অথচ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় যত মৌলিক আদর্শ কাজ করেছে তার মধ্যে সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশ হবে একটি সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের মডেল হবে বাংলাদেশ। এটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন। বঙ্গবন্ধু আমাদের হুঁশিয়ার করে গেছেন। ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের প্রাক্কালে তিনি বলেছিলেন, অসাম্প্রদায়িক আদর্শ সুপ্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে বাংলাদেশকে রক্ষা করা যাবে না। ৫১ বছরের মাথায় এসে বঙ্গবন্ধুর সেই হুঁশিয়ারি ও স্বপ্নের বাস্তব চিত্রটা কী? গত দুর্গাপূজার সময়ে সংঘটিত ঘটনার পরম্পরা, ২০১২ সালের কক্সবাজারের রামুর ঘটনা, ২০১৬ সালের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের ঘটনা, ২০১৯ সালের সুনামগঞ্জের সালমার ঘটনা, ২০২১ সালের মার্চ মাসের ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হেফাজতের তাণ্ডব ও সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা এবং তার পরম্পরা সবাই দেখেছে।
প্রসঙ্গক্রমে কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করলাম। বিগত দিনে সংঘটিত আরো অনেক ছোট-বড় ঘটনা আছে। এসব ঘটনার বিচার-বিশ্লেষণে আমরা কি বলতে পারছি, ৫১ বছরে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনে সামনের দিকে এগিয়েছি। সাম্প্রদায়িকতা বেড়েছে, না কমেছে? যদি বেড়ে থাকে, তাহলে আমরা কী করলাম? উপরোল্লিখিত বড় ঘটনাগুলোতে শুধু ধর্মান্ধ উগ্রবাদী গোষ্ঠী নয়, স্থানীয় সব রাজনৈতিক দলের লোকজন আক্রমণে অংশ নিয়েছে এবং স্থানীয় প্রশাসনের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা স্পষ্টভাবে সামনে এসেছে। অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক পক্ষগুলোর ভেতরে যখন সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, অযৌক্তিকতা ও অন্ধবিশ্বাস ঢুকে পড়ে, তখন সেটাকে মহাবিপদ সংকেতই বলতে হবে।
এবার সাম্প্রতিক ঘটনাবলির ওপর একটু আলোকপাত করি। কয়েক দিন আগে খোদ ঢাকা শহরে একজন হিন্দু নারী, কলেজ শিক্ষিকা কপালে টিপ পরার কারণে ইউনিফর্ম পরা এক পুলিশ সদস্যের গালিগালাজের শিকার হয়েছেন। আরেকজন পুলিশ কর্মকর্তা ওই অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যকে সমর্থন করে পোস্ট দিয়েছেন। দুজনের বিরুদ্ধেই পুলিশ কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিয়েছে। সেটা এক কথা। তবে অন্য কথা হলো, ভাতের হাঁড়িতে একটা চালে টিপ দিয়ে যেমন হাঁড়ির ভেতরের সব চালের অবস্থা বোঝা যায়, তেমনি এই ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে না করে বৃহত্তর সমাজ ও রাষ্ট্রের জায়গায় বসিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, মানুষের মনোজগতের চিত্রটা আজ কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে। আমাদের প্রজন্মের মানুষ আমরা দেখেছি ৫০ বছর আগে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান নারী ও মেয়েরা কপালে টিপ দিত। এখন সেই চিত্র অবশ্য বদলে গেছে। কিন্তু কেন। কোথায় লেখা আছে কপালে টিপ দেওয়া ইসলাম ধর্মে নিষেধ।
