জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর স্বতন্ত্র সমাজতান্ত্রিক ধারণার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশকে শোষণ-বঞ্চনাহীন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত স্বনির্ভর সোনার বাংলা গঠন করতে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সমাজতন্ত্র অন্যান্য দেশের সমাজতন্ত্র থেকে পুরোপুরি ভিন্ন ছিল। সমাজতন্ত্রকে তিনি কোনো তাত্ত্বিক ধারণার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চাননি, বরং তিনি চেয়েছিলেন একটি অর্থনৈতিক দর্শন, যেটি সামাজিক বাস্তবতা ও পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তিনি চেয়েছিলেন এমন একটি সমাজব্যবস্থা, যাতে কৃষকের কল্যাণ হবে, সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সুযোগের সমতা থাকবে, যেখানে জমিদারি ও সামন্তীয় শোষণ প্রথার অস্তিত্ব থাকবে না এবং গরিব মেহনতি মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে।
অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন দর্শন
- ড. শামসুল আলম

শেখ হাসিনার অর্থনৈতিক দর্শনের মূল উপজীব্য হলো অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন মানে হলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল সমাজের সর্বস্তরে পৌঁছে দেওয়া, বিশেষ করে যারা ঐতিহাসিকভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, যারা বরাবর উন্নয়নের সুফল থেকে বঞ্চিত থাকে। কিন্তু এর প্রাথমিক শর্ত হলো অর্থনৈতিক রূপান্তর। এই রূপান্তরের অনেকগুলো উপাদান রয়েছে।
শেখ হাসিনা গত দেড় দশকে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের নিকৃষ্ট সূচকগুলো পুরোপুরি উল্টে দিয়েছেন। সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস বা এসডিজিতে বলা হয়েছে, ‘কাউকে পেছনে রেখে নয়’।
১৯৯৬ সালে যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে, তখনই শেখ হাসিনা তাঁর অর্থনৈতিক চিন্তাধারা বাস্তবায়নে হাত দেন। তাঁর হাত ধরেই যমুনা বহুমুখী সেতু বা বঙ্গবন্ধু সেতু বাস্তবায়িত হয়। এর ফলে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের যোগাযোগ স্থাপিত হয়। সে সময়ে তিনি দারিদ্র্য বিমোচনের পাশাপাশি বেসরকারীকরণ ও রপ্তানিমুখী শিল্প গড়ে তোলার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ব্যক্তি খাতে টেলিভিশন, মুঠোফোন ও বার্জ মাউন্টেড বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ সৃষ্টি করেন, সেই সঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোকে তিনি আরো বিস্তৃত পরিসরে সম্প্রসারণ করেন। ২০০৯ সালে দ্বিতীয়বার সরকার গঠন করার পর তিনি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় হাত দেন। রূপকল্প ২০২১ গ্রহণ করে তার আলোকে ১১ বছর মেয়াদি প্রথম প্রেক্ষিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয় (২০১০-২০২১)। প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে বাংলাদেশ কী অর্জন করতে চায়, তা দুটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হয়। প্রথম প্রেক্ষিত পরিকল্পনার মাধ্যমে বাংলাদেশের পরিকল্পনাজগতে ‘প্যারাডাইম শিফট’ হয়। এর মাধ্যমে বাংলাদেশকে মধ্যম আয় ও ডিজিটাল বাংলাদেশে পরিণত করার রূপরেখা তৈরি হয়। এই পরিকল্পনার মূল বৈশিষ্ট্য হলো পরিকল্পনার সুনির্দিষ্ট কৌশলগত লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে বাজেট ও পরিকল্পনার সামষ্টিক অর্থনৈতিক কর্মসূচিকে সংযুক্ত করা।
বাংলাদেশের প্রথম রূপকল্প দলিল ২০২১ ও তার ভিত্তিতে প্রণীত ষষ্ঠ (২০১১-২০১৫) ও সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০১৬-২০২০) প্রণয়নকালে আন্তর্জাতিক ঋণদান সংস্থাগুলোর কোনো দিকনির্দেশনাভিত্তিক দলিল; যেমন—ওয়াশিংটন কনসেনসাস (১৯৮৯) কিংবা পিআরএসপি (২০০৩-২০০৯) বিবেচনায় ছিল না। তাই এসব পরিকল্পনা ছিল সম্পূর্ণ দেশজ বাস্তবতা ও জনচাহিদায় প্রণীত, যে কারণে এসব দিয়েই বাংলাদেশে নতুন জাতীয় পরিকল্পনার যুগ শুরু হয়। এই ‘নয়া জাতীয় পরিকল্পনা যুগের’ বৈশিষ্ট্য হলো দেশজ বাস্তবতা, জাতীয় সত্তাতাড়িত, জাতীয় নেতৃত্বের সরাসরি তত্ত্বাবধানে প্রণীত। এই নয়া জাতীয় পরিকল্পনার ফলেই বাংলাদেশ নয়া অর্থনৈতিক উন্নয়নের যুগে প্রবেশ করে। এর ফলে গত দেড় দশকে প্রবৃদ্ধির বিরামহীন দ্রুত উল্লম্ফন ঘটে। প্রবৃদ্ধির বিচারে গত দশকে বাংলাদেশের চেয়ে একমাত্র চীনই এগিয়ে ছিল।
অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য তিনি প্রথমে মেগাপ্রকল্পে হাত দেন। তাঁর নির্দেশনায় দেশে হাতিরঝিল, কুড়িল ফ্লাইওভার, পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ইত্যাদিসহ ডজনের ওপর মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়। তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন দেশকে দীর্ঘ মেয়াদের জন্য পরিবর্তন করতে হলে অবকাঠামো উন্নয়নের বিকল্প নেই। অবকাঠামো উন্নয়ন হলেই বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি হবে। ২০০৯ সালের আগে দেশের জনগোষ্ঠীর অর্ধেকেরও কম বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় ছিল। অথচ মাত্র এক দশকে দেশের মানুষ প্রায় ১০০ শতাংশ বিদ্যুতের সুবিধা পেয়েছে। মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে যেটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হলো যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন, বৈদ্যুতিকায়ন এবং এর ফল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। পার্বত্য এলাকা ও হাওর এলাকার কিছু অংশ বাদে বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে এখন সড়ক যোগাযোগের মাধ্যমে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে। অবকাঠামো উন্নয়নের ফলে দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে এবং তা দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রেখেছে। শহর-গ্রাম পার্থক্য কমে গেছে। গত দশকে বেসরকারি বিনিয়োগের পাশাপাশি সরকারি বিনিয়োগ বেশি পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। এর মূলে ছিল ডজনের বেশি মেগাপ্রকল্প গ্রহণ এবং অর্ধশতকের বেশি অর্থনৈতিক অঞ্চল সৃষ্টি। ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের ফলে বিনিয়োগ বিকাশের এক অপূর্ব সুযোগ তৈরি হয়েছে। এরই মধ্যে ৯৭টি অর্থনৈতিক অঞ্চল অনুমোদন পেয়েছে। বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি ও দারিদ্র্য কমে যাওয়ার ফলে মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি বড় বাজার তৈরি হয়েছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে সমার্থক বাংলাদেশের একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে দক্ষিণ এশিয়ার উদীয়মান টাইগার হিসেবে উত্থান ঘটে।
শেখ হাসিনার উদ্যোগে গৃহীত আমার বাড়ি আমার খামার ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক গ্রামের দরিদ্র মানুষের ভাগ্যবদলের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। এর মাধ্যমে গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নিজস্ব পুঁজি গঠন ও বিনিয়োগে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও জীবিকার মাধ্যমে দারিদ্র্য নিরসনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে ছিন্নমূল ও গৃহহীন জনগোষ্ঠীর জীবনে এক নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এর মাধ্যমে দেশের ১৩ লাখ গৃহহীন পরিবার এক নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখছে। তাদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের বদৌলতে জনগণের দোরগোড়ায় এখন সরকারি সেবা পৌঁছে গেছে। দেশে সাড়ে ছয় হাজারের বেশি ডিজিটাল সেন্টার স্থাপিত হয়েছে, যার ফলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগণ দূর থেকেই সরকারি সেবা গ্রহণ করতে পারছে। কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাসহ নারীর প্রজনন, পরিবার পরিকল্পনা, মাতৃস্বাস্থ্য, মা ও শিশুর পুষ্টি বিষয়ে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করা হচ্ছে। বিনা মূল্যে ২৭ রকমের ওষুধ পাচ্ছে প্রান্তিক জনগণ।
