অধুনা কাজকর্মের পৃথিবী ব্যাপক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। প্রথাগত যে কাজ আগে মানুষ করত, তা এখন ক্রমাগত প্রযুক্তির দখলে চলে যাচ্ছে। একই সঙ্গে গাদায় গাদায় তৈরি হয়ে চলেছে প্রযুক্তিপ্রবণ পেশা। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো অনলাইন ফ্রিল্যান্সিং—সোজা কথায় যার অর্থ অনলাইনে নিজের দক্ষতা বিক্রি।
ফ্রিল্যান্সিং কর্মক্ষেত্রে এগোচ্ছে নারীরা
- আব্দুল বায়েস

সমর্থিত এক সূত্র থেকে পাওয়া সুখবর হলো, ফ্রিল্যান্সিংয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এরই মধ্যে একটি অবস্থান তৈরি করতে সমর্থ হয়েছে। বৈশ্বিক অনলাইন শ্রম সরবরাহে ভারতের পর বাংলাদেশের দ্বিতীয় অবস্থান; ৬৫ হাজার নিবন্ধিত ফ্রিল্যান্সার নিয়ে বৈশ্বিক বাজারের প্রায় ১৭ শতাংশ বাংলাদেশের দখলে। তা ছাড়া এই মঞ্চ এবং সুখ্যাতি বাংলাদেশের অনলাইন কর্মীদের জন্য বিশ্বব্যাপী পর্যাপ্ত গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত অন্যান্য কারিগরি কর্মের ক্ষেত্রে যেমন, ফ্রিল্যান্সিংয়ে নিবন্ধিত সব অনলাইন কর্মীর মধ্যেও নারীদের অংশ মাত্র ৯ শতাংশ।
দুই.
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) কয়েকজন গবেষক ফ্রিল্যান্সিংয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রায় এক হাজার নারীর আয়, কর্মসংস্থান, আস্থা, আকাঙ্ক্ষা, ক্ষমতায়ন, দক্ষতা এবং জীবনযাত্রার ধরনের ওপর এই কর্মসূচির প্রভাব মূল্যায়ন করেন। প্রাপ্ত প্রশিক্ষণের প্রভাবের পরিমাণ ও গুণগত দিক বিবেচনায় নিয়ে তাঁরা একটি মিশ্রণ পদ্ধতি অনুসরণ করেন। পরিমাণগত ফলাফল পর্যালোচনা করতে রেনডমাইজড কন্ট্রোল ট্রায়াল (আরসিটি) পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
তিন.
বিআইজিডি পরিচালিত সমীক্ষা থেকে প্রাপ্ত পরিমাণগত পর্যবেক্ষণ বলছে, প্রকল্প বাস্তবায়ন সময়ে দুটি শর্তই প্রায় শতভাগ পূরণ হয়েছে অর্থাৎ প্রশিক্ষণপ্রার্থীদের শতভাগ এসএসসি ডিগ্রিধারী এবং তাদের ৯৫ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ৩৫ বছর।

ফলোআপ সমীক্ষার ভিত্তিতে প্রভাব মূল্যায়নে দেখা যায়, শ্রমবাজারে এ ধরনের প্রশিক্ষণের প্রভাব বেশ উৎসাহব্যঞ্জক; যেমন—প্রশিক্ষণ শেষে কর্মসংস্থান, কাজের ঘণ্টা এবং আয় বৃদ্ধি পায় যথাক্রমে ২৬, ৪২ ও ৫৪ শতাংশ। এর অর্থ দাঁড়ায়, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারী কর্ম ও উৎপাদনশীলতায় অগ্রগামী। এর ফলে তাদের আয়ও বেশি ছিল। বলা বাহুল্য, যেহেতু প্রশিক্ষণ নিয়েছে ফ্রিল্যান্সিংয়ের ওপর, তাই আপাতত ইতিবাচক ফলাফলের পেছনের কারণ প্রশিক্ষণ বলে ধরে নেওয়া যায়। তবে এটিও দেখা যায় যে যারা বেশি বেশি ক্লাস করেছে, তাদের উন্নতিও বেশি হয়েছে; যেমন—যারা ৪৮টি ক্লাসের মধ্যে কমপক্ষে ২৫টি ক্লাসে যোগ দিয়েছে, তাদের ফ্রিল্যান্সিং কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ৪২ শতাংশ।
স্মরণ করা দরকার, ইন্টারভেনশনটি (এখন থেকে হস্তক্ষেপ) ছিল ফ্রিল্যান্সিং কর্মকাণ্ডে কম্পিউটার সফটওয়্যার প্রয়োগ নিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া। তাই প্রথমেই ইতিবাচক প্রবণতা লক্ষ করা যায় যন্ত্রটি নাড়াচাড়া আর ব্যবহারের ক্ষেত্রে। এই বর্ধিত দক্ষতা আয়কে প্রভাবিত করেছে বলে প্রতীয়মান হয়। যেমন—যারা প্রশিক্ষণ নেয়নি, তাদের চেয়ে ৩৮ শতাংশ বেশি আয় ছিল যারা প্রশিক্ষণ নিয়েছে তাদের। স্বভাবতই বর্ধিত আয় উত্তরদাতার ভোগও বাড়ায়। যেমন—তাদের খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় বৃদ্ধি যথাক্রমে ৪৮ ও ৪১ শতাংশ। এর তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী। কেননা হস্তক্ষেপটির জন্য ভোগ বৃদ্ধি মানবপুঁজি গঠনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। অন্যদিকে ঋণগ্রস্ত খানার অনুপাত হ্রাস ও সঞ্চয়কারী খানার অনুপাত বৃদ্ধি পায়; যদিও আস্থা ও আকাঙ্ক্ষা জনিত প্রভাব তেমন তাৎপর্যপূর্ণ নয় বলে লক্ষ করা যায়, তার পরও সমীক্ষায় নারীর ক্ষমতায়নের কিছু নির্দেশকে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন দেখা যায়। অংশগ্রহণকারীদের মনোবৈজ্ঞানিক মঙ্গল বেড়েছে—সুখ ও চাপের ওপর তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। যেমন—ট্রিটমেন্ট গোষ্ঠীর চার-পঞ্চমাংশ জানিয়েছে যে গেল এক মাসে তারা কোনোভাবেই চাপের মধ্যে ছিল না। এর একটি কারণ হয়তো এই যে নিয়ন্ত্রিত গোষ্ঠীর তুলনায় তিন-চতুর্থাংশ বেশি ট্রিটমেন্ট গোষ্ঠী অবহিত করেছে যে তারা গেল মাসে কোনো আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হয়নি। এবং প্রত্যাশিতভাবে এই হস্তক্ষেপের ফলে ফ্রিল্যান্সিং সংক্রান্ত জ্ঞান বৃদ্ধি ঘটেছে ১২ শতাংশ।
