<p>ভারতীয় আইআইটি দিয়েই শুরু করি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখনো শুরু হয়নি, তবে ইউরোপের রাজনীতি ভেতরে ভেতরে উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে। পণ্ডিত জোয়াহেরলাল নেহরু ভারতীয় কংগ্রেসের হাল ধরেছেন। প্রথম ও দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবের ইতিহাস তাঁর জানা। ভারতের স্বাধীনতাই তাঁর ও কংগ্রেসের একমাত্র চিন্তা-ভাবনা ছিল না, স্বাধীনতার পর ভারতের সার্বিক উন্নতির রূপরেখা নিয়েও তিনি চিন্তা-ভাবনা করছেন। দেশপ্রেমিক, আলোকিত মানুষ ও বিজ্ঞানীদের পরামর্শ নিচ্ছেন হরহামেশা তাঁর নিজের চিন্তা-চেতনাকে শাণিত করার জন্য। ১৯৩৬ সালে কংগ্রেসের কাঠামোর ভেতরে তিনি গঠন করলেন ভারতীয় পারমাণবিক শক্তি কমিটি, যা নিয়ে তখন অনেকেই ঠাট্টা-মসকরা করেছে। দরিদ্র ভারতবর্ষে নেহরুর এই চিন্তাকে হাস্যকর ভাবনা বলেই মনে করত অনেকে।</p> <p>নেহরু দমার পাত্র নন। নানা পর্যায়ে যোগাযোগ শুরু করলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নেহরুর থেকে সবুজ সংকেত পেয়ে তখনো পরাধীন ভারতবর্ষের ভাইসরয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের (ভিএসি) ভারতীয় কর্মকর্তা স্যার আর্দেশির দালাল এগিয়ে এলেন। তিনি বললেন, পুঁজিবাজার দিয়ে ভারতবর্ষের যতটা না উন্নতি হবে, তার চেয়েও বেশি দেশকে এগিয়ে নেবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রসার। একই সঙ্গে নেহরু দেশপ্রেমিক বিজ্ঞানীসমাজকে পাশে নিয়ে ভবিষ্যৎ ভারতের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কিভাবে শক্ত ভিত্তিতে দাঁড় করানো যায় তার<br /> রূপরেখা তৈরি করলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর শান্তিবাদী পদার্থবিদ ওপেন হাইমার ও নিলস বোর পশ্চিমা রাজনীতির কাছে প্রায় নিগৃহীত—নিজ নিজ দেশে তাঁরা বলতে গেলে একঘরে। পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র তখন সারা বিশ্বকে বলতে গেলে দুই ভাগে ভাগ করে ফেলেছে। এরই মাঝে নেহরু যোগাযোগ করলেন নিলস বোরের সঙ্গে—তাঁর আমন্ত্রণে বোর এলেন ভারতে। দেশের প্রধানমন্ত্রী বোরের পরামর্শ নিলেন।</p> <p><img alt="আইআইটির আদলে দেশে বিআইটি হোক" height="271" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/0.April/02-04-2024/Untitled-1.jpg" style="float:left" width="321" />পারমাণবিক পদার্থবিদ হোমি জাহাঙ্গীর ভাবাকে ভারতের নবগঠিত পারমাণবিক শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান করা হলো। এখানে বলে রাখা ভালো, জাহাঙ্গীর ভাবা কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেওয়ার পর নেহরুকে একটি শর্ত দিয়েছিলেন। শর্তটি হলো, কমিশনের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী ও চেয়ারম্যানের মধ্যে কোনো তৃতীয় ব্যক্তি থাকবে না—আমলা তো অবশ্যই না। তিনি তাঁর ফাইল নিয়ে আসবেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে, কাজ শেষে তিনি এসে নিয়ে যাবেন ফাইল। বোদ্ধা নেহরুও চেয়েছিলেন তা-ই।</p> <p>পারমাণবিক কমিশনের চেয়ারম্যান ও প্রধানমন্ত্রীর সম্পর্ক সেভাবেই নির্ধারিত হয়েছে। আমলাতন্ত্রের বেড়াজালে পড়ে সেই নিয়মের কোনো ব্যত্যয় হয়নি। আমাদের দেশের পারমাণবিক শক্তি কমিশন (এর কাজটি কী?) আর প্রধানমন্ত্রীর সম্পর্ক কী? আমাদের জানা নেই। তবে শুনেছি, সময়ে-অসময়ে আমলারা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের কর্মপদ্ধতি তৈরি করে দেন। অবাক সেলুকাস! তবে এই পোড়া দেশে বর্তমানে কোনো কিছুতেই আমি আর অবাক হই না।