সম্প্রতি মুন্সীগঞ্জের শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের শ্রেণিকক্ষে শিক্ষাদানকে কেন্দ্র করে উদ্দেশ্যমূলকভাবে এবং উত্তরবঙ্গে একটি স্কুলে হিজাব পরা সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টা হয়েছে। হিজাব পরা না পরা প্রত্যেকের নিজস্ব স্বাধীন পছন্দের বিষয়। এ নিয়ে আমাদের কোনো মন্তব্য নেই।
সাধারণ মানুষ সত্যি অসহায়। কোনটা ধর্ম আর কোনটা ধর্ম নয়। কারা ধর্মের নামে অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টা করছে, তা সাধারণ মানুষ বুঝবে কী করে, কোনো পথ তো কেউ দেখাতে পারছে না।
সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদের কথায় ফিরে আসি। সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদ পরস্পরের পরিপূরক আর জঙ্গিবাদের প্রাথমিক স্তর ও সহায়ক হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা ও উগ্রবাদের যে চিত্র আজকে দেখতে পাই তার সঙ্গে ৫০ বছরের আগের চিত্রটির যদি তুলনা করি, তাহলে বোঝা যায় সাম্প্রদায়িকতার ভয়াবহতা কত গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ হওয়া উচিত ছিল এর বিপরীত। স্বল্পপরিসরে বিস্তারিত লেখা যাবে না। শুধু আমার নিজের দেখা কিছু অভিজ্ঞতার কথা সামান্য উল্লেখ করি। পাকিস্তান সাংবিধানিকভাবে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ছিল। কিন্তু সমাজের প্রকৃত চিত্রটি ছিল ভিন্ন।
এখন দশা হয়েছে, কাজির গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই। আমি যে এলাকার মানুষ, আমার জন্ম যে গ্রামে তার পাশাপাশি সাত-আটটি গ্রামের মধ্যে কার্তিক মাস থেকে শুরু করে চৈত্রসংক্রান্তি পর্যন্ত ডজনের ওপর মেলা হতো। শত শত কী, হাজার হাজার নারী-পুরুষ, বালক-বালিকার সমাবেশ ঘটত। কোথাও কোনো দিন একটি অশান্তির ঘটনা ঘটতে দেখিনি। কোনো মেলায়ই একবারও পুলিশ পাহারা দিতে আসেনি। কত আনন্দ-উৎসব। অশান্তি ঘটতে পারে—এমন প্রশ্ন কখনোই কারো মনে আসেনি। তখন আমাদের মহকুমা শহর গোপালগঞ্জে প্রতিবছর কার্তিক মাসে মাসব্যাপী মেলা হতো। প্রতিদিন রাতে একেকটি ভিন্ন ভিন্ন যাত্রাপালা হতো। একটি অশান্তির ঘটনাও ঘটেনি। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এভাবে চলছিল।
এখন এসবের আর কিছুই হয় না। ১৯৭৫ সালের পর সব কিছু যেন কিভাবে দ্রুত পরিবর্তন হয়ে গেল। বাংলাদেশে বহু সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন রয়েছে, যারা সেই পাকিস্তান আমল থেকে অসাম্প্রদায়িক আদর্শকে রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য কাজ করে চলেছে। এর পরও সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, অযৌক্তিকতা ও অন্ধবিশ্বাসের বিস্তার বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, রাশ টেনে ধরা যায়নি। এত কাজ করার পরও কেন এমনটি হয়ে যাচ্ছে তার নির্মোহ বিচার-বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নপত্র তৈরি করা প্রয়োজন।
