ঢাকা, বুধবার ০৯ জুলাই ২০২৫
২৪ আষাঢ় ১৪৩২, ১৩ মহররম ১৪৪৭

ঢাকা, বুধবার ০৯ জুলাই ২০২৫
২৪ আষাঢ় ১৪৩২, ১৩ মহররম ১৪৪৭
দিল্লির চিঠি

সীমান্ত হত্যা বন্ধে দুই দেশের বোঝাপড়া জরুরি

  • জয়ন্ত ঘোষাল
অন্যান্য
অন্যান্য
শেয়ার
সীমান্ত হত্যা বন্ধে দুই দেশের বোঝাপড়া জরুরি

১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি।

কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেদিনের সেই ঐতিহাসিক বক্তৃতার শুরুতেই বলেছিলেন, ‘আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ভারত-বাংলাদেশের বন্ধুত্ব চিরকালের জন্য থাকবে। পৃথিবীর কোনো ক্ষমতা কখনোই এই সমঝোতা, এই ঐক্যে কোনো রকম চিড় ধরাতে পারবে না।

কোনো সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, ভারত এবং বাংলাদেশের ভূখণ্ডে আর কোনো দিন প্রবেশ করতে পারবে না।’ বঙ্গবন্ধুর এই যে প্রত্যাশা, আজ ৫০ বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও আবার আমাদের মনে করতে হচ্ছে, ভাবতে হচ্ছে যে যেসব জায়গায় সম্পর্কের ফাটল দেখা দিতে পারে বা দেখা দিচ্ছে সেগুলো দ্রুত মেরামত করা প্রয়োজন।

বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তব্যের মাধ্যমে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, আমার বাংলাদেশ তিতুমীরের বাংলাদেশ, আবার সূর্যসেনের বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশের ভূখণ্ড সুভাষ বসু থেকে ফজলুল হক, এমনকি সোহরাওয়ার্দীরও বাংলাদেশ।

এই রকম একটা ঐক্যের বার্তা দিয়ে তিনি সেদিন পাকিস্তানের আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করেছিলেন। আজ এত বছর পর, বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান যখন বলছেন, দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত হত্যা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন।

সীমান্তে সংঘর্ষ কেন হবে? কেন বিজিবি ও বিএসএফের মধ্যেও সংঘাত সৃষ্টি হবে? কেন সেখানে নিরীহ বাংলাদেশের মানুষকে নির্মমভাবে লিথাল অস্ত্র দিয়ে হত্যা করা হবে? আবার বিএসএফের জোয়ানরা, যাঁরা একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, যাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য ভারতের আধাসামরিক বাহিনী হিসেবে কাজ করেছিল, আজ তারা কেন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সক্রিয় হবে? আর কেনই বা বিএসএফের কর্মীরাও নিহত হবে? দুই দেশের মধ্যে সীমান্তবর্তী এলাকার এই যে উদ্বেগ, তা অবিলম্বে মীমাংসা হওয়া প্রয়োজন।

দুই দেশেরই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে এই বিএসএফ ও বিজিবির নিয়মিত বৈঠক হয়।

কখনো বিজিবি দিল্লিতে আসে, বিএসএফ কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে। আবার কখনো বিএসএফ ঢাকায় গিয়ে বিজিবি প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে। যে বিএসএফের জোয়ানরা বিপদের ঝুঁকি নিয়ে, নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন পাকিস্তানি অনুপ্রবেশকারী রুখতে, পাকিস্তানের অপরাধীদের নির্মমভাবে সাজা দিতে, সেই বিএসএফের বিরুদ্ধেই আবার অভিযোগ ওঠে যে তারা অনুপ্রবেশকারীর নাম করে নিরীহ বাংলাদেশিদের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে।

এসব অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগ যে চলতে থাকে, এর ফলে অনেক সময় বৃহৎ পররাষ্ট্রনীতিতে তার কালো ছায়া পড়ে। যেমন—বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, বাংলাদেশের একজন ব্যবসায়ীকে অন্যায়ভাবে বিএসএফ ধরে নিয়ে গেছে।

আবার ভারতের পক্ষ থেকে অভিযোগ করে বলা হচ্ছে, যেসব বাংলাদেশিকে বিএসএফ আক্রমণ করে, তারা চোরাকারবারি, তারা অন্যায়ভাবে ভারতের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করে বলেই তাদের ধরা হচ্ছে এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।

