ঢাকা, মঙ্গলবার ০৮ জুলাই ২০২৫
২৩ আষাঢ় ১৪৩২, ১২ মহররম ১৪৪৭

ঢাকা, মঙ্গলবার ০৮ জুলাই ২০২৫
২৩ আষাঢ় ১৪৩২, ১২ মহররম ১৪৪৭

পণ্যের দাম বেঁধে দেওয়া কার্যকর হচ্ছে না কেন

  • ড. শামসুল আলম
শেয়ার
পণ্যের দাম বেঁধে দেওয়া কার্যকর হচ্ছে না কেন

ভোক্তার কল্যাণ চিন্তা করে সরকার গত ১৪ সেপ্টেম্বর কৃষির কিছু প্রাথমিক পণ্যের (পেঁয়াজ, আলু ও ডিম) বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করে দেয়। সেই সঙ্গে কৃষিজাত কিছু শিল্পপণ্যের (চিনি, সয়াবিন তেল, পাম অয়েল) দাম আগেই নির্ধারণ করে দিয়েছিল।

প্রাথমিক কৃষিপণ্য পেঁয়াজ ২৪ সেপ্টেম্বর বিক্রি হয়েছে (টাউন হল মার্কেট) ৭৫-৮০ টাকা কেজি,  সরকার নির্ধারিত পেঁয়াজের দাম ৬৫ টাকা কেজি, আলু বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫৫ টাকা কেজি, নির্ধারিত দাম ৩৬ টাকা কেজি, ডিম ১২ টাকা পিস নির্ধারিত, বিক্রয় ১৩ টাকা পিস।

কৃষিজাত শিল্পপণ্য চিনির (আমদানীকৃত) নির্ধারিত দাম ১২০ টাকা কেজি, বিক্রয় ১৩৫-১৪০ টাকা কেজি; সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৬৯ টাকা, বিক্রয় ১৭৫-১৮০ টাকা; পাম অয়েল প্রতি লিটার নির্ধারিত ১২৪ টাকা, বিক্রয় ১৪৫-১৫০ টাকা।

ঢাকা শহরের অন্যতম বড় কোনো বাজারেই এসব পণ্য নির্ধারিত দামে বিক্রয় হচ্ছে না। ঢাকার বাইরে অন্য শহর ও উপজেলা বা প্রবৃদ্ধি কেন্দ্রের মতো বাজারগুলোতে (প্রায় ৩৫ হাজার) প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিক্রয় দাম সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে আরো বেশি হবে। তবে একটা বিষয় লক্ষণীয়, নির্ধারিত দামের চেয়ে বিক্রয় দাম বেশি হলেও উল্লিখিত সব পণ্যের ক্ষেত্রেই দাম এখন স্থিতিশীল রয়েছে।

সরকার দাম নির্ধারণ করে দিতে যায় কেন? এখন যে শিরোনাম দিয়ে প্রশ্নাকারে এই নিবন্ধ শুরু করেছি সে বিষয়ে আলোকপাত করা যাক।

পণ্যের দাম বেঁধে দেওয়া কার্যকর হচ্ছে না কেনকৃষি মৌলিক পণ্যশিল্পপণ্যের বাজারব্যবস্থা একেবারেই ভিন্ন প্রকৃতির। বাজারকাঠামোতে মৌলিক কৃষিপণ্যের উৎপাদক লাখ লাখ এবং উৎপাদন দেশের বিস্তৃত অঞ্চলে ব্যাপ্ত। শিল্পপণ্যের প্রতিটির উৎপাদকের সংখ্যা আঙুলে গোনা যায় এবং উৎপাদন নির্দিষ্ট অঞ্চলে বা শিল্পাঞ্চলে সীমিত। শিল্পপণ্য পচনশীল নয়, দীর্ঘকাল সংরক্ষণযোগ্য এবং উৎপাদন কার্যক্রম মৌসুমভিত্তিক নয়।

সে কারণেই শিল্পপণ্যের দামের ওঠানামা অনেক কম।

কৃষিপণ্য মৌসুমভিত্তিক উৎপন্ন হয় এবং পচনশীল বিধায় দীর্ঘকাল সংরক্ষণযোগ্য নয়। দেশব্যাপী উৎপাদন হয় বিধায় কৃষিপণ্যের উৎপাদনের কোনো এজেন্ট ডিলার থাকে না। কোটি কোটি উৎপাদক এবং জড়িত হাজার হাজার ব্যবসায়ী খামার থেকে শহরের ভোক্তাদের দরজা পর্যন্ত পণ্য পৌঁছে দেয়। মৌলিক শিল্পপণ্য নির্দিষ্ট ডিলার এজেন্টের মাধ্যমে যাদের প্রয়োজন মফস্বলে পণ্য পৌঁছে দেয়।

শিল্পপণ্যের ব্র্যান্ডিং থাকে, মান সুনির্দিষ্ট থাকে, যা কৃষিপণ্যের বেলায় অনুপস্থিত। শিল্পপণ্যের বাজারকাঠামো হচ্ছে প্রতিটি পণ্য নিয়ে কতিপয়ের (অলিগোপলি) ব্যবসা। শিল্পগোষ্ঠী পণ্যের দাম বাজার চাহিদা অনুযায়ী নির্ধারণ করে দেয়। দাম নির্ধারণে তারা ভূমিকা রাখে। কৃষি মৌলিক পণ্য। যেহেতু অসংখ্য উৎপাদক একই পণ্য বাজারে নিয়ে আসে; বাজারের চাহিদা অনুযায়ী তাকে দাম মেনে নিতে হয়, না হলে পণ্য বাড়ি ফেরত নিয়ে আসতে হয়, যার জন্য বাড়তি খরচ বহন করতে হয়। কৃষিপণ্যের বাজার অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক। সব সময়ই বাজারে মোট চাহিদার ওপর তার দাম নির্ধারিত হয়। চাহিদার চেয়ে সরবরাহ বেশি হলে দাম কম মেনে নিতে হয়। সংরক্ষণ করা যায় না বিধায় কম দামে লোকসান দিয়েও বিক্রি করতে হয়। মোটাদাগে এসব কারণে কৃষি উৎপাদন ব্যবসা খুব লাভজনক ব্যবসা নয়। শিল্পপণ্যের বাজারব্যবস্থা একেবারেই ভিন্ন।