যেহেতু এত কাজ করার পরও সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বগতি থামছে না, সেহেতু বলা যায় আমাদের কার্যকলাপের ধরন, প্রকার, কৌশলসহ অবজেকটিভ নির্ধারণে ঘাটতি ও গলদ রয়েছে। সবাই গতানুগতিকতার মধ্যে থাকতে চায়। কিন্তু তাতে যে কাজ হচ্ছে না, সেটি উপলব্ধি করা প্রয়োজন। শর্টকাট পন্থায় এত বড় সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে না। এখন সব কিছু বাগ্মিতা ও প্রচারসর্বস্ব হয়েছে। এতে মানুষের মনোজগতের ওপর কতটুকু প্রভাব ফেলছে তার কোনো হিসাব করতে কেউ ইচ্ছুক নয়। কিছু লোক জড়ো করে গত্বাঁধা কিছু কথার পুনরাবৃত্তি করতে পারলে এবং তা যদি একটু মিডিয়ায় প্রচারিত হয়, তাহলেই আমরা মনে করি বিশাল কিছু করে ফেলেছি। চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জিত হয়ে গেল।
আত্মবিশ্লেষণ নয়, গতানুগতিকতাই অবলম্বন। এতে যে কিছুই হয়নি, সেটি তো ৫০ বছরে প্রমাণিত হয়ে গেছে। সুতরাং নতুন করে ভাবতে হবে। একজন মানুষ সাম্প্রদায়িক, তার মানে এই নয় যে সে জঙ্গি। তবে সাম্প্রদায়িক মনোভাবের মানুষের সংখ্যা সমাজ ও রাষ্ট্রে যত বৃদ্ধি পায়, ততই সেটি জঙ্গিবাদের লক্ষ্য পূরণে প্রত্যক্ষভাবে সহায়ক ভূমিকা রাখে এবং প্রভাব ফেলে, যার অনেক উদাহরণ রয়েছে। একটি সুনির্দিষ্ট ঘটনা বলি। ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের গোলচত্বরে লালনের একটি ভাস্কর্য ছিল। ২০০৮ সালে কিছু মাদরাসার ছাত্র এটি সরিয়ে ফেলার দাবি তুলে স্লোগান দিতেই সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ বাঙালি সংস্কৃতির ধারক, বাহক ও ঐতিহ্যের স্মারক লালনের ভাস্কর্যটি ভেঙে ফেলল। অথচ সংবিধানের ২৩ অনুচ্ছেদ অনুসারে এটি রক্ষা করা সিভিল এভিয়েশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব ছিল। কয়েকজন মাদরাসাছাত্রের স্লোগানের মুখে তারা সেদিন যা করল তার জন্য তাদের কোনো জবাবদিহির সম্মুখীন হতে হয়নি। কেউ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেনি। সবাই হয়তো ভেবেছে, তারা ধর্ম রক্ষার কাজ করেছে।
ধর্মান্ধ জঙ্গিবাদীরা এটাই চায়। সবার জঙ্গি হওয়ার প্রয়োজন নেই। জঙ্গিবাদের প্রধান লক্ষ্য সাম্প্রদায়িকতার অযৌক্তিকতায় সমাজ ও রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনোজগেক আবদ্ধ করা। তাহলেই আত্মনিবেদিত ও আত্মবিসর্জনে শপথবদ্ধ স্বল্পসংখ্যক জঙ্গিই তাদের লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হবে। ধর্মের নামে মানুষ নিশ্চুপ থাকলেই যথেষ্ট। এটাই তাদের কৌশল। সংবিধানে যা কিছুই লেখা থাকুক না কেন, তাণ্ডব ঘটিয়ে, রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে, সব কিছু অচল করার হুমকি দিয়ে দাবি আদায় করতে পারলেই তো তাদের লক্ষ্য অর্জিত হয়ে গেল। অন্য কিছু করার দরকার নেই। এই পথে তারা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। তাদের এই এগিয়ে যাওয়া অব্যাহত থাকলে বঙ্গবন্ধুর সেই সতর্কবাণী, অসাম্প্রদায়িক আদর্শ সুপ্রতিষ্ঠা করতে না পারার কারণে বাংলাদেশের অস্তিত্ব মহাসংকটে পড়বে। সুতরাং পহেলা বৈশাখের আগের দিন ঢাকা পুলিশ কর্তৃপক্ষ জঙ্গি আক্রমণের যে তথ্য দিয়েছে, সেটাকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই।
লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
sikder52@gmail.com