<p>মানুষ সব কিছুকেই সাদা-কালোতে দেখতে ভালোবাসে। হয় হ্যাঁ, নয় না। বিদেশনীতির ক্ষেত্রেও এমনভাবে দেখতে গিয়ে আমরা অনেক সময় ভুল করি। পররাষ্ট্রনীতিও তো কোনো স্থিতিশীল ধারণা নয়। পররাষ্ট্রনীতি নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগোয় সময়ের হাত ধরে। পররাষ্ট্রনীতির মধ্যে অনেক স্তর থাকে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হয়েছে। ১৯৭২ সালেই ইসরায়েল স্বাধীন বাংলাদেশকে সমর্থন জানিয়েছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় ইসরায়েল সরকার এবং ইসরায়েলের সাধারণ জনগণ উভয়ই বাঙালি জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে সমর্থন করেছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর নবগঠিত দেশ ১৯৭২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ইসরায়েল কর্তৃক দ্রুত স্বীকৃত হয়। তবে বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েলের স্বীকৃতি প্রত্যাখ্যান করে।<br /> বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ একটি চিঠি জারি করেন যে এই স্বীকৃতি গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশ ইসরায়েলকে নৈতিক রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকার করে না এবং বাংলাদেশি নাগরিকদের ইসরায়েলে ভ্রমণে সরকারি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। বাংলাদেশের পাসপোর্ট ইসরায়েল ছাড়া বিশ্বের সব দেশ ভ্রমণের জন্য বৈধ। বাংলাদেশ ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক রাখতে চায়নি। কারণ ফিলিস্তিনের স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে বাংলাদেশ চিরকাল। আর সে কারণেই আজও ইসরায়েলের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক আনুষ্ঠানিকভাবে নেই। আজও গাজার স্ট্রিপে যখন হামাস ইসরায়েলে আক্রমণ হানে, তখন সেই হামলার েপছনে যে লজিক আছে, যে ইতিহাস আছে, বাংলাদেশ সেটা বিস্মৃত হতে চায় না।<br /> সব কিছুরই তো একটা কার্যকারণ সম্পর্ক আছে। অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্কেরও সুদীর্ঘ ইতিহাস আছে। আবার অনেক পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই সম্পর্ক এগিয়েছে। গান্ধীজি নিজে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের একটা আলাদা দেশ হোক, সেটা কখনো চাননি। আরব দুনিয়ার প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিটা সেই সময় ছিল ইতিবাচক। ফিলিস্তিনিদের স্বাধিকারের পক্ষে ছিল ভারত। রাষ্ট্রসংঘে ইসরায়েলকে যাতে সদস্য হিসেবে অনুমোদন না দেওয়া হয়, তার জন্য ভারত সোচ্চার ছিল। সেই সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন, আরব দেশ এবং ভারতের অক্ষ একই দিকে ছিল। নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর ইসরায়েলের সঙ্গে খুব দ্রুত ভারতের সম্পর্ক এগিয়েছে।<br /> ভারত ও বাংলাদেশ- দুই পৃথক সার্বভৌম রাষ্ট্র। তাদের মধ্যে সম্পর্ক মধুর। সব সময় আলাপ-আলোচনা চলছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব এই নভেম্বর মাসেরই শেষে ২৪-২৫ তারিখে দিল্লি আসছেন। আবার পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে অনেক আলোচনা হবে। ভারত ও বাংলাদেশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ পৃথিবীর তাবড় তাবড় দেশের সঙ্গে যে দৃষ্টিভঙ্গি, তাতে একজন আরেকজনের ব্যাপারে নাক না গলালেও কোথাও একটা অভিন্ন পররাষ্ট্রনীতি কাজও করে।<br /> সৌদি-ইসরায়েল শান্তি পরিকল্পনাটা ভেস্তে গেছে। ইরান-সৌদি এনগেজমেন্ট গভীর হচ্ছে। চীন সেখানে মস্ত বড় মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিয়ে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সাক্ষী, এই যে আব্রাহাম চুক্তির সীমাবদ্ধতা, আজকে তারাও বুঝতে পারছে। এর ফলে চীনের যে আঞ্চলিক আঁতাতের চেষ্টা, সেটার গুরুত্ব বেড়েছে। আসলে পশ্চিম এশিয়ায় তার যে জিরো পলিটিকস, সেটাও তো অনেক বদলে গেছে।