মুক্তবাজার অর্থনীতির সবচেয়ে বড় খাত হচ্ছে কৃষি খাত। মোটাদাগে কৃষি উৎপাদন, বিপণন, প্রক্রিয়াকরণ, গুদামজাতকরণ সব ক্ষেত্রেই অসংখ্য ব্যক্তি বা ব্যবসায়ী জড়িত। প্রায় প্রতিটি পণ্যের দরদাম নির্ধারিত হয় প্রতিযোগিতার পরিবেশে। একজন উৎপাদক, একজন ব্যবসায়ী, একজন পরিবহনকারী এককভাবে বাজারে নগণ্য অস্তিত্ব এবং বাজারের দরদাম মেনে নিতে বাধ্য। বাজারে দাম ঠিক করার ক্ষেত্রে একক কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না। ধানের প্রক্রিয়াকরণ, অটো রাইসমিলার বাংলাদেশে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে আছে সাড়ে পাঁচ হাজারের মতো, গোল আলু রাখার হিমাগার আছে পাঁচ শতাধিক। সংরক্ষণ করা যায় ব্যক্তি খাতে এমন পণ্যের হাজার হাজার মজুদদার আছে। মূলত এই সংখ্যাধিক্যের কারণে কৃষি মৌলিক পণ্যে চটজলদি সিন্ডিকেট গঠন করা প্রায় অসম্ভব। আবার সিন্ডিকেশন সম্ভব হতে পারে কৃষিজাত শিল্পপণ্য যখনই আমদানি করা হয়। কারণ বড় শহরকেন্দ্রিক আমদানিকারকের সংখ্যা কয়েক ডজন থেকে হয়তো শতকের ঘরে। কৃষি বাজার ব্যবস্থায় দেড় শতাধিক শুধু মাঠভিত্তিক উৎপন্ন ফসল বিভিন্ন পর্যায়ে বিপণন হয়ে থাকে, প্রতিটি পণ্যের বাজারব্যবস্থা অদ্বিতীয়। একটির বাজারব্যবস্থার সঙ্গে আরেকটির মিল কম। দাম নির্ধারণ পদ্ধতি, উৎপাদক, ক্রেতা, বিপণনকারী ও প্রক্রিয়াজাতকারকের সংখ্যা এবং বাজার-ভোক্তা দূরত্ব বিভিন্ন রকমের হতে পারে। মোটকথা কৃষি বাজার ব্যবস্থা জটিল এবং বাইরের হস্তক্ষেপ ছাড়া স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালিত, যা মুক্তবাজার অর্থনীতির মূল প্রতিপাদ্য। যেহেতু দাম বাজারে চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়, যেহেতু অসংখ্য ব্যবসায়ী বিভিন্ন পর্যায়ে জড়িত, কৃষি মৌলিক পণ্যের ক্ষেত্রে সাধারণত সিন্ডিকেশন করা বা আঁতাত করে দাম বাড়ানো প্রায় অসম্ভব। সিন্ডিকেট করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে অস্বাভাবিক মুনাফা অর্জনের সুযোগ তৈরি হলে বেশিদিন সেটা টিকে থাকতে পারে না। কারণ হাজার হাজার শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত বেকার অনেক পুঁজিধারী ওই বিশেষ পণ্য ব্যবসায় নেমে পড়ে এবং একসময় সিন্ডিকেট অনেকের অংশগ্রহণে অকার্যকর হয়ে পড়ে। কৃষি দরদামের আরেকটি বিশেষত্ব হলো মৌসুমভিত্তিক উৎপন্ন হওয়ায় এবং প্রকৃতিনির্ভর উৎপাদন হওয়ার বার্ষিক মোট উৎপাদনের অনেক ওঠানামা হয়। সরবরাহের ওঠানামার কারণে কৃষিপণ্যের দরদামের অনেক ওঠানামা হয়ে থাকে। কৃষিপণ্যের চাহিদা আবার অনেকটা স্থিতিশীল, সরবরাহ অস্থিতিশীল, সে কারণে দামের অস্থিতিশীলতা প্রায় সব দেশেই দেখা যায়।

পুনর্ব্যক্ত করছি যে কৃষিপণ্যের বাজারে দাম, বাজারের মোট চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে হয়ে থাকে। কোনো পণ্যের কর্তন মৌসুমে দাম পড়ে যায়। কারণ একসঙ্গে অনেক উৎপাদক বিক্রির জন্য বাজারে আনে, যেহেতু পণ্য চাহিদা প্রায় স্থিতিশীল, তাই দাম হয়ে পড়ে নিম্নমুখী। এই সময়ে ভবিষ্যতে সরবরাহ যখন কমে আসবে এই বিবেচনায় লাভের জন্য মজুদদাররা সংরক্ষণযোগ্য পণ্য মজুদ করে রাখে এবং অমৌসুমে ভোক্তাদের পণ্য পেতে সহায়তা করে থাকে। মজুদদাররা ক্রয় করে বিধায় কর্তন মৌসুমে ভূমিছোঁয়া দাম ওপরে ওঠে এবং কৃষকদের ন্যায্য দাম পেতে সহায়তা করে। অমৌসুমে পণ্য পেতে ভোক্তাদের সহায়তা করে। গুরুত্বপূর্ণ এই কাজটি মজুদদার-মধ্যস্বত্বভোগীরা পালন করে থাকে। অথচ দাম একটু বেড়ে গেলেই এই মধ্যস্বত্বভোগীদের গালমন্দ শুনতে হয়। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ যদি অনেক কম হয় পণ্যের দাম বাজারে অনেক বেড়ে যায়, আর তার জন্য দায় নিতে হয় মধ্যস্বত্বভোগীদের, যা প্রায়শ অযথার্থ।

কৃষিপণ্যের অকস্মাৎ দাম বাড়ার মূল কারণ চাহিদা ও সরবরাহের ব্যবধান। দাম বাড়লে আমরা প্রথমেই দোষারোপ করি মজুদদার বা মধ্যস্বত্বভোগীদের সিন্ডিকেশনের। যা কিছু হারায়, গিন্নি বলেন কেষ্টা বেটাই চোর’—অনেকটা সে রকম। বাজারে দাম অনেকটা বেড়ে গেলে বা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকলে বুঝতে হবে সরবরাহে ঘাটতি আছে, মোট উৎপাদনের পরিমাণ আমরা যা-ই বলি না কেন? প্রকৃত দামই বলে দেবে দেশে উৎপাদন পরিস্থিতি কী, যদি না সেই পণ্য চোরাচালান হয়ে দেশের বাইরে যায়। বাজারে মাছের দাম কিছু মৌসুমি ওঠানামা ছাড়া দেড় দশক ধরে একটা স্থিতিশীল পর্যায়ে আছে। কারণ মাছের উৎপাদন দেশে ব্যাপক বেড়েছে এবং চাহিদা মেটাতে পারছে। এ বছর চালের দাম স্থিতিশীল ও নিম্নমুখী অর্থাৎ উৎপাদন এবং মোটা চাল আমদানি মিলিয়ে চাহিদা ও সরবরাহের ভালো সমন্বয় হচ্ছে এবার। এ কারণেই এবার সিন্ডিকেটের আওয়াজ উঠছে না।

