ্টির স্বার্থে। বর্তমান ক্রীড়ামন্ত্রী সম্প্রতি বলেছেন, সব জায়গায় স্টেডিয়ামের কোনো দরকার নেই—দরকার ভালো মাঠের, যেখানে খেলার চর্চা এবং খেলার আয়োজন সম্ভব হবে।</p> <p>অতীতে অপ্রয়োজনীয় ক্রীড়াকাঠামো নির্মাণ করে সরকারের কোটি কোটি টাকা পানিতে গেছে—অথচ উৎপাদনশীল ক্ষেত্র তথা খেলা পরিচালনা, প্রশিক্ষণ কর্মসূচি, প্রতিভা অন্বেষণ এবং আন্তর্জাতিক কম্পিটিশনে অংশ নেওয়ার বেশ আগে থেকে পরিকল্পনামাফিক অনুশীলন, কর্মসূচির আয়োজন অর্থের অভাবে সম্ভব হয়নি। যে বিনিয়োগ দেশকে কিছু দিতে পারবে, বাস্তবতার আলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেখানে সরকারের অর্থ বরাদ্দ উচিত। যেমন—নারী ফুটবল অনেক ক্ষেত্র থেকে অনেক বেশি সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও অর্থের অভাবে সব সময় ধুঁকছে। নারী ফুটবল দেশজুড়ে বিকশিত হতে পারছে না। এতে ফুটবলে নারীর সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে না। প্রয়োজন নারী ফুটবলের জন্য বাজেটে পৃথক বরাদ্দ। এ ছাড়া পৃথক বরাদ্দ দেওয়া হোক সেই কয়েকটি খেলায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে, যেখান থেকে ক্রীড়াঙ্গন আশা করতে পারে।</p> <p>দেশে বিভিন্ন খেলার চর্চায় ব্যবহৃত ক্রীড়া সরঞ্জামাদির মধ্যে শতকরা ৯৫ ভাগ বিদেশ থেকে আমদানি করা। চড়া মূল্যে এগুলো বাজার থেকে ক্রয় করতে হয়। অগ্রিম কর, ভ্যাট এবং নির্ধারিত কর আছে সরঞ্জামাদির ওপর। ইদানীং ডলার সংকটের কারণে আমদানি করা সরঞ্জামাদির দাম আরেক ধাপ বেড়েছে। এতে দেশজুড়ে খেলার চর্চা অনেক কমে গেছে। কিশোর, তরুণ ও যুবকরা পারছে না তাদের ছোট ছোট ক্লাব ও সংগঠনের মাধ্যমে আগের মতো খেলাধুলা চালিয়ে যেতে। শুধু মফস্বল শহরগুলোতে নয়, খোদ ঢাকা এবং অন্যান্য বিভাগীয় শহরেও অনেক ক্লাব এখন চড়া মূল্যে আমদানি করা সরঞ্জামাদি কিনে বিভিন্ন খেলার চর্চায় উৎসাহ দেখাচ্ছে না। কিছুদিন আগে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের স্পোর্টসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলেছেন, তাঁদের পর্যবেক্ষণে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে খেলার চর্চা কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো সরঞ্জামাদির অভাব এবং চড়া মূল্য। স্কুল ও কলেজ কর্তৃপক্ষ আগে ক্রীড়া সরঞ্জামাদি কিনত। এগুলো তারা বাদ দিয়ে দিয়েছে দাম কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়ায়।</p> <p>আমদানি করা সরঞ্জামাদির ওপর অগ্রিম কর, ভ্যাট এবং কর প্রদান করে বিক্রি করা হয়। এতে দাম অনেক বেড়ে যায়। দেশে ক্রীড়াঙ্গনের স্বার্থে অগ্রিম কর, ভ্যাট এবং সেলস করের একটি বড় অংশ মওকুফ করা হলে সরঞ্জামাদির দাম কিছুটা হলেও কম পড়বে। সুস্থ ও সবল জাতি গঠনে খেলাধুলার যে ভূমিকা, করের একটি অংশ মওকুফ করা সেই তুলনায় কিছুই নয়।</p> <p>আমাদের মতো দেশে সরকারের পক্ষে খেলাধুলার সব দায়দায়িত্ব নিয়ে নেওয়া কখনো সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন বাণিজ্যিক ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা। দুনিয়াজুড়ে দেশে দেশে বাণিজ্যিক পৃষ্ঠপোষকতা খেলার চর্চা এবং খেলার আয়োজনে প্রধান শক্তি হিসেবে কাজ করছে। কিছুদিন আগে ক্রীড়ামন্ত্রী বাণিজ্যিক পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে খেলাধুলা পরিচালনার আহ্বান জানিয়েছেন বিভিন্ন ফেডারেশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলার সময়। বাণিজ্যিক পৃষ্ঠপোষকতার বিষয়টি কিন্তু টু ওয়ে ট্রাফিক। উভয়ের প্রয়োজনে উভয়। বাণিজ্যিক পৃষ্ঠপোষকরা তখনই ক্রীড়াঙ্গনে উৎসাহ দেখাবে, যখন তারা এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করে উল্লেখ করার মতো অর্থ রিবেট পাবে। ক্রীড়াক্ষেত্রকে সাপোর্ট করার জন্য আসন্ন বাজেটে রিবেটের পরিমাণ বৃদ্ধি করা উচিত।</p> <p>লেখক : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি, এআইপিএস এশিয়া। আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন প্যানেল রাইটার, ফুটবল এশিয়া</p>