<p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">পারিবারিক সহিংসতা প্রকৃতিতে গুরুতর একটি সমস্যা, যা আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিকভাবে ব্যক্তি ও সম্প্রদায়কে প্রভাবিত করে। বর্তমানে আমরা দেখছি সম্পত্তি ও পারিবারিক কলহের জেরে সন্তান তার মাকে খুন করছে, বাবাকে হত্যা করছে, এক ভাই আরেক ভাইকে খুন করছে, ভাই তার বোনকে মারছে। এ রকম আরো কত নৃশংসতার ঘটনা আমরা সংবাদ পত্রিকায় দেখতে পাই। এ ধরনের অপ্রচলিত অপরাধ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে পারিবারিক সহিংসতার কারণ, গতিশীলতা ও পরিণতি সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করতে চাইলে আমাদের অবশ্যই অপরাধবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করতে হবে। অপরাধবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে পারিবারিক সহিংসতার কারণ অন্বেষণ করতে হবে। তাত্ত্বিক কাঠামো ও ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার জন্য প্রভাবগুলো বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করতে হবে। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">পারিবারিক সহিংসতা বলতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শুধু নারীদের প্রতি সহিংসতা বোঝালেও সমাজবিজ্ঞানের বিশ্লেষণ অনুযায়ী পরিবারের যেকোনো সদস্যের প্রতি সহিংসতা বা সহিংসতার মনোভাবকে পারিবারিক সহিংসতা বলে। শারীরিক, মানসিক যেকোনো ধরনের অত্যাচার ও নির্যাতনই পারিবারিক সহিংসতার অন্তর্ভুক্ত। এতে শারীরিক, যৌন, মানসিক ও অর্থনৈতিক অপব্যবহার, সেই সঙ্গে অবহেলা জড়িত।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">ক্রিমিনোলজি স্বীকার করে যে পারিবারিক সহিংসতা বিচ্ছিন্ন নয়, বরং বৃহত্তর সামাজিক কারণ এবং স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে আন্ত সম্পর্কিত। অপরাধসংক্রান্ত গবেষণা অনেক কারণের পরামর্শ দেয়, যা পারিবারিক সহিংসতার ঘটনার পেছনে জড়িত। এর মধ্যে রয়েছে পারিবারিক সহিংসতা প্রায়ই অমীমাংসিত দ্বন্দ্ব, সম্পত্তি ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্ব, ক্ষমতার অনুশীলন এবং পারিবারিক সম্পর্কের মধ্যে অপর্যাপ্ত যোগাযোগের ধরন থেকে উদ্ভূত হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আশির দশকের পর থেকেই আমাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিশ্বায়ন ও নগরায়ণের প্রভাব পড়তে থাকে। এ জন্য আমাদের সমাজের মধ্যে সামাজিক স্তরবিন্যাস ও শ্রেণিবৈষম্য বাড়তেই থাকে। এই প্রভাবের ফলে মানুষের মূল্যবোধে পরিবর্তনের পাশাপাশি সংঘাত ও হানাহানির মতো ঘটনাও বাড়তে থাকে। কারণ সবাই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি চায়। সামাজিক এই বৈষম্য ও সংঘাতের আঁচ পড়েছে আমাদের পরিবারকাঠামোতেও। পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের মধ্যেও টাকা-পয়সা, জমিজমা নিয়ে সংঘাত বেড়েই চলেছে। এই সংঘাত নৃশংস হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত গড়িয়েছে। জমি নিয়ে মারামারি, নির্যাতন, হত্যা এখন নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">সামাজিক শিক্ষা তত্ত্ব বলছে, ব্যক্তিরা পর্যবেক্ষণ ও অনুকরণের মাধ্যমে সহিংস আচরণ শেখে। পারিবারিক সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে শিশুরা পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আপত্তিকর, বেআইনি, সহিংস ও দূরত্বসূচক আচরণ দেখে সহিংসতা শিখতে পারে। যারা হিংসাত্মক পরিবারে বা সহিংসতামূলক কর্মকাণ্ডের মধ্যে বেড়ে ওঠে, তারা আক্রমণাত্মক ও আপত্তিজনক আচরণগুলো রপ্ত করে। কারণ তারা সহিংসতাকে বিরোধ নিষ্পত্তির একটি স্বাভাবিক উপায় হিসেবে উপলব্ধি করে। মানুষের আচরণ বোঝার একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণে পারিবারিক পরিবেশ ও মা-বাবার আচরণ ধারাবাহিকভাবে খুবই স্পষ্ট ভূমিকা পালন করে। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">অন্যদিকে রুটিন অ্যাক্টিভিটি থিওরি তত্ত্ব পরামর্শ দেয় যে পারিবারিক সহিংসতা বেশি হওয়ার আশঙ্কা তখনই থাকে, যখন অপরাধী বা অপরাধমূলক আচরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা পরিবারের ভেতর অবস্থান করে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুর্বল পরিবারের সদস্য ও সক্ষম অভিভাবকত্ব বা সুরক্ষামূলক ব্যবস্থার অভাব। অন্যদিকে পারিবারিক কলহ, সম্পত্তির ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্ব প্রভৃতি ব্যাখ্যা করতে হলে প্রথমেই আমাদের আলোকপাত করতে হবে বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী রবার্ট কে. মার্টনের স্ট্রেইন (চাপ) তত্ত্ব, যেখানে স্পষ্ট উল্লেখ করা আছে, মানুষ অপরাধ করে অর্থনৈতিক বা সামাজিক চাপে। মার্টনের তত্ত্ব অনুযায়ী, বিশ্বায়ন, শিল্পায়ন ও নগরায়ণের ফলে একটি সমাজ ও সামাজিক মূল্যবোধে অনেক পরিবর্তন আসে। এই পরিবর্তনের ধারাকে সামাজিক উত্তরণ বা সোশ্যাল ট্রানজিশন বলে। একটি সমাজ যখন সামাজিক উত্তরণের ধারায় থাকে, তখন সামাজিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও কাঠামোতে পরিবর্তন আসতে থাকে। সামাজিক পরিবর্তনের ফলে সমাজবদ্ধ মানুষের আচার-আচরণ ও মূল্যবোধে যেমন পরিবর্তন আসে, তেমনি সামাজিক অবস্থানেও পরিবর্তন আসে। এই পরিবর্তনের ফলে সমাজবদ্ধ মানুষের মধ্যে এক ধরনের চাপ অনুভূত হয় এবং সেই চাপ থেকেই মানুষ অপরাধের দিকে ধাবিত হয়। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এ বছরের পারিবারিক সংঘাত বা কলহের কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে আরো কিছু কারণ দেখতে পাই। এই কারণগুলো হচ্ছে যৌতুকের দাবি, মাদক কেনাবেচা, পরিবারে আধিপত্য বিস্তার, সম্পত্তির লোভ, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, সহিংস আচরণ এবং পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আয়বৈষম্য। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">অপরাধবিজ্ঞানের দিক থেকে এসব বিশ্লেষণ করলে মূলত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য সামাজিক চাপের কারণে মানুষের মধ্যে সংঘর্ষ ও অপরাধের পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। এই স্ট্রেইনের সঙ্গে আমাদের মানসিক ও মনস্তত্ত্বের বিভিন্ন বিষয়ও জড়িত। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">অন্যদিকে এ ধরনের নৃশংস ঘটনাকে আমরা কনফ্লিক্ট থিওরি বা দ্বান্দ্বিক তত্ত্বের আলোকেও ব্যাখ্যা করতে পারি। দ্বন্দ্ব তত্ত্ব অনুযায়ী, পরিবার অর্থনৈতিক বৈষম্যকে আরো বেশি প্ররোচিত করে এবং পিতৃতন্ত্রকে শক্তিশালী করে সামাজিক বৈষম্য বজায় রাখে। পরিবার তার নিজের সদস্যদের জন্য শারীরিক ও মানসিক সহিংসতা, নিষ্ঠুরতাসহ বিভিন্ন ধরনের সংঘর্ষের একটি উৎসও হতে পারে। তার মানে পরিবারের সদস্য এবং আত্মীয়-স্বজনও সহিংসতা, এমনকি হত্যাকাণ্ডের উৎস ও শিকার হতে পারে। আমার মতে, বর্তমানে আমরা যে একটি সামাজিক পরিবর্তনের মধ্য থেকে যাচ্ছি, সেটির জন্যই এত পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষের শিকার হচ্ছি। বাংলাদেশে নিও-লিবেরালিজমের সূচনা হওয়ার পর আমরা দেখছি, মানুষের মধ্যে তাড়াতাড়ি ধনী ও সম্পদশালী হওয়ার এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। এর ফলে যে যেভাবে পারছে সম্পদ অর্জনের চেষ্টায় মত্ত, যা মানুষকে নিকৃষ্টতম অপরাধ করতেও দ্বিধায় ফেলছে না।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">তাই আমি মনে করি, যদি পারিবারিক সহিংসতা সংশ্লিষ্ট অপরাধ ও সামাজিক অবক্ষয়কে আমরা প্রতিরোধ করতে চাই, তাহলে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি আমাদের সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করার দিকে অনেক বেশি কাজ করতে হবে। পারিবারিক সংঘাত দ্বারা সৃষ্ট ঝুঁকির কারণ চিহ্নিত করতে এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা বাস্তবায়নে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীসহ সর্বস্তরের মানুষের সহযোগিতা প্রয়োজন। ঝুঁকিপূর্ণ পরিবারগুলোকে লক্ষ্য করে প্রাথমিক হস্তক্ষেপ কর্মসূচিগুলো পারিবারিক সহিংসতার আশঙ্কা কমাতে সংস্থান, শিক্ষা ও সহায়তা প্রদান করতে পারে। অপরাধসংক্রান্ত গবেষণা পারিবারিক সহিংসতাকে একটি গুরুতর অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অবদান রেখেছে। ক্ষতিগ্রস্তদের রক্ষা করতে এবং অপরাধীদের জবাবদিহি করতে আইন ও নীতি তৈরি করা হয়েছে। যা হোক, ধারাবাহিক প্রয়োগ ও উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জগুলো রয়ে গেছে। আমাদের স্বীকার করতে হবে যে পারিবারিক সহিংসতার শিকার এবং অপরাধী উভয়েরই কাউন্সেলিং ও সহযোগিতা প্রয়োজন। ভিকটিম পরিষেবা এবং আশ্রয়কেন্দ্রগুলো বেঁচে থাকাদের নিরাপত্তা ও সহায়তা প্রদান করে, যখন অপরাধীর পুনর্বাসন কর্মসূচির লক্ষ্য সহিংসতার কারণগুলো মোকাবেলা করা এবং আচরণের পরিবর্তনকে উন্নীত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ডগুলোর মধ্যে পড়ে। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">পারিবারিক সহিংসতা একটি জটিল সামাজিক সমস্যা, যা ব্যাপক বোঝাপড়া ও কার্যকর হস্তক্ষেপের মাধ্যমে একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন। বাংলাদেশে পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ, শিকারদের সুরক্ষা এবং স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ পারিবারিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে সম্মিলিতভাবে কাজ করার বিকল্প নেই। </span></span></span></span></p> <p> </p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ক্রিমিনোলজি বিভাগ</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়</span></span></span></span></p>