ঢাকা, শুক্রবার ১১ জুলাই ২০২৫
২৬ আষাঢ় ১৪৩২, ১৫ মহররম ১৪৪৭

ঢাকা, শুক্রবার ১১ জুলাই ২০২৫
২৬ আষাঢ় ১৪৩২, ১৫ মহররম ১৪৪৭

নতুন শিক্ষাক্রম : প্রতিযোগিতা নয়, সহযোগিতা

  • সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক
অন্যান্য
অন্যান্য
শেয়ার
নতুন শিক্ষাক্রম : প্রতিযোগিতা নয়, সহযোগিতা

নতুন শিক্ষাক্রমে শিখন-শেখানোর বিষয় ও পদ্ধতি এমন হবে যেন শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা সহযোগিতার মনোভাব ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষায় উন্নত সব দেশেই এ বিষয়ে এখন বেশ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, কারণ বরেণ্য শিক্ষাবিদরা বেশ কয়েক দশক ধরে লক্ষ করছেন, শিক্ষাকে উন্নত করার অভিপ্রায়ে বেশির ভাগ অবিমৃশ্যকারী রাষ্ট্রে, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও শিক্ষার্থী-শিক্ষার্থীতে, স্কুলে-স্কুলে প্রতিযোগিতার ভয়াবহ বীজ বপন করে দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে স্ট্যান্ডার্ডাইজড টেস্টের দাপটে এখন কে কাকে কতটা পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে পারবে, সবাই এই প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। এতে শুধু শিক্ষাবিদরা নন, প্রায় সব প্রগতিশীল চিন্তাবিদ উদ্বিগ্ন এই কারণে যে মানুষে-মানুষে যে সহযোগিতার কারণে মানবসভ্যতা এত দূর এগিয়েছে, স্কুলগুলোতে এমন অসুস্থ প্রতিযোগিতার সংস্কৃতি তৈরি হলে তা তো নস্যাৎ হবেই, এমনকি যে সভ্যতা নিয়ে আমাদের এত গর্ব তাও ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।

শিক্ষাবিদদের কথা হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের প্রথমে যেটা বোঝাতে হবে সেটা হচ্ছে অন্য প্রাণীদের চেয়ে যে আমরা উন্নত সেটা যে শুধু আমাদের ‘হাত’ আর ‘বুদ্ধি’ আছে সে কারণে নয়। অন্য প্রাণীদের চেয়ে আমরা উন্নত, তার মূল কারণ হচ্ছে আমাদের পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতা করার মনোভাব ও ক্ষমতা। অন্য প্রাণীদেরও এই ক্ষমতা আছে, কিন্তু আমাদের চেয়ে অনেক কম। আমি যদি ইওভাল নোয়া হারারির কাল্পনিক উদাহরণটা দিই, তাহলে বিষয়টা আরো স্পষ্ট হবে।

ধরুন, একটা নির্জন দ্বীপে আপনি একটা শিম্পাঞ্জি ও একজন মানুষকে রেখে এলেন। কয়েক দিন পর গিয়ে দেখবেন যে ওই শিম্পাঞ্জি মানুষটির চেয়ে অনেক ভালো আছে। কারণ সে মানুষটির চেয়ে অনেক ভালোভাবে নতুন পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছে। আপনি যদি এরপর ১০টি শিম্পাঞ্জি আর ১০ জন মানুষ ওই দ্বীপে রেখে আসেন, কিছুদিন পর গিয়ে আপনি সেই একই চিত্র দেখবেন, শিম্পাঞ্জিগুলো মানুষদের চেয়ে ভালো আছে।
কিন্তু আপনি যদি এরপর ১০ হাজার শিম্পাঞ্জি আর ১০ হাজার মানুষ ওখানে রেখে আসেন, তাহলে দৃশ্যপট পাল্টে যাবে। দেখবেন এবার মানুষই সেখানে কর্তৃত্বের ভূমিকায়; শুধু শিপাঞ্জিরা নয়, পুরো দ্বীপটাই তাদের অধীন। এর কারণ হচ্ছে শিম্পাঞ্জিদের সহযোগিতা করার ক্ষমতা সীমিত আর মানুষের সেই ক্ষমতা অসীম। ১০টা শিম্পাঞ্জি হয়তো নিজেদের মধ্যে এই সহযোগিতার মনোভাব বজায় রাখতে পারে, কিন্তু সংখ্যাটা ১০ হাজার হয়ে গেলে তারা আর সবার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারে না। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে সেটা ১০ হাজার কিংবা ১০ বিলিয়ন হোক, তাতে কিছু আসে-যায় না।
এটাই মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তি।

অবশ্য প্রতিযোগিতার সঙ্গে মানুষের বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতার একটা সম্পর্ক আছে। কারণ বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা দিয়েই সে বোঝে প্রতিযোগিতা নয়, তার জন্য সহযোগিতাই মঙ্গল বয়ে আনে। যেমন—মানুষের বুদ্ধি বাড়ার কারণেই তার সহযোগিতা করার মনোভাব বেড়েছে এবং এ কারণেই পৃথিবীতে যুদ্ধের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে কমে গেছে। রাশিয়া-ইউক্রেনের মতো ছোটখাটো দু-একটা যুদ্ধ যে হচ্ছে না তা নয়, কিন্তু বড় যুদ্ধ আর বহুদিন হয় না। মানুষ সামষ্টিকভাবে বোকা হলে যে তার সহযোগিতা করার মনোভাব কম থাকে, সেটা প্রিজনার্স ডিলেমা নামের একটা গেম ব্যবহার করে অর্থনীতিবিদ গ্যারেট জোনস প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। গেমটা এ রকম।

ধরা যাক, দুজন মিলে একটা অপরাধ করেছে। দুজনকে গ্রেপ্তার করে একটা জেলের একেবারে আলাদা দুটি সেলে রাখা হলো। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে খুব শক্ত প্রমাণ নেই। যদি তারা নিজেদের দোষ স্বীকার করে বা একে অন্যের বিরুদ্ধে বলে, তাহলে তাদের শাস্তি দেওয়া যায়। এ জন্য তাদের একটা প্রস্তাব দেওয়া হলো : যদি একজন অন্যজনের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেয় এবং অন্যজন যদি তার বিরুদ্ধে কিছু না বলে, অর্থাৎ অন্যজন যদি প্রথমজনের সঙ্গে সহযোগিতা করতে চায়, তাহলে প্রথমজনকে মুক্তি দেওয়া হবে এবং দ্বিতীয়জনকে ১০ বছরের জেল খাটতে হবে। ঘটনাটা অন্যভাবেও ঘটতে পারে। দেখা গেল, দুজনই দুজনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিল। সে ক্ষেত্রে দুজনেরই জেল হবে, তবে শাস্তির সময় কমে ছয় বছর হবে। কিন্তু যদি এমন হয় যে দুজনেরই সহযোগিতার মনোভাব আছে; কেউ কারো বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিল না। সে ক্ষেত্রে তাদের দুজনেরই মাত্র ছয় মাসের জেল হবে।

