পার্বত্য শান্তিচুক্তি ২৫ বছরে তথা রজত জয়ন্তীতে পদার্পণ করল। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের অবসান ও শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুকন্যার ঐকান্তিক ইচ্ছায় ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রামের নৃগোষ্ঠীর সংগঠন জনসংহতি সমিতি জেএসএসের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে। উল্লেখ্য, তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে এই সংঘাতের সূচনা হয়। ১৯৬২ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে সৃষ্ট বন্যায় সেখানকার প্রায় এক লাখ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে।
পার্বত্য শান্তিচুক্তির রজত জয়ন্তী
- মো. জাকির হোসেন
অন্যান্য

১৯৭৩ সালে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি।
প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত ইচ্ছায় পার্বত্য এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
সরকার সুনির্দিষ্টভাবে দাবি করেছে, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করা হয়েছে। তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদ এবং নিয়ন্ত্রণাধীন ৩৩টি দপ্তর-সংস্থার মধ্যে রাঙামাটিতে ৩০টি, খাগড়াছড়িতে ৩০টি এবং বান্দরবানে ২৮টি হস্তান্তর করা হয়েছে। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করতে গঠন করা হয়েছে ভূমি কমিশন। প্রত্যাগত ১২ হাজার ২২৩টি উপজাতি শরণার্থী পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। শান্তি বাহিনীর সদস্যদের সাধারণ ক্ষমা এবং ৭২৫ জনকে পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। শান্তিচুক্তির পর দুই হাজার ৫২৪ জনের বিরুদ্ধে ৯৯৯টি মামলার তালিকার মধ্যে ৮৪৪টি মামলা যাচাই-বাছাই করে ৭২০টি প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া চলছে। একটি পদাতিক ব্রিগেডসহ ২৩৮টি নিরাপত্তা বাহিনী ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে। সংসদ উপনেতার নেতৃত্বে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি গঠন করা হয়েছে। নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বিল ২০১০ জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়েছে। তিন পার্বত্য জেলায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিভিন্ন দপ্তরে চাকরির ক্ষেত্রে নৃগোষ্ঠীর লোকদের নির্ধারিত কোটা অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়েছে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নৃগোষ্ঠীর জন্য কোটা সংরক্ষণ করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, জেলা পরিষদ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের শীর্ষস্থানীয় পদে নৃগোষ্ঠীর মধ্য থেকে প্রতিনিধি নিয়োগ করা হয়েছে। পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন করা হয়েছে। ১৯৭৬ সালে জারীকৃত পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড অধ্যাদেশ বাতিল করে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড আইন ২০১৪ জাতীয় সংসদে পাস করা হয়েছে। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি আইন প্রণয়ন করা হয়েছে।
সরকারের তরফ থেকে দাবি করা হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে আর্থ-সামাজিকভাবেও উন্নয়ন হয়েছে। অনেক উন্নয়নকাজ চলমান রয়েছে। ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরের তুলনায় পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়ন বাজেট প্রায় ২০ গুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। তিন পার্বত্য জেলায় দুই হাজার ৮৯৯ কিলোমিটার বিদ্যুৎ লাইন নির্মাণ করা হয়েছে। দুর্গম হওয়ার কারণে যেখানে জাতীয় গ্রিডের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব নয়, এ রকম পাঁচ হাজার ৫০০টি পরিবারকে সৌরবিদ্যুৎ সুবিধা প্রদান করা হয়েছে। শান্তিচুক্তির আগে পার্বত্য অঞ্চলে মাত্র ২০০ কিলোমিটার রাস্তা ছিল। রুমা ও থানচি উপজেলার সাঙ্গু নদীর ওপর কোনো সেতু ছিল না। এখন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে সড়ক ও জনপথ বিভাগের ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম এলাকায় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক রাস্তা ও বিভিন্ন আকারের সেতু-কালভার্ট নির্মাণ করেছে। শান্তিচুক্তির পর এক হাজার ৫৩২ কিলোমিটার পাকা রাস্তা ও গুরুত্বপূর্ণ সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। প্রায় ১০৫ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে এবং প্রায় ৮৬০ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