</p> <p>২.</p> <p>আগের আলোচনায় ফিরে যাই। দূরদর্শী একজন রাজনৈতিক নেতা প্রধানমন্ত্রী নেহরু ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন, মহাত্মা গান্ধীর চরকার সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তিকে এগিয়ে নিতে হবে বিশেষায়িত মানুষকে দিয়ে। সঠিক জায়গায় সঠিক মানুষকে বসাতে হবে সঠিক সময়ে। নেহরু তাতে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নেননি। ড. হুমায়ুন কবির ও ডা. বিধানচন্দ্র রায় এগিয়ে এলেন স্যার আর্দেশির বিজ্ঞান-প্রযুক্তির চেতনাকে এগিয়ে নিতে—সেটি ১৯৪৬ সালের কথা। প্রধানমন্ত্রী নেহরুর পৃষ্ঠপোষকতায় ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভের সঙ্গে সঙ্গেই বিশেষায়িত কমিটি কাজ শুরু করল ভারতের ভবিষ্যৎ বিজ্ঞানচর্চার মূলভূমি তৈরির কাজে। নেহরু সরকার ১৯৪৮ সালে চারটি আইআইটি (ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি) স্থাপনের উদ্যোগ নিল। ১৯৫০ সালে পশ্চিমবঙ্গের খড়গপুরে প্রতিষ্ঠিত হলো ভারতের প্রথম আইআইটি। এর উদ্বোধন করলেন মাওলানা আবুল কালাম আজাদ। তারপর ভারতের চার কোনায় প্রতিষ্ঠিত হলো চারটি আইআইটি। ১৯৫৬ সালে প্রধানমন্ত্রী নেহরু গর্বের সঙ্গে উচ্চারণ করলেন, খড়গপুরের এই প্রতিষ্ঠান ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ তৈরির পথ সুগম করবে। আজকের এই প্রতিষ্ঠান থেকে বের হওয়া স্নাতক/স্নাতকোত্তররা আগামী দিনের ভারতবর্ষের প্রযুক্তিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।</p> <p>শুধু ভারতবর্ষ নয়, সারা জগতের তথ্য-প্রযুক্তিকে আজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন ভারতের আইআইটির গ্র্যাজুয়েটরা। যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালির ৬০ শতাংশ বিশেষজ্ঞই ভারতীয় তথা আইআইটির গ্র্যাজুয়েট।</p> <p>৩.</p> <p>সাত দশকেরও বেশি সময় আগে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ার লক্ষ্যে, আজ তার সুফল পাচ্ছে দেশটির সবাই। ভারতের অনেক রাজ্য, বিশেষ করে দক্ষিণের তামিলনাড়ুর বেঙ্গালুরু শহর হয়ে উঠেছে দেশটির তথ্য-প্রযুক্তির এক বিশ্বকেন্দ্র। ওখানকার তরুণ তথ্য-প্রযুক্তিবিদরা নিজ দেশে বসে উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ ও জগতের বহু দেশে নিয়ত প্রযুক্তি সহায়তা দিচ্ছেন। ভারত সম্ভবত বহির্বিশ্বে তথ্য-প্রযুক্তির এক নম্বর সেবাদাতা দেশ। বছর কয়েক আগে তৎকালীন জাপানের প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রীয় সফরে ভারতে এসে বলেছিলেন, ভারত সফটওয়্যারের গুরু আর আমরা হলাম হার্ডওয়্যারের গুরু। আমাদের ব্যাবসায়িক জুটি হতে পারে। নিজ দেশের চাহিদা মিটিয়ে ভারত আজ সারা বিশ্বে তাদের তথ্য-প্রযুক্তি বিক্রয় করছে, আয় করছে অভাবনীয় বৈদেশিক মুদ্রা। একজন নেতার দূরদর্শিতা দেশকে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির শিখরে নিয়ে যেতে পারে, ভারত তার প্রমাণ।</p> <p>৪.