বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর অক্টোবর ২০২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী মূল্যস্ফীতি ৯.৯৩ বা প্রায় ১০ শতাংশ, খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২.৫৬ শতাংশ। বিগত মার্চ মাস থেকে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, তবে বিভিন্ন কারণে সেগুলো কার্যকর হচ্ছে না বা কার্যকর হতে কিছু সময় লেগে যাচ্ছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাব মতে অক্টোবরে খাদ্য মূল্য সূচক ১২০-এ নেমে এসেছে, যা ২০২১ সালের খাদ্য মূল্য সূচকের (১২৬) কম।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এখন যা করণীয়
- ড. শামসুল আলম


চলতি বছর আমাদের দেশে দ্রব্যমূল্য নিয়ে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় অনেক শিরোনাম হয়েছে। বিশেষ করে বিভিন্ন সময় নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের দাম কয়েক গুণ বেড়ে যায়। যেমন গত জুন মাসে পেঁয়াজের দাম বেড়ে কেজিতে ১০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। আবার ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি হবে ঘোষণায় পেঁয়াজের দাম কমে যায়। পেঁয়াজের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে এবং কৃষকদের স্বার্থ রক্ষার্থে সরকার গত ১৫ মার্চ পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ ঘোষণা করে। সরকার খাদ্যদ্রব্য আমদানি হ্রাস ও স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার লক্ষ্যে বীজ ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ সরবরাহের ব্যবস্থা গ্রহণ করে। সেই সঙ্গে কৃষকরা যাতে ক্ষতির সম্মুখীন না হন সে জন্য আমদানি বন্ধের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। আসলে মজুদদারি নয়, পেঁয়াজের সরবরাহ ঘাটতি ছিল, তাই ঈদের আগে পেঁয়াজের দাম দ্রুত বেড়ে যায়। পেঁয়াজের ক্ষেত্রে আমরা যেমন দেখেছি, চলতি জুলাই মাসে মরিচের ক্ষেত্রে একই ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছি। মরিচের দাম কেজিপ্রতি এক হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত পৌঁছায়। এরই মধ্যে এ বছরের অতিবৃষ্টিতে কাঁচা মরিচের গাছগুলো ক্ষেতে পঁচে যায়। আবার ভারত থেকে আমদানির খবরে দ্রুত দাম পড়ে যায়। কয়েক মাস ধরে ডিমের দাম নিয়ে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। এবার খবরের শিরোনাম হয়েছে আলু ও পেঁয়াজের দাম এবং দুটিরই মূল কারণ সরবরাহ ঘাটতি।
বাংলাদেশ মুক্তবাজার অর্থনীতির শ্রেণির মধ্যে পড়লেও বাজারে সরবরাহ ও চাহিদার মধ্যে সমন্বয় ঘটতে কিছুটা সময় নেয়। এর মূল কারণ আমাদের কৃষিব্যবস্থা আধুনিক ও তাপ নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে হয় না। সে কারণে বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগে আমাদের কৃষির উৎপাদনশীলতার ওপর নানাভাবে প্রভাব ফেলে। যেমন- বর্ষাকালে বন্যায় বাজারে শাক-সবজির দাম স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি থাকে। আবার শীতকাল এলে দাম কমতে শুরু করে। কারণ তখন সরবরাহ বেড়ে যায়। আবার রমজানের সময় নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। পর্যাপ্ত সরবরাহ না দিতে পারায় সেগুলোর দামও বেড়ে যায়। বাজারে কিছু পণ্যের ব্যাপারে সরবরাহজনিত অনিশ্চয়তার আভাস পেলে বড় বড় ব্যবসায়ী কিছু পণ্যের দাম বাড়াতে ভূমিকা পালন করেন। কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে কেবল ঘাটতি হলেই বিশেষভাবে পাইকারি পর্যায়ে সিন্ডিকেশনের আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। কাজেই চাহিদা ও সরবরাহের ক্ষেত্রে যেন বড় ব্যবধান তৈরি না হয় সেটি নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। অমৌসুমে কোনো কৃষিপণ্যের স্বাভাবিকের চেয়ে ক্রমাগত দাম বাড়তে থাকলে বুঝতে হবে পণ্য উৎপাদনে ঘাটতি আছে, তাই দ্রুত আমদানির ব্যবস্থা নিতেই হবে। সময়মতো আমদানির ব্যবস্থা হলে সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেয় না এবং সিন্ডিকেশনের সুযোগ সৃষ্টি হয় না। দেশীয় পণ্য সরবরাহ শৃঙ্খলও যেন কোনো অবস্থায়ই বাধাগ্রস্ত না হয়।
চলতি বছর বাজারে সরবরাহ ও চাহিদার পার্থক্য তৈরি হওয়ার অন্যতম কারণ হলো ডলার সংকটের কারণে উদ্ভূত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা। সরকার সব কৃষিপণ্যের আমদানির অনুমতি দেয় না। বিশেষ করে খামারি বা স্থানীয় উৎপাদনকারীদের স্বার্থ রক্ষার নামে আমদানি সীমিত করে দেয়। সুতরাং ডলার ঘাটতির কারণে কোনো পণ্যের সরবরাহ সমস্যা হলে আমদানির ক্ষেত্রে ঋণপত্র খোলা থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে স্থানীয় বাজারে আসতে আসতে বেশ কিছু সময় লেগে যায়। এই সময়টাই কিছু ব্যবসায়ী কাজে লাগান। তা ছাড়া টাকার মান কৃত্রিমভাবে ধরে রাখার কারণে প্রবাসীরা হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানোতে ডলার সংকট মোকাবেলা করা সহজ হয় না।
টাকার অবমূল্যায়নের কারণে আমদানীকৃত পণ্যের দামের কারণেও স্থানীয় বাজারে তা প্রভাব পড়ছে। গত এক বছরে ডলার সংকটের কারণে টাকার মূল্যমানে ২৭ শতাংশ অবনমন ঘটেছে। টাকার বিপরীতে ডলার শক্তিশালী হওয়ায় বাড়তি দামের আমদানীকৃত পণ্য দেশের বাজারে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। তা ছাড়া সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেওয়ার ফলে বাজারে অর্থ সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যংক নীতি সুদ হার আগের সাড়ে ৫ থেকে বাড়িয়ে ৭.২৫ শতাংশ করেছে। এর মাধ্যমে টাকার সরবরাহ কমাতে সহায়তা করবে। এশিয়ার দেশগুলোর ওপর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের গবেষণায় দেখা গেছে, ১ শতাংশ পয়েন্ট নীতি হার বাড়ালে ০.৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতি কমে, সে কারণে নীতি সুদ হার আরো বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। শ্রীলঙ্কার নীতি সুদ হার ১০ শতাংশে উন্নীত করার পর মূল্যস্ফীতি এখন ২ শতাংশে নেমে এসেছে।
আমাদের দেশে শুধু মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি কমানো যাবে না। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাজস্বনীতির সমন্বয় জরুরি। আমাদের দেশের মূল্যস্ফীতির জন্য চাহিদা ও সরবরাহ দুটি কারণই দায়ী। কাজেই মুদ্রানীতির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি সবটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে- এ আশা করা ঠিক হবে না। নির্বাচন ঘনিয়ে আসার কারণে একদিকে যেমন টাকার বাড়তি চাহিদা তৈরি হচ্ছে, অন্যদিকে আমদানি নিয়ন্ত্রণের কারণে বাজারে সরবরাহজনিত ঘাটতি বা সরবরাহ বিলম্বের কারণে স্থানীয় বাজারে মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। তা ছাড়া আমদানির ওপর গড় শুল্ক কর বেশি হওয়ায় স্থানীয় বাজারে দাম বেড়ে তা মূল্যস্ফীতিতে অবদান রাখছে। টাকার বড় রকমের অবমূল্যায়ন (প্রায় ২৭ শতাংশ) আমাদের মূল্যস্ফীতিতে বড় ইন্ধন জুগিয়েছে। টাকার অবমূল্যায়ন কমাতে যেকোনোভাবে ডলারের সরবরাহ বাড়াতে হবে। রপ্তানিতে আন্ডার ইনভয়েসিং এবং আমদানিতে ওভার ইনভয়েসিং থামাতে কার্যকর ও শক্ত পদক্ষেপ নিতেই হবে। প্রবাস