শান্তিচুক্তির পর পার্বত্য চট্টগ্রামে টেলিযোগাযোগ, মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কের আওতা বৃদ্ধি এবং ইন্টারনেট ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করা হয়েছে। চুক্তির আলোকে পার্বত্য জেলায় কৃষি, স্বাস্থ্য, নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা, শিক্ষা ও সংস্কৃতির পাশাপাশি বেশ কিছু এলাকা পর্যটন উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা, শিক্ষা উপবৃত্তি চালু রয়েছে। ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পের আওতায় দারিদ্র্য বিমোচন তথা জীবনমান উন্নয়ন করা সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে কয়েক শ পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। এর পরও নাখোশ নৃগোষ্ঠীর নেতারা। সন্তু লারমা প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করলেও রাষ্ট্রীয় কোনো অনুষ্ঠানে অংশ নেন না। এলাকায় ভোটার হননি এবং জাতীয় পরিচয়পত্রও নেননি। যেসব বিষয়কে কেন্দ্র করে জেএসএসের অভিযোগ, তা হলো ভূমি সমস্যার সমাধান, ভোটার তালিকা প্রণয়ন, জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন, পরিষদগুলোকে যথাযথ ক্ষমতা দেওয়া, স্থানীয় পুলিশ বাহিনী গঠন, বসতি স্থাপনকারী বাঙালিদের বিষয় সুরাহা, সম্পূর্ণ বেসামরিকীকরণ, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং পাহাড়ি প্রকৃতির সুরক্ষা।
এ কথা অনস্বীকার্য যে পার্বত্য সমস্যার মূল হচ্ছে ভূমি সমস্যা। পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র লড়াইয়ের সময় প্রায় ১৩ হাজার পাহাড়ি পরিবার ভারতে চলে গিয়েছিল। প্রায় ৯৩ হাজার পরিবার অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হয়েছিল। অন্যদিকে প্রায় চার লাখ ভূমিহীন বাঙালিকে পাহাড়ে পুনর্বাসন করা হয়। পাহাড়ি মানুষের অভিযোগ, তাদের জমিতেই বাঙালিদের বসতি স্থাপন করা হয়েছে। পাহাড়িদের দাবি, চুক্তির আওতায় গঠিত ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন প্রকৃত মালিকদের জমির মালিকানা বুঝিয়ে দেবে। কিন্তু কমিশন গঠনের প্রক্রিয়ায় এবং বিতর্কে প্রায় দুই দশক চলে গেছে। অবশেষে আইনটি সংশোধনের পর কমিশন নতুন করে গঠিত হয়েছে। কমিশনের কাছে জমি ফেরত চেয়ে ২২ হাজারের বেশি আবেদন জমা পড়েছে। ভূমি বিরোধের সুরাহা হওয়ার সঙ্গে শুধু জীবন-জীবিকার প্রশ্ন নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভোটার হওয়ার বিষয়। পাহাড়িরা জমি ফিরে পেলে নিশ্চিত হবে সে কোন এলাকার ভোটার হবে। অন্যদিকে চুক্তি অনুযায়ী অ-উপজাতীয় অর্থাৎ পুনর্বাসিত বাঙালিদের ভোটার হতে হলে পাহাড়ের স্থায়ী বাসিন্দা হতে হবে। ভূমির মালিকানা নিরঙ্কুশভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। নয়তো তারা স্থায়ী বাসিন্দার স্বীকৃতি পাবে না। তালিকা করার এই বিধি নিয়ে বাঙালিদের প্রবল আপত্তি। তাদের দাবি, পুনর্বাসিত বাঙালিরা পাহাড়ে একাধিক প্রজন্ম পার করেছে। এখানে তারা ভোটার হবে না কেন? তাদের আরেকটি যুক্তি হলো, সংসদ এবং ইউনিয়ন ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ভোটার তালিকায় পুনর্বাসিত বাঙালিরা অন্তর্ভুক্ত। তাহলে জেলা পরিষদের জন্য স্থায়ী বাসিন্দার শর্তযুক্ত আলাদা ভোটার তালিকা কেন প্রয়োজন? স্থানীয় বাঙালি সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিরা তাই চুক্তির কিছু বিষয়ে সংশোধনসহ এর বাস্তবায়ন দেখতে চান।
শান্তিচুক্তির ২৫ বছর পরও পাহাড়ে শান্তি ও আস্থা ফেরেনি। ইতি ঘটেনি সংঘাত ও অশান্তির। সেখানে একদিকে পাহাড়ি-বাঙালি স্বার্থের সহিংস সংঘাত চলমান; অন্যদিকে পাহাড়ি সশস্ত্র গোষ্ঠীর সন্ত্রাসে প্রায় প্রতিদিনই রক্তস্নাত হচ্ছে পাহাড়ের সবুজ গালিচা। শান্তির নীড়ে কেন এই প্রাণঘাতী সংঘাত? শুধু চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে অসন্তোষ, নাকি অন্য কিছু রয়েছে এর পেছনে? চুক্তি-পরবর্তী সময়ে পাহাড়ে শান্তির সুবাতাস বইতে শুরু করেছিল। কিন্তু শান্তিচুক্তিতে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের প্রতিফলন হয়নি—এমন কথা বলে জেএসএস থেকে বেরিয়ে গিয়ে প্রসিত খীসার নেতৃত্বে ১৯৯৮ সালে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) গঠিত হয়। ২০০১ সালে নানিয়ারচর থেকে তিন বিদেশিকে অপহরণের মাধ্যমে ইউপিডিএফ তাদের সংগঠনের কার্যক্রমের জানান দেয়। সেই থেকে শুরু পাহাড়ে অপহরণের রাজনীতি। আস্তে আস্তে শান্ত পাহাড় আবারও অশান্ত হয়ে উঠতে থাকে। শুরু হয় নতুন করে খুন, গুম, অপহরণ, চাঁদাবাজি ও আধিপত্যের খেলা। শান্তিচুক্তি গৌণ হয়ে পড়ে চাঁদাবাজি ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠার এই প্রক্রিয়ায়। ২০০৭ সালে জেএসএস ভেঙে তৈরি হয় জেএসএস-এম এন লারমা দল। আর ২০১৭ সালে ইউপিডিএফ ভেঙে তৈরি হয় ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক দল।
