সর্বগ্রাসী আগুনের লেলিহান শিখার সঙ্গে অসমযুদ্ধে তিন-চার দিন বিরামহীন, বিশ্রামহীন লড়াই করার পর অবশেষে তাঁরা জয়যুক্ত হয়েছেন—আগুন নিভেছে। তবে সচরাচর যা হয় না, সীতাকুণ্ড রণক্ষেত্রে তাই হয়েছে—অগ্নিনির্বাপক দলের ১০ জন বীর সেনানী ‘শহীদ’ হয়েছেন। এর প্রধান কারণ ওই অসমযুদ্ধ। দমকল বাহিনীর অকুতোভয় বীর সেনানীদের এসওএস (‘সেভ আওয়ার সোল’) পাঠানো হয়েছিল আগুন নেভানোর জন্য।
সেলাই করা খোলা মুখ
অগ্নিযোদ্ধা ও করোনাযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা
- মোফাজ্জল করিম
অন্যান্য

অভূতপূর্ব এই এত বড় দুর্ঘটনার পরপরই সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ তদন্তদল গঠন করে দ্রুত তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। তারা এও বলেছে, যদি পুরো বিষয়টিতে কারো কর্তব্যে অবহেলা বা গাফিলতি ধরা পড়ে তবে তাঁর বা তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ভালো কথা।
তবে সীতাকুণ্ডের দুর্ঘটনার পর একটা জিনিস লক্ষ করে একটু অবাকই হলাম। দুর্ঘটনাটি যেমন ঘটেছে হঠাৎ, তেমনি তার সম্বন্ধে আলোচনা, ক্ষোভ প্রকাশ, শোক প্রকাশও যেন হঠাৎই থেমে গেল। এমন একটি মর্মান্তিক ঘটনার পর সুধীজন ও বিভিন্ন সমাজহিতৈষী সংগঠনের তেমন একটা প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেল না। অবশ্য বাংলাদেশে এখন যেভাবে দুঃসংবাদ ও দুর্ঘটনার প্রাদুর্ভাব বেড়ে গেছে, তাতে মাছের মায়ের পুত্রশোক বাগধারাটির কথাই মনে পড়ে। খুন, ধর্ষণ, শিশু নির্যাতন, সড়ক দুর্ঘটনা, প্রতারণা ইত্যাদি অপরাধ এত বেড়ে গেছে যে মনে হয় কেউ চাইলে শুধু এসবের খবর দিয়ে রোজ একটি মোটামুটি প্রমাণ সাইজের পত্রিকা বের করতে পারে। আজকাল রোজই একটা না একটা চাঞ্চল্যকর অথবা রোমহর্ষক ঘটনা-দুর্ঘটনার সংবাদ থাকেই। আবার দেখা যায়, আজ যে চমক সৃষ্টিকারী সংবাদটি হেডলাইন হয়ে সবার নজর কাড়ছে, কাল সেটাই চাপা পড়ছে নতুন আরেকটি ততোধিক ভয়াবহ অথবা মনোযোগ আকর্ষণী ঘটনার ঘনঘটায়। এ যেন সমুদ্রসৈকতে দাঁড়িয়ে ঢেউয়ের আগমন দেখা। একটি সফেন তরঙ্গ শির উঁচু করে বালুকাবেলায় আছড়ে পড়ার আগেই তার অনুগামী আরেকটি ঢেউ এসে তাকে আচ্ছাদিত করে ফেলছে। আর বাংলাদেশে বারো মাসই যেসব খবর চমক সৃষ্টি করে, তা হচ্ছে দুর্নীতি, দ্রব্যমূল্য, নারী নির্যাতন ইত্যাদি। তবু এত কিছুর মধ্যেও সীতাকুণ্ডের অগ্নিকাণ্ড তথা বিস্ফোরণের সংবাদ এত শিগগির হারিয়ে যেতে পারে না। কারণ এটা কোনো সাধারণ অগ্নিকাণ্ড নয়। বিশেষ করে যেখানে ১০ জন প্রশিক্ষিত ফায়ারম্যান প্রাণ হারিয়েছেন। খবরে প্রকাশ, এখনো আরো তিনজন নিখোঁজ রয়েছেন। আল্লাহ করুন, তাঁরা যেন জীবিত থাকেন, সু্স্থ থাকেন।
২.