আয় বাড়াতে এবং হুন্ডির পথ পরিহার করাতে নির্দিষ্ট অঙ্কের প্রণোদনা বাদ দিয়ে ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক মানি এক্সচেঞ্জ যে ডলার ক্রয় হার দেয়, যেদিন প্রবাসীর ডলার পাওয়া যাবে সেই রেট দিলে প্রবাসীরা হুন্ডির পথ বেছে নেবেন না। ডলার সরবরাহ বাড়বে। আর যাঁরাই দেশে প্রবেশ করবেন, একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের পর (১০ হাজার ডলার সম্ভবত) ঘোষণা দিতে হবে একটি নির্দিষ্ট ফরমে। আনুক না বিদেশি মুদ্রা যার যত ইচ্ছা। দেশে ডলার সংকটে যে ক্ষতি হচ্ছে, তা অর্জিত রাজস্বের চেয়ে অনেক অনেক বেশি। অবারিত ডলার সরবরাহে আয় বৃদ্ধি পেলে অবশ্যই কর আয়ও বাড়বে। এমনকি সোনা অবাধে নিয়ে আসতে দিলে আমাদের স্বর্ণালংকারের বড় রপ্তানি বাজার তৈরি হতে পারে। আমাদের রপ্তানি আয় বাড়লে ডলার সরবরাহ বৃদ্ধি পাবে।
পৃথিবীর উন্নত ও অনেক উন্নয়নশীল দেশ রাজস্বের জন্য প্রত্যক্ষ কর বা আয়করের ওপর অধিক নির্ভরশীল। আমাদের দেশে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি কর আসে পরোক্ষ কর থেকে। পরোক্ষ কর (যেমন- ভ্যাট) মূল্যস্ফীতিতে ভূমিকা রাখে। ১৭ কোটির দেশে করের আইডি আছে ৯০ লাখের কম। এর মধ্যে নিয়মিত কর দেয় মাত্র ২৪ লাখের মতো। অথচ আমাদের দেশে গাড়ির নিবন্ধনই আছে ৫০ লাখের বেশি। রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্রে এই ধারা বদলাতে না পারলে বা প্রত্যক্ষ করের দিকে না ঝুঁকলে সামনের দিনগুলোতে শুধু পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীল হয়ে করের পরিমাণ বাড়ানো যাবে না। ফলে প্রত্যাশিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে আমাদের বিদেশি ঋণের ওপর অধিক নির্ভর করতে হবে এবং বাজেট ঘাটতির চাপও কমানো যাবে না। অবশ্যই রাজস্ব বাড়াতে আমাদের দীর্ঘমেয়াদি ধারাবাহিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে যেতে হবে।
বিদেশি বিনিয়োগের জন্য ডলার সংকট মোকাবেলা ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বিকল্প নেই। সরকার এরই মধ্যে অনেক সংস্কার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিদ্ধান্ত নিয়েছে, মুদ্রানীতি কমিটিতে ব্যাংকের বাইরে দুজন সদস্য হিসেবে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করবে। মুদ্রা ও রাজস্ব নীতির সমন্বিত পদক্ষেপের ফলে ধীরে ধীরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে আশা করা যায়। তবে এই মুহূর্তে আমাদের মূল্যস্ফীতি যেহেতু উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে, এ রকম উৎপাদন খরচ তাড়িত মূল্যস্ফীতি কমাতে সময় নেয়। কারণ উৎপাদন বৃদ্ধি না করে উৎপাদন খরচ খুব কমানো যায় না। কাজেই উৎপাদন বৃদ্ধিতে প্রযুক্তিগত ও ব্যবস্থাপনা উৎকর্ষ অর্জনে পদক্ষেপ নিতে হবে। সব খাতেই উৎপাদন বৃদ্ধির প্রয়াস চালাতে হবে। আশা করা যায়, এই অর্থবছরের শেষ নাগাদ মূল্যস্ফীতি কভিড-পূর্বাবস্থার স্বাভাবিক পর্যায়ে নেমে আসবে।
লেখক : সামষ্টিক পরিকল্পনাবিদ, অর্থনীতিবিদ ও প্রতিমন্ত্রী, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়
সম্পর্কিত খবর

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান : চাওয়া-পাওয়ার দাগ-খতিয়ান
- তুহিন খান

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রায় এক বছর উপলক্ষে জুলাই ও আগস্ট মাসজুড়ে বেশ বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানসূচি ঘোষিত হয়েছে ইন্টেরিম সরকারের তরফে। কিন্তু এক বছরে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব কতটা মেলানো গেল? জুলাইয়ের সুফল কার ঘরে কতটা উঠল?
