গত ১৭ জানুয়ারি অনেকটা আকস্মিকভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২’-এর খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়। এরপর ২৩ জানুয়ারি খসড়াটি বিল আকারে সংসদে উত্থাপন করা হয় এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়।
গণমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী, সংসদীয় কমিটি এক দিনের মধ্যেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দুটি বিষয়ে পরিবর্তন এনে জাতীয় সংসদে পাঠানোর জন্য প্রতিবেদন প্রস্তুত করে। কমিশনারদের যোগ্যতার ক্ষেত্রে সরকারি, বিচার বিভাগীয়, আধাসরকারি বা বেসরকারি পদের পাশাপাশি ‘স্বায়ত্তশাসিত ও অন্যান্য পেশা’ যুক্ত করা হয়েছে।
আর কমিশনারদের অযোগ্যতার ক্ষেত্রে নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে অন্যূন দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার স্থলে ‘যেকোনো মেয়াদে সাজা হলেই তিনি সিইসি এবং ইসি হওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। তবে দণ্ড বলতে কারাদণ্ড হতে হবে’—এই ধারা যুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ নামমাত্র দুটি বিষয় পরিবর্তন করে প্রস্তাবিত খসড়ার পুরোটাই আইন আকারে পাস করেছে সরকার।
বহুল প্রতীক্ষিত ইসি নিয়োগের আইন প্রণয়ন আশাব্যঞ্জক হলেও সব অংশীজনের মতামত গ্রহণ ব্যতীত এ রকম জনগুরুত্বপূর্ণ একটি আইন পাস কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
মাননীয় মন্ত্রী নিজেও বলেছেন : ‘এই আইনটা এমন একটি আইন হওয়া উচিত, যেটা গ্রহণযোগ্য হবে সবার কাছে। শুধু এক দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হলে তো এটা সর্বজনীন আইন হলো না।’ তাই হঠাৎ করে এভাবে আইনের অনুমোদনকে আইন প্রণয়নের মূল উদ্দেশ্য থেকে সরে গিয়ে পঞ্চাশ বছরে প্রথমবারের মতো আইন প্রণয়নের কৃতিত্ব নেওয়ার উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে বলে অনেকে মনে করেন।
অনুমোদিত খসড়া বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, খসড়া আইনটির সঙ্গে অনুসন্ধান কমিটির জন্য ২০১৭ সালের ২৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির জারি করা প্রজ্ঞাপনের পার্থক্য নেই বললেই চলে।
কত সদস্যের কমিটি গঠিত হবে, কমিটির সদস্য কারা হবেন, কমিটির ওপর অর্পিত দায়িত্ব, কমিটির কার্যদিবস, কমিটির কোরাম গঠন, প্রতি পদের বিপরীতে সুপারিশকৃত নামের সংখ্যা, সাচিবিক সহায়তা—এই বিষয়গুলো পাস হওয়া আইনে এবং ২০১৭ সালের প্রজ্ঞাপনে অভিন্ন। কমিটির কার্যাবলির ক্ষেত্রে নাম আহ্বানের বিষয়টি যোগ হয়েছে।
২০১৭ সালের প্রজ্ঞাপন এবং সংসদে পাস হওয়া আইন তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এটি নির্বাচন কমিশন গঠনের নয়, অনুসন্ধান কমিটি গঠনের আইন। অনুসন্ধান কমিটি গঠনের জন্য রাষ্ট্রপতির জারি করা নির্দেশনাকে আইনি মোড়ক দেওয়াই যেন এর উদ্দেশ্য। এই পদ্ধতি অনুসরণ করে গঠিত দুটি কমিশনের অভিজ্ঞতা দেশবাসীর জন্য মোটেও সুখকর ছিল না।
তাই নতুন মোড়কে পুরনো রীতির প্রচলন কোনো সুফল বয়ে আনবে বলে মনে হয় না। পুরনো পথে হেঁটে নতুন গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়।
সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগের জন্য গঠিত অনুসন্ধান কমিটি কিভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে সম্প্রতি দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিচারপতি আব্দুল মতিন কিছুটা আলোকপাত করেছেন। তিনিই প্রথম দুর্নীতি দমন কমিশন নিয়োগের সার্চ কমিটিতে সদস্য এবং পরবর্তী মানবাধিকার কমিশন ও তথ্য কমিশন নিয়োগসংক্রান্ত সার্চ কমিটিতে চেয়ারম্যান ছিলেন। তাঁর অভিজ্ঞতা হলো : ‘এ ব্যবস্থায় চেয়ারম্যান বা সদস্যদের করার তেমন কিছুই থাকে না। কয়েকটি খামের মধ্যে ক্যাবিনেট ডিভিশন দ্বারা সরকার-পছন্দ কিছু ব্যক্তির জীবনবৃত্তান্ত ধরিয়ে দেওয়া হয়। এর বাইরে যাচাই-বাছাই করার কোনো সুযোগ দেওয়া হয় না’।
নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। নির্বাচনের মতো একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল প্রক্রিয়া তদারকির দায়িত্ব সংবিধান এই প্রতিষ্ঠানটির ওপর ন্যস্ত করেছে। তাই কমিশনে সৎ, যোগ্য ও সাহসী ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়ার আইনি কাঠামো তৈরিই নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইনের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত, যাতে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা যেকোনো পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অটল থাকেন। আর এই উদ্দেশ্য পূরণ করতে হলে অনুসন্ধান কমিটির কার্যাবলিকে অনেক চুলচেরা বিশ্লেষণ ও নজরদারির মধ্য দিয়ে যেতে হবে। সত্যিকারের অনুসন্ধান চালিয়ে স্বচ্ছতার সঙ্গে সৎ, যোগ্য, নিরপেক্ষ ও সাহসী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে আনতে হবে, যাতে তাঁরা আইনি ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে নৈতিকতা ও সাহসিকতার সঙ্গে তাঁদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারেন।
জাতীয় সংসদে পাস হওয়া আইনে অনুসন্ধান কমিটিকে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করে দায়িত্ব পালনের কথা বলেও এই নীতি বাস্তবায়ন ও নিশ্চিতের ব্যাপারে একেবারেই নিশ্চুপ। বরাবরের মতো কমিটি কাদের নাম সুপারিশ করছে, কিভাবে সেসব নাম বাছাই করা হয়েছে—তা জনসমক্ষে প্রকাশের কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা রাখা হয়নি। ফলে নিয়োগের পুরো প্রক্রিয়া সম্পর্কে জনগণ অন্ধকারেই থেকে যাবে, যা একটি গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য কাম্য নয়।
প্রস্তাবিত খসড়ায় কমিশনারদের যোগ্যতা-অযোগ্যতার যে মাপকাঠি নির্ধারণ করা হয়েছে তা সবই দালিলিক প্রমাণের বিষয়। কেউ বাংলাদেশের নাগরিক কি না, বয়স ৫০ বছর হয়েছে কি না, ২০ বছর কাজের অভিজ্ঞতা আছে কি না কিংবা খসড়ায় উল্লিখিত অযোগ্যতার আওতায় পড়েন কি না—তা কিছু দালিলিক কাগজপত্র পরীক্ষা করলেই যাচাই করা সম্ভব। কিন্তু একজন ব্যক্তি যোগ্যতা-অযোগ্যতার মাপকাঠিতে উতরে যাওয়ার পরও কমিশনার হওয়ার জন্য তিনি কী কী বিশেষ যোগ্যতা বা গুণের অধিকারী—এটাই মূল বিচার্য বিষয়।
নির্বাচন কমিশনার হিসেবে অর্পিত দায়িত্ব পালনের জন্য প্রশাসনিক দক্ষতার চেয়েও বেশি প্রাসঙ্গিক যোগ্যতা হলো ব্যাবহারিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা বা ফ্রোনেসিস (Phronesis)। গ্রিক শব্দ ‘ফ্রোনেসিস’ বলতে রাষ্ট্রীয় ও জনগুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রজ্ঞা, ব্যাবহারিক বোঝাপড়া, দূরদর্শিতা এবং সঠিক বিচারের যথাযথ প্রয়োগ করে উদ্ভূত পরিস্থিতিকে মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জ্যপূর্ণ রেখে সামাল দেওয়ার যোগ্যতাকে বোঝায়। নির্বাচনের মতো এত বড় একটি কার্যক্রম পরিচালনা করতে গেলে নির্বাচন কমিশনারদের প্রতিনিয়ত এই যোগ্যতার পরীক্ষা দিতে হয়। এসব গুণসম্পন্ন ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে হলে শুধু দালিলিক প্রমাণাদি পরীক্ষা করলেই হবে না, অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে নানা পদ্ধতি অনুসরণ করে যাচাই-বাছাই করতে হবে। জনগণ ও অংশীজনদের অন্ধকারে রেখে যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হলে নিয়োগপ্রক্রিয়া