গোমাংসের দাম প্রতি কেজি অতি উচ্চ, তাই দাম বেঁধে দিয়েও কার্যকর হয় না। কারণ গোমাংসের ঘাটতি আছে। ডিম ও তেলের বর্ধিত দাম আর অকস্মাৎ বিশ্বব্যাপী সব পণ্যের (৮০ থেকে ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত) আমদানি দাম বেড়ে যাওয়া এবং টাকার মানের প্রায় ২৭ শতাংশ দরপতন আমাদের দেশের মূল্যস্ফীতিকে বাড়িয়ে দেয়। আমাদের কৃষি ও শিল্পোৎপাদন ব্যবস্থা উজ্জীবিত থাকায় আমরা হাইপার বা অতি মূল্যস্ফীতি থেকে (এক বছরে ১৫ শতাংশ বা তার বেশি মূল্যস্ফীতি) রক্ষা পাই। আমাদের আমদানীকৃত গোখাদ্য ও পোলট্র্রিজাত খাদ্য উপকরণের দাম কোনো কোনো ক্ষেত্রে দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধি পায়। ফলে উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে যায়। এ বছরের অতি গরম, অতি বৃষ্টিতে পোলট্র্রিজাত সর্বউৎপাদনে বিরূপ প্রভাব পড়ে। অনেক পোলট্রি খামার উৎপাদনের বাইরে চলে যায়। ব্রয়লারসহ ডিম উৎপাদন কমে যায়। ব্রয়লারসহ ডিমের দাম ওঠানামা বা দাম বাড়ার এটাও একটা কারণ। এখানে সিন্ডিকেশনের দোষ অতিরঞ্জিত মনে হয়। কৃষি অর্থনীতিবিদরা এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ সংস্থা এ বিষয়ে অর্থবহ গবেষণা করে দেখতে পারে।

আসলে কৃষিপণ্যের মতো জটিল ব্যবস্থা নিয়ে কেবল সিন্ডিকেটের ওপর দোষ চাপানো বা আলু নিয়ে সিন্ডিকেট হয়েছে বলা অনেকটা সেই গ্রাম্য প্রবাদের মতো দাদার কবর কই, আর দাদি কান্দে কই। কৃষিপণ্য বাজার ব্যবস্থা আমাদের না বোঝার একটি বড় ক্ষেত্র বলেই আমার কাছে প্রতীয়মান হয়। সে কারণেই কৃষিপণ্যের মতো বিশাল ব্যক্তি খাতের যেখানে মুক্তবাজার খেলা সবচেয়ে কার্যকর রয়েছে। উৎপাদন, সংরক্ষণ, বিপণন ক্ষেত্রে বিপুল প্রতিযোগিতা রয়েছে, তেমন একটি ক্ষেত্রে পণ্যের দাম বেঁধে দেওয়া অবিবেচনাপ্রসূত, যা অতীতে কার্যকর হয়নি এবং এখনো কার্যকর হবে না। আর দাম অনেক বেড়ে গেলে মজুদদার পচনশীল পণ্য নিয়ে বসে থাকবে এটা আশা করা যায় না। লাভের আশায়ই সে পণ্য মজুদ করে থাকে, পচিয়ে ফেলার জন্য নয়।

কৃষিপণ্যের দাম ভোক্তার নাগালের বাইরে চলে গেলে কী করতে হবে? জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রে সরকার এর দায় এড়াতে পারে না অবশ্যই। চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ কম হলে দাম বাড়বেই, স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বাড়ার প্রবণতা দেখা দিলেই দ্রুত আমদানি উৎসাহিত করতে হবে। আমদানিব্যবস্থা যতটা সম্ভব উন্মুক্ত রাখতে হবে পণ্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে। দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে মৌলিক কৃষিপণ্য বা কৃষিজাত শিল্পপণ্য, যা ভোক্তার বাস্কেটে অতি প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী, সেসব ক্ষেত্রে আমদানি কর (আরডি, সিডি ইত্যাদি) আরোপ না করাই বাঞ্ছনীয়। এতে মূল্যস্ফীতিও কমে আসবে। রাজস্ব আদায়ে আমাদের এখন আয়কর সংগ্রহের ওপরই জোর দিতে হবে। কৃষিজাত শিল্পপণ্য (চিনি, ভোজ্য তেল বা মৌলিক কৃষিপণ্য ডাল) ইত্যাদি যেহেতু কেবল কিছুসংখ্যক ব্যবসায়ী আমদানি করে থাকে, এ ক্ষেত্রে সিন্ডিকেশন করা অসম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে অবশ্যই নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে এবং সব খরচসহ আমদানি দামের বেশি দাম চাইলে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে। যতটা সম্ভব আমদানিকারকের সংখ্যা বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে। বাজারের দাম বাড়া-কমা কিংবা অত্যধিক বেড়ে যাওয়া সমস্যা, বাজার প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই সমাধান করতে হবে। মূলকথা বাজারকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করতে দিতে হবে, গোডাউনে অভিযান চালিয়ে নয়।   

আর উৎপাদকের ক্ষতি হবে বলে কৃষি খাতের অনেকেই বরাবর আমদানি নিরুৎসাহ করেন। অধিক মূল্যে ভোক্তার পকেট কেটে উৎপাদককে সহায়তা করার কথা অন্যায্য। উৎপাদককে সহায়তা করতে হবে উৎপাদনে খরচ কমিয়ে, উন্নত চাষপদ্ধতি গ্রহণের মাধ্যমে, প্রয়োজনে ঋণ সহায়তা দিতে হবে, যাতে অন্তত আমদানিমূল্যের অথবা তার নিচে আমাদের উৎপাদন খরচ থাকে। এটাই হবে উৎপাদককে সহায়তার টেকসই কৃষির নীতিমালা।                 

 

লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত, অর্থনীতিবিদ ও প্রতিমন্ত্রী, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়     

 

 

 

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

ইরানের পরমাণু স্থাপনায় আবারও মার্কিন হামলার শঙ্কা

    ড. ফরিদুল আলম
শেয়ার
ইরানের পরমাণু স্থাপনায় আবারও মার্কিন হামলার শঙ্কা

ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলো যুক্তরাষ্ট্রের বোমা হামলায় মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তাঁদের মজুদ করা ইউরেনিয়াম সম্পূর্ণ বা আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কি না বা আদৌ এর কোনো ক্ষতি হয়েছে কি না, সে সম্পর্কে তাঁরা কিছু স্পষ্ট করেননি। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, তাঁরা তাঁদের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে সক্ষম হয়েছেন এবং ইরানের পরমাণু কর্মসূচি কয়েক দশক পিছিয়ে দেওয়া গেছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থা (আইএইএ) জানিয়েছে, ইরানের পরমাণু কর্মসূচির খুব একটা ক্ষতি হয়নি এবং তারা কয়েক মাস বা তারও কম সময়ের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত সেন্ট্রিফিউজগুলো মেরামত করে নতুন করে ইউরেনিয়াম উৎপাদন করতে সক্ষম হবে।