এ ক্ষেত্রে একেবারে সাধারণ বুদ্ধির একজন মানুষ অন্যের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে চাইবে। কারণ সে হিসাব করবে যদি সে অন্যের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়, তাহলে কম করে হলেও তার চার বছরের জেল মাফ হবে। আর যদি অন্যজন তাকে সহযোগিতা করতে চায়, তাহলে তো সোনায় সোহাগা, পুরো ১০ বছরই মাফ। অন্যপক্ষে সে যদি সহযোগিতা করে, তাহলে কমপক্ষে তাকে ছয় মাস জেল খাটতে হবে; আর যদি ভাগ্য খারাপ হয় এবং সেটা হওয়ার আশঙ্কাই বেশি, অর্থাৎ অন্যপক্ষ যদি তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়, তাহলে তাকে ১০ বছর জেল খাটতে হবে। ফলে শেষ পর্যন্ত যেটা হবে সেটা হলো দুজনই দুজনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে, কেউ কারো বিরুদ্ধে সহযোগিতা করবে না।

আমাদের ট্র্যাজেডি হচ্ছে, আমরা এখনো অনেকে মনে করছি একজন ব্যক্তির তখন সবচেয়ে বেশি লাভ হয় যখন সে অন্যকে ফাঁসিয়ে দেয়, আরেকজন ব্যক্তির সবচেয়ে ক্ষতি হয় তখন যখন সে অন্যের সঙ্গে সহযোগিতা করতে চায়। ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে বিষয়টা কিছুটা সত্যি হলেও বুদ্ধির ঘাটতি থাকার কারণে আমরা বুঝি না যে সামষ্টিকভাবে সবচেয়ে বেশি লাভ হয় তখন যখন দুজন দুজনকে সহযোগিতা করে এবং সামষ্টিকভাবে সবচেয়ে ক্ষতি হয় তখন যখন দুজন দুজনের বিরুদ্ধে কথা বলে। স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীদের সামষ্টিকভাবে চিন্তা করতে শেখানো হয় না বলেই তারা বড় হয়ে ব্যক্তিগত লাভের জন্য স্বার্থপরের মতো আচরণ করে সামষ্টিক ক্ষতি করে এবং এতে আখেরে তাদের নিজেদেরও ক্ষতি হয়।

তবে মানুষ বারবার এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেলে বিষয়টা নিশ্চয়ই বুঝবে। আর বুদ্ধি থাকলেও যে সে বোঝে সেটারও প্রমাণ জোনস তাঁর গবেষণায় পেয়েছেন। তিনি ১৯৫৯ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পরিচালিত প্রিজনার্স ডিলেমার তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি দেখলেন যে স্কুলের গড় আইকিউ যত ভালো সেই স্কুলের শিক্ষার্থীরা তত সহযোগিতামূলক মনোভাব পোষণ করে। এ রকম আরেকটা পরীক্ষা করেছিলেন আরেকজন অর্থনীতিবিদ স্টেফান বার্কস। সেখানেও দেখা গেল এক হাজার প্রশিক্ষণার্থী ট্রাক ড্রাইভারের মধ্যে যাদের আইকিউ ভালো তারা প্রায় সবাই প্রতিযোগিতা এড়িয়ে সহযোগিতা করতে চায়।

আশার কথা হচ্ছে, আমাদের নতুন শিক্ষাক্রম বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। এখানে সহযোগিতার মতো সফট স্কিল শেখানোর জন্য প্রকল্পভিত্তিক অভিজ্ঞতামূলক শিখন-শেখানো কার্যক্রমের কথা বলা হয়েছে, যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা পরস্পরের মধ্যে সহযোগিতা চর্চা করার সুযোগ পাবে এবং সেই সব অভিজ্ঞতা দিয়ে সহযোগিতার গুরুত্ব উপলব্ধি করবে। একই সঙ্গে বিষয়টি তারা যেন তাদের সূক্ষ্মচিন্তন দক্ষতা দিয়েও বুঝতে পারে, নতুন শিক্ষাক্রমে নিশ্চয়ই সেই ব্যবস্থা থাকবে। এখন শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা এই বিষয়টিকে কতটা গুরুত্ব দেবেন তার ওপর নির্ভর করবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মানুষরা পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে পিছিয়ে পড়বে, না পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতা করে এগিয়ে যাবে।

 

 লেখক : মাউশির সাবেক মহাপরিচালক

 

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

অভ্যুত্থানের এক বছর : সংকট, সম্ভাবনা ও ভবিষ্যৎ

    এজাজ ইউসুফী
শেয়ার
অভ্যুত্থানের এক বছর : সংকট, সম্ভাবনা ও ভবিষ্যৎ

২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা একটি গণ-অভ্যুত্থানের সূচনা করে, যা রাষ্ট্রব্যবস্থা ওলটপালট করে দেয়। এক বছর পরে এসে অভ্যুত্থানের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব, কাঠামোগত সংকট, সংস্কার প্রচেষ্টার সাফল্য-ব্যর্থতা এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে অল্পবিস্তর আলোচনা করতে চাই।  

১.

ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার জুলাই অভ্যুত্থান কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না। এটি ছিল পতিত সরকারের দমননীতি, বাকস্বাধীনতা হরণ, শিক্ষার বেসরকারীকরণ এবং রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে দেড় দশক ধরে চলে আসা সম্মিলিত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।

গবেষক আহমেদ তাঁর গ্রন্থ ‘The Anatomy of Authoritarianism in Bangladesh’

(২০২৩)-এ দেখিয়েছেন, কিভাবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমে দলীয়করণের শিকার হয়ে পড়ে এবং ছাত্র-জনতার রাজনৈতিক স্বাধীনতা হরণ করা হয়।

২০২৩ সালের শেষ দিকে কোটা বাতিল, ন্যূনতম নিরাপদ ক্যাম্পাস, ন্যায়সংগত উপবৃত্তি এবং নিরপেক্ষ ছাত্রসংসদ নির্বাচন ঘিরে আন্দোলন শুরু হলেও তা দ্রুত রূপ নেয় একটি বৃহৎ রাজনৈতিক প্রতিবাদে। সমাজতাত্ত্বিক রহমান ও সুলতানা তাঁদের এক গবেষণায় আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে একে উল্লেখ করেছেন, ‘control of knowledge and control of political destiny’,  যা এক সূত্রে মিলে গিয়েছে। ফলে একটি  গণ-অভ্যুত্থান অনিবার্য হয়ে ওঠে রাজনৈতিক-সামাজিক মুক্তির প্রয়াস হিসেবে।

২.