শেখ হাসিনার অর্থনৈতিক দর্শনের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো মানবসম্পদের উন্নয়ন ও বিকাশ। এ লক্ষ্যে ব্যাপক শিক্ষা সহায়তা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। তা ছাড়া বাংলাদেশে বাধ্যতামূলক ও বিনা মূল্যে প্রাথমিক শিক্ষা কর্মসূচি শিক্ষাক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। প্রাথমিকের ক্ষেত্রে ভর্তির হার এখন ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের বেশি। বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে যে সামাজিক পুঁজির উদ্ভব ঘটে তার মূল কারণ সরকারের দূরদর্শী নীতি। এর ফলে দলভিত্তিক ও ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে নারীদের মধ্যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পায়। সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২ অনুযায়ী নারীদের কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণের হার ২০০৬ সালের ২৯ শতাংশ এবং ২০১৭ সালের জরিপের ৩৬.৩ শতাংশ থেকে এখন ৪৩ শতাংশে পৌঁছেছে। অথচ ভারতে এই হার মাত্র ২০ শতাংশ, পাকিস্তানে তা ২০ শতাংশ। নারীর এই অপূর্ব ক্ষমতায়ন ঘটেছে শেখ হাসিনার হাত ধরেই।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বিগত দশকে বাংলাদেশে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। সেই সঙ্গে সরকার এখন কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিচ্ছে। সারা দেশে ব্যাপক শিক্ষা অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ তথা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে সরকার এখন জনগণের দোরগোড়ায় সেবা দিতে বদ্ধপরিকর। ডিজিটাল আউটসোর্সিং সেবা প্রদানে সারা দেশে এখন প্রায় সাড়ে ছয় লাখ তরুণ জড়িত রয়েছে, তাদের বার্ষিক আয় প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা।
শেখ হাসিনার উদ্যোগের ফলে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। অর্থাৎ গ্রামে শহরের সুবিধাদি নিশ্চিত করার মাধ্যমে গ্রাম ও শহরের ব্যবধান কমিয়ে আনা হচ্ছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলো আরো সমন্বিত করার জন্য আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে জীবনচক্রভিত্তিক কাঠামোর আওতায় আনতে সরকার ২০১৫ সালে জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্র গ্রহণ করে। এর উদ্দেশ্য হলো প্রচলিত কর্মসূচিগুলো আরো কার্যকর ও ফলপ্রসূ করে তোলা এবং স্বেচ্ছামূলক সবার জন্য পেনশন স্কিম চালু করা। এরই মধ্যে এই স্কিম ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এ পর্যন্ত ১০ কোটি প্রান্তিক ও নিম্নবিত্ত মানুষ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সহায়তা পেয়েছে।
শেখ হাসিনার উন্নয়ন মডেলের বড় শক্তি হচ্ছে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও ভারত সরকারের সাবেক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কৌশিক বসুর বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির মডেল হলো অন্তর্ভুক্তিমূলক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নারীর ক্ষমতায়নের মতো তৃণমূল পর্যায়ের মানব উন্নয়ন দ্বারা উদ্বুদ্ধ।’ শেখ হাসিনার অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন দর্শন দেশকে অভূতপূর্বভাবে এগিয়ে নিচ্ছে।
লেখক : সামষ্টিক পরিকল্পনাবিদ, অর্থনীতিবিদ ও প্রতিমন্ত্রী, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়
সম্পর্কিত খবর

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান : চাওয়া-পাওয়ার দাগ-খতিয়ান
- তুহিন খান

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রায় এক বছর উপলক্ষে জুলাই ও আগস্ট মাসজুড়ে বেশ বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানসূচি ঘোষিত হয়েছে ইন্টেরিম সরকারের তরফে। কিন্তু এক বছরে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব কতটা মেলানো গেল? জুলাইয়ের সুফল কার ঘরে কতটা উঠল?
গণ-অভ্যুত্থান নিজেই একটি বড় প্রাপ্তি। যে অভ্যুত্থানের ফলে আওয়ামী লীগের মতো একটি নিকৃষ্ট ফ্যাসিস্ট শাসকগোষ্ঠীর পতন হলো, তার চেয়ে বড় প্রাপ্তি এ দেশের জনগণের জীবনে খুব কমই আছে। এই অভ্যুত্থানের আগে-পরে দেশে যে বিপুল জনসচেতনতা ও সৃষ্টিশীল গণক্ষমতার উদ্বোধন আমরা দেখেছি, তরুণদের মধ্যে যে স্বচ্ছ রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ও দেশ গঠনের দৃঢ় প্রত্যয় জন্ম নিতে দেখেছি, তা এককথায় মহাকাব্যিক।
গত বছর ৮ আগস্ট ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার ভারত পলায়নের পরিপ্রেক্ষিতে যে সরকারটি গঠিত হয়, তার ধরনটি ঠিক কী হবে, কী হলে আরো ভালো হতো, এ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা আছে। অন্তর্বর্তী এই সরকারটি গঠিত হয়েছে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করেই; আবার গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের কেউ কেউ এ সরকারের অংশ হয়েছেন।
