<p>বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী মিয়ানমার রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাখাইন প্রদেশটি দীর্ঘকাল ধরে নিদারুণ বঞ্চনা ও বিড়ম্বনার শিকার। বর্তমান রাখাইন প্রদেশ, যা অতীতে স্বাধীন আরাকান রাজ্য হিসেবে পরিচিত ছিল। বিগত ১৬৪ বছরে মোট সাতবার তার ঔপনিবেশিক অবস্থানের পরিবর্তন ঘটলেও স্বাধীনতার স্বপ্ন ধরাছোঁয়ার কাছে আসেনি, বরং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি এই বৃহত্তর উপমহাদেশ ছেড়ে গেলেও বর্তমানে চীন, ভারত, এমনকি যুক্তরাষ্ট্র তাদের কায়েমি স্বার্থ নিয়ে নতুনভাবে সেখানে তৎপর হয়ে উঠেছে। এই রাখাইন প্রদেশ বা অতীতের আরাকান রাজ্য নিয়ে এরই মধ্যে ঘটে গেছে আরো অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা। পালাবদল ঘটেছে বহু ঔপনিবেশিক শক্তির। আদি বার্মার রাজশক্তি কনবংগ সাম্রাজ্য ১৭৮৪ সালে তৎকালীন আরাকান রাজ্য দখল করে নেওয়ার পর থেকে ১৯৪৮ সালে নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বার্মার অভ্যুদয়ের পূর্ব পর্যন্ত স্থানীয় অনেক জাতিগত বিরোধ কিংবা উপজাতিগত সহিংসতার ঘটনার মধ্য দিয়ে এক দীর্ঘ এবং অসহনীয় সময় পার করেছে রাখাইন প্রদেশের অধিবাসীরা। তবু তারা তাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও স্বাধীনতার স্বপ্নকে বিস্মৃত হয়নি। অতীতের আরাকান রাজ্য কিংবা বর্তমান রাখাইন প্রদেশের অধিবাসীরা ১৭৮৫ থেকে ১৮২৬ সাল পর্যন্ত তৎকালীন বার্মার বৃহত্তর রাজশক্তি, ১৮২৬ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন এবং ১৯৪৮ থেকে এ পর্যন্ত স্বাধীন বার্মা বা নতুন রাষ্ট্রের (পরবর্তী সময়ে মিয়ানমার) অধীনে শাসিত হয়ে এসেছে একটি চরম উপেক্ষিত জনগোষ্ঠী হিসেবে। এর মধ্যে এ অঞ্চল নিয়ে একসময়ের জাপানি পরাশক্তির সঙ্গেও ব্রিটিশদের সংঘর্ষ চলেছে দীর্ঘদিন পর্যন্ত।</p> <p><img alt="" src="http://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/ckfinder/innerfiles/images/Print Version Online/print /2022/10.October/06-10-2022/121/1.jpg" style="float:left; height:231px; margin:12px; width:294px" />উত্তর রাখাইন রাজ্য নিয়ে ব্রিটিশদের সঙ্গে একসময় জাপানিদের যুদ্ধ হয়েছিল, রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল সে অঞ্চল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাখাইনকে (আরাকান) জাপানি দখলদারির অধীনে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়েছিল এবং ‘আরাকান ডিফেন্স ফোর্স’ নামে তাদের নিজস্ব সামরিক বাহিনী গঠন করার অধিকার দেওয়া হয়েছিল। পরে আরাকান প্রতিরক্ষা বাহিনী মিত্রশক্তির পক্ষে অবস্থান নেয় এবং ১৯৪৫ সালের শুরুতে জাপানিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। কিন্তু সে সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত কোনো কাজে আসেনি আরাকানদের। ১৯৪৮ সালের পর মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে রাখাইনকে স্বাধীন বার্মার অংশ হিসেবে সংযুক্ত করা হয়েছিল। এতে রাখাইন রাজ্যের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার স্পৃহা পদদলিত হয়েছিল। বার্মার তৎকালীন শাসকদের অদ্ভুত এক জাতীয়তাবাদের স্লোগানের চাপে দেশব্যাপী তখন এক গৃহযুদ্ধের আবির্ভাব ঘটে। এতে ১৯৭৩ সালে আরাকানকে ‘সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক অব দি ইউনিয়ন