এই চারটি আঞ্চলিক সংগঠনের স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলে পাহাড়ের সবুজ গালিচা রক্তাক্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। পাহাড়ি নেতারা চুক্তির বাস্তবায়নের ধীরগতিকে রক্তপাতের কারণ হিসেবে অভিহিত করলেও প্রকৃতপক্ষে চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রক্ত ঝরছে পাহাড়ে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সূত্র মতে, চাঁদাবাজি, ক্ষমতা দখল, আধিপত্য বিস্তার ও ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে সশস্ত্র চার সন্ত্রাসী গ্রুপের হাতে গত এক বছরে শতাধিক মানুষ খুন-গুম হয়েছে। আর শান্তিচুক্তির পর এ পর্যন্ত ২৫ বছরে সশস্ত্র চার গ্রুপের হাতে ৯ শতাধিক মানুষ খুন এবং এক হাজার ৫০০ গুম হয়েছে।
একটি প্রতিবেদনে প্রকাশ, পার্বত্যাঞ্চলে গত ২৫ বছরে গুম হওয়াদের মধ্যে ৬০ শতাংশ মুক্তিপণের অর্থ দিয়ে জীবন বাঁচিয়েছে। বাকিদের বিভিন্ন জঙ্গলে লাশ ফেলে দেওয়া হয়েছে। সংবাদপত্রে প্রকাশ, আঞ্চলিক এই সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের কাছে অত্যাধুনিক অস্ত্রের মজুদ রয়েছে। একই সঙ্গে ইয়াবা, আইসসহ ভয়ংকর সব মাদকও দেশে আসছে। সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলা-হত্যা একসময় নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কয়েক বছর ধরে সন্ত্রাসীরা সেনাবাহিনী, পুলিশ, আনসার, নির্বাচনী কর্মকর্তাসহ সামরিক-বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা-হামলা করছে।
এটি রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করা ও রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ওপর হামলা। এসব হামলা শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন কিংবা পাহাড়িদের অধিকার রক্ষার সঙ্গে কোনোভাবেই সম্পর্কযুক্ত নয়। অন্যদিকে এটি শান্তিচুক্তির শর্তেরও সরাসরি লঙ্ঘন। সশস্ত্র গ্রুপের শীর্ষ নেতারা চাঁদার টাকায় বিভিন্ন শহরে বিলাসবহুল জীবন যাপন করেন। অনেকের বিদেশেও বাড়ি রয়েছে। কারো কারো পরিবার-পরিজন এ দেশে থাকে না, বিদেশে বসবাস-পড়াশোনা করে। এসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিপুল অর্থের সমাগম ও বিলাসী জীবনে অনুপ্রাণিত হয়ে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফ নামে নতুন বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগঠন আত্মপ্রকাশ করেছে। এরা অর্থের বিনিময়ে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ নামে নব্য জঙ্গিগোষ্ঠীর সদস্যদের সামরিক প্রশিক্ষণ ও আধুনিক অস্ত্র সরবরাহ করছে। পার্বত্য সংঘাতের দৃশ্যপটে নতুন নতুন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী আবির্ভূত হচ্ছে। পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। পার্বত্য অঞ্চলে শুধু অশান্তি নয়, রাষ্ট্রের জন্য ভয়ানক নিরাপত্তা শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। কেউ কেউ একে শান্তিচুক্তির পূর্ববর্তী অবস্থা সৃষ্টির পাঁয়তারা হিসেবে বিবেচনা করছে।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে সরকার ও শান্তিচুক্তির পাহাড়িপক্ষের মধ্যে কিছুটা আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছে। সমস্যা সমাধানের সবচেয়ে প্রাচীন ও কার্যকর পদ্ধতি হচ্ছে পক্ষদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা। খোলা মন নিয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এই আস্থার সংকট কাটিয়ে পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি নিশ্চিত করা সম্ভব। অস্ত্র হাতে নিয়ে, মানুষ হত্যা করে আর যা-ই হোক শান্তি প্রতিষ্ঠা হতে পারে না।
লেখক : অধ্যাপক, আইন বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
zhossain1965@gmail.com
সম্পর্কিত খবর

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান : চাওয়া-পাওয়ার দাগ-খতিয়ান
- তুহিন খান

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রায় এক বছর উপলক্ষে জুলাই ও আগস্ট মাসজুড়ে বেশ বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানসূচি ঘোষিত হয়েছে ইন্টেরিম সরকারের তরফে। কিন্তু এক বছরে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব কতটা মেলানো গেল? জুলাইয়ের সুফল কার ঘরে কতটা উঠল?