মূল্যায়নে দেখা যায়, অংশগ্রহণের হার বা আপটেক খুব একটা বেশি ছিল না, মাত্র ৫৫ শতাংশ অংশগ্রহণকারী কমপক্ষে মোট ক্লাসের অর্ধেক করেছে, যেখানে অংশগ্রহণকারীদের মাত্র এক-পঞ্চমাংস সব ক্লাসে উপস্থিত ছিল। উপদেশমূলক অধিবেশনে অংশগ্রহণের হার ছিল খুবই কম। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ সংক্রান্ত অধিবেশনে অংশগ্রহণ বৃদ্ধি সাপেক্ষে প্রকল্পটির প্রভাবের প্রসার সম্ভবত আরো বেশি হতে পারত।
চার.
গুণগত পর্যালোচনা করতে গিয়ে গবেষকরা মূলত প্রকল্পপ্রক্রিয়ার অংশগ্রহণকারীদের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে প্রতিটি ধাপের আলোকে হস্তক্ষেপের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। তুলনামূলক আলোচনা তুলে ধরে তাঁরা সফল ও ব্যর্থ অংশগ্রহণকারীদের বৈশিষ্ট্যের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণে ব্রতী হন।
প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ না করা কিংবা ফ্রিল্যান্সিং চালিয়ে না যাওয়ার পেছনে প্রধান একটি কারণ হচ্ছে সফলতার জন্য যে সময় বিনিয়োগ করা দরকার, সে সময়ের অভাব। বেশির ভাগ প্রশিক্ষণার্থীকে তাদের নিজ নিজ খানার ব্যবস্থাপনায় সময় দিতে হয়, সবার দেখভাল ও খানার অন্যান্য কাজ সেরে প্রশিক্ষণ ক্লাসে যাওয়ার সময় থাকে না অথবা সময় থাকে খুব কম। আবার ক্লাসে এলেও খানার বিভিন্ন বিষয়, দায়িত্ব এবং ঘটনা মনোযোগ ছিনিয়ে নেয়। দ্বিতীয় কারণ ক্রেতার সঙ্গে অব্যাহতভাবে ইংরেজি ভাষায় যোগাযোগ রক্ষা করার ক্ষেত্রে পারঙ্গমতার খামতি। কিছু প্রার্থীর ধারণা এই যে তাদের লব্ধ ইংরেজি জ্ঞান ক্রেতার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষায় পর্যাপ্ত নয়, যা প্রতিনিধিত্ব বা দর-কষাকষির জন্য উপযুক্ত নয়। তৃতীয়ত, কিছুসংখ্যক প্রশিক্ষণার্থীকে মা-বাবার নৈতিক সমর্থন না পেয়ে তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করতে হয়েছে। তারা মনে করে, মা-বাবার সহযোগিতা পেলে প্রশিক্ষণ থেকে আরো ভালোভাবে লাভবান হতে পারত। এমনকি কারো কারো ক্ষেত্রে পরিবারের প্রতি চ্যালেঞ্জের বিপরীতে ফ্রিল্যান্সিং থেকে পাওয়া উপার্জন দেখাতে হয়েছে। চতুর্থত, দরকারি সফটওয়্যার মসৃণভাবে চালাতে হলে চাই উঁচু ক্ষমতা এবং মানসম্মত কম্পিউটার, যা অনেক প্রার্থীর লভ্যতার বাইরে ছিল বলে প্রতীয়মান হয়।
অবশ্য এর সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে অবস্থান ছিল সফলকামীদের। তাদের না ছিল সময়ের অভাব, না ছিল পারিবারিক প্রতিবন্ধকতা। খুব সুন্দর করে দক্ষতার সঙ্গে দুই দিক সামলাতে পেরেছে এই কামিয়াব নারীরা। আসলে বাড়িতে বসে ফ্রিল্যান্সিং করতে সময় পাওয়াটা যেমন সুবিধাজনক, পারিবারিক সমর্থন তার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয় বলে তাদের ধারণা। ফ্রিল্যান্সিং যারা সফলভাবে শেষ করতে পেরেছে, তাদের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে সুপারিশ ও জাতীয় ফ্রিল্যান্সিং বাজারে চাকরির খোঁজ পাওয়ার নিমিত্তে বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের সদস্যদের সংযোগ। তৃতীয়ত, কারো কারো শিক্ষাগত যোগ্যতা অথবা ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা দর-কষাকষি করে নিজের নৈপুণ্য বিক্রির বেলায় অন্যের চেয়ে সুবিধা বেশি ছিল। সব শেষে নিরবচ্ছিন্ন মনোযোগে কাজ করে যাওয়া এবং উন্নতি করার বেলায় বিজ্ঞ পরামর্শদাতা কিংবা সমকক্ষের সহযোগিতা সফলতার অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে বিবেচনা করেছে কেউ কেউ।
ছয়.