গণ-অভ্যুত্থান নিজেই একটি বড় প্রাপ্তি। যে অভ্যুত্থানের ফলে আওয়ামী লীগের মতো একটি নিকৃষ্ট ফ্যাসিস্ট শাসকগোষ্ঠীর পতন হলো, তার চেয়ে বড় প্রাপ্তি এ দেশের জনগণের জীবনে খুব কমই আছে। এই অভ্যুত্থানের আগে-পরে দেশে যে বিপুল জনসচেতনতা ও সৃষ্টিশীল গণক্ষমতার উদ্বোধন আমরা দেখেছি, তরুণদের মধ্যে যে স্বচ্ছ রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ও দেশ গঠনের দৃঢ় প্রত্যয় জন্ম নিতে দেখেছি, তা এককথায় মহাকাব্যিক।
গত বছর ৮ আগস্ট ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার ভারত পলায়নের পরিপ্রেক্ষিতে যে সরকারটি গঠিত হয়, তার ধরনটি ঠিক কী হবে, কী হলে আরো ভালো হতো, এ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা আছে। অন্তর্বর্তী এই সরকারটি গঠিত হয়েছে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করেই; আবার গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের কেউ কেউ এ সরকারের অংশ হয়েছেন।
জুলাইয়ের বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষা, অন্তর্বর্তী সরকারের এই ধরন ও রাজনৈতিক শক্তিগুলোর অবস্থান—এই তিনের টানাপড়েন শেষমেশ যে জাতীয় আকাঙ্ক্ষায় থিতু হয়েছে, তার আলংকারিক নাম : সংস্কার। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আগ থেকেই বেশ কিছু রাজনৈতিক দল ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্ল্যাটফর্মের কারণে ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ ধারণাটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ফলে সেটির প্রায়োগিক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে এবং কিভাবে ও কতটুকু হবে এই সংস্কার—সেটিই প্রধান আলোচ্য বিষয়। বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন হয়েছে দেশে এবং সেসব কমিশন বড় বড় রিপোর্টও তৈরি করেছে।
রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদের স্বাভাবিক ফলাফল হিসেবেই যে সামাজিক ফ্যাসিবাদ ও ধর্মীয় চরমপন্থা সুপ্তাবস্থায় প্রায় এক যুগ ধরে আস্তে আস্তে গাঢ় হয়ে উঠছিল, তা অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে নিঃশেষিত হয়নি, বরং নানা ধরনের সামাজিক ও ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী প্রবণতা নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন শক্তিতে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে পরাজিত ফ্যাসিস্ট শক্তি ও তার দেশি-বিদেশি এজেন্টরা এই প্রবণতাগুলোকে অনেক রংচং মেখে বাস্তবের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বিকট করে উপস্থাপন করার চেষ্টায় রত। জুলাইয়ের শক্তিগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন ও মেরুকরণও এই পরিস্থিতিটিকে বেশ ঘোলাটে করে তুলছে। সে ব্যাপারে সতর্ক থেকেও বলা যায় যে এই ঘটনাগুলো ঘটছে।
‘মব’ শুনলেই অনেকে খেপে যান আজকাল, তার সংগত কারণও আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু সত্য কথা এটিই যে ৫ আগস্টের পর দেশে নানা রকম মব তৈরি হয়েছে। সামাজিক-নৈতিক পুলিশগিরি বাড়ছে। এসবের সঙ্গে জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা বা বিপ্লবী তৎপরতার যোগ সামান্য। ধর্মীয় চরমপন্থাও এই পরিস্থিতিকে একটি সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করছে।
বিপ্লবী ছাত্র-জনতা ও সরকারের কাজ ছিল সমাজে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা এই নতুন প্রতিবিপ্লবী, হঠকারী ও ফ্যাসিস্ট তৎপরতাগুলোরও বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, যেখানে মোটাদাগে স্পষ্টতই তারা ব্যর্থ হয়েছে। এতে সমাজে সরকার ও অভ্যুত্থানের নেতৃত্বের ব্যাপারে যে মাত্রারই হোক, একটি নেতিবাচকতা তৈরি হয়েছে।
৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ের একটি প্রধান জনদাবি ও গুরুতর কাজ ছিল বিচার ও আনুষ্ঠানিক রিকনসিলিয়েশন প্রসেস শুরু করা। কিন্তু এই দাবিটি বিদ্যমান কোনো রাজনৈতিক শক্তিই সততার সঙ্গে সামনে আনতে পেরেছে বলে মনে হয় না। নির্বাচনী রাজনীতির হিসাব-নিকাশ, সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর টানাপড়েন, মামলা বাণিজ্যের পলিটিক্যাল ইকোনমি, ঘোলা পানিতে মাছ শিকারিদের নানা রকম অপতৎপরতা, বিচারহীন পুনর্বাসনের বিবিধ উদ্যোগ আর সরকারের অস্পষ্ট ও গতিহীন নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যে বিচারের দাবিটির বহুলাংশ অপচয় হয়েছে। একটি ফ্যাসিস্ট সরকারকে উত্খাত করার পর অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি জাতীয় অখণ্ডতা রক্ষা ও সামাজিক-রাজনৈতিক রিকনসিলিয়েশন নিশ্চিতে যে ধরনের ব্যাপক, বহুমুখী ও কুশলী প্রাতিষ্ঠানিক তৎপরতা প্রয়োজন ছিল, সরকার সেটি করতে বেশ খানিকটা ব্যর্থই হয়েছে বলা যায়।
অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দলটিকে ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে এক ধরনের কৌতূহল, আকাঙ্ক্ষা ও দরদ তৈরি হয়েছে। তবে এই আকাঙ্ক্ষা নিরঙ্কুশ নয়। নির্বাচনী রাজনীতিতে ঢুকে পড়ায় বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামোর অনেক বিষয়ই আত্তীকৃত করতে হয়েছে দলটির, যা তাদের নানাভাবে বিতর্কিত করেছে। আবার এই দলটির গতি-প্রকৃতি কী হবে, তার কল্পনার বাংলাদেশটি ঠিক কেমন হবে—এসব বিষয়েও নানা ধরনের অনুমান তৈরি হয়েছে। এসব সত্ত্বেও পরিবর্তনকামী বা সংস্কারবাদীরা এখনো এই দলটির ওপর ভরসা রাখতে চাইছেন বলেই মনে হয়।
প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির এই হিসাব চলবে। কিন্তু জুলাইয়ে ঘটে যাওয়া মহাকাব্যিক অভ্যুত্থানটি আমাদের জাতীয় জীবনে যে বিপুল পরিবর্তনের সম্ভাবনা হাজির করেছে, তা অসামান্য। আমরা এর কতটা কাজে লাগাতে পারব, তা এখনো অনিশ্চিত। তবে বাংলাদেশ যত দিন থাকবে, তত দিন মুক্তির এই অসামান্য সম্ভাবনা এ দেশের মানুষকে অনুপ্রাণিত করে যাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক : কবি, অনুবাদক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করা প্রয়োজন
- ড. নিয়াজ আহম্মেদ

করোনার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমে যে ছেদ তৈরি হয়েছিল, তা এখনো আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এ ছাড়া গত বছরের গণ-আন্দোলনে তিন-চার মাস আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। বিশ্ব্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত আমাদের এইচএসসি নামক পাবলিক পরীক্ষা। কোনো কারণে এইচএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে গেলে আমাদের ভর্তি কার্যক্রমও পিছিয়ে যায়।
আমরা যদি জানুয়ারি মাসে এসএসসি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে এইচএসসি পরীক্ষা নিতে পারি, তাহলে জুলাই মাসে উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা যাবে।
উচ্চশিক্ষা যেহেতু বহু রকমের, সেহেতু এখানেও অনেক বিষয় রয়েছে। মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার বিষয়টি সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ দ্বারা পরিচালিত হয়। তাই তারা বেশ দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারে। সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যদি একটি পরীক্ষায় ভর্তি নিতে পারত, তাহলেও সময় বাঁচত। কিন্তু তা সম্ভব হয়ে উঠছে না। আমাদের মানে শিক্ষকদের এখানে করণীয় রয়েছে। এইচএসসি পরীক্ষা শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে ভাবতে হবে। আমরা প্রতিবছর একই পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা এবং এর কার্যক্রম সম্পন্ন করি। ফলে দ্রুত কার্যক্রম শুরু করতে সমস্যা নেই। ফলাফল প্রকাশের এক সপ্তাহের মধ্যে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, এক মাসের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা এবং সর্বোচ্চ তিন মাসের মধ্যে পুরো ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করা সম্ভব।
আমাদের কাছে মনে হয়, সরকারের আন্তরিকতা এবং শিক্ষকদের সহযোগিতা এখানে মুখ্য বিষয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, কতটা সহজে এবং দ্রুত আমরা আমাদের ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারি। আমাদের টার্গেট যদি থাকে জানুয়ারি মাসের প্রথম দিন ক্লাস শুরু করা, তাহলে টার্গেট অনুযায়ী কাজটি করতে হবে। একদিকে শিক্ষার্থীরা পাবলিক পরীক্ষা দেবে, অন্যদিকে আমরা ভর্তি পরীক্ষার কার্যক্রম শুরু করব। সরকার যদি পাবলিক পরীক্ষা আগে এবং দ্রুত সম্পন্ন করতে পারে, তাহলে আমরাও দ্রুত ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারব। ধরুন, এখন এইচএসসি পরীক্ষা চলছে। আশা করা যায়, সেপ্টেম্বরে ফলাফল প্রকাশিত হবে। আমরা অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা শেষ করতে পারি। তিন মাসে কি ভর্তি পরীক্ষার যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করা যথেষ্ট নয়? আমাদের দরকার সরকারের ইচ্ছা এবং সবচেয়ে বড় দরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়, শিক্ষকদের মধ্যে সহযোগিতা ও আন্তরিকতা। আমরা আশা করব, আগামী শিক্ষাবর্ষে যেন জানুয়ারি মাসেই শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয়।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
