<p style="margin-bottom:13px">বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫) বিশ্বব্যাপী একজন মুক্তিসংগ্রামী ও মহান রাজনীতিবিদ হিসেবেই সমধিক পরিচিত। প্রকৃত প্রস্তাবেই তিনি রাজনীতির মানুষ—রাজনীতিই ছিল তাঁর জীবনের ধ্যান-জ্ঞান। তিনিই বাঙালির শ্রেষ্ঠতম জাতীয়তাবাদী নেতা। বাঙালির সম্মিলিত চেতনায় জাতীয়তাবোধ সঞ্চারে তিনি পালন করেছেন ঐতিহাসিক ভূমিকা। বিশ্ব-ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর মতো জাতীয়তাবাদী নেতার দৃষ্টান্ত বিরল। তিনিই একমাত্র নেতা, যিনি জাতীয় পুঁজির আত্মবিকাশের আকাঙ্ক্ষা এবং বাঙালির সম্মিলিত মুক্তির বাসনাকে মেলাতে পেরেছেন অভিন্ন মোহনায়। বিশ্ব-ইতিহাসে কোনো জাতীয়তাবাদী নেতার কর্মসাধনায় এই যুগলস্রোতের মিলন লক্ষ করা যায় না।</p> <p>রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান—উৎসর্গ করেছেন নিজের জীবন। তবে কেবল রাজনৈতিক ও অথনৈতিক মুক্তিই নয়, বাংলাদেশের ভাষা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মুক্তিসংগ্রামের অন্যতম নেতা হিসেবেও বঙ্গবন্ধু পালন করেছেন ঐতিহাসিক ভূমিকা। বস্তুত তাঁর সাধনার মধ্য দিয়েই ভাষা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকেন্দ্রিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের পূর্ণাঙ্গ ভিত্তি রচিত হয়েছে। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন ভাষা, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রভিত্তিক জাতীয়তাবাদ। সন্দেহ নেই, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের চেতনা এ ক্ষেত্রে তরুণ শেখ মুজিবকে প্রভাবিত করেছে সবচেয়ে বেশি।</p> <p>বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করতে ভালোবাসতেন—বাংলা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসা থেকেই তিনি বাংলায় বক্তৃতা করতেন। ১৯৫২ সালের অক্টোবর মাসে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের আট মাস পরে, বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর প্রতিনিধিদের শান্তি সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু অংশগ্রহণ করেন। সেই শান্তি সম্মেলনে পাকিস্তানের প্রতিনিধিদলের সদস্য শেখ মুজিবুর রহমান বাংলা ভাষায় বক্তব্য দেন, যা ইংরেজি, চীনা, রুশ ও স্প্যানিশ ভাষায় অনুবাদ করে উপস্থিত প্রতিনিধিদের শোনানো হয়। এ প্রসঙ্গে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন :</p> <p>‘পূর্ব পাকিস্তান থেকে আতাউর রহমান খান ও আমি বক্তৃতা করলাম। আমি বাংলায় বক্তৃতা করলাম। আতাউর রহমান সাহেব ইংরেজি করে দিলেন।...কেন বাংলায় বক্তৃতা করব না। ভারত থেকে মনোজ বসু বাংলায় বক্তৃতা করেছেন। পূর্ব বাংলার ছাত্ররা জীবন দিয়েছে মাতৃভাষার জন্য। বাংলা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু লোকের ভাষা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে না চেনে এমন শিক্ষিত লোক চীন কেন, দুনিয়ার অন্য দেশেও আমি খুব কম দেখেছি। আমি ইংরেজিতে বক্তৃতা করতে পারি। তবু আমার মাতৃভাষায় বলা কর্তব্য।’</p> <p><img alt="বঙ্গবন্ধু ও জাতিসংঘে বাংলা ভাষা" height="382" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2023/09.September/25-09-2023/MK/kalerkantho-6-2023-09-25-01a.jpg" style="float:left" width="400" />বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসা বঙ্গবন্ধুর জীবনের উত্তরকালেও ছিল গভীরভাবে প্রবহমান। এরই ধারাবাহিকতায় ৫০ বছর আগে ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৯তম অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলা ভাষায় বক্তব্য দিয়ে বিশ্ববাসীকে অবাক করে দেন। বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করবেন—এমন কথা প্রচারিত হলে অনেকেই উসখুস করতে থাকেন। আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ারি বুমেদিন বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়ে ইংরেজি ভাষায় বক্তব্য দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু মাতৃভাষার প্রতি গভীর ভালোবাসায় অটল বঙ্গবন্ধু সেদিন বাংলা ভাষায় তাঁর বক্তব্য উপস্থাপন করেন। এই ঘটনা বাংলা ভাষার বিশ্বায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিকীকরণে বঙ্গবন্ধুর এই দুঃসাহসী ভূমিকা সম্পর্কে অনেকেই সদর্থক মূল্যায়ন করেন। প্রসঙ্গত, সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী লিখেছেন :</p> <p>‘রবীন্দ্রনাথ যেমন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়ে বাঙালির আন্তর্জাতিক কালচারাল নেশনহুডের ভিত্তি তৈরির সূচনা করেছেন, শেখ মুজিবুর রহমান তেমনি জাতিসংঘে বাংলা ভাষায় ভাষণ দিয়ে সেই নেশনহুডের রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক মর্যাদার স্বীকৃতি আদায় করেছেন।’ সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্ত লিখেছেন : ‘বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলা ভাষায় ভাষণ দিয়ে আমাদের ভাষার মর্যাদাকে বিশ্ব রাষ্ট্রসভায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। দুর্ভাগ্য আমাদের এবং আমাদের লজ্জা এখানেই যে আমরা সেদিন এর গভীর তাৎপর্য অনুধাবন করতে চাইনি।’</p> <p>জাতিসংঘের অধিবেশনে তাঁর ভাষণে বঙ্গবন্ধু বিশ্বব্যাপী শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের অঙ্গীকারের কথা জোরের সঙ্গে উচ্চারণ করেন। বক্তৃতার শুরুতেই তিনি বলেন : ‘যে মহান আদর্শ জাতিসংঘ সনদে রক্ষিত আছে, আমাদের লক্ষ লক্ষ মানুষ সেই আদর্শের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করিয়াছেন। আমি জানি, শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সব মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের উপযোগী একটি বিশ্ব গড়িয়া তোলার জন্য বাঙালি জাতি পূর্ণ প্রতিশ্রুতবদ্ধ, আমাদের এই অঙ্গীকারের সাথে শহীদানের বিদেহী আত্মাও মিলিত হইবে।’</p> <p>কেবল নিজের দেশ নয়, বরং গোটা বিশ্বের শান্তি ও উন্নয়নের স্বপ্ন দেখতেন বঙ্গবন্ধু। ভাষণে বঙ্গবন্ধু বিশ্বশান্তি ও উন্নতির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তাই জাতিসংঘের ভবিষ্যৎ পথরেখা নির্দেশ করে বলেন : ‘একটি যথার্থ আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়িয়া তোলার পদক্ষেপ নিতে জাতিসংঘকে এর আগে কোথাও এই ধরনের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করিতে হয় নাই।...একটি স্থায়ী এবং যথার্থ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্য বিশ্বের দেশগুলির সাধারণ স্বার্থের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক কাঠামো প্রণয়নেরও ব্যবস্থা থাকিতে হইবে। এই মুহূর্তে আমরা প্রত্যেক মানুষের জন্য মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক ঘোষণায় স্বীকৃত মুক্তভাবে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সুবিধা ভোগের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করার আন্তর্জাতিক দায়িত্বের কথা দ্ব্যর্থহীনভাবে পুনরুল্লেখ করিতেছি। আন্তর্জাতিক ঘোষণা অনুযায়ী প্রত্যেকটি মানুষের স্বাস্থ্য এবং পরিবারের কল্যাণের জন্য পর্যাপ্ত জীবনযাত্রার ব্যবস্থা নিশ্চিত করিতে হইবে।’ এ উদ্দেশ্যে তিনি বাংলাদেশের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যও সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করে তাঁর ভাষণ শেষ করেন এভাবে :</p> <p>‘আমাদের লক্ষ্য স্বনির্ভরতা। আমাদের পথ হইতেছে জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও যৌথ প্রচেষ্টা। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং সম্পদ ও প্রযুক্তিবিদ্যার শরিকানা মানুষের দুঃখ-দুর্দশা হ্রাস করিবে এবং আমাদের কর্মকাণ্ডকেও সহজতর করিবে ইহাতে কোন সন্দেহ নাই। নতুন বিশ্বের অভ্যুদয় ঘটিতেছে। আমাদের নিজেদের শক্তির উপর আমাদের বিশ্বাস রাখিতে হইবে। আর লক্ষ্য পূরণ এবং সুন্দর ভাবীকালের জন্য আমাদের নিজেদেরকে গড়িয়া তুলিবার জন্য জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও সমন্বিত প্রয়াসের মাধ্যমে আমরা আগাইয়া যাইব।’</p> <p>জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। পিতার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে বঙ্গবন্ধু-আত্মজা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিগত বছরগুলোতে ১৭ বার বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করেছেন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে। এসব দৃষ্টান্ত বাংলা ভাষার মর্যাদা ও গৌরবকেই বিশ্বব্যাপী প্রসারিত করেছে।</p> <p>লেখক : সাবেক উপাচার্য</p> <p>রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়</p>