উপসংহারে উপলব্ধি এই যে ফ্রিল্যান্সিং কর্মসূচিতে নিয়মিত অংশগ্রহণ শিক্ষিত, স্বল্প প্রাধিকারপ্রাপ্ত নারীদের আর্থিক ক্ষমতায়নে বড়মাপের প্রভাব রাখতে পারে।
কার্যকর সম্প্রসারণের স্বার্থে বাস্তবায়নকারী, অংশগ্রহণকারী এবং নীতিনির্ধারক—এই তিন শ্রেণির জন্য কয়েকটি সুপারিশ তুলে ধরা যায়।
ক. বাস্তবায়নকারীর জন্য সুপারিশ : প্রত্যেক প্রার্থীর আবেদন তার অন্তর্নিহিত সামর্থ্য ও দক্ষতার ভিত্তিতে মূল্যায়নের নিমিত্তে লক্ষ্যপ্রক্রিয়া শাণানো। প্রশিক্ষণার্থীদের দরকার এবং দক্ষতা অনুযায়ী বিভিন্ন গোষ্ঠীর জন্য পাঠ্যসূচি প্রবর্তন। এবং প্রশিক্ষণ থেকে অর্জিত দক্ষতা যথাযথ কাজে লাগানোর জন্য অতিরিক্ত দক্ষতা ও জ্ঞানের ওপর জোর দেওয়া। অনলাইন বাজারে বিদ্যমান ভালো এবং মন্দ অভ্যাসগুলো সম্পর্কে ধারণা দেওয়া। অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রার্থীকে যথেষ্ট পরিমাণে সহায়তা এবং অতিথিপরায়ণ পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং সব শেষে দক্ষ বাজার কৌশল গ্রহণ করা।
খ. অংশগ্রহণকারীদের জন্য সুপারিশ : যোগদান করার আগে প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট এবং কাজের সুযোগ সম্পর্কে সব জেনেশুনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন। ফ্রিল্যান্স কার্যক্রমে কার্যকর অংশ নিন এবং ভালো আচরণ প্রদর্শন করুন। বেশি পাওয়ার জন্য দর-কষাকষির দক্ষতা উন্নত করুন। ফ্রিল্যান্সিংয়ের জন্য বিদ্যমান বহুবিধ সুযোগ-সুবিধার সদ্ব্যবহারকল্পে করণীয় নিয়ে ভাবুন।
গ. নীতিনির্ধারকদের জন্য সুপারিশ : শ্রমবাজারে যারা পিছিয়ে রয়েছে, তাদের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক অনলাইন ফ্রিল্যান্সিং চাহিদা সৃষ্টিতে সাহায্য করুন। অনলাইন ফ্রিল্যান্সিং যাতে প্রয়োজনীয় সামাজিক বৈধতা পায় তার জন্য কাজ করুন। শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণযোগ্য নীতিমালা ও লাইসেন্সিং পদ্ধতির মাধ্যমে প্রশিক্ষণকেন্দ্রগুলো শক্তিশালী করুন। অনলাইন ফ্রিল্যান্সিংয়ে ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় কলকবজার ওপর আমদানি শুল্ক হ্রাস করুন। ফ্রিল্যান্সিং দক্ষতা উন্নয়নের জন্য আরো গবেষণা সহায়তা প্রদান করুন। দক্ষতার সঙ্গে কর্মসূচির সম্প্রসারণ এবং কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে প্রমাণসাপেক্ষ মডেল তৈরি করুন।
একটি স্থিতিশীল চাহিদা সরবরাহ ইকোসিস্টেম সৃষ্টির জন্য বিশ্বাসযোগ্য অর্থায়ন মডেল তৈরি করুন। প্রাপ্তি আদায়ে যেন জটিলতা না হয় সে জন্য আন্তর্জাতিক আর্থিক বিনিময় মসৃণ করুন।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, সাবেক উপাচার্য
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পর্কিত খবর

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান : চাওয়া-পাওয়ার দাগ-খতিয়ান
- তুহিন খান

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রায় এক বছর উপলক্ষে জুলাই ও আগস্ট মাসজুড়ে বেশ বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানসূচি ঘোষিত হয়েছে ইন্টেরিম সরকারের তরফে। কিন্তু এক বছরে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব কতটা মেলানো গেল? জুলাইয়ের সুফল কার ঘরে কতটা উঠল?