গণ-অভ্যুত্থান নিজেই একটি বড় প্রাপ্তি। যে অভ্যুত্থানের ফলে আওয়ামী লীগের মতো একটি নিকৃষ্ট ফ্যাসিস্ট শাসকগোষ্ঠীর পতন হলো, তার চেয়ে বড় প্রাপ্তি এ দেশের জনগণের জীবনে খুব কমই আছে। এই অভ্যুত্থানের আগে-পরে দেশে যে বিপুল জনসচেতনতা ও সৃষ্টিশীল গণক্ষমতার উদ্বোধন আমরা দেখেছি, তরুণদের মধ্যে যে স্বচ্ছ রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ও দেশ গঠনের দৃঢ় প্রত্যয় জন্ম নিতে দেখেছি, তা এককথায় মহাকাব্যিক।
গত বছর ৮ আগস্ট ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার ভারত পলায়নের পরিপ্রেক্ষিতে যে সরকারটি গঠিত হয়, তার ধরনটি ঠিক কী হবে, কী হলে আরো ভালো হতো, এ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা আছে। অন্তর্বর্তী এই সরকারটি গঠিত হয়েছে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করেই; আবার গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের কেউ কেউ এ সরকারের অংশ হয়েছেন।
জুলাইয়ের বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষা, অন্তর্বর্তী সরকারের এই ধরন ও রাজনৈতিক শক্তিগুলোর অবস্থান—এই তিনের টানাপড়েন শেষমেশ যে জাতীয় আকাঙ্ক্ষায় থিতু হয়েছে, তার আলংকারিক নাম : সংস্কার। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আগ থেকেই বেশ কিছু রাজনৈতিক দল ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্ল্যাটফর্মের কারণে ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ ধারণাটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ফলে সেটির প্রায়োগিক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে এবং কিভাবে ও কতটুকু হবে এই সংস্কার—সেটিই প্রধান আলোচ্য বিষয়। বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন হয়েছে দেশে এবং সেসব কমিশন বড় বড় রিপোর্টও তৈরি করেছে।
রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদের স্বাভাবিক ফলাফল হিসেবেই যে সামাজিক ফ্যাসিবাদ ও ধর্মীয় চরমপন্থা সুপ্তাবস্থায় প্রায় এক যুগ ধরে আস্তে আস্তে গাঢ় হয়ে উঠছিল, তা অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে নিঃশেষিত হয়নি, বরং নানা ধরনের সামাজিক ও ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী প্রবণতা নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন শক্তিতে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে পরাজিত ফ্যাসিস্ট শক্তি ও তার দেশি-বিদেশি এজেন্টরা এই প্রবণতাগুলোকে অনেক রংচং মেখে বাস্তবের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বিকট করে উপস্থাপন করার চেষ্টায় রত। জুলাইয়ের শক্তিগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন ও মেরুকরণও এই পরিস্থিতিটিকে বেশ ঘোলাটে করে তুলছে। সে ব্যাপারে সতর্ক থেকেও বলা যায় যে এই ঘটনাগুলো ঘটছে।
‘মব’ শুনলেই অনেকে খেপে যান আজকাল, তার সংগত কারণও আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু সত্য কথা এটিই যে ৫ আগস্টের পর দেশে নানা রকম মব তৈরি হয়েছে। সামাজিক-নৈতিক পুলিশগিরি বাড়ছে। এসবের সঙ্গে জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা বা বিপ্লবী তৎপরতার যোগ সামান্য। ধর্মীয় চরমপন্থাও এই পরিস্থিতিকে একটি সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করছে।
বিপ্লবী ছাত্র-জনতা ও সরকারের কাজ ছিল সমাজে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা এই নতুন প্রতিবিপ্লবী, হঠকারী ও ফ্যাসিস্ট তৎপরতাগুলোরও বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, যেখানে মোটাদাগে স্পষ্টতই তারা ব্যর্থ হয়েছে। এতে সমাজে সরকার ও অভ্যুত্থানের নেতৃত্বের ব্যাপারে যে মাত্রারই হোক, একটি নেতিবাচকতা তৈরি হয়েছে।
৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ের একটি প্রধান জনদাবি ও গুরুতর কাজ ছিল বিচার ও আনুষ্ঠানিক রিকনসিলিয়েশন প্রসেস শুরু করা। কিন্তু এই দাবিটি বিদ্যমান কোনো রাজনৈতিক শক্তিই সততার সঙ্গে সামনে আনতে পেরেছে বলে মনে হয় না। নির্বাচনী রাজনীতির হিসাব-নিকাশ, সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর টানাপড়েন, মামলা বাণিজ্যের পলিটিক্যাল ইকোনমি, ঘোলা পানিতে মাছ শিকারিদের নানা রকম অপতৎপরতা, বিচারহীন পুনর্বাসনের বিবিধ উদ্যোগ আর সরকারের অস্পষ্ট ও গতিহীন নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যে বিচারের দাবিটির বহুলাংশ অপচয় হয়েছে। একটি ফ্যাসিস্ট সরকারকে উত্খাত করার পর অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি জাতীয় অখণ্ডতা রক্ষা ও সামাজিক-রাজনৈতিক রিকনসিলিয়েশন নিশ্চিতে যে ধরনের ব্যাপক, বহুমুখী ও কুশলী প্রাতিষ্ঠানিক তৎপরতা প্রয়োজন ছিল, সরকার সেটি করতে বেশ খানিকটা ব্যর্থই হয়েছে বলা যায়।
অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দলটিকে ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে এক ধরনের কৌতূহল, আকাঙ্ক্ষা ও দরদ তৈরি হয়েছে। তবে এই আকাঙ্ক্ষা নিরঙ্কুশ নয়। নির্বাচনী রাজনীতিতে ঢুকে পড়ায় বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামোর অনেক বিষয়ই আত্তীকৃত করতে হয়েছে দলটির, যা তাদের নানাভাবে বিতর্কিত করেছে। আবার এই দলটির গতি-প্রকৃতি কী হবে, তার কল্পনার বাংলাদেশটি ঠিক কেমন হবে—এসব বিষয়েও নানা ধরনের অনুমান তৈরি হয়েছে। এসব সত্ত্বেও পরিবর্তনকামী বা সংস্কারবাদীরা এখনো এই দলটির ওপর ভরসা রাখতে চাইছেন বলেই মনে হয়।
প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির এই হিসাব চলবে। কিন্তু জুলাইয়ে ঘটে যাওয়া মহাকাব্যিক অভ্যুত্থানটি আমাদের জাতীয় জীবনে যে বিপুল পরিবর্তনের সম্ভাবনা হাজির করেছে, তা অসামান্য। আমরা এর কতটা কাজে লাগাতে পারব, তা এখনো অনিশ্চিত। তবে বাংলাদেশ যত দিন থাকবে, তত দিন মুক্তির এই অসামান্য সম্ভাবনা এ দেশের মানুষকে অনুপ্রাণিত করে যাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক : কবি, অনুবাদক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করা প্রয়োজন
- ড. নিয়াজ আহম্মেদ

করোনার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমে যে ছেদ তৈরি হয়েছিল, তা এখনো আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এ ছাড়া গত বছরের গণ-আন্দোলনে তিন-চার মাস আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। বিশ্ব্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত আমাদের এইচএসসি নামক পাবলিক পরীক্ষা। কোনো কারণে এইচএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে গেলে আমাদের ভর্তি কার্যক্রমও পিছিয়ে যায়।
আমরা যদি জানুয়ারি মাসে এসএসসি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে এইচএসসি পরীক্ষা নিতে পারি, তাহলে জুলাই মাসে উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা যাবে।
উচ্চশিক্ষা যেহেতু বহু রকমের, সেহেতু এখানেও অনেক বিষয় রয়েছে। মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার বিষয়টি সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ দ্বারা পরিচালিত হয়। তাই তারা বেশ দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারে। সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যদি একটি পরীক্ষায় ভর্তি নিতে পারত, তাহলেও সময় বাঁচত। কিন্তু তা সম্ভব হয়ে উঠছে না। আমাদের মানে শিক্ষকদের এখানে করণীয় রয়েছে। এইচএসসি পরীক্ষা শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে ভাবতে হবে। আমরা প্রতিবছর একই পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা এবং এর কার্যক্রম সম্পন্ন করি। ফলে দ্রুত কার্যক্রম শুরু করতে সমস্যা নেই। ফলাফল প্রকাশের এক সপ্তাহের মধ্যে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, এক মাসের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা এবং সর্বোচ্চ তিন মাসের মধ্যে পুরো ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করা সম্ভব।
আমাদের কাছে মনে হয়, সরকারের আন্তরিকতা এবং শিক্ষকদের সহযোগিতা এখানে মুখ্য বিষয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, কতটা সহজে এবং দ্রুত আমরা আমাদের ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারি। আমাদের টার্গেট যদি থাকে জানুয়ারি মাসের প্রথম দিন ক্লাস শুরু করা, তাহলে টার্গেট অনুযায়ী কাজটি করতে হবে। একদিকে শিক্ষার্থীরা পাবলিক পরীক্ষা দেবে, অন্যদিকে আমরা ভর্তি পরীক্ষার কার্যক্রম শুরু করব। সরকার যদি পাবলিক পরীক্ষা আগে এবং দ্রুত সম্পন্ন করতে পারে, তাহলে আমরাও দ্রুত ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারব। ধরুন, এখন এইচএসসি পরীক্ষা চলছে। আশা করা যায়, সেপ্টেম্বরে ফলাফল প্রকাশিত হবে। আমরা অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা শেষ করতে পারি। তিন মাসে কি ভর্তি পরীক্ষার যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করা যথেষ্ট নয়? আমাদের দরকার সরকারের ইচ্ছা এবং সবচেয়ে বড় দরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়, শিক্ষকদের মধ্যে সহযোগিতা ও আন্তরিকতা। আমরা আশা করব, আগামী শিক্ষাবর্ষে যেন জানুয়ারি মাসেই শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয়।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