আইএইএর এ ধরনের অবস্থানের ফলে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে, তারা তাদের ৪০০ কেজি ইউরেনিয়ামের মজুদ যদি রক্ষা করতে সক্ষম হয়ে থাকে, তাহলে দ্রুততম সময়ের মধ্যেই তারা পরমাণু অস্ত্র তৈরির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যেতে পারে। আর এ ক্ষেত্রে তাদের দিক থেকে পরমাণু অস্ত্র তৈরির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় তাগিদ হিসেবে কাজ করবে সাম্প্রতিক সময়ের ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের বোমা হামলা, যা অন্ততপক্ষে দেশটির অভ্যন্তরীণ জনসমর্থনকে সরকারের পক্ষে নিতে পারে।

আইএইএ, ইরান বা যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল, কাদের দাবি কতটুকু যৌক্তিক, তা পরিষ্কার নয়। তবে মার্কিন বিমান হামলার পর ইরানের পার্লামেন্ট তাদের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে আইএইএকে আর কোনো ধরনের সহায়তা না করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা সম্প্রতি দেশটির প্রেসিডেন্ট অনুমোদন দিয়েছেন।

ইরানের দিক থেকে আইএইএর নিরপেক্ষতা নিয়ে অভিযোগ করা হয়েছে। তারা ইসরায়েল ও মার্কিন হামলার বিষয়ে নিন্দা জানায়নি, উপরন্তু মার্কিন-ইসরায়েলি চাওয়া অনুযায়ী ইরানের পরমাণু কর্মসূচির লাগাম টানতে চাইছে। ইরানের বক্তব্য থেকে এটিও বোঝা যায় যে তাদের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে আইএইএর তদন্ত মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলকে ভবিষ্যতে ইরানের বিষয়ে এক ধরনের তথ্য পাচারের শামিল, যার মাধ্যমে তারা ভবিষ্যতে তাদের ইরাননীতিকে পুনর্গঠন করবে।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যতই বলুন না কেন যে তাঁর দেশের বিমান হামলায় ইরানের পরমাণু কর্মসূচি গুঁড়িয়ে দেওয়া গেছে, বাস্তবে তিনি যে বিষয়টি নিয়ে চিন্তামুক্ত নন, এর আভাস পাওয়া গেছে তাঁর সাম্প্রতিক বক্তব্যে।

তিনি জানিয়ে দিয়েছেন যে ইরানকে কোনোভাবেই পরমাণু অস্ত্রধর হতে দেওয়া হবে না। আর যদি তারা এই প্রচেষ্টা আবারও করে, তাহলে ইরানে হামলা চালানো হবে বলে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন। একই বক্তব্য ইসরায়েলের। এমন অবস্থায় আইএইএর অবস্থানকে ইরান দেখছে অন্যভাবে। আর তাই সম্প্রতি আইএইএর পর্যবেক্ষকদল ইরান সফর করে তাদের পরমাণু কর্মসূচি তদন্ত করতে চাইলে ইরানের পক্ষ থেকে তাদের ফেরত পাঠানো হয়েছে।
এমন বাস্তবতায় ইরান কী করছে বা করতে যাচ্ছে, তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের জন্য নতুন চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ইরানের পরমাণু সক্ষমতার বিষয়টি এখনো বহাল রয়েছে, এটি প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও ভেতরে ভেতরে যুক্তরাষ্ট্র খুব ভালো করে জানে যে তাদের এমন কিছু সক্ষমতা রয়েছে, যার মধ্য দিয়ে যেকোনো ধরনের ক্ষতি তারা পুষিয়ে ওঠার সামর্থ্য রাখে। সাম্প্রতিক যুদ্ধে নতুন করে প্রমাণিত হয়েছে যে ইরানের বর্তমান সরকারব্যবস্থা নিয়ে দেশটির ভেতরে ব্যাপক জন-অসন্তোষ থাকলেও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা যখন বিপন্ন হতে বসে, তখন ইরানিরা সবাই এক জাতীয়তাবাদী আদর্শের পতাকাতলে সমবেত হয়। ইরানের সাবেক শাহর নির্বাসিত পুত্র রেজা শাহকে নিয়ে ইসরায়েল এবং পশ্চিমারা আবারও ইরানের ভেতরে সরকারবিরোধী আন্দোলনকে চাঙ্গা করতে চাইলেও ইরানে ইসরায়েলের হামলা এবং প্রাণহানি নিয়ে তিনি ইসরায়েলের প্রশংসা করে সরকারবিরোধীদেরও রোষানলে পড়েছেন। পশ্চিমারা রেজা শাহকে সামনে নিয়ে ইরানে নতুন করে কোনো বিপ্লব সংগঠিত করতে চাইলে এ ক্ষেত্রে এর ব্যর্থতা অনিবার্য। তবে ইরানকে আবারও ঘুরে দাঁড়ানো দেখাটাও তাদের জন্য এক চপেটাঘাতের শামিল। আর সে জন্যই ইরানের নীতিনির্ধারকরা পর্যন্ত এটি শঙ্কা করছেন যে আইএইএকে কোনো ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে নাএমন অভিযোগ তুলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল আবারও ইরানে হামলা করে বসতে পারে। 

ইরানের অবস্থানকে সুবিধার মনে করছে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অস্থিরতার প্রকাশ ঘটেছে তাঁর নতুন সিদ্ধান্তে। গত ৪ জুলাই ইরানের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। এই নিষেধাজ্ঞা ইরানের ওপর আগেকার নিষেধাজ্ঞার চেয়ে কিছুটা ব্যতিক্রম। এত দিন ধরে চাউর ছিল যে ইরানের তেল ও গ্যাস রপ্তানির ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থাকলেও শ্যাডো ফ্লিটের (গোপন জাহাজ) মাধ্যমে ইরান এই রপ্তানি চালিয়ে যাচ্ছে। নতুন করে জানা গেছে, ইরাকি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ ব্যবসায়ী সালেহ আহমেদ সাঈদীর মালিকানাধীন বিভিন্ন কম্পানির মাধ্যমে ইরানের তেল ইরাকের তেলের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে আরব আমিরাত হয়ে পশ্চিমা দেশগুলোতে রপ্তানি হয়ে আসছে, যার মাধ্যমে বছরে ১০০ কোটি ডলারের বেশি আয় করছে ইরান। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ব্যবসায়ী সালেহর কম্পানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন, যেন ইরান এভাবে বাণিজ্য করে এর থেকে অর্জিত অর্থ দিয়ে তা সামরিক খাতে ব্যয় করতে না করে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মনে করছেন, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি থেকে তাকে বিরত রাখতে হলে সর্বাগ্রে তার অর্থনৈতিক সামর্থ্যের জায়গায় আঘাত করতে হবে। তবে এখানে একটি কথা থেকে যায়, যে ১০০ কোটি ডলার আয়ের কথা বলা হয়েছে, বাস্তবে এটি ইরানের অর্থনীতিতে যে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে তার পারমাণবিক সক্ষমতাকে চালিয়ে নেওয়ার জন্য, সেটি খুব একটা যুক্তিগ্রাহ্য নয়।  