জুলাইয়ের বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষা, অন্তর্বর্তী সরকারের এই ধরন ও রাজনৈতিক শক্তিগুলোর অবস্থান—এই তিনের টানাপড়েন শেষমেশ যে জাতীয় আকাঙ্ক্ষায় থিতু হয়েছে, তার আলংকারিক নাম : সংস্কার। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আগ থেকেই বেশ কিছু রাজনৈতিক দল ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্ল্যাটফর্মের কারণে ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ ধারণাটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ফলে সেটির প্রায়োগিক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে এবং কিভাবে ও কতটুকু হবে এই সংস্কার—সেটিই প্রধান আলোচ্য বিষয়। বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন হয়েছে দেশে এবং সেসব কমিশন বড় বড় রিপোর্টও তৈরি করেছে।
রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদের স্বাভাবিক ফলাফল হিসেবেই যে সামাজিক ফ্যাসিবাদ ও ধর্মীয় চরমপন্থা সুপ্তাবস্থায় প্রায় এক যুগ ধরে আস্তে আস্তে গাঢ় হয়ে উঠছিল, তা অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে নিঃশেষিত হয়নি, বরং নানা ধরনের সামাজিক ও ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী প্রবণতা নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন শক্তিতে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে পরাজিত ফ্যাসিস্ট শক্তি ও তার দেশি-বিদেশি এজেন্টরা এই প্রবণতাগুলোকে অনেক রংচং মেখে বাস্তবের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বিকট করে উপস্থাপন করার চেষ্টায় রত। জুলাইয়ের শক্তিগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন ও মেরুকরণও এই পরিস্থিতিটিকে বেশ ঘোলাটে করে তুলছে। সে ব্যাপারে সতর্ক থেকেও বলা যায় যে এই ঘটনাগুলো ঘটছে।
‘মব’ শুনলেই অনেকে খেপে যান আজকাল, তার সংগত কারণও আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু সত্য কথা এটিই যে ৫ আগস্টের পর দেশে নানা রকম মব তৈরি হয়েছে। সামাজিক-নৈতিক পুলিশগিরি বাড়ছে। এসবের সঙ্গে জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা বা বিপ্লবী তৎপরতার যোগ সামান্য। ধর্মীয় চরমপন্থাও এই পরিস্থিতিকে একটি সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করছে।
বিপ্লবী ছাত্র-জনতা ও সরকারের কাজ ছিল সমাজে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা এই নতুন প্রতিবিপ্লবী, হঠকারী ও ফ্যাসিস্ট তৎপরতাগুলোরও বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, যেখানে মোটাদাগে স্পষ্টতই তারা ব্যর্থ হয়েছে। এতে সমাজে সরকার ও অভ্যুত্থানের নেতৃত্বের ব্যাপারে যে মাত্রারই হোক, একটি নেতিবাচকতা তৈরি হয়েছে।
৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ের একটি প্রধান জনদাবি ও গুরুতর কাজ ছিল বিচার ও আনুষ্ঠানিক রিকনসিলিয়েশন প্রসেস শুরু করা। কিন্তু এই দাবিটি বিদ্যমান কোনো রাজনৈতিক শক্তিই সততার সঙ্গে সামনে আনতে পেরেছে বলে মনে হয় না। নির্বাচনী রাজনীতির হিসাব-নিকাশ, সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর টানাপড়েন, মামলা বাণিজ্যের পলিটিক্যাল ইকোনমি, ঘোলা পানিতে মাছ শিকারিদের নানা রকম অপতৎপরতা, বিচারহীন পুনর্বাসনের বিবিধ উদ্যোগ আর সরকারের অস্পষ্ট ও গতিহীন নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যে বিচারের দাবিটির বহুলাংশ অপচয় হয়েছে। একটি ফ্যাসিস্ট সরকারকে উত্খাত করার পর অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি জাতীয় অখণ্ডতা রক্ষা ও সামাজিক-রাজনৈতিক রিকনসিলিয়েশন নিশ্চিতে যে ধরনের ব্যাপক, বহুমুখী ও কুশলী প্রাতিষ্ঠানিক তৎপরতা প্রয়োজন ছিল, সরকার সেটি করতে বেশ খানিকটা ব্যর্থই হয়েছে বলা যায়।
অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দলটিকে ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে এক ধরনের কৌতূহল, আকাঙ্ক্ষা ও দরদ তৈরি হয়েছে। তবে এই আকাঙ্ক্ষা নিরঙ্কুশ নয়। নির্বাচনী রাজনীতিতে ঢুকে পড়ায় বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামোর অনেক বিষয়ই আত্তীকৃত করতে হয়েছে দলটির, যা তাদের নানাভাবে বিতর্কিত করেছে। আবার এই দলটির গতি-প্রকৃতি কী হবে, তার কল্পনার বাংলাদেশটি ঠিক কেমন হবে—এসব বিষয়েও নানা ধরনের অনুমান তৈরি হয়েছে। এসব সত্ত্বেও পরিবর্তনকামী বা সংস্কারবাদীরা এখনো এই দলটির ওপর ভরসা রাখতে চাইছেন বলেই মনে হয়।