আজকের নিবন্ধে আমি দায়িত্ব পালনকারী সরকারি-বেসরকারি-আধাসরকারি-নিমসরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে পাবলিকের সম্পর্কের টানাপোড়েনের ওপর যৎসামান্য আলোকপাত করতে চাই। সীতাকুণ্ডের মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় ১০ জন শক্ত-সমর্থ প্রশিক্ষিত অগ্নিযোদ্ধার অকালমৃত্যুতে আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে : এই বীর সেনানীরা কি ইচ্ছা করলে অকুস্থলে দায়িত্ব পালনে ফাঁকি দিয়ে একটা নিরাপদ দূরত্বে থেকে যেনতেন প্রকারেন ভাবে ডিউটি শেষ করতে পারতেন না? শুধু সীতাকুণ্ডের সেদিনের ডিউটি কেন, যেকোনো স্থানে আগুন নেভানোর ডিউটিতে গিয়ে তাঁরা ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ নীতি অবলম্বন করে চাচা আপন প্রাণ বাঁচাতে পারেন না? বড়জোর ‘সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না’ এরূপ কায়দা অবলম্বন করতে তো পারেন। এসব প্রশ্নের উত্তরে বলব, হ্যাঁ, পারেন। অবশ্যই নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দোহাই দিয়ে—ইংরেজিতে যাকে বলে ‘সেফটি ফার্স্ট’—যেকোনোভাবে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কয়েক ঘণ্টা সময় ব্যয় করে, গায়ে আঁচড়টিও না লাগিয়ে, এমনকি পরনের ইউনিফর্ম শুকনো ঝকঝকে রেখে ডিউটি শেষ করতে পারেন। এতে হয়তো অগ্নিকবলিত সম্পত্তির মালিক বা তাঁর লোকজন কেউ মারা যেতে পারেন, সম্পত্তির একটু বেশি ক্ষতি সাধিত হতে পারে, কিন্তু দমকল বাহিনীর কর্মীদের দায়িত্ব পালন সম্বন্ধে কেউ কোনো প্রশ্ন তুলতে পারবে না। কিন্তু না, একজন ফায়ারম্যান দায়িত্ব পালনকালে এ ধরনের দুই নম্বরি কাজ করেন না। তাঁর শিক্ষা-দীক্ষা, তাঁর প্রশিক্ষণ, তাঁর শপথ, সর্বোপরি তাঁর বিবেকের অনুশাসন তাঁকে এ ধরনের আচরণ থেকে বিরত রাখে। অগ্নিনির্বাপণের রণক্ষেত্রে আগুন তাঁর শত্রু। এই শত্রু নিধন করতে তিনি একজন নিষ্ঠাবান, বিবেকসম্পন্ন, কর্তব্যপরায়ণ সৈনিকের প্রজ্ঞা ও শহীদি মনোভাব নিয়ে এগিয়ে যান, পিছিয়ে পড়েন না। তাঁর একমাত্র লক্ষ্য থাকে দ্রুত আগুন নেভানো, জানমাল রক্ষা করা। এভাবে এই অগ্নিযোদ্ধারা অগ্নিকুণ্ড থেকে উদ্ধার করেন দুগ্ধপোষ্য শিশু, অবলা নারী ও অসহায় পঙ্গু বৃদ্ধদের। আগুনের করাল ছোবল থেকে রক্ষা করেন অর্থবিত্ত, মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী ও অমূল্য দলিল দস্তাবেজ।
ফায়ার ব্রিগেড বা দমকল বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের কেবল আপৎকালেই যোগাযোগ হয়। আগুন নেভানো তাঁদের প্রধান দায়িত্ব হলেও আরো কিছু কিছু বিশেষ দায়িত্বও তাঁরা পালন করে থাকেন। যেমন—লঞ্চডুবি, নৌকাডুবি ইত্যাদি হলে ডাক পড়ে দমকল বাহিনীর। আগুন নেভানো ছাড়াও তাঁরা ডুবুরি হিসেবেও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তেমনি অন্যান্য উদ্ধারকার্যেও তাঁদের সাহায্য নেওয়া হয়। লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, একমাত্র আকস্মিক দুর্ঘটনা, যেমন— অগ্নিকাণ্ড, জলে ডোবা, দুর্গম স্থান থেকে কাউকে উদ্ধার করা ব্যতীত স্বাভাবিক সময়ে দমকল বাহিনীর সদস্যদের দেখা মেলে না। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস শহরের কোথাও তাঁরা তাঁদের বিশেষভাবে নির্মিত অগ্নিনির্বাপক গাড়ি ও অন্যান্য সাজসরঞ্জাম নিয়ে অবস্থান করেন নীরব কর্মীর মতো, জনসমক্ষে তাঁদের বড় একটা দেখা যায় না। শুধু কোথাও কখনো আগুন লাগলে তাঁরা দলবল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন গাড়িতে ঘণ্টি বাজাতে বাজাতে। দুর্ঘটনাস্থলে দ্রুত পৌঁছে পুরো পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণভার তাঁরাই গ্রহণ করেন, তাঁদের নির্দেশেই পরিচালিত হয় আগুন নেভানোর কাজ। সেখানে অন্য কোনো ব্যক্তি, তিনি যেই হোন না কেন, তাঁদের কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারেন না। দায়িত্ব পালন শেষে তাঁরা ফিরে যান নিজেদের আস্তানায়, এক ধরনের অজ্ঞাতবাসে থেকে অপেক্ষায় থাকেন পরবর্তী ঘটনা-দুর্ঘটনার জন্য। একসময় সমাজের সবাই ভুলতে বসে তাঁদের কথা।
সরকারি সব বিভাগ বা দপ্তরের সঙ্গে জনগণের কমবেশি যোগাযোগ আছে। মানুষ নিজ প্রয়োজনে এই দপ্তর, সেই দপ্তরে যায়, যেতে হয় তাকে। সবাই নানাবিধ সেবার প্রত্যাশী। এতে জনগণের সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এক ধরনের মিথস্ত্রিয়া (বেশ কঠিন ও অপ্রচলিত একটা শব্দ, এর ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘ইন্টারঅ্যাকশন’ বরং অধিক পরিচিত) যেমন সৃষ্টি হয়, তেমনি নানা ধরনের ভালো-মন্দ কথাও শোনা যায়। দমকল বাহিনীর সঙ্গে পাবলিকের কোনো মেলামেশা না থাকায় এই বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে কোনো ফালতু কথা শোনা যায় না। বরং অগ্নিকাণ্ডের মতো আপৎকালে তাঁদের আন্তরিক সেবাপ্রদান মানুষের প্রশংসাই অর্জন করে। সীতাকুণ্ডে দমকল বাহিনীর আন্তরিকভাবে দায়িত্ব পালনের পরাকাষ্ঠাই লক্ষ করা গেছে। এমন একটি বাহিনীর দশটি মূল্যবান প্রাণ কেন, কার ভুলে, কার গাফিলতিতে অকালে ঝরে গেল তা অবশ্যই জানতে হবে। আমরা আশা করব যে তদন্তকার্য চলছে তা কেবলমাত্র চক্ষুধোলাই (‘আইওয়াশ’) হবে না। পত্র-পত্রিকায় এসেছে, এই কনটেইনার ডিপো কর্তৃপক্ষ নাকি অনেক বাধ্যতামূলক বিধি-নিষেধ না মেনেই তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিল দিনের পর দিন। তাই যদি সত্যি হয়, তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে সরকারি নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ এত দিন এগুলো দেখেনি কেন। নাকি তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েই চলছিল সব কিছু।
৩.