<br /> অন্যদিকে পশ্চিম এশিয়ার ওপরে যুক্তরাষ্ট্রের যে অগ্রাধিকার, সেই অগ্রাধিকারটা কিছুটা কমে যাচ্ছিল। আর তার সুযোগটা নিয়েছিল চীন। চীন  এই গালফের উত্তীর্ণ দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক খুব ভালো করতে শুরু করল, শান্তি স্থাপন করল এবং সৌদি ও ইরানের মধ্যে বোঝাপড়ার ব্যাপারে একটা মস্ত বড় ভূমিকা নিতে শুরু করল। সব মিলিয়ে পরিস্থিতিটা কিন্তু আরো জটিল হয়ে গেল।<br /> এই পরিস্থিতিতে ৭ অক্টোবর যখন হামাসের আক্রমণ হলো, তখন যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পারল যে অনেক ভুল হয়ে গেছে। এটা শুধু ইসরায়েলের গোয়েন্দার ব্যর্থতা নয়, যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক ব্যর্থতাও এর মধ্যে জড়িয়ে রয়েছে। এখন ইরান ও সৌদির পুনর্মিলন চীনের মধ্যস্থতায়, এটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য মস্ত বড় সাম্প্রতিক set back. আরব দেশগুলোর স্বায়ত্তশাসনের ক্ষুধা বাড়ছে। সৌদি আরব এবং ইউএই তারা যুক্তরাষ্ট্রের যে স্যাংশন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে যে নিষেধাজ্ঞা, তাতে শামিল হতে রাজি হয়নি।<br /> সৌদি আরব অর্গানাইজেশন অব দ্য পেট্রোলিয়াম এক্সপোর্টিং কান্ট্রিস বা ওপেক ছাড়াও মস্কোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা করেছে। সেখানে ওয়াশিংটনের পরামর্শ তারা মানেনি। চীন গালফ এলাকায় একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে। এই রকম একটা পরিস্থিতিতে নরেন্দ্র মোদি আগের অবস্থা থেকে কি সরে এলেন? ফিলিস্তিন সম্পর্কে কি নরম মনোভাব নিতে বাধ্য হচ্ছেন? আসল ব্যাপারটা কী? এখানে আরএসএস নেতা মোহন ভাগবত কিন্তু স্পষ্টভাবে লিখেছেন যে আরএসএস প্রথম থেকেই ফিলিস্তিনের ব্যাপারে অত্যন্ত সংবেদনশীল।<br /> আরএসএস নেতা রাম মাধব ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় ১৮ নভেম্বর স্পষ্ট ভাষায় লিখেছেন. ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের সংঘাতে ভারতের অবস্থান হলো, বৃহৎ শান্তির স্ফটিকে বিষয়টা ভারত দেখতে চায় এবং পশ্চিম এশিয়ায় স্থায়িত্ব চায়। সেই কারণে পশ্চিম এশিয়ার অনেক রাষ্ট্র হামাস ও হিজবুল্লাহকে সমর্থন করে। ভারত এ ক্ষেত্রে টু স্টেট সলিউশনের পক্ষে। একটা স্বাধীন-সার্বভৌম কার্যকর ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন হোক, ভারত সেটা চায়। পাশাপাশি যাতে ইসরায়েলেও শান্তি স্থাপিত হয়। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র একটা ভূমিকা নিয়েছিল।  <br /> ১৯৯৩ সালে অসলো অ্যাকর্ড হয়েছিল। বিল ক্লিনটন তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে সক্রিয় ছিলেন। ইসরায়েলের সঙ্গে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের একটা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে সেটা কার্যকর হয়নি। বিষয়টা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। ফিলিস্তিন অভিযোগ তোলে যে ইসরায়েল সরকার চুক্তি ভঙ্গ করেছে। কিন্তু মূল কথাটা হলো পররাষ্ট্রনীতি থেমে থাকে না। বাংলাদেশের সঙ্গে ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন। সেখানে ভারতের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক মধুর।  <br /> এতৎসত্ত্বেও ভারত ও বাংলাদেশ কিন্তু নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে পশ্চিম এশিয়ায় শান্তি এবং স্থায়িত্বের পক্ষে। এর কারণ চীন, রাশিয়া, পাকিস্তান অক্ষ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটা যুদ্ধের বাতাবরণ তৈরি করেছে। ইউক্রেনের যুদ্ধ এখনো থামেনি। একটা আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে, গোটা পৃথিবীতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ না হয়ে যায়! সেই পরিস্থিতিতে একটা স্থায়িত্বের স্বার্থে, গোটা পৃথিবীর শান্তির স্বার্থে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের সংঘাত যে থামা উচিত, ভারত তার পক্ষে। এ ব্যাপারে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গেও আলাপ-আলোচনা করে এই উপমহাদেশের শান্তি বজায় রাখতে আগ্রহী।<br /> লেখক : নয়াদিল্লিতে কালের কণ্ঠ’র<br /> বিশেষ প্রতিনিধি</p>