প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির এই হিসাব চলবে। কিন্তু জুলাইয়ে ঘটে যাওয়া মহাকাব্যিক অভ্যুত্থানটি আমাদের জাতীয় জীবনে যে বিপুল পরিবর্তনের সম্ভাবনা হাজির করেছে, তা অসামান্য। আমরা এর কতটা কাজে লাগাতে পারব, তা এখনো অনিশ্চিত। তবে বাংলাদেশ যত দিন থাকবে, তত দিন মুক্তির এই অসামান্য সম্ভাবনা এ দেশের মানুষকে অনুপ্রাণিত করে যাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক : কবি, অনুবাদক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করা প্রয়োজন
- ড. নিয়াজ আহম্মেদ

করোনার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমে যে ছেদ তৈরি হয়েছিল, তা এখনো আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এ ছাড়া গত বছরের গণ-আন্দোলনে তিন-চার মাস আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। বিশ্ব্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত আমাদের এইচএসসি নামক পাবলিক পরীক্ষা। কোনো কারণে এইচএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে গেলে আমাদের ভর্তি কার্যক্রমও পিছিয়ে যায়।
আমরা যদি জানুয়ারি মাসে এসএসসি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে এইচএসসি পরীক্ষা নিতে পারি, তাহলে জুলাই মাসে উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা যাবে।
উচ্চশিক্ষা যেহেতু বহু রকমের, সেহেতু এখানেও অনেক বিষয় রয়েছে। মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার বিষয়টি সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ দ্বারা পরিচালিত হয়। তাই তারা বেশ দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারে। সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যদি একটি পরীক্ষায় ভর্তি নিতে পারত, তাহলেও সময় বাঁচত। কিন্তু তা সম্ভব হয়ে উঠছে না। আমাদের মানে শিক্ষকদের এখানে করণীয় রয়েছে। এইচএসসি পরীক্ষা শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে ভাবতে হবে। আমরা প্রতিবছর একই পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা এবং এর কার্যক্রম সম্পন্ন করি। ফলে দ্রুত কার্যক্রম শুরু করতে সমস্যা নেই। ফলাফল প্রকাশের এক সপ্তাহের মধ্যে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, এক মাসের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা এবং সর্বোচ্চ তিন মাসের মধ্যে পুরো ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করা সম্ভব।
আমাদের কাছে মনে হয়, সরকারের আন্তরিকতা এবং শিক্ষকদের সহযোগিতা এখানে মুখ্য বিষয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, কতটা সহজে এবং দ্রুত আমরা আমাদের ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারি। আমাদের টার্গেট যদি থাকে জানুয়ারি মাসের প্রথম দিন ক্লাস শুরু করা, তাহলে টার্গেট অনুযায়ী কাজটি করতে হবে। একদিকে শিক্ষার্থীরা পাবলিক পরীক্ষা দেবে, অন্যদিকে আমরা ভর্তি পরীক্ষার কার্যক্রম শুরু করব। সরকার যদি পাবলিক পরীক্ষা আগে এবং দ্রুত সম্পন্ন করতে পারে, তাহলে আমরাও দ্রুত ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারব। ধরুন, এখন এইচএসসি পরীক্ষা চলছে। আশা করা যায়, সেপ্টেম্বরে ফলাফল প্রকাশিত হবে। আমরা অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা শেষ করতে পারি। তিন মাসে কি ভর্তি পরীক্ষার যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করা যথেষ্ট নয়? আমাদের দরকার সরকারের ইচ্ছা এবং সবচেয়ে বড় দরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়, শিক্ষকদের মধ্যে সহযোগিতা ও আন্তরিকতা। আমরা আশা করব, আগামী শিক্ষাবর্ষে যেন জানুয়ারি মাসেই শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয়।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
nahmed1973@gmail.com

কজন জানে জুলাই সনদ কী
- গাজীউল হাসান খান