এ তো গেল নীরব কর্মী দমকল বাহিনীর সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডির কথা। হ্যাঁ, তাঁরা নীরব কর্মী, তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করেন কেবল প্রয়োজনের সময় আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে। আর নিবন্ধের শিরোনামে এই অগ্নিযোদ্ধাদের পাশাপাশি অন্য যে যোদ্ধাদের কথা উল্লেখ করেছি, তাঁরা কিন্তু সারাক্ষণই আমাদের জীবনের সঙ্গে, অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। তাঁরা ডাক্তার। পৃথিবীর সব দেশে, সব সমাজে এঁরা মানুষকে সেবা দেওয়ার জন্য সদা প্রস্তুত। সৃষ্টিকর্তা তাঁর সৃষ্ট জীবকে কেবল নিরবচ্ছিন্ন সুখ যেমন দেননি, তেমনি নিরবচ্ছিন্ন দুঃখ-বালাই-যন্ত্রণাও দেননি। জীবনে সুখ-শান্তি, আনন্দ-হাসি-গান যেমন সত্যি; দুঃখ-কষ্ট, রোগ-বালাই-যন্ত্রণাও তেমনি সত্যি। আর রোগ-বালাইয়ের উপশমের জন্য যে জ্ঞান, যে দক্ষতা, সর্বোপরি যে আকাঙ্ক্ষা যাঁর মধ্যে বিধাতা প্রোথিত করে দিয়েছেন তিনি ডাক্তার। জীবনে কোনো দিন কোনো ডাক্তারের কাছে চিকিৎসার জন্য যেতে হয়নি এমন লোকের দেখা পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত যিনি আমাদের সঙ্গী তাঁর নাম ডাক্তার। এখন তো পাড়ায় পাড়ায় বড় বড় ডিগ্রিধারী ডাক্তারের ভিড়। কত তাঁদের চেম্বার, কত ক্লিনিক, বড় শহরগুলোতে কত বড় বড় হাসপাতাল। আমাদের শৈশবের নিরিবিলি মৌলভীবাজার শহরে দেশভাগের সময় (১৯৪৭) সাকুল্যে বোধ হয় হাজার পাঁচ-সতেক লোকের বসবাস ছিল। আর সারা শহরে এমবিবিএস পাস ডাক্তার ছিলেন সরকারি হাসপাতালের সিভিল সার্জন সাহেব এবং অন্য একজন সৌম্যদর্শন স্বল্পভাষী প্রৌঢ় সনাতন ধর্মাবলম্বী ডাক্তার। হাসপাতাল বলতে ছিল মনু গাঙের পারের ছিমছাম দালানবাড়ি সরকারি হাসপাতাল। সেখানকার ডাক্তাররা সাধ্যমতো সেবা দিতেন রোগীদের। তখনো হয়তো পাবলিকের অনেক অনুযোগ-অভিযোগ ছিল ডাক্তারদের বিরুদ্ধে, কিন্তু তাকে ইস্যু বানিয়ে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি কখনো। তখনকার বাংলাদেশের কোথাও পাবলিক কর্তৃক ডাক্তার আক্রান্ত হওয়ার কথা শোনা যায়নি। আর এখন? দুঃখের বিষয় যেকোনো ইস্যুতে বাগবিতণ্ডা, বচসা, এমনকি হাতাহাতি, ভাংচুর ইত্যাদি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই নিবন্ধে এ ব্যাপারে বিশদ আলোচনার সুযোগ নেই। তবে আমি বলব যেকোনো অশোভন আচরণ দুঃখজনক এবং অবশ্যই পরিত্যাজ্য। ডাক্তারদের যেমন বোঝা উচিত যারা সেবা নিতে আসে তারা এ দেশেরই মানুষ, প্রায় সবাই নানাভাবে সরকারকে কর দিয়ে থাকে, যে করের টাকায় সরকারি চিকিৎসক ও অন্য কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ইত্যাদি প্রদান করা হয়; তেমনি সেবাগ্রহীতাদেরও মানতে হবে ডাক্তাররাও মানুষ, তাঁদেরও অনেক সীমাবদ্ধতা আছে, বিশ্বাস করতে হবে সব ধরনের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও কোনো ডাক্তার বা নার্স চান না তাঁর রোগী তাঁর গাফিলতির জন্য মারা যাক।
আমাদের ভুললে চলবে না গত দুই-আড়াই বছরে সম্মুখসারির যোদ্ধা অনেক ডাক্তার ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী ব্যক্তিগত ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কোভিড আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। তাঁরা আমাদেরই সন্তান, আমাদেরই সেবায় নিয়োজিত ছিলেন তাঁরা। একটু ধৈর্য ও সহনশীলতার পরিচয় দিলে কিন্তু যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি পরিহার করা যায়। ডাক্তার ও রোগী পরস্পর পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে, তাঁদের আচরণ হতে হবে মানবিক। একটি হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে উভয়কেই হতে হবে আন্তরিক।
৪.