nahmed1973@gmail.com

কজন জানে জুলাই সনদ কী
- গাজীউল হাসান খান

সমাজ ও বৃহত্তরভাবে রাষ্ট্র মেরামত কিংবা পরিবর্তনের জন্য যেসব কাঙ্ক্ষিত বা আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়, মূলত সেগুলোকেই সংস্কার বা ‘রিফর্ম’ বলা হয়। দেশের সংবিধান থেকে শুরু করে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নাগরিকরা কিংবা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সেসব সংস্কারের উদ্যোগ নিতে পারেন। তবে শেষ পর্যন্ত জাতীয় কিংবা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সেসব সংস্কার প্রস্তাবকে কার্যকর করতে হলে একটি আইনানুগ ভিত্তি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। বাংলাদেশে চব্বিশ সালের গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর সময়ে অতীত স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী শাসন এবং আর্থ-সামাজিক শোষণ-বঞ্চনার অবসানের জন্য দল-মত-নির্বিশেষে সবাই রাষ্ট্র মেরামতের একটি জোরালো দাবি উত্থাপন করেছে।
এ কথা ঠিক যে বিগত জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান কোনো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ছিল না। তবু সেটি আমাদের বিগত ৫৩ বছরের স্বাধীনতা-উত্তর আন্দোলনের ইতিহাসে একটি বিরাট মাইলফলক। স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী শাসন-শোষণের কবল থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে একটি বিশাল পদক্ষেপ। সুতরাং কোনো বিবেচনায়ই সে অভ্যুত্থানকে খাটো করে দেখা যাবে না।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান অধ্যাপক ড. ইউনূসসহ আমাদের রাজনৈতিক মহলের অনেকেই এরই মধ্যে গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। এতে তাঁদের অনেকের মধ্যেই বিগত ১১ মাসে ঘটে যাওয়া অনেক ব্যর্থতার চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে অনেকে দায়ী করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতা ও অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে সমন্বয়ের অভাবকে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সাবেক নেতারা এরই মধ্যে বহুবার অভিযোগ করেছেন যে অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে সময়োচিতভাবে একটি ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণার অভাবে রাজনৈতিক মহলে এখনো অনেক বিভ্রান্তি এবং ভবিষ্যৎ দিকদর্শনের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। ফলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই তাদের নিজ নিজ দলের পতাকাতলে অবস্থান নিয়েছে। ভুলে গেছে সেই মহান গণ-অভ্যুত্থানের জাতীয় প্রেক্ষাপটটি। রাজনৈতিক ঐক্য কিংবা রাজনৈতিক কর্মসূচিগত সমন্বয়ের বিষয়টি। ফলে চারদিকে মাথা তোলার অবকাশ বা সুযোগ পেয়েছে পতিত আওয়ামী সরকারের দোসর কিংবা বশংবদরা। সে পরিস্থিতিতে ড. ইউনূস হতাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘আমাদের একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বিফলে যেতে বসেছে। আমরা মুখে বলছি, সাবেক ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রতিনিধিরা এখনো সর্বত্র বসে রয়েছে। আমরা তাদের সরাতে পারিনি। আমরা তাদের স্বভাব-চরিত্র বদলাতে পারিনি।’ এ অবস্থায় অনতিবিলম্বে সর্বক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে না পারলে এবং সব জায়গায় কাঙ্ক্ষিত সংস্কার কিংবা পরিবর্তন সাধন করতে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতে ক্ষমতার রাজনীতিতে কোনো নির্বাচিত সরকারই স্থিতিশীল হতে পারবে না। এতে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন, উন্নয়ন কিংবা সমৃদ্ধি আশা করা হয়েছিল, তা বিফলে যেতে বাধ্য হবে। এখানেই অতীতে সংঘটিত সব গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের মৌলিক এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিগত কিছু পার্থক্য ছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারটি ছিল গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী একটি ভিন্নধর্মী রাজনৈতিক উদ্যোগের ফসল, কিন্তু তাতে অন্য অনেক কিছু থাকলেও ছিল না রাজনৈতিক দূরদর্শিতা।