গণ-অভ্যুত্থান নিজেই একটি বড় প্রাপ্তি। যে অভ্যুত্থানের ফলে আওয়ামী লীগের মতো একটি নিকৃষ্ট ফ্যাসিস্ট শাসকগোষ্ঠীর পতন হলো, তার চেয়ে বড় প্রাপ্তি এ দেশের জনগণের জীবনে খুব কমই আছে। এই অভ্যুত্থানের আগে-পরে দেশে যে বিপুল জনসচেতনতা ও সৃষ্টিশীল গণক্ষমতার উদ্বোধন আমরা দেখেছি, তরুণদের মধ্যে যে স্বচ্ছ রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ও দেশ গঠনের দৃঢ় প্রত্যয় জন্ম নিতে দেখেছি, তা এককথায় মহাকাব্যিক।
গত বছর ৮ আগস্ট ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার ভারত পলায়নের পরিপ্রেক্ষিতে যে সরকারটি গঠিত হয়, তার ধরনটি ঠিক কী হবে, কী হলে আরো ভালো হতো, এ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা আছে। অন্তর্বর্তী এই সরকারটি গঠিত হয়েছে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করেই; আবার গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের কেউ কেউ এ সরকারের অংশ হয়েছেন।
জুলাইয়ের বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষা, অন্তর্বর্তী সরকারের এই ধরন ও রাজনৈতিক শক্তিগুলোর অবস্থান—এই তিনের টানাপড়েন শেষমেশ যে জাতীয় আকাঙ্ক্ষায় থিতু হয়েছে, তার আলংকারিক নাম : সংস্কার। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আগ থেকেই বেশ কিছু রাজনৈতিক দল ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্ল্যাটফর্মের কারণে ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ ধারণাটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ফলে সেটির প্রায়োগিক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে এবং কিভাবে ও কতটুকু হবে এই সংস্কার—সেটিই প্রধান আলোচ্য বিষয়। বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন হয়েছে দেশে এবং সেসব কমিশন বড় বড় রিপোর্টও তৈরি করেছে।
রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদের স্বাভাবিক ফলাফল হিসেবেই যে সামাজিক ফ্যাসিবাদ ও ধর্মীয় চরমপন্থা সুপ্তাবস্থায় প্রায় এক যুগ ধরে আস্তে আস্তে গাঢ় হয়ে উঠছিল, তা অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে নিঃশেষিত হয়নি, বরং নানা ধরনের সামাজিক ও ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী প্রবণতা নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন শক্তিতে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে পরাজিত ফ্যাসিস্ট শক্তি ও তার দেশি-বিদেশি এজেন্টরা এই প্রবণতাগুলোকে অনেক রংচং মেখে বাস্তবের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বিকট করে উপস্থাপন করার চেষ্টায় রত। জুলাইয়ের শক্তিগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন ও মেরুকরণও এই পরিস্থিতিটিকে বেশ ঘোলাটে করে তুলছে। সে ব্যাপারে সতর্ক থেকেও বলা যায় যে এই ঘটনাগুলো ঘটছে।
‘মব’ শুনলেই অনেকে খেপে যান আজকাল, তার সংগত কারণও আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু সত্য কথা এটিই যে ৫ আগস্টের পর দেশে নানা রকম মব তৈরি হয়েছে। সামাজিক-নৈতিক পুলিশগিরি বাড়ছে। এসবের সঙ্গে জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা বা বিপ্লবী তৎপরতার যোগ সামান্য। ধর্মীয় চরমপন্থাও এই পরিস্থিতিকে একটি সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করছে।
বিপ্লবী ছাত্র-জনতা ও সরকারের কাজ ছিল সমাজে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা এই নতুন প্রতিবিপ্লবী, হঠকারী ও ফ্যাসিস্ট তৎপরতাগুলোরও বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, যেখানে মোটাদাগে স্পষ্টতই তারা ব্যর্থ হয়েছে। এতে সমাজে সরকার ও অভ্যুত্থানের নেতৃত্বের ব্যাপারে যে মাত্রারই হোক, একটি নেতিবাচকতা তৈরি হয়েছে।
৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ের একটি প্রধান জনদাবি ও গুরুতর কাজ ছিল বিচার ও আনুষ্ঠানিক রিকনসিলিয়েশন প্রসেস শুরু করা। কিন্তু এই দাবিটি বিদ্যমান কোনো রাজনৈতিক শক্তিই সততার সঙ্গে সামনে আনতে পেরেছে বলে মনে হয় না। নির্বাচনী রাজনীতির হিসাব-নিকাশ, সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর টানাপড়েন, মামলা বাণিজ্যের পলিটিক্যাল ইকোনমি, ঘোলা পানিতে মাছ শিকারিদের নানা রকম অপতৎপরতা, বিচারহীন পুনর্বাসনের বিবিধ উদ্যোগ আর সরকারের অস্পষ্ট ও গতিহীন নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যে বিচারের দাবিটির বহুলাংশ অপচয় হয়েছে। একটি ফ্যাসিস্ট সরকারকে উত্খাত করার পর অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি জাতীয় অখণ্ডতা রক্ষা ও সামাজিক-রাজনৈতিক রিকনসিলিয়েশন নিশ্চিতে যে ধরনের ব্যাপক, বহুমুখী ও কুশলী প্রাতিষ্ঠানিক তৎপরতা প্রয়োজন ছিল, সরকার সেটি করতে বেশ খানিকটা ব্যর্থই হয়েছে বলা যায়।
অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দলটিকে ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে এক ধরনের কৌতূহল, আকাঙ্ক্ষা ও দরদ তৈরি হয়েছে। তবে এই আকাঙ্ক্ষা নিরঙ্কুশ নয়। নির্বাচনী রাজনীতিতে ঢুকে পড়ায় বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামোর অনেক বিষয়ই আত্তীকৃত করতে হয়েছে দলটির, যা তাদের নানাভাবে বিতর্কিত করেছে। আবার এই দলটির গতি-প্রকৃতি কী হবে, তার কল্পনার বাংলাদেশটি ঠিক কেমন হবে—এসব বিষয়েও নানা ধরনের অনুমান তৈরি হয়েছে। এসব সত্ত্বেও পরিবর্তনকামী বা সংস্কারবাদীরা এখনো এই দলটির ওপর ভরসা রাখতে চাইছেন বলেই মনে হয়।
প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির এই হিসাব চলবে। কিন্তু জুলাইয়ে ঘটে যাওয়া মহাকাব্যিক অভ্যুত্থানটি আমাদের জাতীয় জীবনে যে বিপুল পরিবর্তনের সম্ভাবনা হাজির করেছে, তা অসামান্য। আমরা এর কতটা কাজে লাগাতে পারব, তা এখনো অনিশ্চিত। তবে বাংলাদেশ যত দিন থাকবে, তত দিন মুক্তির এই অসামান্য সম্ভাবনা এ দেশের মানুষকে অনুপ্রাণিত করে যাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক : কবি, অনুবাদক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করা প্রয়োজন
- ড. নিয়াজ আহম্মেদ

করোনার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমে যে ছেদ তৈরি হয়েছিল, তা এখনো আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এ ছাড়া গত বছরের গণ-আন্দোলনে তিন-চার মাস আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। বিশ্ব্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত আমাদের এইচএসসি নামক পাবলিক পরীক্ষা। কোনো কারণে এইচএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে গেলে আমাদের ভর্তি কার্যক্রমও পিছিয়ে যায়।
আমরা যদি জানুয়ারি মাসে এসএসসি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে এইচএসসি পরীক্ষা নিতে পারি, তাহলে জুলাই মাসে উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা যাবে।
উচ্চশিক্ষা যেহেতু বহু রকমের, সেহেতু এখানেও অনেক বিষয় রয়েছে। মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার বিষয়টি সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ দ্বারা পরিচালিত হয়। তাই তারা বেশ দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারে। সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যদি একটি পরীক্ষায় ভর্তি নিতে পারত, তাহলেও সময় বাঁচত। কিন্তু তা সম্ভব হয়ে উঠছে না। আমাদের মানে শিক্ষকদের এখানে করণীয় রয়েছে। এইচএসসি পরীক্ষা শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে ভাবতে হবে। আমরা প্রতিবছর একই পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা এবং এর কার্যক্রম সম্পন্ন করি। ফলে দ্রুত কার্যক্রম শুরু করতে সমস্যা নেই। ফলাফল প্রকাশের এক সপ্তাহের মধ্যে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, এক মাসের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা এবং সর্বোচ্চ তিন মাসের মধ্যে পুরো ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করা সম্ভব।
আমাদের কাছে মনে হয়, সরকারের আন্তরিকতা এবং শিক্ষকদের সহযোগিতা এখানে মুখ্য বিষয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, কতটা সহজে এবং দ্রুত আমরা আমাদের ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারি। আমাদের টার্গেট যদি থাকে জানুয়ারি মাসের প্রথম দিন ক্লাস শুরু করা, তাহলে টার্গেট অনুযায়ী কাজটি করতে হবে। একদিকে শিক্ষার্থীরা পাবলিক পরীক্ষা দেবে, অন্যদিকে আমরা ভর্তি পরীক্ষার কার্যক্রম শুরু করব। সরকার যদি পাবলিক পরীক্ষা আগে এবং দ্রুত সম্পন্ন করতে পারে, তাহলে আমরাও দ্রুত ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারব। ধরুন, এখন এইচএসসি পরীক্ষা চলছে। আশা করা যায়, সেপ্টেম্বরে ফলাফল প্রকাশিত হবে। আমরা অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা শেষ করতে পারি। তিন মাসে কি ভর্তি পরীক্ষার যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করা যথেষ্ট নয়? আমাদের দরকার সরকারের ইচ্ছা এবং সবচেয়ে বড় দরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়, শিক্ষকদের মধ্যে সহযোগিতা ও আন্তরিকতা। আমরা আশা করব, আগামী শিক্ষাবর্ষে যেন জানুয়ারি মাসেই শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয়।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