আজকের নিবন্ধে শুধু ডাক্তার ও রোগীদের নিয়ে নিজের উপলব্ধি এবং অভিজ্ঞতার আলোকে যা বললাম তা অবশ্যই অন্যান্য কর্মকর্তা, যেমন সাধারণ প্রশাসন, পুলিশ, কর কর্মকর্তা ইত্যাদি সকলের বেলায়ই প্রযোজ্য। শুধু এটা মনে রাখলেই হয় ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’ পাওয়া এ দেশ আমার, আপনার সবার। জন্মগত, পেশাগত, আদর্শগত কারণে আমরা কেউ সাদা, কেউ কালো, কেউ নীল, কিন্তু আমাদের আদি ও অকৃত্রিম পরিচয় আমরা বাংলাদেশের মানুষ। সেই পরিচয়, সেই রক্তের বন্ধনের চেয়ে আর কোনো পরিচয়, আর কোনো বন্ধন বড় হতে পারে না। সেটা ধনদৌলত, বংশমর্যাদা, রাজনৈতিক পরিচয় যা-ই হোক না কেন। রাজনীতি করুন, ধর্মকর্ম করুন, চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য যা-ই করুন, নিজেদের আদি ও অকৃত্রিম পরিচয় ভুলে গিয়ে শুধু পরস্পর পরস্পরের প্রতি বিষোদ্গারই করবেন না (যেকোনো টিভি চ্যানেলের প্রোগ্রাম দ্রষ্টব্য!)। এতে পরিবেশ-পরিস্থিতি বিষাক্ত হচ্ছে, ভবিষ্যত প্রজন্ম ভুল পথে চালিত হচ্ছে। তাতে আপনার-আমার হয়তো তাৎক্ষণিকভাবে দুটো ভোট বাড়বে বা কমবে, কিন্তু দেশটাকে, দেশের ১৭ কোটি মানুষকে যে আলোর পথে না নিয়ে হিংসা-বিদ্বেষ, অসহিষ্ণুতা, অভব্যতার অমাবস্যার নিকষ কালো অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, সেই ভয়াবহ পরিণতির কথা ভেবে দেখেছেন কি?
লেখক : সাবেক সচিব, কবি
mkarim06@yahoo.com
সম্পর্কিত খবর

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান : চাওয়া-পাওয়ার দাগ-খতিয়ান
- তুহিন খান

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রায় এক বছর উপলক্ষে জুলাই ও আগস্ট মাসজুড়ে বেশ বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানসূচি ঘোষিত হয়েছে ইন্টেরিম সরকারের তরফে। কিন্তু এক বছরে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব কতটা মেলানো গেল? জুলাইয়ের সুফল কার ঘরে কতটা উঠল?
গণ-অভ্যুত্থান নিজেই একটি বড় প্রাপ্তি। যে অভ্যুত্থানের ফলে আওয়ামী লীগের মতো একটি নিকৃষ্ট ফ্যাসিস্ট শাসকগোষ্ঠীর পতন হলো, তার চেয়ে বড় প্রাপ্তি এ দেশের জনগণের জীবনে খুব কমই আছে। এই অভ্যুত্থানের আগে-পরে দেশে যে বিপুল জনসচেতনতা ও সৃষ্টিশীল গণক্ষমতার উদ্বোধন আমরা দেখেছি, তরুণদের মধ্যে যে স্বচ্ছ রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ও দেশ গঠনের দৃঢ় প্রত্যয় জন্ম নিতে দেখেছি, তা এককথায় মহাকাব্যিক।
গত বছর ৮ আগস্ট ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার ভারত পলায়নের পরিপ্রেক্ষিতে যে সরকারটি গঠিত হয়, তার ধরনটি ঠিক কী হবে, কী হলে আরো ভালো হতো, এ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা আছে। অন্তর্বর্তী এই সরকারটি গঠিত হয়েছে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করেই; আবার গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের কেউ কেউ এ সরকারের অংশ হয়েছেন।
জুলাইয়ের বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষা, অন্তর্বর্তী সরকারের এই ধরন ও রাজনৈতিক শক্তিগুলোর অবস্থান—এই তিনের টানাপড়েন শেষমেশ যে জাতীয় আকাঙ্ক্ষায় থিতু হয়েছে, তার আলংকারিক নাম : সংস্কার। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আগ থেকেই বেশ কিছু রাজনৈতিক দল ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্ল্যাটফর্মের কারণে ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ ধারণাটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ফলে সেটির প্রায়োগিক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে এবং কিভাবে ও কতটুকু হবে এই সংস্কার—সেটিই প্রধান আলোচ্য বিষয়। বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন হয়েছে দেশে এবং সেসব কমিশন বড় বড় রিপোর্টও তৈরি করেছে।
রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদের স্বাভাবিক ফলাফল হিসেবেই যে সামাজিক ফ্যাসিবাদ ও ধর্মীয় চরমপন্থা সুপ্তাবস্থায় প্রায় এক যুগ ধরে আস্তে আস্তে গাঢ় হয়ে উঠছিল, তা অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে নিঃশেষিত হয়নি, বরং নানা ধরনের সামাজিক ও ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী প্রবণতা নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন শক্তিতে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে পরাজিত ফ্যাসিস্ট শক্তি ও তার দেশি-বিদেশি এজেন্টরা এই প্রবণতাগুলোকে অনেক রংচং মেখে বাস্তবের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বিকট করে উপস্থাপন করার চেষ্টায় রত। জুলাইয়ের শক্তিগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন ও মেরুকরণও এই পরিস্থিতিটিকে বেশ ঘোলাটে করে তুলছে। সে ব্যাপারে সতর্ক থেকেও বলা যায় যে এই ঘটনাগুলো ঘটছে।