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নতুন অন্তর্বর্তী সরকার বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করে। উদ্দেশ্য, রাজনীতির অবকাঠামোগত পরিবর্তন, প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, নির্বাহী ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টি এবং অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের ভিত্তি স্থাপন করা। কিন্তু এক বছর পেরিয়ে গেলেও সংস্কার কমিশনের কার্যক্রমের দৃশ্যমান সাফল্য নেই।

প্রশাসনিক ক্ষেত্রে আমলারা পুরনো রীতি বজায় রেখেছেন।

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গভীর বিভেদকার্যত নির্বাচনী কিংবা সংস্কার কাঠামোতে কোনো মৌলিক পরিবর্তনের ব্যাপারে জাতীয় ঐকমত্য তৈরি করা যায়নি, বিশেষ করে সংবিধান সংশোধন কতটা হবে সে বিষয়ে জটিলতা দেখা দেয়। কেউ বাহাত্তরের সংবিধান বাতিল করার কথা বলে, কিন্তু বিএনপিসহ অনেক রাজনৈতিক দলের তাতে সেই অর্থে সায় নেই।

সংস্কার কমিশন দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের প্রস্তাব করেছে। এটি বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য কতটা গ্রহণযোগ্য, তা গভীর বিবেচনার বিষয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এর সুবিধা ও সীমাবদ্ধতা উভয়ই রয়েছে।

এটি আইন প্রণয়নে অধিক পর্যালোচনা ও পরিপক্বতা আনতে পারে। প্রান্তিক অঞ্চল ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার সুযোগ তৈরি হতে পারে। অন্যদিকে এটি আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে প্রশাসনিক ব্যয় ও জটিলতা বাড়াবে। রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব ও দুর্বল সাংবিধানিক চর্চা এটিকে অকার্যকর বা কর্তৃত্ববাদী উপায়ে ব্যবহৃত হওয়ার ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক-প্রশাসনিক কাঠামো এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা বিবেচনায় দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ এখনই গ্রহণযোগ্য নয়।

৩.

জুলাই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর রাজনীতিতে যে গুণগত পরিবর্তন আশা করা হয়েছিল, তা প্রায় স্তিমিত।

Transparency Watch (২০২৫)-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, তিনজন শীর্ষ ছাত্রনেতার বিরুদ্ধে বিদেশি তহবিল অপব্যবহার এবং অবৈধ সুবিধা গ্রহণের অভিযোগ তদন্তাধীন। এ ছাড়া সমাজের সর্বক্ষেত্রে  মব সন্ত্রাস দেখা যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে নতুন নেতৃত্বও পুরনো দমননীতি গ্রহণ করেছে। আন্দোলনের সময় বাম-ডান-মধ্য সবাই একটি অভিন্ন প্ল্যাটফর্মে যূথবদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু কয়েকজন ছাত্রনেতার উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ঐক্য ভেঙে যায়। আন্দোলনকারী ছাত্ররা তাদের নিজ নিজ আদর্শিক সংগঠনে ফিরে যায়।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ছিল গণতান্ত্রিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু এটি পরবর্তীকালে এমন কিছু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের জন্ম দেয়, যা বাংলাদেশের ইতিহাস ও জাতিসত্তার মূল ভিত্তিমহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে তীব্র আঘাতের মুখে ফেলে। বিশেষ করে বিরাজনৈতিকীকরণের প্রবণতা মুক্তিযুদ্ধের গণমুখী চেতনার বিপরীতে এক বিপজ্জনক স্খলন। প্রতীকী স্থাপনা ধ্বংস ও ইতিহাস বিকৃতির প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে দুর্বল করে উগ্রপন্থী ও সুবিধাবাদী চেতনার পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র দেখা দিতে থাকে।

৪.

অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে একাধিক ধর্মীয় ও প্রান্তিক গোষ্ঠী প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদন দেখিয়েছে, রক্ষণশীল গোষ্ঠীগুলো ছাত্রসমাজের বিভাজনকে কাজে লাগিয়ে সমাজে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। অন্যদিকে নারী, আদিবাসী এবং সংখ্যালঘুদের আন্দোলনও মূলধারার রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেই। ফলে অভ্যুত্থান-পরবর্তী গণতান্ত্রিক কাঠামোতে ইনক্লুসিভনেস বা অংশগ্রহণমূলক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এটি ভবিষ্যতে রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলতে পারে। বিশেষ করে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ, সংস্কার এবং নির্বাচন ইস্যুতে সরকার, ছাত্র, রাজনৈতিক গোষ্ঠী ও সেনাবাহিনীর মধ্যে আস্থাহীনতা গণতান্ত্রিক উত্তরণ প্রক্রিয়াকে অনেকটা জটিল করে তুলতে পারে।

৫.

সরকার যে নির্বাচন কমিশন গঠন করেছে, তা কার্যত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমর্থন পেলেও বড় দলগুলোর মধ্যে আস্থার কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। নির্বাচনপ্রক্রিয়া নিয়ে বিভ্রান্তি, অভিযোগ এবং গোপন এজেন্ডা নিয়ে সন্দেহ অব্যাহত রয়েছে।

দেশে এখন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নানাভাবে ঘায়েল করা এবং মব ভায়োলেন্সের দাপট চলছে। ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার অর্থনীতি সংস্কারে কিছুটা সাফল্য দেখালেও সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়। পররাষ্ট্রনীতি বলতে তেমন কোনো কিছু দৃশ্যমান নয়। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের বহুল প্রচারিত সফরের পরও রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসনে গতি আসেনি, উপরন্তু নতুন করে লক্ষাধিক রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। অন্যদিকে আরাকান আর্মির জন্য মানবিক করিডরের (সরকারি ভাষ্যে মানবিক চ্যানেল) চিন্তা এবং চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনার কাজ বিদেশি সংস্থাকে দেওয়ার দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা পরিস্থিতি জটিল করেছে। এটিকে অনেক রাজনৈতিক দল ও সুধীসমাজ দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি এবং নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র বলে ভাবছে।

৬.

জুলাই ২০২৪-এর অভ্যুত্থান কেবল শাসনব্যবস্থার পতন ঘটায়নি, বরং রাষ্ট্রকাঠামোর গভীরে জমে থাকা সংকটকে উন্মোচিত করেছে। এখন প্রশ্ন হলো, এই অভ্যুত্থান কি ইতিহাসে একটি অপূর্ণ ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হবে, নাকি এটি ভবিষ্যতের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের ভিত্তি হবে?

রহমান ও সুলতানা (২০২৪) এ প্রসঙ্গে যুক্তি দিয়েছেন, ‘Movements fail not just because of external repression, but due to internal contradictions.’

বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলন যে আন্তরিকতা ও উদ্দীপনা নিয়ে দীর্ঘ স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়েছিল, তা আজ অনেকটাই ক্ষয়িষ্ণু। তবে আশার দিকও রয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নবীন নেতৃত্ব, বিকল্প রাজনৈতিক চিন্তার বিকাশ ও স্থানীয় পর্যায়ে গণসংগঠন গঠনের প্রবণতা বাড়ছে। সামাজিক মিডিয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক বিকল্প পাঠচক্রের মাধ্যমে তারা নতুন বয়ান তৈরির আবহ সৃষ্টি করছে।

৭.

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম পদক্ষেপ ছিল জুলাই ঘোষণাপত্র তৈরি করা, যা জাতীয় সনদ হবে বলে উল্লেখ করা হলেও তা বাস্তবায়ন কঠিন বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।

ইউনূস সরকার একে সময়োচিত ও সংকট উত্তরণে অপরিহার্য বলে দাবি করলেও জাতীয় সনদ বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে তুলতে সক্ষম হয়নি।

৮.