ফরাসি বিপ্লব রাশিয়ায় সংঘটিত সমাজতান্ত্রিক (বলশেভিক) বিপ্লবের মতো ছিল না। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রায় শেষ দশকে (১৭৮৯-১৭৯৯) ফ্রান্সে সংঘটিত সে বিপ্লব ছিল একটি ‘দশক স্থায়ী সামাজিক-রাজনৈতিক অভ্যুত্থান’। ফ্রান্সের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের উল্লেখযোগ্য সময়। সে অভ্যুত্থানের শুরুতেই অর্থাৎ ১৭৮৯ সালে তার নেতারা ফ্রান্সের নাগরিক কিংবা মানুষের অধিকার নিয়ে ফ্রেঞ্চ চার্টার নামে একটি সনদ ঘোষণা করেন। সে সনদই ফরাসি বিপ্লবের মৌলিক চরিত্র বা বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরে। তাদের মুক্তি, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের নীতি প্রকাশ করে। এর পাশাপাশি মানুষের মৌলিক অধিকার ও দায়দায়িত্বের পথনির্দেশ প্রদান করে। সেদিক থেকে পর্যালোচনা করলে বাংলাদেশে সংঘটিত জুলাই-আগস্টের বিপ্লবও ছিল মূলত একটি গণ-অভ্যুত্থান। কিন্তু সে সফল অভ্যুত্থানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতাদের কী প্রত্যাশা ছিল, সেগুলো তাঁরা একটি সনদ আকারে নিজেরা প্রকাশ করেননি। তাঁরা অপেক্ষা করেছেন এই দায়িত্বটি সম্পন্ন করার ব্যাপারে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য, যাদের সঙ্গে সে গণ-অভ্যুত্থান কিংবা রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। সে কারণেই জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান সম্পর্কিত ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণা কিংবা নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়টি অনিশ্চিতভাবে ঝুলে রয়েছে। জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের কোনো কিছু উদযাপনের ক্ষেত্রেই কোনো গুরুত্ব দেখা যাচ্ছে না। এ রকম একটি রাজনীতিগত দোদুল্যমান অবস্থায় কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান আমাদের জীবনে কী পরিবর্তন এনেছে? যদি কোনো পরিবর্তন না-ই হয়ে থাকে, তাহলে দেশে ফ্যাসিবাদের পতন বা তাদের উত্খাত করা হলো কিভাবে? কেন এত বিশাল গণ-আন্দোলন ও সাধারণ মানুষের এত আত্মত্যাগ? অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান বলেছেন, ‘অতীতের অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন বদলাতে আমরা রাষ্ট্র মেরামতসহ সর্বত্র সংস্কার সাধনের যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছি, সেগুলো আমাদের প্রস্তাবিত জুলাই সনদে স্থান পেতে হবে।’ দল-মত-নির্বিশেষে জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে প্রস্তাবিত ঘোষণাগুলো বাস্তবায়িত করতে হবে। কিন্তু কী সে প্রস্তাবিত ঘোষণা, তা এখনো জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেক দলই জানে না। বিএনপিসহ বিভিন্ন দেশপ্রেমিক দলের নেতাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কোনো আলোচনায়ই এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বসা হয়নি। কারা কারা হবেন এই প্রস্তাবিত সনদে স্বাক্ষরকারী? এ পর্যন্ত তারও কোনো হদিস নেই। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং দেশি-বিদেশি আধিপত্যকে প্রতিরোধ করে আমরা কিভাবে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করব—প্রস্তাবিত সনদে আমরা সে ব্যাপারে সবার সম্মিলিত প্রতিশ্রুতি চাই।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
gaziulhkhan@gmail.com

বাবনপুরে জেগে আছেন শহীদ আবু সাঈদ
- ড. মো. ফখরুল ইসলাম

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে জুলাই ২০২৪ মাসটি এক অনন্য মর্যাদার দাবিদার। এই মাসে বারবার রক্ত ঝরেছে, শিক্ষার্থী-শ্রমিক-জনতার আহ্বানে কেঁপে উঠেছে শাসকের প্রাসাদ। সেই উত্তাল জুলাইয়ের সূচনা ঘটেছিল রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) মাটি রঞ্জিত করে আবু সাঈদ নামের এক শিক্ষার্থীর রক্তে। পীরগঞ্জের বাবনপুর নামক গ্রামে একটি বাঁশের বেড়া দেওয়া কবরে তিনি শুয়ে আছেন নীরবে, নিঃশব্দে।
রংপুরে শিক্ষার বাতিঘর হয়ে উঠেছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের অব্যবস্থাপনা, নিয়োগ বাণিজ্য, রাজনৈতিক দখল ও অবমূল্যায়নের কারণে নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বারবার পরিণত হয়েছে ক্ষোভের আগ্নেয়গিরিতে।
জুলাই বিপ্লব তাই কেবল রংপুরের বা বেরোবির নয়।
এই শহীদ যেন আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, বাংলাদেশে ছাত্ররাই বারবার যুগ পরিবর্তনের সূচনা করেন। হোক তা ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার সংগ্রাম কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী লড়াই। আমরা চাই, এই শহীদের রক্ত বৃথা না যাক।
জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদের স্মরণে রাষ্ট্র কি আরো একটু নত হবে, নাকি আবারও চলবে এড়িয়ে যাওয়ার নীলনকশা? যদি তা-ই হয়, তবে আগামী দিনগুলো আরো অস্থির, আরো উত্তাল হবে।