‘মব’ শুনলেই অনেকে খেপে যান আজকাল, তার সংগত কারণও আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু সত্য কথা এটিই যে ৫ আগস্টের পর দেশে নানা রকম মব তৈরি হয়েছে। সামাজিক-নৈতিক পুলিশগিরি বাড়ছে। এসবের সঙ্গে জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা বা বিপ্লবী তৎপরতার যোগ সামান্য। ধর্মীয় চরমপন্থাও এই পরিস্থিতিকে একটি সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করছে।
বিপ্লবী ছাত্র-জনতা ও সরকারের কাজ ছিল সমাজে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা এই নতুন প্রতিবিপ্লবী, হঠকারী ও ফ্যাসিস্ট তৎপরতাগুলোরও বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, যেখানে মোটাদাগে স্পষ্টতই তারা ব্যর্থ হয়েছে। এতে সমাজে সরকার ও অভ্যুত্থানের নেতৃত্বের ব্যাপারে যে মাত্রারই হোক, একটি নেতিবাচকতা তৈরি হয়েছে।
৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ের একটি প্রধান জনদাবি ও গুরুতর কাজ ছিল বিচার ও আনুষ্ঠানিক রিকনসিলিয়েশন প্রসেস শুরু করা। কিন্তু এই দাবিটি বিদ্যমান কোনো রাজনৈতিক শক্তিই সততার সঙ্গে সামনে আনতে পেরেছে বলে মনে হয় না। নির্বাচনী রাজনীতির হিসাব-নিকাশ, সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর টানাপড়েন, মামলা বাণিজ্যের পলিটিক্যাল ইকোনমি, ঘোলা পানিতে মাছ শিকারিদের নানা রকম অপতৎপরতা, বিচারহীন পুনর্বাসনের বিবিধ উদ্যোগ আর সরকারের অস্পষ্ট ও গতিহীন নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যে বিচারের দাবিটির বহুলাংশ অপচয় হয়েছে। একটি ফ্যাসিস্ট সরকারকে উত্খাত করার পর অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি জাতীয় অখণ্ডতা রক্ষা ও সামাজিক-রাজনৈতিক রিকনসিলিয়েশন নিশ্চিতে যে ধরনের ব্যাপক, বহুমুখী ও কুশলী প্রাতিষ্ঠানিক তৎপরতা প্রয়োজন ছিল, সরকার সেটি করতে বেশ খানিকটা ব্যর্থই হয়েছে বলা যায়।
অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দলটিকে ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে এক ধরনের কৌতূহল, আকাঙ্ক্ষা ও দরদ তৈরি হয়েছে। তবে এই আকাঙ্ক্ষা নিরঙ্কুশ নয়। নির্বাচনী রাজনীতিতে ঢুকে পড়ায় বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামোর অনেক বিষয়ই আত্তীকৃত করতে হয়েছে দলটির, যা তাদের নানাভাবে বিতর্কিত করেছে। আবার এই দলটির গতি-প্রকৃতি কী হবে, তার কল্পনার বাংলাদেশটি ঠিক কেমন হবে—এসব বিষয়েও নানা ধরনের অনুমান তৈরি হয়েছে। এসব সত্ত্বেও পরিবর্তনকামী বা সংস্কারবাদীরা এখনো এই দলটির ওপর ভরসা রাখতে চাইছেন বলেই মনে হয়।
প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির এই হিসাব চলবে। কিন্তু জুলাইয়ে ঘটে যাওয়া মহাকাব্যিক অভ্যুত্থানটি আমাদের জাতীয় জীবনে যে বিপুল পরিবর্তনের সম্ভাবনা হাজির করেছে, তা অসামান্য। আমরা এর কতটা কাজে লাগাতে পারব, তা এখনো অনিশ্চিত। তবে বাংলাদেশ যত দিন থাকবে, তত দিন মুক্তির এই অসামান্য সম্ভাবনা এ দেশের মানুষকে অনুপ্রাণিত করে যাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক : কবি, অনুবাদক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করা প্রয়োজন
- ড. নিয়াজ আহম্মেদ

করোনার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমে যে ছেদ তৈরি হয়েছিল, তা এখনো আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এ ছাড়া গত বছরের গণ-আন্দোলনে তিন-চার মাস আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। বিশ্ব্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত আমাদের এইচএসসি নামক পাবলিক পরীক্ষা। কোনো কারণে এইচএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে গেলে আমাদের ভর্তি কার্যক্রমও পিছিয়ে যায়।
আমরা যদি জানুয়ারি মাসে এসএসসি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে এইচএসসি পরীক্ষা নিতে পারি, তাহলে জুলাই মাসে উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা যাবে।
উচ্চশিক্ষা যেহেতু বহু রকমের, সেহেতু এখানেও অনেক বিষয় রয়েছে। মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার বিষয়টি সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ দ্বারা পরিচালিত হয়। তাই তারা বেশ দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারে। সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যদি একটি পরীক্ষায় ভর্তি নিতে পারত, তাহলেও সময় বাঁচত। কিন্তু তা সম্ভব হয়ে উঠছে না। আমাদের মানে শিক্ষকদের এখানে করণীয় রয়েছে। এইচএসসি পরীক্ষা শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে ভাবতে হবে। আমরা প্রতিবছর একই পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা এবং এর কার্যক্রম সম্পন্ন করি। ফলে দ্রুত কার্যক্রম শুরু করতে সমস্যা নেই। ফলাফল প্রকাশের এক সপ্তাহের মধ্যে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, এক মাসের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা এবং সর্বোচ্চ তিন মাসের মধ্যে পুরো ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করা সম্ভব।