জুলাই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। আন্তোনিও গ্রামসির সংকট তত্ত্ব আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সংকটের সময়ে পুরনো গঠন মরে যায়, কিন্তু নতুনটি জন্মাতে না পারলে নেতৃত্বশূন্যতা জন্ম নেয়। বাংলাদেশ আজ সেই যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে।

সর্বশেষ বলা যায়, দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল, সুধী মুরব্বিরা, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রসমাজ ও সংশ্লিষ্ট নাগরিক শক্তি যদি সঠিক আত্মসমালোচনার সাহস দেখায়, বর্তমান নেতৃত্বকে জবাবদিহির কাঠামোয় আনে এবং আদর্শিক স্পষ্টতা বজায় রাখতে পারে, তবে এখনো একটি অংশগ্রহণমূলক, ন্যায্য রাষ্ট্র বিনির্মাণের সম্ভাবনা অটুট রয়েছে।

লেখক : সাবেক সাধারণ সম্পাদক, চট্টগ্রাম

প্রেস ক্লাব, সাবেক সভাপতি, সিইউজে

মন্তব্য

ফুটবলে বাংলাদেশের মেয়েদের অনন্য সাফল্য

    ইকরামউজ্জমান
শেয়ার
ফুটবলে বাংলাদেশের মেয়েদের অনন্য সাফল্য

নারী ফুটবলাররা ফুটবলকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরেক ধাপ উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ার গণ্ডি অতিক্রম করে স্থান করে নিয়েছে এশিয়ার বৃহৎ অঙ্গনে। এই অসাধারণ কৃতিত্বে বিশ্ব ফুটবল জগতে বাংলাদেশ নামের দেশটি আলো ছড়িয়েছে। এএফসি উইমেন্স এশিয়ান কাপ ফুটবলের কোয়ালিফাইং রাউন্ডের সি গ্রুপে ফিফা র্যাংকিংয়ে অনেক বেশি এগিয়ে থাকা বাহরাইন ও মায়ানমার, তুর্কমেনিস্তান অবশ্য বাংলাদেশ থেকে পিছিয়ে আছে, এই তিন অচেনা প্রতিপক্ষের বিপক্ষে লড়াইয়ের মঞ্চে দাপটের সঙ্গে চিত্তাকর্ষক ফুটবল উপহার দিয়ে অপরাজিত থেকে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত রাউন্ডে প্রথমবারের মতো খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে অদম্য নারী দল।

সত্যি কথা বলতে কি, ফুটবলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকেও ভাবতে পারেননি যে বাংলাদেশের নারীরা এত সুন্দরভাবে কোয়ালিফাই করতে পারবেন। আন্তর্জাতিক ফুটবলে দেশের জন্য নারী ফুটবলারদের এবারের অর্জন বিশাল। নারীরা খুলে দিয়েছেন দেশের জন্য সম্ভাবনার প্রশস্ত সিংহদ্বার। পাল্টে দিয়েছেন ফুটবলকে ঘিরে চিন্তা-ভাবনা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি।
ক্রীড়াঙ্গনে নারীরা এখন দেশের গৌরব, আলোর দিশারি এবং অনুপ্রেরণা। জাগরণের প্রতীক।

১৯৭৯ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সপ্তম এশিয়ান কাপের গ্রুপ-২ কোয়ালিফাইয়িং রাউন্ডে কোয়ালিফাই করে ১৯৮০ সালে কুয়েতে চূড়ান্ত পর্যায়ে খেলেছিল বাংলাদেশ পুরুষ দল। এর ৪৫ বছর পর বাংলাদেশ নারী দল এএফসি এশিয়ান কাপে কোয়ালিফাই করল।

শুরু হলো ফুটবল ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের। আগামী বছর ১ থেকে ২১ মার্চ ২১তম উইমেন্স এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্যায়ে খেলা হবে ১২টি দেশ নিয়ে। দক্ষিণ এশিয়া থেকে লড়াইয়ের মঞ্চে থাকবে বাংলাদেশ ও ভারত। ভেবে আবেগে আপ্লুত হচ্ছি, আগামী বছর অস্ট্রেলিয়ার স্টেডিয়ামে এশিয়ার ফুটবলে শক্তিধর দেশগুলোর পাশে আমাদের লাল-সবুজ পতাকা সগৌরবে উড়বে। দেশে নারী ফুটবলের আনুষ্ঠানিক যাত্রার বয়স তো ৫০ বছরও হয়নি।

অনূর্ধ্ব-১৪ মেয়ে বাংলাদেশ দল ২০১৫ সালে নেপালে প্রথম এএফসি আঞ্চলিক (দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চল) টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়সেটিই শুরু। এর পর থেকে দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবল মঞ্চ বয়সভিত্তিক এবং জাতীয় দলের রোমাঞ্চকর সাফল্যের গল্পে ঠাসা। ২০২২ ও ২০২৪ সালে বাংলাদেশ নারী দল সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে পর পর দুইবার শিরোপা জিতে দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলে অন্যতম শক্তি হিসেবে নিজেকে পরিচিত করেছে। এরপর এএফসি এশিয়ান কাপে কোয়ালিফাই করে বড় স্বপ্ন পূরণের মাধ্যমে দেশের ফুটবলকে আরেক ধাপ উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করা হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতা এবং ভীষণ সীমাবদ্ধতার মধ্যে নারী ফুটবলারদের অসাধারণ এবং স্মরণীয় জার্নি। আর এই জার্নিতে অনেক প্রশ্ন আছে, কিন্তু উত্তর নেই!

এশিয়ান কাপের চত্বর যেমন তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ, তেমনি সম্ভাবনার হাতছানিতে ভরপুর। অস্ট্রেলিয়ায় চূড়ান্ত খেলায় ছয়ে থাকলে ২০২৭ সালের ব্রাজিল নারী বিশ্বকাপে সরাসরি সুযোগ মিলবে। সেরা আটে থাকলে থাকবে আন্তর্মহাদেশীয় প্লে অফে খেলার সুযোগ। এ ক্ষেত্রে স্বপ্নের জাল বোনা আর স্বপ্নকে বাস্তবায়নের চেষ্টা করতে হলে নারী ফুটবল নিয়ে সর্বাত্মক প্রস্তুতি শুরু করা এখনই জরুরি। অস্ট্রেলিয়া মিশন স্লোগানের মধ্যে অবশ্যই একটি চেতনা ও লক্ষ্য আছে। ফুটবল ফেডারেশন নারী ফুটবলারদের পাশে ছিল এবং থাকবে। ফুটবল ফেডারেশন যদি পাশে না থাকত, তাহলে নারী ফুটবল এত রাস্তা অতিক্রম করে আজকের অবস্থানে আসতে পারত না।