মোটকথা হচ্ছে, ইরান মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ও ইসরায়েলের স্বার্থের পথে সবচেয়ে বড় বাধা। এখন কথা হচ্ছে, ইরান যদি এমনটা মনে করে থাকে যে তারা আবারও সম্ভাব্য হামলা থেকে নিরাপদ নয়, সে ক্ষেত্রে তাদের প্রতিরক্ষার ধরন কেমন হবে? এ ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে কয়েকটি অনুমান করা যেতে পারে। প্রথমত, হরমুজ প্রণালি ঘিরে তারা তাদের কৌশলকে শাণিত করতে পারে, যেন পশ্চিমা বিশ্ব ইরানের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আগাম ধারণা পেতে পারে; দ্বিতীয়ত, তাদের নতুন করে আরো উন্নতমানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সংগ্রহ করে ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করতে হবে; তৃতীয়ত, যুদ্ধাস্ত্রের ক্ষেত্রে ইসরায়েলি প্রযুক্তির বিপরীতে নিজেদের প্রযুক্তি দুর্বলএই বাস্তবতার আলোকে এটিকে আরো উন্নত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে তারা চীন ও রাশিয়ার সহায়তা নিতে পারে এবং চতুর্থত, রাশিয়ার সঙ্গে তাদের চলমান কৌশলগত সম্পর্ককে আরো কার্যকর করার পাশাপাশি চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে উন্নত করা এবং ইসরায়েলের যেমন যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি শক্তি সর্বদা তাদের পাশে রয়েছে, ইরানকেও এমন পাশে থাকার মতো বৃহৎ শক্তিধর রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ককে আরো জোরদার করতে হবে।

আগামী কয়েক দিনের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে গাজায় হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধের আপাত অবসান হতে চলছে বলে মনে হচ্ছে। এটি মানে এই নয় যে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। বরং হামাস, হুতি ও হিজবুল্লাহর মতো সংগঠনগুলোর দুর্বলতার এই সুযোগে ইরানকে আরো পর্যুদস্ত করার নতুন চেষ্টা করতে পারে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র। তারা খুব ভালো করেই জানে এই সময়ে এসে তারা যদি ইরানকে ছাড় দেয়, তাহলে ইরান দ্রুতই আরো শক্তি সঞ্চয় করে তার প্রক্সিদের মাধ্যমে ইসরায়েলকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলবে। এসব যুক্তিতে ইরানে ফের হামলার শঙ্কা থেকেই যায়।

 

লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

mfulka@yahoo.com

মন্তব্য

ব্যাংকিং খাতে মানুষের আস্থা ফেরাতে হবে

    ড. মো. শফিকুল ইসলাম
শেয়ার
ব্যাংকিং খাতে মানুষের আস্থা ফেরাতে হবে

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে কিছু গুরুতর সমস্যা বিদ্যমান। অতীতে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন দেওয়া ব্যাংকগুলো ভালো পারফরম করতে পারছে না। বর্তমানে ব্যাংক খাতের জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে খেলাপি ঋণের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি, যদিও এই সমস্যাটি অতীতের জের ধরেই তৈরি। খেলাপি ঋণের সমস্যার সমাধান করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক উল্লেখযোগ্য কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, যেখানে কিছু ব্যাংকের অতীতের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়াসহ আর্থিক খাত সংস্কারের জন্য টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে তফসিলি ব্যাংকগুলোর মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা মোট ঋণের ২০.২ শতাংশ। ২০২৪ সালের জুনে ছিল দুই লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা, যা ছিল মোট ঋণের ১২ শতাংশ। জুন থেকে ডিসেম্বর সময়ে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে এক লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকা। অনেক ব্যাংক এখন মূলধন ঘাটতিতে ভুগছে, যা তাদের ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতাও কমিয়েছে।

ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের অভাব একটি বড় সমস্যা। এখানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ঘাটতি রয়েছে, যা দুর্নীতি ও অনিয়মকে উৎসাহিত করে। ব্যাংকিং খাতকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। অন্যথায় বিভিন্ন অনিয়ম ও জালিয়াতি বাড়তে থাকবে, যা ব্যাংকের ওপর মানুষের আস্থা কমাবে।

ব্যাংকিং খাতে এখন অনেক ধরনের অনিয়ম ঘটে এবং তা নিয়মিত গণমাধ্যমে আসে। ব্যাংকের কর্মকর্তার টাকা নিয়ে পালিয়ে যাওয়া, ভুয়া রসিদের মাধ্যমে গ্রাহকদের কয়েক কোটি টাকা তুলে নেওয়াএমনই আরো অনেক অভিযোগই পাওয়া যায়।

বিগত এক দশকের খেলাপি ঋণ অনুপাতের চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ব্যাংক সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ঋণ আদায়ে অদক্ষতা এবং ত্রুটিপূর্ণ ঋণ ব্যবস্থার কারণে ওই অনুপাত ২০১৪ সালের ৬.১০ থেকে ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৮ সালে ১০.৩০ শতাংশে পৌঁছে। এরপর অনুপাত একটু কমে ২০২০ সালে হয় ৭.১০ শতাংশ।

তবে ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে আবার তা বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৪ সালে খেলাপি ঋণ অনুপাত ২০.২০ শতাংশে উন্নীত হয়, যা এক বছরে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এই বৃদ্ধি ব্যাংকিং খাতের আর্থিক অবস্থার চরম সংকটেরই বহিঃপ্রকাশ।

উচ্চ খেলাপি ঋণের কারণে আমানতকারীদের আস্থায় ঘাটতি দেখা দিতে পারে। সঞ্চয়ের নিরাপত্তার জন্য বিদেশি ব্যাংক, এমনকি অনানুষ্ঠানিক, অনিয়ন্ত্রিত চ্যানেলে স্থানান্তর বা জমা করতে তাঁরা প্ররোচিত হতে পারেন, যা বেসরকারি ব্যাংকের জন্য চ্যালেঞ্জ। সীমিত ঋণপ্রবাহ শিল্প উৎপাদন, বিনিয়োগ এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে ব্যাহত করে। এ ছাড়া মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক অস্থিরতাকেও বাড়িয়ে তোলে। যখন খেলাপিরা শাস্তি থেকে বেঁচে যায়, তখন এটি ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণের সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করে।

বৈদেশিক বিনিয়োগকারী, ক্রেডিট রেটিং সংস্থা ও উন্নয়ন অংশীদাররা দেশের আর্থিক বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর প্রশ্ন তুলতে পারে, যা ঋণের খরচ বাড়িয়ে দিতে পারে এবং বিদেশি বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। যদি কার্যকর কাঠামোগত সংস্কার, সঠিকভাবে আইন প্রয়োগ এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার মাধ্যমে খেলাপি ঋণ সংকটের সমাধান করা না হয়, তাহলে বাংলাদেশের আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক গতিপথ দুর্বল হয়ে পড়তে পারে, যা কোনোভাবেই দেশের অর্থনীতির জন্য সুখকর নয়। এ জন্য প্রয়োজন ব্যাপক সংস্কার। সরকার ও নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