nahmed1973@gmail.com

কজন জানে জুলাই সনদ কী
- গাজীউল হাসান খান

সমাজ ও বৃহত্তরভাবে রাষ্ট্র মেরামত কিংবা পরিবর্তনের জন্য যেসব কাঙ্ক্ষিত বা আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়, মূলত সেগুলোকেই সংস্কার বা ‘রিফর্ম’ বলা হয়। দেশের সংবিধান থেকে শুরু করে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নাগরিকরা কিংবা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সেসব সংস্কারের উদ্যোগ নিতে পারেন। তবে শেষ পর্যন্ত জাতীয় কিংবা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সেসব সংস্কার প্রস্তাবকে কার্যকর করতে হলে একটি আইনানুগ ভিত্তি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। বাংলাদেশে চব্বিশ সালের গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর সময়ে অতীত স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী শাসন এবং আর্থ-সামাজিক শোষণ-বঞ্চনার অবসানের জন্য দল-মত-নির্বিশেষে সবাই রাষ্ট্র মেরামতের একটি জোরালো দাবি উত্থাপন করেছে।
এ কথা ঠিক যে বিগত জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান কোনো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ছিল না। তবু সেটি আমাদের বিগত ৫৩ বছরের স্বাধীনতা-উত্তর আন্দোলনের ইতিহাসে একটি বিরাট মাইলফলক। স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী শাসন-শোষণের কবল থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে একটি বিশাল পদক্ষেপ। সুতরাং কোনো বিবেচনায়ই সে অভ্যুত্থানকে খাটো করে দেখা যাবে না।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান অধ্যাপক ড. ইউনূসসহ আমাদের রাজনৈতিক মহলের অনেকেই এরই মধ্যে গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। এতে তাঁদের অনেকের মধ্যেই বিগত ১১ মাসে ঘটে যাওয়া অনেক ব্যর্থতার চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে অনেকে দায়ী করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতা ও অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে সমন্বয়ের অভাবকে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সাবেক নেতারা এরই মধ্যে বহুবার অভিযোগ করেছেন যে অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে সময়োচিতভাবে একটি ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণার অভাবে রাজনৈতিক মহলে এখনো অনেক বিভ্রান্তি এবং ভবিষ্যৎ দিকদর্শনের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। ফলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই তাদের নিজ নিজ দলের পতাকাতলে অবস্থান নিয়েছে। ভুলে গেছে সেই মহান গণ-অভ্যুত্থানের জাতীয় প্রেক্ষাপটটি। রাজনৈতিক ঐক্য কিংবা রাজনৈতিক কর্মসূচিগত সমন্বয়ের বিষয়টি। ফলে চারদিকে মাথা তোলার অবকাশ বা সুযোগ পেয়েছে পতিত আওয়ামী সরকারের দোসর কিংবা বশংবদরা। সে পরিস্থিতিতে ড. ইউনূস হতাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘আমাদের একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বিফলে যেতে বসেছে। আমরা মুখে বলছি, সাবেক ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রতিনিধিরা এখনো সর্বত্র বসে রয়েছে। আমরা তাদের সরাতে পারিনি। আমরা তাদের স্বভাব-চরিত্র বদলাতে পারিনি।’ এ অবস্থায় অনতিবিলম্বে সর্বক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে না পারলে এবং সব জায়গায় কাঙ্ক্ষিত সংস্কার কিংবা পরিবর্তন সাধন করতে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতে ক্ষমতার রাজনীতিতে কোনো নির্বাচিত সরকারই স্থিতিশীল হতে পারবে না। এতে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন, উন্নয়ন কিংবা সমৃদ্ধি আশা করা হয়েছিল, তা বিফলে যেতে বাধ্য হবে। এখানেই অতীতে সংঘটিত সব গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের মৌলিক এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিগত কিছু পার্থক্য ছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারটি ছিল গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী একটি ভিন্নধর্মী রাজনৈতিক উদ্যোগের ফসল, কিন্তু তাতে অন্য অনেক কিছু থাকলেও ছিল না রাজনৈতিক দূরদর্শিতা।