</p> <p>এবার আসি নিজ দেশের কথায়। বছর দেড়েক আগে মণি সিংহ-ফরহাদ ট্রাস্ট আয়োজিত এক ওয়েবিনারে যোগ দিয়েছিলাম। আলোচনার এক পর্যায়ে ওয়েবিনারে থাকা তৎকালীন তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রীকে প্রশ্ন করেছিলাম, ভারতবর্ষ তার স্বাধীনতার ঠিক পরপরই ওদের প্রথম আইআইটি চালু করে। আজ ওখানে দুই ডজনের মতো আইআইটি আছে, যা তাদের চাহিদা মিটিয়ে সারা জগেক তথ্য-প্রযুক্তির সেবা দিচ্ছে। আমাদের দেশে আইআইটির আদলে একটিও বিআইটি (বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি) হলো না কেন? উনি উত্তর দিলেন, বঙ্গবন্ধুর বিজ্ঞ চেতনায় বিআইটির মতো কিছু একটা ছিল, কিন্তু তাঁর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর আর সেটা হয়নি। আমি তাঁকে সবিনয়ে বললাম, দেখুন, আমিও বিশ্বাস করি, বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে তাঁর সময়কালেই আমরা অন্তত একটি বিআইটি পেতাম। তাঁর মর্মান্তিক মৃত্যুর পর প্রায় চার যুগ চলে গেছে, কিন্তু এর মধ্যে কি এমন কেউ আসেননি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়, যিনি দেরিতে হলেও বাংলাদেশে অন্তত একটি বিআইটি তৈরি করতে পারতেন? এর উত্তর হয়তো বা মন্ত্রী দিতে চাননি অথবা দেননি।</p> <p>৫.</p> <p>ভারত যেখানে এক বছরও কালক্ষেপণ করেনি, সেখানে আমাদের ইতিহাস থেকে ৫৩ বছর চলে গেল, অথচ আমরা আজও একটি বিআইটি পেলাম না। যা হোক, শত হতাশার মধ্যেও আমরা আশার আলো দেখতে চাই। তাই আশা করি, কোনো ধরনের কালক্ষেপণ না করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে দেশে প্রথম বিআইটি তৈরির পদক্ষেপ নেওয়া হবে।</p> <p>বিআইটির জন্য কার্যপ্রণালী ও নীতিনির্ধারণী তৈরি করতে আমাদের বেগ মোটেই পেতে হবে না। ভারতের আইআইটির আদলে প্রথম পর্যায়ে স্নাতকোত্তর শিক্ষাক্রম শুরু করতে হবে। এখানে শুধু তথ্য-প্রযুক্তিই নয়, স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিতে আসবে ফলিত বিজ্ঞানেরও বাছাই করা শিক্ষার্থীরা। এক দশক স্নাতকোত্তর শিক্ষার পরপরই অবস্থা বুঝে স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষাক্রম শুরু করা যেতে পারে। আজ দেশে ১৫০টির মতো বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যার মধ্যে একটির মানও আন্তর্জাতিক মানের নয়। এটি আমার কথা নয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাংকিংয়ের অবস্থা দেখে সহজেই সেটি বোধগম্য। টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় নামে যেগুলো খোলা হচ্ছে, ওখানে ভালো টেকনিশিয়ানও তৈরি হয় না। সাম্প্রতিককালে ভারতের চন্দ্রযান চাঁদের সবচেয়ে বিরল জায়গায় অবতরণ করেছে। অবাক হওয়ার কিছু নেই, পশ্চিমবঙ্গের টেকনিক্যাল কলেজগুলো থেকে পাস করা তরুণ প্রযুক্তিবিদরা চন্দ্রযানটির সফটওয়্যার তৈরি করেছেন।</p> <p>বাংলাদেশ এক সম্ভাবনার দেশ। আমাদের তরুণসমাজের মেধা বিশ্বমানের। বিআইটি তৈরি হলে আমাদের বর্তমান প্রজন্ম থেকেই বেরিয়ে আসবে সুন্দর পিচাই আর পরাগ আগরওয়ালের মতো তথ্য-প্রযুক্তিবিদ, যারা বিশ্বপ্রযুক্তিতে বিশ্বমানের অবদান রাখতে পারবে। বিআইটির মাধ্যমে আমাদের তরুণসমাজকে একটু ধরিয়ে দিলেই হয়, বাকিটা তারাই করে নেবে। আর আজ যদি আমরা সেটা না করতে পারি, তবে এই না পারার গ্লানি যুগের পর যুগ আমাদের বয়ে বেড়াতে হবে।</p> <p>লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, সুলতান কাবুস বিশ্ববিদ্যালয়, ওমান এবং সাবেক অধ্যাপক</p> <p>ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়</p>