ফুটবলে বাংলাদেশের মেয়েদের অনন্য সাফল্যএকবার ভাবুন দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে পর পর দুইবার সেরা শক্তিধর হিসেবে শিরোপা জিতেছে নারী দল। জিতেছে অনেক বয়সভিত্তিক আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের শিরোপা। বাংলাদেশ নারী দল এবার দক্ষিণ এশিয়ার গণ্ডি অতিক্রম করে স্থান করে নিয়েছে এশিয়ান মঞ্চে। এই বাংলাদেশের নারী ফুটবলারদের জন্য দেশে একটিও ডেডিকেটেড ফুটবল গ্রাউন্ড নেই, যাতে তাঁরা নিয়মিতভাবে অনুশীলন করতে পারেন। নেই মেয়েদের জন্য ফুটবল কাঠামো। নেই পৃথক নারী ফুটবল একাডেমি, বাফুফের অফিসের ওপরতলায় বছরের পর বছর ধরে থাকছেন নারীরা ক্যাম্প করে। একবার একজন ফুটবল সংগঠক আমাকে বলেছেন, ফুটবলের এই আবাসিক ক্যাম্পকে এএফসি স্বীকৃতি দিয়েছে। মাঠ না থাকায় খেলার আয়োজন সম্ভব হয় না। জোড়াতালি দিয়ে অনিয়মিতভাবে স্বল্প সময়ের জন্য লীগের আয়োজন হয়। এ ক্ষেত্রে খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক খুব কম। বসুন্ধরা গ্রুপের ক্লাব বসুন্ধরা কিংস নারী লীগে একনাগাড়ে তিন বছর শিরোপা জিতেছে। তখন এই ক্লাবটি নারী ফুটবলারদের ভালো পারিশ্রমিক দিয়েছে। পুল ও বিভিন্ন কারণে বসুন্ধরা কিংস আর নারী লীগে অংশ নেয় না। বাফুফের উচিত অবিলম্বে এএফসি প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী পেশাদার লীগ শুরু করা।

ভুটানে নারী পেশাদার লীগ চলে ছয় মাস ধরে। তাদের ক্লাবের এএফসি লাইসেন্স আছে। ভুটানের ক্লাব দলের আন্তর্জাতিক ফুটবলে খেলার সুযোগ আছে। বাংলাদেশে নারী পেশাদার লীগ শুরু করার এখনই সময়। এ ক্ষেত্রে বসুন্ধরাসহ অন্য বড় গ্রুপগুলোর যাতে দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকে এটি নিশ্চিত করা উচিত। এতে নারী ফুটবল এগিয়ে যাবেপাশাপাশি খেলোয়াড়রা আর্থিক নিরাপত্তার বলয়ে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন। অর্থের অভাবে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলকে ফিফার উইন্ডোতে প্রীতি ম্যাচ খেলানো সম্ভব হয় না। এতে খেলোয়াড়দের মান যাচাই এবং অগ্রগতি ও অবনতি নির্ণয় করা সম্ভব হয় না। এর পরও নারী ফুটবলাররা জাদু দেখিয়ে চলেছেন। বেতন বাকি থাকা সত্ত্বেও তাঁরা খেলেন। ফুটবলাররাও বুঝে ফেলেছেন উপায় নেই, তাঁদের লড়তে হবে বিভিন্ন প্রতিকূলতা সত্ত্বেও নিজস্ব অবস্থান থেকে। এতে তাঁদের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা সব সময় ভর করে থাকে। দেশের জন্য যাঁরা এত কিছু করছেন, তাঁদের ভবিষ্যৎ কী?

ফুটবলে প্রচুর সেন্টিমেন্টের ছড়াছড়ি। মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেন্টিমেন্ট যেভাবে ব্যবহার করা হচ্ছেএটি কতটুকু যুক্তিসংগত হচ্ছে ভেবে দেখা উচিত। ব্যক্তিগত দুর্বলতা ও অসহায়ত্ব নিয়ে হাইপ সৃষ্টি করা তো মানবতা নয়। ব্রিটিশ পেশাদার কোচকে বিভিন্ন ধরনের প্ররোচনা ও বিরোধিতার পরিপ্রেক্ষিতে অসম্মান করে ভিলেন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। কোচের বিদায় চাওয়া হয়েছে। কোচ কিন্তু সবকিছুই বুঝেছেন। তিনি নীতি আর আদর্শের প্রশ্নে আপস করেননি। সব সময় বলেছেন, আমার ব্যক্তিগত কোনো অভিলাষ নেই বাংলাদেশে। আমি দেশের ফুটবলের ভালো চাচ্ছি। মেয়েদের ফুটবলের ভালো চাচ্ছি।

নারী দলের অধিনায়ক সাবিনার নেতৃত্বে গত ৩০ জানুয়ারি ব্রিটিশ কোচ পিটার বাটলারের বিরুদ্ধে (২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে নারী জাতীয় দল এই পিটার বাটলারের অধীনে দ্বিতীয়বারের মতো সাফ শিরোপা জিতেছে) বিদ্রোহ ঘোষণা করে বাফুফের অফিসের সামনে সংবাদ সম্মেলন করা হয়েছে। ইংরেজিতে লেখা তিন পৃষ্ঠা পড়ে শোনানো হয়েছে। মেয়েরা সাফ জানিয়েছেন, এই কোচের অধীনে তাঁরা আর খেলবেন না, প্রশিক্ষণ নেবেন না, দরকার হলে সবাই জাতীয় দল থেকে পদত্যাগ করবেন। বাফুফের চুক্তিবদ্ধ খেলোয়াড়রা কি এ ধরনের সংবাদ সম্মেলন করতে পারেন বাফুফের নিযুক্ত হেড কোচের বিরুদ্ধে? তাঁরা বিভিন্ন অভিযোগ উত্থাপনের পাশাপাশি তাঁদের ব্যক্তিগত বিষয়ে কোচের হস্তক্ষেপের কথা বলেছেন। মিডিয়া বিষয়টিকে লুফে নিয়েছে। প্রতিদিনই মেয়েদের বড় কাভারেজ। কোচও কখনো কখনো কথা বলতে বাধ্য হয়েছেন। তাঁর কথা হলো, মেয়েদের অভিযোগগুলো পুরোপুরি অযৌক্তিক। তিনি অন্যায় আবদার, নীতি, আদর্শ, ফিটনেস এবং শৃঙ্খলার প্রশ্নে কখনো আপস করবেন নাআর এটি মেয়েদের ফুটবলের স্বার্থে।

বাফুফের প্রেসিডেন্ট তাবিথ আউয়াল নারী ফুটবলারদের সঙ্গে বারবার বসা সত্ত্বেও সমস্যার আশু সমাধান হয়েছে বলে মনে হয়নি। শেষ পর্যন্ত বাফুফে সিনিয়র সহসভাপতি মো. ইমরুল হাসানের নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দেয়। এই কমিটিতে বাফুফের প্রতিনিধি ছাড়াও বাইরে থেকে সদস্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তদন্ত রিপোর্ট জমা দেওয়ার জন্য সময় দেওয়া হয়েছে সাত দিন। মো. ইমরুল হাসানের নেতৃত্বে কমিটি বিদ্রোহী নারী খেলোয়াড় ও বিদেশি কোচের সঙ্গে ধৈর্য ধরে সময় নিয়ে কথা বলেছে। এরপর তাঁদের বেশ কয়েকটি সুপারিশসহ রিপোর্ট সময়মতো জমা দিয়েছে। এই রিপোর্ট পেশের পর থেকে পর্যবেক্ষকমহল মনে করে, বাফুফের যে ধরনের অবস্থান নেওয়া উচিত সেটি নিয়েছে। বাফুফে পেশাদার কোচের বিষয়ে অন্যায্য অভিযোগ ও আবদারকে প্রশ্রয় দেয়নি। এতে নারী ফুটবলে শৃঙ্খলাহীন কার্যকলাপ, ব্যক্তি ও সমষ্টির স্বার্থে অরাজকতা সৃষ্টির পাঁয়তারার অবসান হয়েছে।