অব বার্মা’র অংশ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, রাখাইন জনগণের স্বদেশভূমি হিসেবে বিবেচিত হবে। সেটি মেনে নেয়নি রাখাইন জনগোষ্ঠী। তারা প্রকাশ্যেই বার্মা থেকে বিচ্ছিন্নতা কিংবা স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিল, যা শক্ত হাতে দমন করা হয়েছিল। এবং ১৯৭৪ সালে তৎকালীন নে উইন সরকার তাদের নয়া সংবিধানে রাখাইন (আরাকান) প্রদেশকে একটি ‘ইউনিয়ন স্টেট’-এর মর্যাদা দেওয়া হয়। কিন্তু ১৯৮৯ সালে পরবর্তী সামরিক জান্তা আরাকান রাজ্যের নাম পরিবর্তন করে রাখাইন প্রদেশ ঘোষণা করে। অর্থাৎ আগাগোড়াই আরাকান রাজ্য কিংবা রাখাইন জনগোষ্ঠীর সঙ্গে এক চরম প্রতারণার খেলা চলে এসেছে, কিন্তু রাখাইনরা তা মেনে নেয়নি। তারা তাদের স্বাধীনতার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার জন্য নতুন করে শপথ নেয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৯ সালের ১০ এপ্রিল গঠন করা হয়েছে ‘আরাকান আর্মি’, যা ‘ইউনাইটেড লীগ অব আরাকান (ইউএলএ)’-এর সামরিক শাখা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। আরাকান আর্মি এখন ‘কাচিন ইনডিপেনডেন্ট আর্মির (কেআইএ)’ সঙ্গে একাত্ম হয়ে মিয়ানমার আর্মড ফোর্সেসের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। ২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী আরাকান আর্মির আড়াই হাজারের বেশি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সামরিক সদস্য ছিল, যা এখন সংখ্যায় চার গুণের বেশি শক্তিশালী হয়েছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। তারা এখন বাংলাদেশ সীমান্তে রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সামরিক জান্তার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে বলে নিয়মিত খবর পাওয়া যাচ্ছে।</p> <p>সে বাহিনী অর্থাৎ আরাকান আর্মি এখন বাংলাদেশসহ বন্ধুভাবাপন্ন বিদেশি রাষ্ট্রের কাছে বিভিন্ন ধরনের উপযুক্ত সামরিক ও অসামরিক সাহায্য চাচ্ছে, যা দিয়ে তারা রাখাইন রাজ্যের স্বাধীনতার পরিকল্পনা ত্বরান্বিত করতে পারবে। তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, স্বাধীন রাখাইন রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হলে সেখানে বিতাড়িত রোহিঙ্গা বা শরণার্থীদের বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নেওয়া হবে। তাদের পূর্ণাঙ্গ গণতান্ত্রিক ও নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হবে। বাংলাদেশের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গভাবে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চালু করতে তারা আগ্রহী। শুধু তা-ই নয়, বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধনের জন্য তারা বাংলাদেশের সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ মুহূর্তে তারা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের কূটনৈতিক স্বীকৃতি প্রার্থনা করেছে। স্বীকৃতি প্রার্থনা করেছে যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কাছেও। মিয়ানমানের রাখাইনসহ চার থেকে পাঁচটি রাজ্যে এখন ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে একযোগে সংঘর্ষ চলছে। তারা স্বাধীনতা চায়। তারা চায় নিজেদের জন্য স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যেখানে নাগরিকদের থাকবে মানবাধিকারসহ সব সুযোগ-সুবিধা। তারা