বছরের পর বছর ধরে অনিয়ম, দুর্নীতি এবং আইন ভঙ্গের চর্চার জন্য ব্যাংকিং খাতের আজকের এই পরিণতি, যা থেকে এ খাতের উত্তরণ অত্যন্ত জরুরি। এ ছাড়া ব্যাংক প্রশাসনকে রাজনীতিমুক্ত করা, ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপিদের নাম প্রকাশের মাধ্যমে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করা এবং স্বাধীন আর্থিক ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করা যেতে পারে। ব্যাংকিং খাতের সমস্যা সমাধানের জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাচালিত ঋণ মূল্যায়ন এবং ডিজিটাল ঋণ পর্যবেক্ষণের মতো প্রযুক্তিগত ব্যবস্থার প্রসার ঘটাতে হবে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে দায়িত্বশীল ঋণগ্রহীতাদের পুরস্কৃত করার পাশাপাশি ঋণখেলাপিদের নানাভাবে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। স্বাধীন ব্যাংকিং সংস্কার কমিশন প্রতিষ্ঠা করা বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য অত্যন্ত জরুরি।

 

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

মন্তব্য

নির্বাচন ব্যবস্থায় উপযুক্ত পরিবেশ জরুরি

    ড. সুলতান মাহমুদ রানা
শেয়ার
নির্বাচন ব্যবস্থায় উপযুক্ত পরিবেশ জরুরি

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন (ইসি) ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি ও এপ্রিলএই দুটি টাইমফ্রেম বা সময়সীমা সামনে রেখে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে তাদের বক্তব্য-বিবৃতি থেকে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। এমনকি এ তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে যে স্থানীয় সরকার নয়, বরং সংসদ নির্বাচন ঘিরে পুরোদমে প্রস্তুতি নিচ্ছে সাংবিধানিক এই সংস্থা। কিন্তু যেমন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এবং তেমনি সরকারের সঙ্গেও বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের এক ধরনের টানাপড়েন চলছে। এমনকি বাংলাদেশের রাজনীতি কোন দিকে যাচ্ছে, সেটিও এখন অনুমান করা কষ্টকর হয়ে পড়েছে।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় নির্ধারণ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে যে উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল, লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠকের পর সেটি কেটেছে বলে মনে করা হচ্ছিল, কিন্তু দুই সপ্তাহ যেতে না যেতেই নতুন করে নির্বাচনকেন্দ্রিক সংশয় তৈরি হয়েছে নানা মহলে। বিশেষ করে ভোটের বিষয়ে সরকারের দিক থেকে এখন পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনকে স্পষ্ট কোনো বার্তা না দেওয়ায় এ নিয়ে জল্পনাকল্পনা বাড়ছে। আবার দু-একটি রাজনৈতিক দলও এমন সব বক্তব্য দিচ্ছে, যা জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় নিয়ে সংশয় সৃষ্টি করছে। এর মধ্যে আছে, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন দাবি করা, গণহত্যার বিচার ও সংস্কার সম্পন্ন করার আগে কোনো নির্বাচন নয় ইত্যাদি।

https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/07.july/08-07-2025/kalerkantho-ed-1a.jpgবাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ইতিহাসে সংকট ও অনাস্থার পরিবেশ নতুন নয়। অনাস্থার বেড়াজাল থেকে রাজনৈতিক দলগুলো কখনোই বের হতে পারেনি। গণতন্ত্রের নামে এবং গণতন্ত্র রক্ষার অঙ্গীকারে রাজনৈতিক দলগুলো বারবারই রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। সাম্প্রতিককালে এমনই এক অনিশ্চয়তার দোলাচলে ঘুরপাক খাচ্ছে বিদ্যমান রাজনীতি।

দেশে আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এখনো অনেক সংশয় রয়েছে। নির্বাচনের সময় ও অন্যান্য বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পথনির্দেশ থাকতে হবে। নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা, স্বচ্ছতা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে আস্থার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। তা না হলে দেশে সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলে নানা মহল থেকে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ জন্য একটি সুশৃঙ্খল গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে বর্তমানে সরকার, নির্বাচন কমিশন ও সব রাজনৈতিক দলকে আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে।

বর্তমানে বিশিষ্টজনরা নির্বাচনমুখী আলোচনায় ব্যস্ত। কারণ সবাই একটি নির্বাচনী টাইমফ্রেম চায়।

আমরা লক্ষ করছি, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সংস্কার এবং বিচারের আগে নির্বাচন না দেওয়ার বিষয়ে কথা বলে যাচ্ছে। এমনকি এনসিপির আহবায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, জুলাই ঘোষণাপত্র না দিলে তাঁরা নির্বাচনে অংশ নেবেন না। কয়েকটি দলের নেতাদের বক্তব্য-বিবৃতি শুনে মনে হচ্ছে, তাঁরা নির্বাচন বিষয়ে ধীরগতিতে আগাতে চান। কারণ তাঁদের উপলব্ধি হচ্ছে নবগঠিত দলের ৩০০ আসনে প্রার্থিতা নিশ্চিত করা এবং ভোটারদের কাছে তাঁদের নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা কিংবা জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে তুলতে কিছুটা সময় প্রয়োজন। অন্যদিকে বিএনপি দ্রুত নির্বাচনের দিকে আগাতে চায়। জামায়াত সংস্কার প্রসঙ্গে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।

রাজনৈতিক দলগুলোর মূল লক্ষ্য হলো নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া। আর এই লক্ষ্য সামনে রেখে প্রতিটি রাজনৈতিক দলই নিজস্ব কৌশল প্রয়োগে ব্যস্ত থাকবে, সেটি স্বাভাবিক। কৌশল প্রয়োগের লক্ষ্যে সব দলই নিজ নিজ জায়গা থেকে সামনে এগিয়ে যাবে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মেরুকরণ ঘটবেএটি অস্বাভাবিক কিছু না। মূলত নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য রাজনৈতিক মেরুকরণে পরিবর্তন হতে পারে। তবে কোনো দল যদি রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিজ নির্বাচনী আয়োজনের পক্ষে কাজে লাগানোর সুযোগ পায় অথবা কাজে লাগায়, তাহলে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সেটি উপযুক্ত হবে না। নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে সামনে আসবে। আর নির্বাচন কমিশনও যদি প্রভাবিত না হয়ে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারে, তাহলেই নির্বাচন ও রাজনীতি দুটিই গ্রহণযোগ্য মাত্রা পাবে। আর এ কারণেই সব পক্ষকে সমান সুযোগের আওতায় নিয়ে আসার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশন ও সরকারের।