খেলোয়াড়দের কাজ পারফরম করা। পারফরম না করতে পারলে দলে স্থান নেই। কোচের কাছেও প্রত্যাশা হলো রেজাল্ট। এ ক্ষেত্রে ব্যত্যয় হলে কোচের প্রয়োজনীয়তাও শেষ হয়ে যায়। এখন পিটার বাটলারকে নিয়ে এত উচ্ছ্বাসের কারণ হলো, তিনি রেজাল্ট দিতে পারছেন। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর নারী দল ১৪টি খেলায় অংশ নিয়ে সাতটি জিতেছে। তিনটি ড্র করেছে, চারটি হেরেছে। এর মধ্যে আছে চায়নিজ তাইপের বিপক্ষে দুটি এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিপক্ষে দুটি ম্যাচ।

জীবন থেমে থাকে না। কারো জন্য অপেক্ষা করে না। নারী ফুটবলকে তুঙ্গে নিয়ে গেছেন খেলোয়াড়রা এবং ব্রিটিশ কোচ। পারফরম্যান্সের জন্য ১০ জন বিদ্রোহী খেলোয়াড়কেও দলে নিয়েছেন কোচ। তাঁরা কোচের সঙ্গে সুন্দরভাবে মানিয়েও নিয়েছেন। পেশাদার কোচের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে নারী ফুটবলারদের বুঝতে তাঁর সময় লাগেনি। খেলোয়াড়রা কোচ কী চাচ্ছেন, কিভাবে চাচ্ছেন, কেন চাচ্ছেন, তাঁরা বুঝতে পেরেছেন। কোচ পিটার মেয়েদের সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে পেরেছেন। তাঁদের মধ্যে সাহস ও আত্মবিশ্বাসের জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছেন। জ্বালিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন তাঁদের ভেতরের বারুদ। কোচের গেম পরিকল্পনাকে খেলোয়াড়রা একটি দল হয়ে অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছেন বলেই এগিয়ে থাকা দলগুলোর বিপক্ষে লড়াইয়ে কামিয়াব হওয়া সম্ভব হয়েছে।

কোচের লক্ষ্য সব সময় এগিয়ে চলা। তাঁর একটাই দর্শন, ফিফা ফ্রেন্ডলি বা টুর্নামেন্ট খেলতে হবে র্যাংকিংয়ে এগিয়ে থাকা প্রতিপক্ষের বিপক্ষেএতে খেলোয়াড়দের মধ্যে ভয়ডর থাকবে না। তাঁদের সাহস ও আত্মবিশ্বাস বাড়বে। আসল কম্পিটিশনে অংশ নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি ভালো হবে। সবাই এক মন এক প্রাণের অধিকারী হয়ে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত লড়াই করায় ধরা দিয়েছে স্মরণীয় সাফল্য। খেলোয়াড়দের অসাধারণ পারফরম্যান্স নিয়ে আগামী কলামে বিশ্লেষণ করব। খেলোয়াড়, কোচ, টিম ম্যানেজমেন্ট, কোচিং স্টাফসবাইকে অভিনন্দন দেশে অস্থিরতা ও বিভাজনে ভরপুর সময়ে মাঠে দারুণ জয় পুরো জাতিকে আরেকবার ঐক্যবদ্ধ করেছে। রোমাঞ্চকর ফুটবল গল্প অনেক দিন মুখে মুখে থাকবে।

 

লেখক : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি, এআইপিএস এশিয়া। আজীবন সদস্য বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন। প্যানেল রাইটার, ফুটবল এশিয়া

মন্তব্য

ন্যাটোর বর্ধিত প্রতিরক্ষা ব্যয় ও বৈশ্বিক উদ্বেগ

    ড. সুজিত কুমার দত্ত
শেয়ার
ন্যাটোর বর্ধিত প্রতিরক্ষা ব্যয় ও বৈশ্বিক উদ্বেগ

সম্প্রতি পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য দেশগুলোর প্রতিরক্ষা বাজেট অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধির বিষয়টি বিশ্ব উদ্বেগ নিয়ে দেখছে। ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্রগুলো ২০৩৫ সালের মধ্যে প্রতিরক্ষা ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা দ্বিগুণেরও বেশি বাড়িয়ে তাদের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫ শতাংশ নির্ধারণের ব্যাপারে একমত হয়েছে। এই সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্ত শুধু ন্যাটোর নিজস্ব ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা কৌশলই নয়, বরং সমগ্র বৈশ্বিক নিরাপত্তার প্রেক্ষাপটে এক নতুন সমীকরণ তৈরি করতে যাচ্ছে।

ইউক্রেন যুদ্ধ ন্যাটোর সদস্য দেশগুলোকে তাদের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়ানোর এবং সম্মিলিত প্রতিরক্ষাব্যবস্থার প্রতি আরো বেশি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তীব্রভাবে সচেতন করেছে।

এটি শুধু ইউক্রেনের সীমানায় সংঘটিত একটি যুদ্ধ নয়, বরং ইউরোপের স্থিতিশীলতা এবং ন্যাটো জোটের ভবিষ্যৎ অস্তিত্বের ওপর সরাসরি হুমকি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, মধ্যপ্রাচ্যের চলমান উত্তেজনা, সন্ত্রাসবাদের ক্রমাগত হুমকি এবং চীনের ক্রমবর্ধমান সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তিকেও এই সিদ্ধান্তের পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে। ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্রগুলো মনে করে যে এই বহুমুখী হুমকির মুখে তাদের ঐক্যবদ্ধ এবং শক্তিশালী প্রতিরক্ষা অপরিহার্য।

ন্যাটোর নতুন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, সদস্য রাষ্ট্রগুলো ২০৩৫ সালের মধ্যে তাদের জিডিপির ৫ শতাংশ প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তাসংক্রান্ত মূল খাতে ব্যয় বা বিনিয়োগে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে।

এটি ২০১৪ সালে নির্ধারিত ২ শতাংশের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আড়াই গুণ বেশি। এই ৫ শতাংশের মধ্যে অন্তত ৩.৫ শতাংশ ব্যয় করা হবে সরাসরি প্রতিরক্ষার জন্য। অর্থাৎ সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়, গবেষণা ও উন্নয়ন, সৈন্য প্রশিক্ষণ এবং সামরিক অবকাঠামো নির্মাণে। বাকি ১.৫ শতাংশ ব্যয় করা হবে প্রতিরক্ষাসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো, নাগরিক প্রস্তুতি, উদ্ভাবন এবং প্রতিরক্ষা শিল্প খাতের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য।

ন্যাটোর এই পদক্ষেপ বৈশ্বিক নিরাপত্তার প্রেক্ষাপটে এক নতুন সমীকরণ তৈরি করবে, যার বহুমাত্রিক প্রভাব রয়েছে। প্রথমত, ন্যাটোর সম্মিলিত সামরিক সক্ষমতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে। অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র, উন্নত প্রশিক্ষণ এবং শক্তিশালী সামরিক কাঠামো সম্ভাব্য আগ্রাসীদের জন্য একটি শক্তিশালী প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করবে। ইউরো-আটলান্টিক অঞ্চলে ন্যাটোর উপস্থিতি আরো জোরদার হবে, যা এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে আত্মবিশ্বাস বাড়াবে এবং স্থিতিশীলতা আনতে সাহায্য করবে।