nahmed1973@gmail.com

কজন জানে জুলাই সনদ কী
- গাজীউল হাসান খান

সমাজ ও বৃহত্তরভাবে রাষ্ট্র মেরামত কিংবা পরিবর্তনের জন্য যেসব কাঙ্ক্ষিত বা আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়, মূলত সেগুলোকেই সংস্কার বা ‘রিফর্ম’ বলা হয়। দেশের সংবিধান থেকে শুরু করে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নাগরিকরা কিংবা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সেসব সংস্কারের উদ্যোগ নিতে পারেন। তবে শেষ পর্যন্ত জাতীয় কিংবা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সেসব সংস্কার প্রস্তাবকে কার্যকর করতে হলে একটি আইনানুগ ভিত্তি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। বাংলাদেশে চব্বিশ সালের গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর সময়ে অতীত স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী শাসন এবং আর্থ-সামাজিক শোষণ-বঞ্চনার অবসানের জন্য দল-মত-নির্বিশেষে সবাই রাষ্ট্র মেরামতের একটি জোরালো দাবি উত্থাপন করেছে।
এ কথা ঠিক যে বিগত জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান কোনো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ছিল না। তবু সেটি আমাদের বিগত ৫৩ বছরের স্বাধীনতা-উত্তর আন্দোলনের ইতিহাসে একটি বিরাট মাইলফলক। স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী শাসন-শোষণের কবল থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে একটি বিশাল পদক্ষেপ। সুতরাং কোনো বিবেচনায়ই সে অভ্যুত্থানকে খাটো করে দেখা যাবে না।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান অধ্যাপক ড. ইউনূসসহ আমাদের রাজনৈতিক মহলের অনেকেই এরই মধ্যে গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। এতে তাঁদের অনেকের মধ্যেই বিগত ১১ মাসে ঘটে যাওয়া অনেক ব্যর্থতার চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে অনেকে দায়ী করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতা ও অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে সমন্বয়ের অভাবকে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সাবেক নেতারা এরই মধ্যে বহুবার অভিযোগ করেছেন যে অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে সময়োচিতভাবে একটি ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণার অভাবে রাজনৈতিক মহলে এখনো অনেক বিভ্রান্তি এবং ভবিষ্যৎ দিকদর্শনের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। ফলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই তাদের নিজ নিজ দলের পতাকাতলে অবস্থান নিয়েছে। ভুলে গেছে সেই মহান গণ-অভ্যুত্থানের জাতীয় প্রেক্ষাপটটি। রাজনৈতিক ঐক্য কিংবা রাজনৈতিক কর্মসূচিগত সমন্বয়ের বিষয়টি। ফলে চারদিকে মাথা তোলার অবকাশ বা সুযোগ পেয়েছে পতিত আওয়ামী সরকারের দোসর কিংবা বশংবদরা। সে পরিস্থিতিতে ড. ইউনূস হতাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘আমাদের একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বিফলে যেতে বসেছে। আমরা মুখে বলছি, সাবেক ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রতিনিধিরা এখনো সর্বত্র বসে রয়েছে। আমরা তাদের সরাতে পারিনি। আমরা তাদের স্বভাব-চরিত্র বদলাতে পারিনি।’ এ অবস্থায় অনতিবিলম্বে সর্বক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে না পারলে এবং সব জায়গায় কাঙ্ক্ষিত সংস্কার কিংবা পরিবর্তন সাধন করতে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতে ক্ষমতার রাজনীতিতে কোনো নির্বাচিত সরকারই স্থিতিশীল হতে পারবে না। এতে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন, উন্নয়ন কিংবা সমৃদ্ধি আশা করা হয়েছিল, তা বিফলে যেতে বাধ্য হবে। এখানেই অতীতে সংঘটিত সব গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের মৌলিক এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিগত কিছু পার্থক্য ছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারটি ছিল গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী একটি ভিন্নধর্মী রাজনৈতিক উদ্যোগের ফসল, কিন্তু তাতে অন্য অনেক কিছু থাকলেও ছিল না রাজনৈতিক দূরদর্শিতা।