নিয়ে সন্দেহ ও অবিশ্বাস থেকেই যাবে। কারণ নাম সুপারিশের ক্ষেত্রে যথাযথভাবে সঠিক ব্যক্তিদের অনুসন্ধান ও যাচাই-বাছাই করা হয়েছে, নাকি সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশেই নিয়োগ সম্পন্ন করা হয়েছে সে সম্পর্কে নাগরিকরা অন্ধকারে থেকে যাবে। তাই নিয়োগপ্রক্রিয়া নিয়ে সন্দেহ ও অবিশ্বাস যথাযম্ভব কমিয়ে এনে সবার জন্য কল্যাণকর একটা সর্বজনীন সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্যই কমিটির কার্যাবলিকে স্বচ্ছ রাখাসহ যাচাই প্রক্রিয়ায় নাগরিক ও রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি।
নতুন আইনে অনুসন্ধান কমিটির কাজের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে অনুসন্ধান কমিটির সদস্য সাতজন রাখা যেত। যাচাই প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দলের সম্পৃক্ততা রাখার জন্য কমিটিতে তিনজন সংসদ সদস্য রাখা যেত। এ ছাড়া নাগরিক সমাজের একজন এবং গণমাধ্যমের একজন প্রতিনিধিও রাখা যেত।
জাতীয় সংসদে পাস হওয়া আইনের সঙ্গে সুজন প্রস্তাবিত খসড়ার বড় পার্থক্য হলো—সুজন প্রস্তাবিত খসড়ায় কমিটির কার্যাবলির স্বচ্ছতা নিশ্চিতের জন্য নামের তালিকা প্রকাশ এবং যাচাই প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিতের জন্য গণশুনানির বিধান রাখা ছিল। কমিটির নাম যাচাই প্রক্রিয়াকে আরো পুঙ্খানুপুঙ্খ করার লক্ষ্যে দুই ধাপে নামের তালিকা প্রকাশের বিধান রাখা হয়েছে—১৫ থেকে ২০ জনের একটি প্রাথমিক তালিকা এবং সাতজনের চূড়ান্ত তালিকা। শুধু তা-ই নয়, সুজন প্রস্তাবিত খসড়ায় যাচাই প্রক্রিয়া সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশের বাধ্যবাধকতাও রাখা হয়েছে। রাখা হয়েছে কমিটির সভার পূর্ণাঙ্গ কার্যবিবরণী এবং সদস্যদের ভোট প্রদানের তথ্য লিপিবদ্ধ ও সংরক্ষণের বিধান। কোনো নাগরিক যদি কমিটির সভার কার্যবিবরণীর অনুলিপি পাওয়ার জন্য আবেদন করেন, তবে অনতিবিলম্বে তা প্রদান করার বিধান রাখা হয়েছে, যাতে নাগরিকদের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত হয়।
আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় দায় না নেওয়া এবং দায় থেকে মুক্তি লাভের দৃষ্টান্ত রয়েছে। রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক ও সুশাসনের ভিত্তির ওপর শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে হলে দায়মুক্তি দেওয়ার এই ধারা থেকে বেরিয়ে এসে জবাবদিহিমূলক একটি ব্যবস্থা সৃষ্টি করতে হবে।
নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়াকে যথাসম্ভব বিতর্কমুক্ত রাখা এবং স্বচ্ছতার ভিত্তিতে নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্যই নাগরিক সমাজ দীর্ঘদিন ধরে কমিশনার নিয়োগের আইন প্রণয়নের দাবি করে এসেছে, যাতে ভবিষ্যতে অনুষ্ঠেয় সব নির্বাচন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়। একটি আইন করে পুরনো প্রক্রিয়াকে নতুন মোড়ক দিলে সে উদ্দেশ্য তো পূরণ হবেই না, উল্টো বিতর্ক সৃষ্টি করবে।
অবাধ, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ ও একটি অর্থবহ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইনই যথেষ্ট নয়। এ জন্য প্রয়োজন আইনি ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে নৈতিকতা ও সাহসিকতার সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের কাজ করা; সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে সরকারের সদিচ্ছা ও নির্বাচনসংশ্লিষ্ট সব অংশীজনকে নিজ নিজ অবস্থানে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করা।
লেখক : সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)