বাংলাদেশ সংবিধানের ১২০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালনের জন্য যেরূপ কর্মচারীদের প্রয়োজন হইবে, নির্বাচন কমিশন অনুরোধ করিলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনকে সেইরূপ কর্মচারী প্রদানের ব্যবস্থা করিবেন। কাজেই নির্বাচন কমিশনই প্রশাসনকে ঢেলে সাজিয়ে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করতে পারে। মূলত নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের উপযুক্ত ভূমিকার ওপরই সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়টি বহুলাংশে নির্ভর করে।

আসন্ন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে তিনটি চ্যালেঞ্জ দৃশ্যমান হতে পারে। প্রথমত, নির্বাচনে বেশির ভাগ ভোটারের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা; দ্বিতীয়ত, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান; তৃতীয়ত, ভবিষ্যতে সাধারণ জনগণের ভোটে অংশ নেওয়ার বিষয়ে আগ্রহ সৃষ্টি করা। কারণ নির্বাচন যদি ভালো হয়, তাহলে নির্বাচনী রাজনীতিতে জনগণের আস্থা তৈরি হবে আর ভালো না হলে তৈরি হবে স্থায়ী অনাস্থা।

অবশ্য রাজনীতিতে কিছু গুণগত পরিবর্তন আনাও জরুরি। আর তা করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরাই নিজেদের পথের কাঁটা হওয়া থেকে সরে আসতে হবে। দেশ ও জাতির উন্নয়ন করতে হলে রাষ্ট্রক্ষমতার চাবি হাতে থাকা যেহেতু জরুরি, সেহেতু রাজনৈতিক দলগুলোর মূল লক্ষ্য থাকে ক্ষমতায় যাওয়া। ক্ষমতায় যেতে অর্থাৎ আগামী নির্বাচনে বিজয়ী হতে রাজনৈতিক দলগুলো এখন মরিয়া হয়ে উঠবেএমনটাই স্বাভাবিক। তবে শিষ্টাচারসম্মত রাজনীতির জন্য জনপ্রতিনিধিদের গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি।

আমাদের নিজেদের বিবেক এবং চিন্তা যদি পরিশীলিত বা মার্জিত না হয়, তাহলে কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক উত্তরণের ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তনের প্রত্যাশা সফল হবে না। আমরা বাংলাদেশে যে কাঠামোই চয়েস করি না কেন কিংবা যেমন আইনই তৈরি করি না কেন অথবা যেমন সংস্কারই হোক না কেন, এগুলো বাস্তবায়নের মূলে রয়েছে নাগরিক এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মানসিকতার পরিবর্তন। মানসিকতা পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই একটি গ্রহণযোগ্য মানের উদার নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা পেতে পারে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, দেশের সাধারণ মানুষ রাজনীতির একটি গুণগত পরিবর্তন প্রত্যাশা করে। আর এ কারণে নতুন রাজনৈতিক দলসহ বিদ্যমান সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের উদ্দেশে বলব, আপনারা যদি দেশের রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন চান, তাহলে অতীতের অনেক আচরণ বদলানোর প্রয়োজন হবে। মনে রাখবেন, রাজনীতি মানে উগ্রতা বা প্রতিহিংসা নয়। রাজনীতি মানে ভদ্রতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং সহনশীলতা। আর এসব গুণের মধ্য দিয়ে জনগণের মনে স্থান করে নিতে হবে। রাগ, হিংস্রতা কিংবা প্রতিহিংসাপরায়ণ আচরণ দিয়ে রাজনীতি করলে কখনোই রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আসবে না। আমরা অপেক্ষাকৃত উন্নত, ভালো এবং নতুন কিছু প্রত্যাশা করি। আর এ জন্য পরিবর্তন শুধু মুখে নয়, আচরণে এবং কার্যক্রমে প্রমাণ করা এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।

 

লেখক : অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

sultanmahmud.rana@gmail.com

মন্তব্য

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান : চাওয়া-পাওয়ার দাগ-খতিয়ান

    তুহিন খান
শেয়ার
জুলাই গণ-অভ্যুত্থান : চাওয়া-পাওয়ার দাগ-খতিয়ান

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রায় এক বছর উপলক্ষে জুলাই ও আগস্ট মাসজুড়ে বেশ বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানসূচি ঘোষিত হয়েছে ইন্টেরিম সরকারের তরফে। কিন্তু এক বছরে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব কতটা মেলানো গেল? জুলাইয়ের সুফল কার ঘরে কতটা উঠল?

গণ-অভ্যুত্থান নিজেই একটি বড় প্রাপ্তি। যে অভ্যুত্থানের ফলে আওয়ামী লীগের মতো একটি নিকৃষ্ট ফ্যাসিস্ট শাসকগোষ্ঠীর পতন হলো, তার চেয়ে বড় প্রাপ্তি এ দেশের জনগণের জীবনে খুব কমই আছে। এই অভ্যুত্থানের আগে-পরে দেশে যে বিপুল জনসচেতনতা ও সৃষ্টিশীল গণক্ষমতার উদ্বোধন আমরা দেখেছি, তরুণদের মধ্যে যে স্বচ্ছ রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ও দেশ গঠনের দৃঢ় প্রত্যয় জন্ম নিতে দেখেছি, তা এককথায় মহাকাব্যিক।

সেদিন থেকে জুলাই ওয়ান্স ইন আ লাইফটাইম ইভেন্ট এবং এর প্রাপ্তির দিকটি অনেক বড়। কিন্তু জুলাই-পরবর্তী সরকার, রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সাংস্কৃতিক রাজনীতি ও সমাজব্যবস্থার বাস্তব ক্ষেত্রগুলোতে এই মহাকাব্যিক ঘটনা কাঠামোগতভাবে কতটা অনূদিত হতে পারল, আমরা নানা রকম ভাঙার পাশাপাশি কতটা গড়তে পারলামসেদিক বিবেচনায় অপ্রাপ্তিও কম না।

গত বছর ৮ আগস্ট ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার ভারত পলায়নের পরিপ্রেক্ষিতে যে সরকারটি গঠিত হয়, তার ধরনটি ঠিক কী হবে, কী হলে আরো ভালো হতো, এ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা আছে। অন্তর্বর্তী এই সরকারটি গঠিত হয়েছে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করেই; আবার গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের কেউ কেউ এ সরকারের অংশ হয়েছেন।