ফরাসি বিপ্লব রাশিয়ায় সংঘটিত সমাজতান্ত্রিক (বলশেভিক) বিপ্লবের মতো ছিল না। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রায় শেষ দশকে (১৭৮৯-১৭৯৯) ফ্রান্সে সংঘটিত সে বিপ্লব ছিল একটি ‘দশক স্থায়ী সামাজিক-রাজনৈতিক অভ্যুত্থান’। ফ্রান্সের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের উল্লেখযোগ্য সময়। সে অভ্যুত্থানের শুরুতেই অর্থাৎ ১৭৮৯ সালে তার নেতারা ফ্রান্সের নাগরিক কিংবা মানুষের অধিকার নিয়ে ফ্রেঞ্চ চার্টার নামে একটি সনদ ঘোষণা করেন। সে সনদই ফরাসি বিপ্লবের মৌলিক চরিত্র বা বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরে। তাদের মুক্তি, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের নীতি প্রকাশ করে। এর পাশাপাশি মানুষের মৌলিক অধিকার ও দায়দায়িত্বের পথনির্দেশ প্রদান করে। সেদিক থেকে পর্যালোচনা করলে বাংলাদেশে সংঘটিত জুলাই-আগস্টের বিপ্লবও ছিল মূলত একটি গণ-অভ্যুত্থান। কিন্তু সে সফল অভ্যুত্থানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতাদের কী প্রত্যাশা ছিল, সেগুলো তাঁরা একটি সনদ আকারে নিজেরা প্রকাশ করেননি। তাঁরা অপেক্ষা করেছেন এই দায়িত্বটি সম্পন্ন করার ব্যাপারে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য, যাদের সঙ্গে সে গণ-অভ্যুত্থান কিংবা রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। সে কারণেই জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান সম্পর্কিত ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণা কিংবা নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়টি অনিশ্চিতভাবে ঝুলে রয়েছে। জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের কোনো কিছু উদযাপনের ক্ষেত্রেই কোনো গুরুত্ব দেখা যাচ্ছে না। এ রকম একটি রাজনীতিগত দোদুল্যমান অবস্থায় কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান আমাদের জীবনে কী পরিবর্তন এনেছে? যদি কোনো পরিবর্তন না-ই হয়ে থাকে, তাহলে দেশে ফ্যাসিবাদের পতন বা তাদের উত্খাত করা হলো কিভাবে? কেন এত বিশাল গণ-আন্দোলন ও সাধারণ মানুষের এত আত্মত্যাগ? অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান বলেছেন, ‘অতীতের অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন বদলাতে আমরা রাষ্ট্র মেরামতসহ সর্বত্র সংস্কার সাধনের যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছি, সেগুলো আমাদের প্রস্তাবিত জুলাই সনদে স্থান পেতে হবে।’ দল-মত-নির্বিশেষে জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে প্রস্তাবিত ঘোষণাগুলো বাস্তবায়িত করতে হবে। কিন্তু কী সে প্রস্তাবিত ঘোষণা, তা এখনো জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেক দলই জানে না। বিএনপিসহ বিভিন্ন দেশপ্রেমিক দলের নেতাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কোনো আলোচনায়ই এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বসা হয়নি। কারা কারা হবেন এই প্রস্তাবিত সনদে স্বাক্ষরকারী? এ পর্যন্ত তারও কোনো হদিস নেই। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং দেশি-বিদেশি আধিপত্যকে প্রতিরোধ করে আমরা কিভাবে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করব—প্রস্তাবিত সনদে আমরা সে ব্যাপারে সবার সম্মিলিত প্রতিশ্রুতি চাই।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
gaziulhkhan@gmail.com

বাবনপুরে জেগে আছেন শহীদ আবু সাঈদ
- ড. মো. ফখরুল ইসলাম

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে জুলাই ২০২৪ মাসটি এক অনন্য মর্যাদার দাবিদার। এই মাসে বারবার রক্ত ঝরেছে, শিক্ষার্থী-শ্রমিক-জনতার আহ্বানে কেঁপে উঠেছে শাসকের প্রাসাদ। সেই উত্তাল জুলাইয়ের সূচনা ঘটেছিল রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) মাটি রঞ্জিত করে আবু সাঈদ নামের এক শিক্ষার্থীর রক্তে। পীরগঞ্জের বাবনপুর নামক গ্রামে একটি বাঁশের বেড়া দেওয়া কবরে তিনি শুয়ে আছেন নীরবে, নিঃশব্দে।
রংপুরে শিক্ষার বাতিঘর হয়ে উঠেছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের অব্যবস্থাপনা, নিয়োগ বাণিজ্য, রাজনৈতিক দখল ও অবমূল্যায়নের কারণে নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বারবার পরিণত হয়েছে ক্ষোভের আগ্নেয়গিরিতে।
জুলাই বিপ্লব তাই কেবল রংপুরের বা বেরোবির নয়।
এই শহীদ যেন আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, বাংলাদেশে ছাত্ররাই বারবার যুগ পরিবর্তনের সূচনা করেন। হোক তা ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার সংগ্রাম কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী লড়াই। আমরা চাই, এই শহীদের রক্ত বৃথা না যাক।
জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদের স্মরণে রাষ্ট্র কি আরো একটু নত হবে, নাকি আবারও চলবে এড়িয়ে যাওয়ার নীলনকশা? যদি তা-ই হয়, তবে আগামী দিনগুলো আরো অস্থির, আরো উত্তাল হবে।