দ্বিতীয়ত, ন্যাটোর এই বিশাল প্রতিরক্ষা বাজেট বৃদ্ধি রাশিয়া, চীন এবং তাদের মিত্রদের তাদের নিজস্ব সামরিক ব্যয় আরো বাড়াতে উৎসাহিত করবে।

এর ফলে একটি নতুন বৈশ্বিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হতে পারে, যা ঠাণ্ডা যুদ্ধের সময়ের চেয়েও দ্রুতগতিসম্পন্ন হতে পারে। কারণ বর্তমানে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি অনেক বেশি দ্রুত। এই প্রতিযোগিতা শুধু প্রচলিত অস্ত্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং পারমাণবিক অস্ত্র, সাইবার নিরাপত্তা, মহাকাশ প্রতিরক্ষা এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো আধুনিক সামরিক প্রযুক্তিগুলোতেও এর প্রভাব দেখা যাবে। এই ধরনের প্রতিযোগিতা বিশ্বজুড়ে উত্তেজনা বাড়াবে এবং ভুল-বোঝাবুঝি বা আকস্মিক সংঘাতের ঝুঁকি বহুগুণে বাড়িয়ে দেবে।

তৃতীয়ত, জিডিপির ৫ শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করা বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতিগুলোর জন্য একটি বিশাল আর্থিক বোঝা। এর ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হতে পারে, মুদ্রাস্ফীতি বাড়তে পারে এবং জনসাধারণকে সামাজিক খাতে (যেমনস্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, অবকাঠামো) কম বরাদ্দ নিয়ে চলতে হতে পারে। এই ব্যয়ভার বৈশ্বিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, বিশেষ করে যদি অন্যান্য দেশও একই পথে হাঁটে। এটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

চতুর্থত, ন্যাটোর এই সামরিকীকরণ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য নতুন উদ্বেগ তৈরি করতে পারে। উন্নত দেশগুলো যখন তাদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে মনোযোগী হয়, তখন উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য উন্নয়ন সহায়তা, মানবিক সাহায্য বা আন্তর্জাতিক সহযোগিতা কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ ছাড়া বৈশ্বিক মেরুকরণ বাড়লে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো বড় শক্তিগুলোর প্রতিযোগিতার শিকার হতে পারে এবং তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের ঝুঁকি বাড়তে পারে। পঞ্চমত,  ন্যাটোর এই পদক্ষেপ বিশ্বকে আরো বেশি সামরিক জোটকেন্দ্রিক ও মেরুকৃত করতে পারে। ন্যাটো একটি শক্তিশালী সামরিক জোটে পরিণত হলে এর বিপরীতে রাশিয়া-চীন অক্ষ আরো শক্তিশালী হওয়ার চেষ্টা করবে, যা বিশ্বকে দুটি প্রধান সামরিক ব্লকে বিভক্ত করার দিকে ঠেলে দিতে পারে।

ন্যাটোর বর্ধিত প্রতিরক্ষা বাজেট বিশ্বকে এক নতুন এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই সিদ্ধান্তকে ন্যাটোর অভ্যন্তরীণ ঐক্য ও নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য মনে করা হলেও এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার জন্য গুরুতর চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। সামরিক শক্তি বৃদ্ধি অবশ্যই জাতীয় নিরাপত্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক, তবে তা যেন বৈশ্বিক শান্তি ও সহযোগিতার মূল্যবোধকে ছাড়িয়ে না যায় তা নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক। এই মুহূর্তে সামরিক ব্যয়ের প্রবণতা থেকে সরে এসে কূটনীতি, আলোচনা এবং পারস্পরিক বোঝাপড়ার ওপর জোর দেওয়া পূর্বের চেয়েও বেশি জরুরি। ন্যাটোর এই সিদ্ধান্ত বৈশ্বিক নিরাপত্তায় কী ধরনের নতুন সমীকরণ নিয়ে আসে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে একটি শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল বিশ্ব গড়ার জন্য সব দেশেরই দায়িত্বশীল আচরণ এবং দূরদর্শী পদক্ষেপ প্রয়োজন।

 

লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

datta.ir@cu.ac.bd

মন্তব্য

জুলাই আন্দোলন : প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

    সাঈদ খান
শেয়ার
জুলাই আন্দোলন : প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

শুধু রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণেশুধু ভিন্নমত পোষণ করলেইএকটি রাষ্ট্র যদি তারই নাগরিকদের ধরে নিয়ে যায়, দিনের পর দিন বন্দি করে রাখে, নির্মম, নিষ্ঠুর, অমানবিক এবং অবর্ণনীয় নির্যাতনে হত্যা করে, তারপর নিথর দেহটি পর্যন্ত গোপনে গুম করে ফেলে, তাহলে প্রশ্ন উঠে এই বর্বরতা থেকে রাষ্ট্র কী আনন্দ পায়? রাষ্ট্রের প্রতিনিধি, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিএতটা নিষ্ঠুর কিভাবে হতে পারে? আয়নাঘরের ইতিহাস আমাদের সামনে এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেযেখানে প্রতিটি গুম, প্রতিটি নিষ্ঠুরতা আর প্রতিটি মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মানবতা বারবার হেরে গেছে রাষ্ট্রীয় পাশবিকতার কাছে। এই ভয়ংকর ইতিহাস থেকে কি আগামী দিনের সরকার ও তার নিরাপত্তা বাহিনী কোনো শিক্ষা নেবে? নাকি আগের মতোই নিষ্ঠুরতার ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে? তবে আমরা সেই খুনি রাষ্ট্র দিয়ে কী করব?

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান ছিল দুঃখ-দুর্দশার বিরুদ্ধে জনতার এক অভূতপূর্ব সংগ্রাম। এটি ছিল গণতন্ত্রের পুনর্জন্ম ও বৈষম্যহীন সমতার বাংলাদেশ গড়ার ডাক। এই আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল মানুষের মৌলিক অধিকার, ন্যায়বিচার, মানবিক মর্যাদা, সুশাসন এবং ন্যায্য সমাজ গড়ার প্রত্যাশা।

২০২৪ সালের জুলাই মাসটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে এক উত্তাল ও ঘটনাবহুল অধ্যায়। মানুষের বিশ্বাস জন্মেছিল, ইতিহাস এবার নতুনভাবে লেখা হবে। কিন্তু বছরের শেষ নাগাদ দেখা গেল সেই বিশ্বাস ও বাস্তবতার মাঝে রয়েছে বিস্তৃত ফারাক।

এই গণ-আন্দোলন হঠাৎ গড়ে ওঠেনি।

দীর্ঘ সাড়ে পনেরো বছরের দুঃশাসন, গুম-খুন, ভোটাধিকার হরণ, বিচারহীনতা, দলীয় দমননীতি, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, দুর্নীতি ও সামাজিক বৈষম্য এই আন্দোলনের ভিত্তি রচনা করে। আন্দোলনের পেছনে ছিল বিএনপি, বামপন্থী রাজনৈতিক দল, ইসলামী দল, পেশাজীবী সংগঠন, মানবাধিকার ও নারী সংগঠন, পরিবেশবাদী, প্রবাসী সমাজ, এমনকি সরকারি চাকরিজীবীদের একাংশ ও আওয়ামী লীগের হতাশ কর্মীদেরও সক্রিয় বা নীরব সমর্থন। এটা সবার আন্দোলন