‘যেখানে বাধাগ্রস্ত হবে, সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে’—এই চেতনা দেরিতে এলো কেন? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে রাষ্ট্রযন্ত্রের চেহারার ভেতরে, যা দিন দিন হয়ে উঠছে আরো দুর্বিনীত, অসহনশীল ও জনবিচ্ছিন্ন। যখন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা পাস করার পর চাকরির জন্য ঘুরে বেড়ান, তাঁদের দাবি উপেক্ষা করে, বিরোধিতা করে, এমনকি দমন করতে গিয়েই সরকার তার আসল চেহারা উন্মোচন করে। ঠিক এখানেই জুলাই এসে দাঁড়িয়েছিল প্রতিবাদের ভাষা হয়ে। এটি কেবল একটি মাস নয়, এটি একটি ধারণা, একটি রাজনৈতিক চেতনা, একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার নাম, যা শেখায় জুলুমের বিরুদ্ধে চুপ থাকা মানেই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া। তাই যখনই কোথাও প্রতিবাদ বাধাগ্রস্ত হবে, যখনই মত প্রকাশের অধিকার পদদলিত হবে, তখনই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে প্রতিরোধের এক ছায়াছবির মতো।
বাবনপুরে শায়িত জুলাই বিপ্লবের প্রথম শহীদ, তাঁর জীবন দিয়ে আমাদের আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, প্রতিবাদের মুখ বন্ধ করে রাখা যায় না। তাই তাঁর মৃত্যু আর দশটি মৃত্যুর মতো নয়, বরং এটি এক বিস্মৃত সময়কে জাগিয়ে তোলার মুহূর্ত, যেখানে জুলাই আবার ফিরে এসেছে জনতার পাশে দাঁড়াতে।
এখন বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনে, কর্মক্ষেত্রে, সংবাদমাধ্যমে, এমনকি সংসদের ভেতরেও যদি অন্যায় চাপিয়ে দেওয়া হয়, তবে সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে। কারণ এই মাস শেখায় শুধু স্মৃতিচারণা নয়, স্মৃতি দিয়ে বাস্তব পরিবর্তনের দাবিও তোলা যায়।
তাই আমাদের দায়িত্ব এই শহীদের মৃত্যু যেন অন্ধকারে হারিয়ে না যায়। রাষ্ট্র যদি কখনো ন্যায়ের পথ ছেড়ে নিপীড়নের দিকে হাঁটে, তাহলে প্রতিটি গ্রামে বাবনপুরের মতো একেকটি জুলাই জন্ম নিতে পারে।
এমন সময় হয়তো আবারও প্রশ্ন উঠবে, জুলাই-জুলাই বলে এত মাতামাতি কেন? আমরা তখন উত্তর দেব, এর কারণ আমাদের প্রতিবাদের জায়গাগুলো একে একে নিঃশব্দ হয়ে যাচ্ছে। আর যেখানে হাতে মুষ্টি তুলে পথে নেমে সমস্বরে চিৎকার করা নিষিদ্ধ, সেখানে জুলাই-ই হয়ে উঠতে পারে একমাত্র ভাষা।
শহীদ আবু সাঈদের মৃত্যু কেবল একটি গুলি বা একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল না। এটি একটি সাবধানবাণীও ছিল। বেরোবির পার্কের মোড়ের অদূরে যা ঘটেছিল, তা ছিল আসলে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। যেখানে কথা বলা মানেই অপরাধ, দাবি জানানো মানেই রাষ্ট্রদ্রোহ মনে করা হয়েছিল।
সেদিন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা যখন শান্তিপূর্ণভাবে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন রাষ্ট্র কী করেছিল? তারা কেন সেদিন তাঁদের দিকে বন্দুক তাক করল? সেদিন যে তরুণ শহীদ হলেন, তিনি যেন গোটা বাংলাদেশের হয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন, তৎকালীন ক্ষমতাধরদের কাছে তা অনুধাবন করা কি খুব জটিল বিষয় ছিল?
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রতিবাদের ঐতিহ্য খুব গর্বের। ভাষা আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন—সবখানেই ছাত্রসমাজ পথ দেখিয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালে এসেও ছাত্রসমাজের কণ্ঠ রোধ করতে গুলি ব্যবহার করতে হয়, এটি কি রাষ্ট্রের দুর্বলতা নয়? আগামী দিনে আমরা এ ধরনের আর কোনো রাষ্ট্রীয় দুর্বলতা ও ভয় দেখতে চাই না।
জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদ শব্দটি যেন আমাদের সবার কাঁধে নতুন দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়। এর মানে, আরো অনেক শহীদ আসতে পারেন, যদি রাষ্ট্র তার দমননীতি থেকে ফিরে না আসে। যদি কথা বলার জায়গা, ভিন্নমতের জায়গা একে একে নিঃশব্দ হয়ে যায়, তাহলে শেষ ভরসা হয় রক্ত। বেরোবির ইংরেজি পড়ুয়া অকুতোভয় ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের তাক করা বন্দুকের নলের সামনে বুক উঁচিয়ে গুলি খেতে দ্বিধাহীন না থাকলে আজ কী করতাম আমরা, তা কি কেউ ভেবে দেখেছেন?
জন্ম নিলেই সবাইকে একদিন না একদিন নির্বাক হতে হয়। কিন্তু সবার কথা কি সব মানুষের অনন্তকালব্যাপী মনে থাকে? শহীদ আবু সাঈদ বাবনপুরে শুয়ে আমাদের শিখিয়ে দিচ্ছেন, দেশের যেকোনো প্রয়োজনে যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্বাক থাকার দিন শেষ।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন
fakrul@ru.ac.bd