আমাদের কাছে মনে হয়, সরকারের আন্তরিকতা এবং শিক্ষকদের সহযোগিতা এখানে মুখ্য বিষয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, কতটা সহজে এবং দ্রুত আমরা আমাদের ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারি। আমাদের টার্গেট যদি থাকে জানুয়ারি মাসের প্রথম দিন ক্লাস শুরু করা, তাহলে টার্গেট অনুযায়ী কাজটি করতে হবে। একদিকে শিক্ষার্থীরা পাবলিক পরীক্ষা দেবে, অন্যদিকে আমরা ভর্তি পরীক্ষার কার্যক্রম শুরু করব। সরকার যদি পাবলিক পরীক্ষা আগে এবং দ্রুত সম্পন্ন করতে পারে, তাহলে আমরাও দ্রুত ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারব। ধরুন, এখন এইচএসসি পরীক্ষা চলছে। আশা করা যায়, সেপ্টেম্বরে ফলাফল প্রকাশিত হবে। আমরা অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা শেষ করতে পারি। তিন মাসে কি ভর্তি পরীক্ষার যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করা যথেষ্ট নয়? আমাদের দরকার সরকারের ইচ্ছা এবং সবচেয়ে বড় দরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়, শিক্ষকদের মধ্যে সহযোগিতা ও আন্তরিকতা। আমরা আশা করব, আগামী শিক্ষাবর্ষে যেন জানুয়ারি মাসেই শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয়।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
nahmed1973@gmail.com

কজন জানে জুলাই সনদ কী
- গাজীউল হাসান খান

সমাজ ও বৃহত্তরভাবে রাষ্ট্র মেরামত কিংবা পরিবর্তনের জন্য যেসব কাঙ্ক্ষিত বা আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়, মূলত সেগুলোকেই সংস্কার বা ‘রিফর্ম’ বলা হয়। দেশের সংবিধান থেকে শুরু করে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নাগরিকরা কিংবা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সেসব সংস্কারের উদ্যোগ নিতে পারেন। তবে শেষ পর্যন্ত জাতীয় কিংবা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সেসব সংস্কার প্রস্তাবকে কার্যকর করতে হলে একটি আইনানুগ ভিত্তি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। বাংলাদেশে চব্বিশ সালের গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর সময়ে অতীত স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী শাসন এবং আর্থ-সামাজিক শোষণ-বঞ্চনার অবসানের জন্য দল-মত-নির্বিশেষে সবাই রাষ্ট্র মেরামতের একটি জোরালো দাবি উত্থাপন করেছে।
এ কথা ঠিক যে বিগত জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান কোনো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ছিল না। তবু সেটি আমাদের বিগত ৫৩ বছরের স্বাধীনতা-উত্তর আন্দোলনের ইতিহাসে একটি বিরাট মাইলফলক। স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী শাসন-শোষণের কবল থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে একটি বিশাল পদক্ষেপ। সুতরাং কোনো বিবেচনায়ই সে অভ্যুত্থানকে খাটো করে দেখা যাবে না।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান অধ্যাপক ড. ইউনূসসহ আমাদের রাজনৈতিক মহলের অনেকেই এরই মধ্যে গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। এতে তাঁদের অনেকের মধ্যেই বিগত ১১ মাসে ঘটে যাওয়া অনেক ব্যর্থতার চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে অনেকে দায়ী করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতা ও অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে সমন্বয়ের অভাবকে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সাবেক নেতারা এরই মধ্যে বহুবার অভিযোগ করেছেন যে অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে সময়োচিতভাবে একটি ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণার অভাবে রাজনৈতিক মহলে এখনো অনেক বিভ্রান্তি এবং ভবিষ্যৎ দিকদর্শনের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। ফলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই তাদের নিজ নিজ দলের পতাকাতলে অবস্থান নিয়েছে। ভুলে গেছে সেই মহান গণ-অভ্যুত্থানের জাতীয় প্রেক্ষাপটটি। রাজনৈতিক ঐক্য কিংবা রাজনৈতিক কর্মসূচিগত সমন্বয়ের বিষয়টি। ফলে চারদিকে মাথা তোলার অবকাশ বা সুযোগ পেয়েছে পতিত আওয়ামী সরকারের দোসর কিংবা বশংবদরা। সে পরিস্থিতিতে ড. ইউনূস হতাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘আমাদের একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বিফলে যেতে বসেছে। আমরা মুখে বলছি, সাবেক ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রতিনিধিরা এখনো সর্বত্র বসে রয়েছে। আমরা তাদের সরাতে পারিনি। আমরা তাদের স্বভাব-চরিত্র বদলাতে পারিনি।’ এ অবস্থায় অনতিবিলম্বে সর্বক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে না পারলে এবং সব জায়গায় কাঙ্ক্ষিত সংস্কার কিংবা পরিবর্তন সাধন করতে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতে ক্ষমতার রাজনীতিতে কোনো নির্বাচিত সরকারই স্থিতিশীল হতে পারবে না। এতে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন, উন্নয়ন কিংবা সমৃদ্ধি আশা করা হয়েছিল, তা বিফলে যেতে বাধ্য হবে। এখানেই অতীতে সংঘটিত সব গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের মৌলিক এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিগত কিছু পার্থক্য ছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারটি ছিল গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী একটি ভিন্নধর্মী রাজনৈতিক উদ্যোগের ফসল, কিন্তু তাতে অন্য অনেক কিছু থাকলেও ছিল না রাজনৈতিক দূরদর্শিতা।