ফলে এ সরকারের ধরনটি ঠিক কী, তার মেয়াদ ও ম্যান্ডেট কতটুকু হওয়া সংগত, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। যদিও কিছুদিন আগে এক টক শোতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, এই সরকারের সবকিছু করারই ম্যান্ডেট আছে; তবে কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে এই দাবিটি খুব জোরালো বাস্তব ভিত্তি নিয়ে হাজির নেই। গেল বছর ডিসেম্বর থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে যে বহুমুখী জটিলতা ও ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে, তার মূলেও আছে অন্তর্বর্তী সরকারের ধরন নিয়ে এই তর্ক। ঘোষিতভাবে একটি অন্তর্বর্তী সরকার হলেও সরকারের ভেতরে ও বাইরে অনেকেই একে একটি বিপ্লবী সরকার করে তুলতে আগ্রহী, যদিও এর কোনো সুস্পষ্ট রূপরেখা জনসমাজে স্পষ্টভাবে হাজির নেই।
পুরনো ধারার রাজনৈতিক দলগুলো, যারা এই গণ-অভ্যুত্থানের এবং সরকারেরও অন্যতম প্রধান শরিকএই বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষার ব্যাপারে তাদের বেশির ভাগেরই মনোভাব নেতিবাচক, কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত।

জুলাইয়ের বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষা, অন্তর্বর্তী সরকারের এই ধরন ও রাজনৈতিক শক্তিগুলোর অবস্থানএই তিনের টানাপড়েন শেষমেশ যে জাতীয় আকাঙ্ক্ষায় থিতু হয়েছে, তার আলংকারিক নাম : সংস্কার। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আগ থেকেই বেশ কিছু রাজনৈতিক দল ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্ল্যাটফর্মের কারণে রাষ্ট্র সংস্কার ধারণাটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ফলে সেটির প্রায়োগিক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে এবং কিভাবে ও কতটুকু হবে এই সংস্কারসেটিই প্রধান আলোচ্য বিষয়। বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন হয়েছে দেশে এবং সেসব কমিশন বড় বড় রিপোর্টও তৈরি করেছে।

কিন্তু এসব সংস্কার প্রস্তাবের ঠিক কতটুকু বাস্তবায়ন করা যাবে বা গেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন ও অনিশ্চয়তা আছে। তা ছাড়া সংস্কার আর নির্বাচনকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে, সংস্কারের এজেন্ডাটিকে আরো কঠিন করে তোলা হয়েছে।

রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদের স্বাভাবিক ফলাফল হিসেবেই যে সামাজিক ফ্যাসিবাদ ও ধর্মীয় চরমপন্থা সুপ্তাবস্থায় প্রায় এক যুগ ধরে আস্তে আস্তে গাঢ় হয়ে উঠছিল, তা অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে নিঃশেষিত হয়নি, বরং নানা ধরনের সামাজিক ও ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী প্রবণতা নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন শক্তিতে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে পরাজিত ফ্যাসিস্ট শক্তি ও তার দেশি-বিদেশি এজেন্টরা এই প্রবণতাগুলোকে অনেক রংচং মেখে বাস্তবের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বিকট করে উপস্থাপন করার চেষ্টায় রত। জুলাইয়ের শক্তিগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন ও মেরুকরণও এই পরিস্থিতিটিকে বেশ ঘোলাটে করে তুলছে। সে ব্যাপারে সতর্ক থেকেও বলা যায় যে এই ঘটনাগুলো ঘটছে।

মব শুনলেই অনেকে খেপে যান আজকাল, তার সংগত কারণও আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু সত্য কথা এটিই যে ৫ আগস্টের পর দেশে নানা রকম মব তৈরি হয়েছে। সামাজিক-নৈতিক পুলিশগিরি বাড়ছে। এসবের সঙ্গে জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা বা বিপ্লবী তৎপরতার যোগ সামান্য। ধর্মীয় চরমপন্থাও এই পরিস্থিতিকে একটি সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করছে।

বিপ্লবী ছাত্র-জনতা ও সরকারের কাজ ছিল সমাজে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা এই নতুন প্রতিবিপ্লবী, হঠকারী ও ফ্যাসিস্ট তৎপরতাগুলোরও বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, যেখানে মোটাদাগে স্পষ্টতই তারা ব্যর্থ হয়েছে। এতে সমাজে সরকার ও অভ্যুত্থানের নেতৃত্বের ব্যাপারে যে মাত্রারই হোক, একটি নেতিবাচকতা তৈরি হয়েছে।

৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ের একটি প্রধান জনদাবি ও গুরুতর কাজ ছিল বিচার ও আনুষ্ঠানিক রিকনসিলিয়েশন প্রসেস শুরু করা। কিন্তু এই দাবিটি বিদ্যমান কোনো রাজনৈতিক শক্তিই সততার সঙ্গে সামনে আনতে পেরেছে বলে মনে হয় না। নির্বাচনী রাজনীতির হিসাব-নিকাশ, সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর টানাপড়েন, মামলা বাণিজ্যের পলিটিক্যাল ইকোনমি, ঘোলা পানিতে মাছ শিকারিদের নানা রকম অপতৎপরতা, বিচারহীন পুনর্বাসনের বিবিধ উদ্যোগ আর সরকারের অস্পষ্ট ও গতিহীন নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যে বিচারের দাবিটির বহুলাংশ অপচয় হয়েছে। একটি ফ্যাসিস্ট সরকারকে উত্খাত করার পর অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি জাতীয় অখণ্ডতা রক্ষা ও সামাজিক-রাজনৈতিক রিকনসিলিয়েশন নিশ্চিতে যে ধরনের ব্যাপক, বহুমুখী ও কুশলী প্রাতিষ্ঠানিক তৎপরতা প্রয়োজন ছিল, সরকার সেটি করতে বেশ খানিকটা ব্যর্থই হয়েছে বলা যায়।

অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দলটিকে ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে এক ধরনের কৌতূহল, আকাঙ্ক্ষা ও দরদ তৈরি হয়েছে। তবে এই আকাঙ্ক্ষা নিরঙ্কুশ নয়। নির্বাচনী রাজনীতিতে ঢুকে পড়ায় বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামোর অনেক বিষয়ই আত্তীকৃত করতে হয়েছে দলটির, যা তাদের নানাভাবে বিতর্কিত করেছে। আবার এই দলটির গতি-প্রকৃতি কী হবে, তার কল্পনার বাংলাদেশটি ঠিক কেমন হবেএসব বিষয়েও নানা ধরনের অনুমান তৈরি হয়েছে। এসব সত্ত্বেও পরিবর্তনকামী বা সংস্কারবাদীরা এখনো এই দলটির ওপর ভরসা রাখতে চাইছেন বলেই মনে হয়।

প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির এই হিসাব চলবে। কিন্তু জুলাইয়ে ঘটে যাওয়া মহাকাব্যিক অভ্যুত্থানটি আমাদের জাতীয় জীবনে যে বিপুল পরিবর্তনের সম্ভাবনা হাজির করেছে, তা অসামান্য। আমরা এর কতটা কাজে লাগাতে পারব, তা এখনো অনিশ্চিত। তবে বাংলাদেশ যত দিন থাকবে, তত দিন মুক্তির এই অসামান্য সম্ভাবনা এ দেশের মানুষকে অনুপ্রাণিত করে যাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

লেখক : কবি, অনুবাদক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