সমাজ ও বৃহত্তরভাবে রাষ্ট্র মেরামত কিংবা পরিবর্তনের জন্য যেসব কাঙ্ক্ষিত বা আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়, মূলত সেগুলোকেই সংস্কার বা ‘রিফর্ম’ বলা হয়। দেশের সংবিধান থেকে শুরু করে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নাগরিকরা কিংবা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সেসব সংস্কারের উদ্যোগ নিতে পারেন। তবে শেষ পর্যন্ত জাতীয় কিংবা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সেসব সংস্কার প্রস্তাবকে কার্যকর করতে হলে একটি আইনানুগ ভিত্তি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। বাংলাদেশে চব্বিশ সালের গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর সময়ে অতীত স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী শাসন এবং আর্থ-সামাজিক শোষণ-বঞ্চনার অবসানের জন্য দল-মত-নির্বিশেষে সবাই রাষ্ট্র মেরামতের একটি জোরালো দাবি উত্থাপন করেছে।
এ কথা ঠিক যে বিগত জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান কোনো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ছিল না। তবু সেটি আমাদের বিগত ৫৩ বছরের স্বাধীনতা-উত্তর আন্দোলনের ইতিহাসে একটি বিরাট মাইলফলক। স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী শাসন-শোষণের কবল থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে একটি বিশাল পদক্ষেপ। সুতরাং কোনো বিবেচনায়ই সে অভ্যুত্থানকে খাটো করে দেখা যাবে না।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান অধ্যাপক ড. ইউনূসসহ আমাদের রাজনৈতিক মহলের অনেকেই এরই মধ্যে গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। এতে তাঁদের অনেকের মধ্যেই বিগত ১১ মাসে ঘটে যাওয়া অনেক ব্যর্থতার চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে অনেকে দায়ী করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতা ও অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে সমন্বয়ের অভাবকে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সাবেক নেতারা এরই মধ্যে বহুবার অভিযোগ করেছেন যে অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে সময়োচিতভাবে একটি ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণার অভাবে রাজনৈতিক মহলে এখনো অনেক বিভ্রান্তি এবং ভবিষ্যৎ দিকদর্শনের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। ফলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই তাদের নিজ নিজ দলের পতাকাতলে অবস্থান নিয়েছে। ভুলে গেছে সেই মহান গণ-অভ্যুত্থানের জাতীয় প্রেক্ষাপটটি। রাজনৈতিক ঐক্য কিংবা রাজনৈতিক কর্মসূচিগত সমন্বয়ের বিষয়টি। ফলে চারদিকে মাথা তোলার অবকাশ বা সুযোগ পেয়েছে পতিত আওয়ামী সরকারের দোসর কিংবা বশংবদরা। সে পরিস্থিতিতে ড. ইউনূস হতাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘আমাদের একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বিফলে যেতে বসেছে। আমরা মুখে বলছি, সাবেক ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রতিনিধিরা এখনো সর্বত্র বসে রয়েছে। আমরা তাদের সরাতে পারিনি। আমরা তাদের স্বভাব-চরিত্র বদলাতে পারিনি।’ এ অবস্থায় অনতিবিলম্বে সর্বক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে না পারলে এবং সব জায়গায় কাঙ্ক্ষিত সংস্কার কিংবা পরিবর্তন সাধন করতে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতে ক্ষমতার রাজনীতিতে কোনো নির্বাচিত সরকারই স্থিতিশীল হতে পারবে না। এতে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন, উন্নয়ন কিংবা সমৃদ্ধি আশা করা হয়েছিল, তা বিফলে যেতে বাধ্য হবে। এখানেই অতীতে সংঘটিত সব গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের মৌলিক এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিগত কিছু পার্থক্য ছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারটি ছিল গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী একটি ভিন্নধর্মী রাজনৈতিক উদ্যোগের ফসল, কিন্তু তাতে অন্য অনেক কিছু থাকলেও ছিল না রাজনৈতিক দূরদর্শিতা।
ফরাসি বিপ্লব রাশিয়ায় সংঘটিত সমাজতান্ত্রিক (বলশেভিক) বিপ্লবের মতো ছিল না। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রায় শেষ দশকে (১৭৮৯-১৭৯৯) ফ্রান্সে সংঘটিত সে বিপ্লব ছিল একটি ‘দশক স্থায়ী সামাজিক-রাজনৈতিক অভ্যুত্থান’। ফ্রান্সের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের উল্লেখযোগ্য সময়। সে অভ্যুত্থানের শুরুতেই অর্থাৎ ১৭৮৯ সালে তার নেতারা ফ্রান্সের নাগরিক কিংবা মানুষের অধিকার নিয়ে ফ্রেঞ্চ চার্টার নামে একটি সনদ ঘোষণা করেন। সে সনদই ফরাসি বিপ্লবের মৌলিক চরিত্র বা বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরে। তাদের মুক্তি, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের নীতি প্রকাশ করে। এর পাশাপাশি মানুষের মৌলিক অধিকার ও দায়দায়িত্বের পথনির্দেশ প্রদান করে। সেদিক থেকে পর্যালোচনা করলে বাংলাদেশে সংঘটিত জুলাই-আগস্টের বিপ্লবও ছিল মূলত একটি গণ-অভ্যুত্থান। কিন্তু সে সফল অভ্যুত্থানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতাদের কী প্রত্যাশা ছিল, সেগুলো তাঁরা একটি সনদ আকারে নিজেরা প্রকাশ করেননি। তাঁরা অপেক্ষা করেছেন এই দায়িত্বটি সম্পন্ন করার ব্যাপারে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য, যাদের সঙ্গে সে গণ-অভ্যুত্থান কিংবা রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। সে কারণেই জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান সম্পর্কিত ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণা কিংবা নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়টি অনিশ্চিতভাবে ঝুলে রয়েছে। জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের কোনো কিছু উদযাপনের ক্ষেত্রেই কোনো গুরুত্ব দেখা যাচ্ছে না। এ রকম একটি রাজনীতিগত দোদুল্যমান অবস্থায় কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান আমাদের জীবনে কী পরিবর্তন এনেছে? যদি কোনো পরিবর্তন না-ই হয়ে থাকে, তাহলে দেশে ফ্যাসিবাদের পতন বা তাদের উত্খাত করা হলো কিভাবে? কেন এত বিশাল গণ-আন্দোলন ও সাধারণ মানুষের এত আত্মত্যাগ? অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান বলেছেন, ‘অতীতের অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন বদলাতে আমরা রাষ্ট্র মেরামতসহ সর্বত্র সংস্কার সাধনের যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছি, সেগুলো আমাদের প্রস্তাবিত জুলাই সনদে স্থান পেতে হবে।’ দল-মত-নির্বিশেষে জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে প্রস্তাবিত ঘোষণাগুলো বাস্তবায়িত করতে হবে। কিন্তু কী সে প্রস্তাবিত ঘোষণা, তা এখনো জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেক দলই জানে না। বিএনপিসহ বিভিন্ন দেশপ্রেমিক দলের নেতাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কোনো আলোচনায়ই এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বসা হয়নি। কারা কারা হবেন এই প্রস্তাবিত সনদে স্বাক্ষরকারী? এ পর্যন্ত তারও কোনো হদিস নেই। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং দেশি-বিদেশি আধিপত্যকে প্রতিরোধ করে আমরা কিভাবে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করব—প্রস্তাবিত সনদে আমরা সে ব্যাপারে সবার সম্মিলিত প্রতিশ্রুতি চাই।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
gaziulhkhan@gmail.com

বাবনপুরে জেগে আছেন শহীদ আবু সাঈদ
- ড. মো. ফখরুল ইসলাম

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে জুলাই ২০২৪ মাসটি এক অনন্য মর্যাদার দাবিদার। এই মাসে বারবার রক্ত ঝরেছে, শিক্ষার্থী-শ্রমিক-জনতার আহ্বানে কেঁপে উঠেছে শাসকের প্রাসাদ। সেই উত্তাল জুলাইয়ের সূচনা ঘটেছিল রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) মাটি রঞ্জিত করে আবু সাঈদ নামের এক শিক্ষার্থীর রক্তে। পীরগঞ্জের বাবনপুর নামক গ্রামে একটি বাঁশের বেড়া দেওয়া কবরে তিনি শুয়ে আছেন নীরবে, নিঃশব্দে।
রংপুরে শিক্ষার বাতিঘর হয়ে উঠেছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের অব্যবস্থাপনা, নিয়োগ বাণিজ্য, রাজনৈতিক দখল ও অবমূল্যায়নের কারণে নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বারবার পরিণত হয়েছে ক্ষোভের আগ্নেয়গিরিতে।
জুলাই বিপ্লব তাই কেবল রংপুরের বা বেরোবির নয়।
এই শহীদ যেন আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, বাংলাদেশে ছাত্ররাই বারবার যুগ পরিবর্তনের সূচনা করেন। হোক তা ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার সংগ্রাম কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী লড়াই। আমরা চাই, এই শহীদের রক্ত বৃথা না যাক।
জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদের স্মরণে রাষ্ট্র কি আরো একটু নত হবে, নাকি আবারও চলবে এড়িয়ে যাওয়ার নীলনকশা? যদি তা-ই হয়, তবে আগামী দিনগুলো আরো অস্থির, আরো উত্তাল হবে।