ফরাসি বিপ্লব রাশিয়ায় সংঘটিত সমাজতান্ত্রিক (বলশেভিক) বিপ্লবের মতো ছিল না। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রায় শেষ দশকে (১৭৮৯-১৭৯৯) ফ্রান্সে সংঘটিত সে বিপ্লব ছিল একটি ‘দশক স্থায়ী সামাজিক-রাজনৈতিক অভ্যুত্থান’। ফ্রান্সের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের উল্লেখযোগ্য সময়। সে অভ্যুত্থানের শুরুতেই অর্থাৎ ১৭৮৯ সালে তার নেতারা ফ্রান্সের নাগরিক কিংবা মানুষের অধিকার নিয়ে ফ্রেঞ্চ চার্টার নামে একটি সনদ ঘোষণা করেন। সে সনদই ফরাসি বিপ্লবের মৌলিক চরিত্র বা বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরে। তাদের মুক্তি, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের নীতি প্রকাশ করে। এর পাশাপাশি মানুষের মৌলিক অধিকার ও দায়দায়িত্বের পথনির্দেশ প্রদান করে। সেদিক থেকে পর্যালোচনা করলে বাংলাদেশে সংঘটিত জুলাই-আগস্টের বিপ্লবও ছিল মূলত একটি গণ-অভ্যুত্থান। কিন্তু সে সফল অভ্যুত্থানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতাদের কী প্রত্যাশা ছিল, সেগুলো তাঁরা একটি সনদ আকারে নিজেরা প্রকাশ করেননি। তাঁরা অপেক্ষা করেছেন এই দায়িত্বটি সম্পন্ন করার ব্যাপারে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য, যাদের সঙ্গে সে গণ-অভ্যুত্থান কিংবা রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। সে কারণেই জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান সম্পর্কিত ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণা কিংবা নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়টি অনিশ্চিতভাবে ঝুলে রয়েছে। জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের কোনো কিছু উদযাপনের ক্ষেত্রেই কোনো গুরুত্ব দেখা যাচ্ছে না। এ রকম একটি রাজনীতিগত দোদুল্যমান অবস্থায় কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান আমাদের জীবনে কী পরিবর্তন এনেছে? যদি কোনো পরিবর্তন না-ই হয়ে থাকে, তাহলে দেশে ফ্যাসিবাদের পতন বা তাদের উত্খাত করা হলো কিভাবে? কেন এত বিশাল গণ-আন্দোলন ও সাধারণ মানুষের এত আত্মত্যাগ? অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান বলেছেন, ‘অতীতের অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন বদলাতে আমরা রাষ্ট্র মেরামতসহ সর্বত্র সংস্কার সাধনের যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছি, সেগুলো আমাদের প্রস্তাবিত জুলাই সনদে স্থান পেতে হবে।’ দল-মত-নির্বিশেষে জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে প্রস্তাবিত ঘোষণাগুলো বাস্তবায়িত করতে হবে। কিন্তু কী সে প্রস্তাবিত ঘোষণা, তা এখনো জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেক দলই জানে না। বিএনপিসহ বিভিন্ন দেশপ্রেমিক দলের নেতাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কোনো আলোচনায়ই এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বসা হয়নি। কারা কারা হবেন এই প্রস্তাবিত সনদে স্বাক্ষরকারী? এ পর্যন্ত তারও কোনো হদিস নেই। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং দেশি-বিদেশি আধিপত্যকে প্রতিরোধ করে আমরা কিভাবে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করব—প্রস্তাবিত সনদে আমরা সে ব্যাপারে সবার সম্মিলিত প্রতিশ্রুতি চাই।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
gaziulhkhan@gmail.com

বাবনপুরে জেগে আছেন শহীদ আবু সাঈদ
- ড. মো. ফখরুল ইসলাম

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে জুলাই ২০২৪ মাসটি এক অনন্য মর্যাদার দাবিদার। এই মাসে বারবার রক্ত ঝরেছে, শিক্ষার্থী-শ্রমিক-জনতার আহ্বানে কেঁপে উঠেছে শাসকের প্রাসাদ। সেই উত্তাল জুলাইয়ের সূচনা ঘটেছিল রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) মাটি রঞ্জিত করে আবু সাঈদ নামের এক শিক্ষার্থীর রক্তে। পীরগঞ্জের বাবনপুর নামক গ্রামে একটি বাঁশের বেড়া দেওয়া কবরে তিনি শুয়ে আছেন নীরবে, নিঃশব্দে।
রংপুরে শিক্ষার বাতিঘর হয়ে উঠেছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের অব্যবস্থাপনা, নিয়োগ বাণিজ্য, রাজনৈতিক দখল ও অবমূল্যায়নের কারণে নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বারবার পরিণত হয়েছে ক্ষোভের আগ্নেয়গিরিতে।
জুলাই বিপ্লব তাই কেবল রংপুরের বা বেরোবির নয়।
এই শহীদ যেন আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, বাংলাদেশে ছাত্ররাই বারবার যুগ পরিবর্তনের সূচনা করেন। হোক তা ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার সংগ্রাম কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী লড়াই। আমরা চাই, এই শহীদের রক্ত বৃথা না যাক।
জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদের স্মরণে রাষ্ট্র কি আরো একটু নত হবে, নাকি আবারও চলবে এড়িয়ে যাওয়ার নীলনকশা? যদি তা-ই হয়, তবে আগামী দিনগুলো আরো অস্থির, আরো উত্তাল হবে।
‘যেখানে বাধাগ্রস্ত হবে, সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে’—এই চেতনা দেরিতে এলো কেন? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে রাষ্ট্রযন্ত্রের চেহারার ভেতরে, যা দিন দিন হয়ে উঠছে আরো দুর্বিনীত, অসহনশীল ও জনবিচ্ছিন্ন। যখন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা পাস করার পর চাকরির জন্য ঘুরে বেড়ান, তাঁদের দাবি উপেক্ষা করে, বিরোধিতা করে, এমনকি দমন করতে গিয়েই সরকার তার আসল চেহারা উন্মোচন করে। ঠিক এখানেই জুলাই এসে দাঁড়িয়েছিল প্রতিবাদের ভাষা হয়ে। এটি কেবল একটি মাস নয়, এটি একটি ধারণা, একটি রাজনৈতিক চেতনা, একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার নাম, যা শেখায় জুলুমের বিরুদ্ধে চুপ থাকা মানেই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া। তাই যখনই কোথাও প্রতিবাদ বাধাগ্রস্ত হবে, যখনই মত প্রকাশের অধিকার পদদলিত হবে, তখনই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে প্রতিরোধের এক ছায়াছবির মতো।
বাবনপুরে শায়িত জুলাই বিপ্লবের প্রথম শহীদ, তাঁর জীবন দিয়ে আমাদের আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, প্রতিবাদের মুখ বন্ধ করে রাখা যায় না। তাই তাঁর মৃত্যু আর দশটি মৃত্যুর মতো নয়, বরং এটি এক বিস্মৃত সময়কে জাগিয়ে তোলার মুহূর্ত, যেখানে জুলাই আবার ফিরে এসেছে জনতার পাশে দাঁড়াতে।
এখন বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনে, কর্মক্ষেত্রে, সংবাদমাধ্যমে, এমনকি সংসদের ভেতরেও যদি অন্যায় চাপিয়ে দেওয়া হয়, তবে সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে। কারণ এই মাস শেখায় শুধু স্মৃতিচারণা নয়, স্মৃতি দিয়ে বাস্তব পরিবর্তনের দাবিও তোলা যায়।
তাই আমাদের দায়িত্ব এই শহীদের মৃত্যু যেন অন্ধকারে হারিয়ে না যায়। রাষ্ট্র যদি কখনো ন্যায়ের পথ ছেড়ে নিপীড়নের দিকে হাঁটে, তাহলে প্রতিটি গ্রামে বাবনপুরের মতো একেকটি জুলাই জন্ম নিতে পারে।
এমন সময় হয়তো আবারও প্রশ্ন উঠবে, জুলাই-জুলাই বলে এত মাতামাতি কেন? আমরা তখন উত্তর দেব, এর কারণ আমাদের প্রতিবাদের জায়গাগুলো একে একে নিঃশব্দ হয়ে যাচ্ছে। আর যেখানে হাতে মুষ্টি তুলে পথে নেমে সমস্বরে চিৎকার করা নিষিদ্ধ, সেখানে জুলাই-ই হয়ে উঠতে পারে একমাত্র ভাষা।
শহীদ আবু সাঈদের মৃত্যু কেবল একটি গুলি বা একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল না। এটি একটি সাবধানবাণীও ছিল। বেরোবির পার্কের মোড়ের অদূরে যা ঘটেছিল, তা ছিল আসলে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। যেখানে কথা বলা মানেই অপরাধ, দাবি জানানো মানেই রাষ্ট্রদ্রোহ মনে করা হয়েছিল।
সেদিন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা যখন শান্তিপূর্ণভাবে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন রাষ্ট্র কী করেছিল? তারা কেন সেদিন তাঁদের দিকে বন্দুক তাক করল? সেদিন যে তরুণ শহীদ হলেন, তিনি যেন গোটা বাংলাদেশের হয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন, তৎকালীন ক্ষমতাধরদের কাছে তা অনুধাবন করা কি খুব জটিল বিষয় ছিল?
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রতিবাদের ঐতিহ্য খুব গর্বের। ভাষা আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন—সবখানেই ছাত্রসমাজ পথ দেখিয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালে এসেও ছাত্রসমাজের কণ্ঠ রোধ করতে গুলি ব্যবহার করতে হয়, এটি কি রাষ্ট্রের দুর্বলতা নয়? আগামী দিনে আমরা এ ধরনের আর কোনো রাষ্ট্রীয় দুর্বলতা ও ভয় দেখতে চাই না।
জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদ শব্দটি যেন আমাদের সবার কাঁধে নতুন দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়। এর মানে, আরো অনেক শহীদ আসতে পারেন, যদি রাষ্ট্র তার দমননীতি থেকে ফিরে না আসে। যদি কথা বলার জায়গা, ভিন্নমতের জায়গা একে একে নিঃশব্দ হয়ে যায়, তাহলে শেষ ভরসা হয় রক্ত। বেরোবির ইংরেজি পড়ুয়া অকুতোভয় ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের তাক করা বন্দুকের নলের সামনে বুক উঁচিয়ে গুলি খেতে দ্বিধাহীন না থাকলে আজ কী করতাম আমরা, তা কি কেউ ভেবে দেখেছেন?
জন্ম নিলেই সবাইকে একদিন না একদিন নির্বাক হতে হয়। কিন্তু সবার কথা কি সব মানুষের অনন্তকালব্যাপী মনে থাকে? শহীদ আবু সাঈদ বাবনপুরে শুয়ে আমাদের শিখিয়ে দিচ্ছেন, দেশের যেকোনো প্রয়োজনে যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্বাক থাকার দিন শেষ।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন
fakrul@ru.ac.bd