মিয়ানমারে সামরিক জান্তাদের পর্যায়ক্রমিক ক্ষমতা দখল ও অপশাসনের পথ বন্ধ করতে চায় চিরতরে। বন্ধ করতে চায় অস্ত্র প্রতিযোগিতার সর্বনাশা পথ। দেশের সাধারণ মানুষকে ভুখা রেখে, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করে, শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে পেছনে ঠেলে দিয়ে বিদেশি অস্ত্র কিনে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিঃশেষ করছে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা। প্রতিবেশী শান্তিপ্রিয় বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ১২ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে তাদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে আঞ্চলিক শান্তি ও উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে মিয়ানমারকে। এর পরিবর্তে বাংলাদেশের সীমান্তে উত্তেজনা বাড়িয়ে কিংবা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে হামলা চালিয়ে লাভবান হবে না মিয়ানমার। এতে মিয়ানমার খণ্ড খণ্ড হয়ে যাবে।</p> <p>৯ মাসের একটি সশস্ত্র যুদ্ধে বাংলাদেশ তার স্বাধীনতা অর্জন করেছে। বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতা যুদ্ধ কিংবা সশস্ত্র আক্রমণকে ভয় পায় না। জল, স্থল ও অন্তরীক্ষে মিয়ানমারকে প্রতিরোধ করার সাহস, যোগ্যতা কিংবা ক্ষমতা বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী ও মানুষের রয়েছে। সে বিষয়ে বিশ্বের সচেতন মানুষ ওয়াকিফহাল রয়েছেন। সুতরাং রোহিঙ্গা ইস্যুকে পাশ কাটিয়ে কিংবা মিয়ানমারের অধিকার সচেতন মানুষকে বোকা বানিয়ে আর বেশি দূর এগোতে পারবে না সামরিক জান্তা। রাশিয়া কিংবা অন্যরা সামরিক জান্তার কাছে অস্ত্র বিক্রির ক্ষেত্রে তৎপর হলেও মিয়ানমারের অখণ্ডতা রক্ষা করতে পারবে না তারা। এর প্রধান কারণ মিয়ানমারের সংগ্রামী জনতা কিংবা গণতন্ত্রকামী মানুষ, যারা সামরিক জান্তার রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে এখন অধিক সংখ্যায় মাঠে নামছে প্রতিদিন। তাদের প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন ও সব সহযোগিতার আশ্বাস রয়েছে গণতান্ত্রিক বিশ্বের। মিয়ানমার ও বাংলাদেশের শান্তিকামী মানুষের প্রতি সব ধরনের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা চীনের মতো পরাশক্তি দেশগুলোর এবং জাতিসংঘের মতো বিশ্ব সংস্থার। অন্যদিকে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার পেছনে যাদের সাহায্যের কালো হাত দেখা যাচ্ছে, অবস্থা বেগতিক দেখলে তারা একে একে সবাই সরে পড়বে।</p> <p>বাংলাদেশ সব উসকানির মুখেও চরম ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছে। এখনো বাংলাদেশ সংঘাতকে এড়িয়ে যাওয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট সচেষ্ট রয়েছে। কিন্তু কোনো কিছুই একতরফাভাবে চলতে পারে না। বাংলাদেশকে কূটনৈতিক, এমনকি কৌশলগত সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে। মিয়ানমার চলমান অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষেই খণ্ড খণ্ড হয়ে যেতে পারে। মিয়ানমারের মুক্তিকামী সংগ্রামী মানুষের পক্ষে সমর্থনের ক্ষেত্রে কোনো ঘাটতি নেই।</p> <p> </p> <p>লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস)</p> <p>সাবেক প্রধান সম্পাদক ও  ব্যবস্থাপনা পরিচালক, মুক্তিযোদ্ধা</p> <p>gaziulhkhan@gmail.com</p> <p> </p>