‘যেখানে বাধাগ্রস্ত হবে, সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে’—এই চেতনা দেরিতে এলো কেন? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে রাষ্ট্রযন্ত্রের চেহারার ভেতরে, যা দিন দিন হয়ে উঠছে আরো দুর্বিনীত, অসহনশীল ও জনবিচ্ছিন্ন। যখন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা পাস করার পর চাকরির জন্য ঘুরে বেড়ান, তাঁদের দাবি উপেক্ষা করে, বিরোধিতা করে, এমনকি দমন করতে গিয়েই সরকার তার আসল চেহারা উন্মোচন করে। ঠিক এখানেই জুলাই এসে দাঁড়িয়েছিল প্রতিবাদের ভাষা হয়ে। এটি কেবল একটি মাস নয়, এটি একটি ধারণা, একটি রাজনৈতিক চেতনা, একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার নাম, যা শেখায় জুলুমের বিরুদ্ধে চুপ থাকা মানেই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া। তাই যখনই কোথাও প্রতিবাদ বাধাগ্রস্ত হবে, যখনই মত প্রকাশের অধিকার পদদলিত হবে, তখনই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে প্রতিরোধের এক ছায়াছবির মতো।
বাবনপুরে শায়িত জুলাই বিপ্লবের প্রথম শহীদ, তাঁর জীবন দিয়ে আমাদের আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, প্রতিবাদের মুখ বন্ধ করে রাখা যায় না। তাই তাঁর মৃত্যু আর দশটি মৃত্যুর মতো নয়, বরং এটি এক বিস্মৃত সময়কে জাগিয়ে তোলার মুহূর্ত, যেখানে জুলাই আবার ফিরে এসেছে জনতার পাশে দাঁড়াতে।
এখন বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনে, কর্মক্ষেত্রে, সংবাদমাধ্যমে, এমনকি সংসদের ভেতরেও যদি অন্যায় চাপিয়ে দেওয়া হয়, তবে সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে। কারণ এই মাস শেখায় শুধু স্মৃতিচারণা নয়, স্মৃতি দিয়ে বাস্তব পরিবর্তনের দাবিও তোলা যায়।
তাই আমাদের দায়িত্ব এই শহীদের মৃত্যু যেন অন্ধকারে হারিয়ে না যায়। রাষ্ট্র যদি কখনো ন্যায়ের পথ ছেড়ে নিপীড়নের দিকে হাঁটে, তাহলে প্রতিটি গ্রামে বাবনপুরের মতো একেকটি জুলাই জন্ম নিতে পারে।
এমন সময় হয়তো আবারও প্রশ্ন উঠবে, জুলাই-জুলাই বলে এত মাতামাতি কেন? আমরা তখন উত্তর দেব, এর কারণ আমাদের প্রতিবাদের জায়গাগুলো একে একে নিঃশব্দ হয়ে যাচ্ছে। আর যেখানে হাতে মুষ্টি তুলে পথে নেমে সমস্বরে চিৎকার করা নিষিদ্ধ, সেখানে জুলাই-ই হয়ে উঠতে পারে একমাত্র ভাষা।
শহীদ আবু সাঈদের মৃত্যু কেবল একটি গুলি বা একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল না। এটি একটি সাবধানবাণীও ছিল। বেরোবির পার্কের মোড়ের অদূরে যা ঘটেছিল, তা ছিল আসলে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। যেখানে কথা বলা মানেই অপরাধ, দাবি জানানো মানেই রাষ্ট্রদ্রোহ মনে করা হয়েছিল।
সেদিন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা যখন শান্তিপূর্ণভাবে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন রাষ্ট্র কী করেছিল? তারা কেন সেদিন তাঁদের দিকে বন্দুক তাক করল? সেদিন যে তরুণ শহীদ হলেন, তিনি যেন গোটা বাংলাদেশের হয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন, তৎকালীন ক্ষমতাধরদের কাছে তা অনুধাবন করা কি খুব জটিল বিষয় ছিল?
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রতিবাদের ঐতিহ্য খুব গর্বের। ভাষা আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন—সবখানেই ছাত্রসমাজ পথ দেখিয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালে এসেও ছাত্রসমাজের কণ্ঠ রোধ করতে গুলি ব্যবহার করতে হয়, এটি কি রাষ্ট্রের দুর্বলতা নয়? আগামী দিনে আমরা এ ধরনের আর কোনো রাষ্ট্রীয় দুর্বলতা ও ভয় দেখতে চাই না।
জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদ শব্দটি যেন আমাদের সবার কাঁধে নতুন দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়। এর মানে, আরো অনেক শহীদ আসতে পারেন, যদি রাষ্ট্র তার দমননীতি থেকে ফিরে না আসে। যদি কথা বলার জায়গা, ভিন্নমতের জায়গা একে একে নিঃশব্দ হয়ে যায়, তাহলে শেষ ভরসা হয় রক্ত। বেরোবির ইংরেজি পড়ুয়া অকুতোভয় ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের তাক করা বন্দুকের নলের সামনে বুক উঁচিয়ে গুলি খেতে দ্বিধাহীন না থাকলে আজ কী করতাম আমরা, তা কি কেউ ভেবে দেখেছেন?
জন্ম নিলেই সবাইকে একদিন না একদিন নির্বাক হতে হয়। কিন্তু সবার কথা কি সব মানুষের অনন্তকালব্যাপী মনে থাকে? শহীদ আবু সাঈদ বাবনপুরে শুয়ে আমাদের শিখিয়ে দিচ্ছেন, দেশের যেকোনো প্রয়োজনে যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্বাক থাকার দিন শেষ।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন
fakrul@ru.ac.bd