ফরাসি বিপ্লব রাশিয়ায় সংঘটিত সমাজতান্ত্রিক (বলশেভিক) বিপ্লবের মতো ছিল না। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রায় শেষ দশকে (১৭৮৯-১৭৯৯) ফ্রান্সে সংঘটিত সে বিপ্লব ছিল একটি ‘দশক স্থায়ী সামাজিক-রাজনৈতিক অভ্যুত্থান’। ফ্রান্সের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের উল্লেখযোগ্য সময়। সে অভ্যুত্থানের শুরুতেই অর্থাৎ ১৭৮৯ সালে তার নেতারা ফ্রান্সের নাগরিক কিংবা মানুষের অধিকার নিয়ে ফ্রেঞ্চ চার্টার নামে একটি সনদ ঘোষণা করেন। সে সনদই ফরাসি বিপ্লবের মৌলিক চরিত্র বা বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরে। তাদের মুক্তি, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের নীতি প্রকাশ করে। এর পাশাপাশি মানুষের মৌলিক অধিকার ও দায়দায়িত্বের পথনির্দেশ প্রদান করে। সেদিক থেকে পর্যালোচনা করলে বাংলাদেশে সংঘটিত জুলাই-আগস্টের বিপ্লবও ছিল মূলত একটি গণ-অভ্যুত্থান। কিন্তু সে সফল অভ্যুত্থানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতাদের কী প্রত্যাশা ছিল, সেগুলো তাঁরা একটি সনদ আকারে নিজেরা প্রকাশ করেননি। তাঁরা অপেক্ষা করেছেন এই দায়িত্বটি সম্পন্ন করার ব্যাপারে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য, যাদের সঙ্গে সে গণ-অভ্যুত্থান কিংবা রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। সে কারণেই জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান সম্পর্কিত ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণা কিংবা নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়টি অনিশ্চিতভাবে ঝুলে রয়েছে। জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের কোনো কিছু উদযাপনের ক্ষেত্রেই কোনো গুরুত্ব দেখা যাচ্ছে না। এ রকম একটি রাজনীতিগত দোদুল্যমান অবস্থায় কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান আমাদের জীবনে কী পরিবর্তন এনেছে? যদি কোনো পরিবর্তন না-ই হয়ে থাকে, তাহলে দেশে ফ্যাসিবাদের পতন বা তাদের উত্খাত করা হলো কিভাবে? কেন এত বিশাল গণ-আন্দোলন ও সাধারণ মানুষের এত আত্মত্যাগ? অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান বলেছেন, ‘অতীতের অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন বদলাতে আমরা রাষ্ট্র মেরামতসহ সর্বত্র সংস্কার সাধনের যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছি, সেগুলো আমাদের প্রস্তাবিত জুলাই সনদে স্থান পেতে হবে।’ দল-মত-নির্বিশেষে জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে প্রস্তাবিত ঘোষণাগুলো বাস্তবায়িত করতে হবে। কিন্তু কী সে প্রস্তাবিত ঘোষণা, তা এখনো জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেক দলই জানে না। বিএনপিসহ বিভিন্ন দেশপ্রেমিক দলের নেতাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কোনো আলোচনায়ই এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বসা হয়নি। কারা কারা হবেন এই প্রস্তাবিত সনদে স্বাক্ষরকারী? এ পর্যন্ত তারও কোনো হদিস নেই। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং দেশি-বিদেশি আধিপত্যকে প্রতিরোধ করে আমরা কিভাবে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করব—প্রস্তাবিত সনদে আমরা সে ব্যাপারে সবার সম্মিলিত প্রতিশ্রুতি চাই।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
gaziulhkhan@gmail.com

বাবনপুরে জেগে আছেন শহীদ আবু সাঈদ
- ড. মো. ফখরুল ইসলাম

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে জুলাই ২০২৪ মাসটি এক অনন্য মর্যাদার দাবিদার। এই মাসে বারবার রক্ত ঝরেছে, শিক্ষার্থী-শ্রমিক-জনতার আহ্বানে কেঁপে উঠেছে শাসকের প্রাসাদ। সেই উত্তাল জুলাইয়ের সূচনা ঘটেছিল রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) মাটি রঞ্জিত করে আবু সাঈদ নামের এক শিক্ষার্থীর রক্তে। পীরগঞ্জের বাবনপুর নামক গ্রামে একটি বাঁশের বেড়া দেওয়া কবরে তিনি শুয়ে আছেন নীরবে, নিঃশব্দে।
রংপুরে শিক্ষার বাতিঘর হয়ে উঠেছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের অব্যবস্থাপনা, নিয়োগ বাণিজ্য, রাজনৈতিক দখল ও অবমূল্যায়নের কারণে নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বারবার পরিণত হয়েছে ক্ষোভের আগ্নেয়গিরিতে।
জুলাই বিপ্লব তাই কেবল রংপুরের বা বেরোবির নয়।
এই শহীদ যেন আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, বাংলাদেশে ছাত্ররাই বারবার যুগ পরিবর্তনের সূচনা করেন। হোক তা ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার সংগ্রাম কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী লড়াই। আমরা চাই, এই শহীদের রক্ত বৃথা না যাক।
জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদের স্মরণে রাষ্ট্র কি আরো একটু নত হবে, নাকি আবারও চলবে এড়িয়ে যাওয়ার নীলনকশা? যদি তা-ই হয়, তবে আগামী দিনগুলো আরো অস্থির, আরো উত্তাল হবে।