এই আন্দোলনের ফলেই গঠিত হয় একটি অন্তর্বর্তী সরকার।

ড. ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত এই সরকার নিয়ে জনমনে আশা ছিল যে এটি হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক, ভারসাম্যপূর্ণ ও দায়িত্বশীল। কিন্তু ক্রমেই এ সরকারের মধ্যে নির্বাচিত এলিটদের নিয়ে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার প্রবণতা স্পষ্ট হয়। উপদেষ্টা পরিষদে বাদ পড়ে গণ-আন্দোলনের চালিকাশক্তি রাজনৈতিক দল, শ্রমিক, কৃষক, নারী, আদিবাসী ও পেশাজীবীদের প্রতিনিধিত্ব। আন্দোলনকে মেটিক্যুলাস ডিজাইন হিসেবে তুলে ধরে জনতার বাস্তব ভূমিকা অস্বীকার করা হয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে একক নেতৃত্বে আন্দোলনের কৃতিত্ব নির্দিষ্ট করা হয়, যা গণ-আন্দোলনের বহুমাত্রিকতাকে সংকুচিত ও বিকৃত করে।

৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পর নতুন করে শুরু হয় হামলা-মামলা, সন্ত্রাস, খুন, নির্যাতনের ধারা।

গুম হওয়া মানুষ ফেরে না, দুর্নীতি বন্ধ হয় না, অর্থপাচারকারী ধরা পড়ে না, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয় না। জনগণের মৌলিক সমস্যা থেকে শুরু করে পরিবেশ, নিরাপত্তা, খাদ্য ও চিকিৎসাসব কিছুতেই ব্যর্থতার ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রশাসনিক সংস্কারের নামে র্যাব-পুলিশ-আনসারের পোশাক পাল্টানো হলেও চরিত্রের কোনো পরিবর্তন হয়নি।

গণ-অভ্যুত্থানের মূল চেতনা ছিল বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়া। কিন্তু আজও সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। এই পরিস্থিতিতে সংস্কার প্রশ্নেও অস্পষ্টতা দেখা দেয়। সংস্কারকে শুধুই একটি টিক দেওয়ার নীতিপত্রে পরিণত করে ধোঁয়াশাপূর্ণ করে তোলা হয়। নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় নিয়ে সংশয় ও বিভ্রান্তি বাড়ে।

২০২৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি নামে একটি রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করলেও তাদের প্রস্তাবনা ও রাজনৈতিক ভাষা সাধারণ মানুষের বাস্তবতা ও চেতনার সঙ্গে মেলেনি। বাংলাদেশ নামবদলের চিন্তা, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ-এর পরিবর্তে ইনকিলাব জিন্দাবাদ’—এসব প্রচেষ্টা বিভ্রান্তি তৈরি করে। দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র, রিসেট বাটন, নতুন সংবিধান ইত্যাদি ধারণা সাধারণ মানুষের জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন এবং বাস্তবতাবিবর্জিত বলে অনেকে মনে করেন।

দলীয় প্রধান ও সংসদ নেতা আলাদা করা, উচ্চকক্ষ গঠন, ১৭ বছর বয়সে ভোটাধিকারএসব প্রস্তাব সাধারণের কাছে দুর্বোধ্য। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য, সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজকে হুমকি, আর নেতাদের প্রতি অবমাননাকর আচরণ তাদের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তারা হয়ে ওঠে শহুরে শ্রেণির কল্পনানির্ভর এক রাজনৈতিক কাঠামো।

অন্যদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিচারহীনতা, গুম-খুন অব্যাহত, মাজার ও সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা বৃদ্ধি এবং নিরাপত্তা রক্ষায় এই সরকারের অবহেলা সমাজে নিরাপত্তাহীনতার বোধ তৈরি করেছে। উগ্রবাদী গোষ্ঠী ও সহিংস কর্মকাণ্ড সরকারের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ব্যর্থতার জ্বলন্ত প্রমাণ। অভ্যুত্থানের পর ১১ মাস ধরে চলা মব কালচার, দমন-পীড়ন, প্রতিহিংসামূলক হামলাএগুলো স্পষ্ট করে জনগণের বিজয়ের পরও শাসনযন্ত্রের ব্যর্থতা। স্বৈরাচার ও তাদের দোসরদের বিচার না হওয়ায় জনগণ বেআইনি পথে ঝুঁকছে। মানুষ বুঝতে পারছে, আন্দোলন সফল হলেও ক্ষমতা কাঠামোর বদল না ঘটলে কোনো অর্থ নেই।

এই পরিস্থিতিতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বারবার বলেছেন, নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই, নির্বাচনই একমাত্র বিকল্প। তিনি অন্তর্ভুক্তিমূলক, গ্রহণযোগ্য এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণে পরিচালিত নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার আহবান জানান। তাঁর মতে, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে একটি বৈধ, জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার প্রয়োজন।

গণতন্ত্র শুধু একটি শাসনব্যবস্থা নয়; এটি মানুষের অধিকার, মর্যাদা এবং নিরাপত্তার প্রতীক। গণতন্ত্রের ভিত্তি হলো জনগণের মতামত এবং অংশগ্রহণ। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্রকে বহুবার বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে। প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পেছনে সাধারণ মানুষের যে ত্যাগ, তা শুধু সুশাসন এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করলেই সার্থক হবে।

২০২৪ সালের এই আন্দোলনের চূড়ান্ত অর্জন হতে পারে স্থায়ী রাজনৈতিক সমঝোতা, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনব্যবস্থা ও গণভিত্তিক সরকার। সংস্কার ছাড়া নির্বাচন নয় কিংবা আগে নির্বাচন তারপর সংস্কারএই বিতর্কের বাইরে বাস্তবতা হলো : সংস্কার ও নির্বাচন উভয়ই জরুরি। কারণ জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত না হলে সুশাসন ও গণতন্ত্র টেকসই হয় না। ১৯৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন ও ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান প্রমাণ করে জনগণই প্রধান শক্তি। তারা ভোট, মতপ্রকাশ ও আন্দোলনের মাধ্যমে নেতৃত্ব বদলায়, জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করে।

এ জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় প্রথমেই সংস্কার দরকার, যাতে অবাধ ও গ্রহণযোগ্য ভোট হয়। সুনির্দিষ্ট নির্বাচনী রোডম্যাপ ছাড়া গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও নেতৃত্ব গড়া সম্ভব নয়। অতএব জনগণের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচিত, জবাবদিহিমূলক সরকার ও সংসদ গড়াই হবে অন্তর্বর্তী সরকারের যাবতীয় সংস্কার কার্যক্রমের প্রাথমিক ও প্রধান লক্ষ্য। কারণ রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ছাড়া সংস্কার কখনোই কার্যকর ও টেকসই হয় না।

জুলাই আন্দোলন আমাদের শেখায়গণ-আন্দোলন যদি জনগণের দ্বারা গড়ে ওঠে, তবে তার ফসলও হতে হবে জনগণের হাতে।

 

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সাংগঠনিক সম্পাদক, ডিইউজে

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