‘যেখানে বাধাগ্রস্ত হবে, সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে’—এই চেতনা দেরিতে এলো কেন? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে রাষ্ট্রযন্ত্রের চেহারার ভেতরে, যা দিন দিন হয়ে উঠছে আরো দুর্বিনীত, অসহনশীল ও জনবিচ্ছিন্ন। যখন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা পাস করার পর চাকরির জন্য ঘুরে বেড়ান, তাঁদের দাবি উপেক্ষা করে, বিরোধিতা করে, এমনকি দমন করতে গিয়েই সরকার তার আসল চেহারা উন্মোচন করে। ঠিক এখানেই জুলাই এসে দাঁড়িয়েছিল প্রতিবাদের ভাষা হয়ে। এটি কেবল একটি মাস নয়, এটি একটি ধারণা, একটি রাজনৈতিক চেতনা, একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার নাম, যা শেখায় জুলুমের বিরুদ্ধে চুপ থাকা মানেই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া। তাই যখনই কোথাও প্রতিবাদ বাধাগ্রস্ত হবে, যখনই মত প্রকাশের অধিকার পদদলিত হবে, তখনই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে প্রতিরোধের এক ছায়াছবির মতো।
বাবনপুরে শায়িত জুলাই বিপ্লবের প্রথম শহীদ, তাঁর জীবন দিয়ে আমাদের আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, প্রতিবাদের মুখ বন্ধ করে রাখা যায় না। তাই তাঁর মৃত্যু আর দশটি মৃত্যুর মতো নয়, বরং এটি এক বিস্মৃত সময়কে জাগিয়ে তোলার মুহূর্ত, যেখানে জুলাই আবার ফিরে এসেছে জনতার পাশে দাঁড়াতে।
এখন বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনে, কর্মক্ষেত্রে, সংবাদমাধ্যমে, এমনকি সংসদের ভেতরেও যদি অন্যায় চাপিয়ে দেওয়া হয়, তবে সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে। কারণ এই মাস শেখায় শুধু স্মৃতিচারণা নয়, স্মৃতি দিয়ে বাস্তব পরিবর্তনের দাবিও তোলা যায়।
তাই আমাদের দায়িত্ব এই শহীদের মৃত্যু যেন অন্ধকারে হারিয়ে না যায়। রাষ্ট্র যদি কখনো ন্যায়ের পথ ছেড়ে নিপীড়নের দিকে হাঁটে, তাহলে প্রতিটি গ্রামে বাবনপুরের মতো একেকটি জুলাই জন্ম নিতে পারে।
এমন সময় হয়তো আবারও প্রশ্ন উঠবে, জুলাই-জুলাই বলে এত মাতামাতি কেন? আমরা তখন উত্তর দেব, এর কারণ আমাদের প্রতিবাদের জায়গাগুলো একে একে নিঃশব্দ হয়ে যাচ্ছে। আর যেখানে হাতে মুষ্টি তুলে পথে নেমে সমস্বরে চিৎকার করা নিষিদ্ধ, সেখানে জুলাই-ই হয়ে উঠতে পারে একমাত্র ভাষা।
শহীদ আবু সাঈদের মৃত্যু কেবল একটি গুলি বা একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল না। এটি একটি সাবধানবাণীও ছিল। বেরোবির পার্কের মোড়ের অদূরে যা ঘটেছিল, তা ছিল আসলে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। যেখানে কথা বলা মানেই অপরাধ, দাবি জানানো মানেই রাষ্ট্রদ্রোহ মনে করা হয়েছিল।
সেদিন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা যখন শান্তিপূর্ণভাবে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন রাষ্ট্র কী করেছিল? তারা কেন সেদিন তাঁদের দিকে বন্দুক তাক করল? সেদিন যে তরুণ শহীদ হলেন, তিনি যেন গোটা বাংলাদেশের হয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন, তৎকালীন ক্ষমতাধরদের কাছে তা অনুধাবন করা কি খুব জটিল বিষয় ছিল?
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রতিবাদের ঐতিহ্য খুব গর্বের। ভাষা আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন—সবখানেই ছাত্রসমাজ পথ দেখিয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালে এসেও ছাত্রসমাজের কণ্ঠ রোধ করতে গুলি ব্যবহার করতে হয়, এটি কি রাষ্ট্রের দুর্বলতা নয়? আগামী দিনে আমরা এ ধরনের আর কোনো রাষ্ট্রীয় দুর্বলতা ও ভয় দেখতে চাই না।
জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদ শব্দটি যেন আমাদের সবার কাঁধে নতুন দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়। এর মানে, আরো অনেক শহীদ আসতে পারেন, যদি রাষ্ট্র তার দমননীতি থেকে ফিরে না আসে। যদি কথা বলার জায়গা, ভিন্নমতের জায়গা একে একে নিঃশব্দ হয়ে যায়, তাহলে শেষ ভরসা হয় রক্ত। বেরোবির ইংরেজি পড়ুয়া অকুতোভয় ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের তাক করা বন্দুকের নলের সামনে বুক উঁচিয়ে গুলি খেতে দ্বিধাহীন না থাকলে আজ কী করতাম আমরা, তা কি কেউ ভেবে দেখেছেন?
জন্ম নিলেই সবাইকে একদিন না একদিন নির্বাক হতে হয়। কিন্তু সবার কথা কি সব মানুষের অনন্তকালব্যাপী মনে থাকে? শহীদ আবু সাঈদ বাবনপুরে শুয়ে আমাদের শিখিয়ে দিচ্ছেন, দেশের যেকোনো প্রয়োজনে যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্বাক থাকার দিন শেষ।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন
fakrul@ru.ac.bd