‘যেখানে বাধাগ্রস্ত হবে, সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে’—এই চেতনা দেরিতে এলো কেন? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে রাষ্ট্রযন্ত্রের চেহারার ভেতরে, যা দিন দিন হয়ে উঠছে আরো দুর্বিনীত, অসহনশীল ও জনবিচ্ছিন্ন। যখন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা পাস করার পর চাকরির জন্য ঘুরে বেড়ান, তাঁদের দাবি উপেক্ষা করে, বিরোধিতা করে, এমনকি দমন করতে গিয়েই সরকার তার আসল চেহারা উন্মোচন করে। ঠিক এখানেই জুলাই এসে দাঁড়িয়েছিল প্রতিবাদের ভাষা হয়ে। এটি কেবল একটি মাস নয়, এটি একটি ধারণা, একটি রাজনৈতিক চেতনা, একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার নাম, যা শেখায় জুলুমের বিরুদ্ধে চুপ থাকা মানেই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া। তাই যখনই কোথাও প্রতিবাদ বাধাগ্রস্ত হবে, যখনই মত প্রকাশের অধিকার পদদলিত হবে, তখনই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে প্রতিরোধের এক ছায়াছবির মতো।
বাবনপুরে শায়িত জুলাই বিপ্লবের প্রথম শহীদ, তাঁর জীবন দিয়ে আমাদের আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, প্রতিবাদের মুখ বন্ধ করে রাখা যায় না। তাই তাঁর মৃত্যু আর দশটি মৃত্যুর মতো নয়, বরং এটি এক বিস্মৃত সময়কে জাগিয়ে তোলার মুহূর্ত, যেখানে জুলাই আবার ফিরে এসেছে জনতার পাশে দাঁড়াতে।
এখন বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনে, কর্মক্ষেত্রে, সংবাদমাধ্যমে, এমনকি সংসদের ভেতরেও যদি অন্যায় চাপিয়ে দেওয়া হয়, তবে সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে। কারণ এই মাস শেখায় শুধু স্মৃতিচারণা নয়, স্মৃতি দিয়ে বাস্তব পরিবর্তনের দাবিও তোলা যায়।
তাই আমাদের দায়িত্ব এই শহীদের মৃত্যু যেন অন্ধকারে হারিয়ে না যায়। রাষ্ট্র যদি কখনো ন্যায়ের পথ ছেড়ে নিপীড়নের দিকে হাঁটে, তাহলে প্রতিটি গ্রামে বাবনপুরের মতো একেকটি জুলাই জন্ম নিতে পারে।
এমন সময় হয়তো আবারও প্রশ্ন উঠবে, জুলাই-জুলাই বলে এত মাতামাতি কেন? আমরা তখন উত্তর দেব, এর কারণ আমাদের প্রতিবাদের জায়গাগুলো একে একে নিঃশব্দ হয়ে যাচ্ছে। আর যেখানে হাতে মুষ্টি তুলে পথে নেমে সমস্বরে চিৎকার করা নিষিদ্ধ, সেখানে জুলাই-ই হয়ে উঠতে পারে একমাত্র ভাষা।
শহীদ আবু সাঈদের মৃত্যু কেবল একটি গুলি বা একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল না। এটি একটি সাবধানবাণীও ছিল। বেরোবির পার্কের মোড়ের অদূরে যা ঘটেছিল, তা ছিল আসলে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। যেখানে কথা বলা মানেই অপরাধ, দাবি জানানো মানেই রাষ্ট্রদ্রোহ মনে করা হয়েছিল।
সেদিন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা যখন শান্তিপূর্ণভাবে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন রাষ্ট্র কী করেছিল? তারা কেন সেদিন তাঁদের দিকে বন্দুক তাক করল? সেদিন যে তরুণ শহীদ হলেন, তিনি যেন গোটা বাংলাদেশের হয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন, তৎকালীন ক্ষমতাধরদের কাছে তা অনুধাবন করা কি খুব জটিল বিষয় ছিল?
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রতিবাদের ঐতিহ্য খুব গর্বের। ভাষা আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন—সবখানেই ছাত্রসমাজ পথ দেখিয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালে এসেও ছাত্রসমাজের কণ্ঠ রোধ করতে গুলি ব্যবহার করতে হয়, এটি কি রাষ্ট্রের দুর্বলতা নয়? আগামী দিনে আমরা এ ধরনের আর কোনো রাষ্ট্রীয় দুর্বলতা ও ভয় দেখতে চাই না।
জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদ শব্দটি যেন আমাদের সবার কাঁধে নতুন দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়। এর মানে, আরো অনেক শহীদ আসতে পারেন, যদি রাষ্ট্র তার দমননীতি থেকে ফিরে না আসে। যদি কথা বলার জায়গা, ভিন্নমতের জায়গা একে একে নিঃশব্দ হয়ে যায়, তাহলে শেষ ভরসা হয় রক্ত। বেরোবির ইংরেজি পড়ুয়া অকুতোভয় ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের তাক করা বন্দুকের নলের সামনে বুক উঁচিয়ে গুলি খেতে দ্বিধাহীন না থাকলে আজ কী করতাম আমরা, তা কি কেউ ভেবে দেখেছেন?
জন্ম নিলেই সবাইকে একদিন না একদিন নির্বাক হতে হয়। কিন্তু সবার কথা কি সব মানুষের অনন্তকালব্যাপী মনে থাকে? শহীদ আবু সাঈদ বাবনপুরে শুয়ে আমাদের শিখিয়ে দিচ্ছেন, দেশের যেকোনো প্রয়োজনে যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্বাক থাকার দিন শেষ।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন
fakrul@ru.ac.bd