দুই দেশের মধ্যে আজ যা পরিস্থিতি এসে দাঁড়িয়েছে, তাতে বারবার এটাই মনে হচ্ছে যে আলোচনার মাধ্যমে এই বিষয়টার মীমাংসা হওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলেছেন, সীমান্ত হত্যা বন্ধ হওয়া দরকার। ভারতের পক্ষ থেকেও বলা হচ্ছে, দুই দেশের সরকারই কিন্তু এ ধরনের সন্ত্রাসকে চায় না বা তারা কোনোভাবে মদদ দিচ্ছে না, তবু এই রকম ঘটনা ঘটে।

আমার মনে হয়, ডাণ্ডা দিয়ে ঠাণ্ডা করে দেব—এই মানসিকতা থেকে কিঞ্চিৎ বেরোতে হবে। দুই দেশের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন হচ্ছে। দুই দেশের মধ্যে একটা সুষ্ঠু বোঝাপড়া দরকার। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি হলেও যেমন এখনো অনেক বাংলাদেশি নাগরিকের ভারতে আসার প্রয়োজনীয়তা থাকে, সেরকমই আবার অনেক ভারতীয়রও বাংলাদেশে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা থাকে। যেকোনো কারণে হোক, এ ক্ষেত্রে দুই দেশের ভিসার যে নীতি, তাতেও অনেক আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দেখা দিয়েছে। সেই জটিলতার ফাঁসগুলো মেরামত করার জন্য দুই দেশের হাইকমিশনের পক্ষ থেকে এই ভিসাসংক্রান্ত সমস্যাগুলোর মীমাংসা হওয়া প্রয়োজন। ভারতের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তারা তাদের ভিসানীতি অনেকটাই শিথিল করেছে। তা সত্ত্বেও এখনো বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ভারতকে এ ব্যাপারে আরো অনেক বেশি উদার হতে হবে। কেননা ভারত তুলনামূলকভাবে বড় দেশ বলে বাংলাদেশের নাগরিকদের ভারতে আসার প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি।

আসাদুজ্জামান খান একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ এমন একটা জায়গায় অবস্থিত, যেখানে একটা সুদীর্ঘ সীমান্ত আছে। ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্ত সুবিশাল এবং এটা একটা ঐতিহাসিক সীমান্তও বটে। এত বড় সীমান্তের মধ্যে বাংলাদেশের মতো আয়তনে ছোট একটা দেশের টিকে থাকা খুব একটা সহজ কাজ নয়। এখানে সীমান্ত সব সময়ই সংবেদনশীল। কাজেই সব রকম সমস্যারও মীমাংসা হওয়া খুব জরুরি। এ ব্যাপারে দুই দেশের মধ্যে সংঘাত যাতে আর না বাড়ে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। গুলি চালিয়ে একজন চোরাকারবারিকে নিহত করা যেতে পারে, কিন্তু তাতে কি মূল সমস্যার সমাধান হচ্ছে? মূল সমস্যার সমাধান করতে গেলে আলোচনার পথে আসতে হবে। কূটনীতির পথেও এই মুহূর্তে ভারতের কিন্তু বাংলাদেশকে প্রয়োজন এবং বাংলাদেশেরও যে ভারতকে প্রয়োজন, সে ব্যাপারে তো কোনো সন্দেহ নেই। সেই কারণে আজ আরো বেশি করে এ বিষয়ে দুই দেশের আলোচনা করা প্রয়োজন। যদিও দুই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পক্ষ থেকেও অনেক আলোচনা হয়েছে এবং আরো আলোচনা হওয়া প্রয়োজন।

ভারত এবং বাংলাদেশের সীমান্ত চার হাজার ৯৬ কিমি। আমাদের দুর্ভাগ্য যে দুই দেশেরই বিভাজন ১৯৪৭ সালে হয়েছে। সেখানে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির চাপিয়ে দেওয়ার ব্যাপার ছিল। আমি গাজা স্ট্রিপে দেখেছি, ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের মধ্যে যে সীমারেখা, সেটা খুব সুনির্দিষ্ট একটা সীমারেখা। অন্যদিকে ভারত এবং বাংলাদেশের সীমান্তে নদী ও সমতল ভূমি দুই দেশের মধ্যে এমনভাবে জড়িয়ে রয়েছে যে এই সীমান্তবর্তী এলাকায় অস্বাভাবিকভাবে দুই দেশের মানুষেরই বসবাস রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, এই দুই দেশের মধ্যে বসবাসকারী মানুষদের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও জাতিগতভাবে অনেক বেশি সাযুজ্যও আছে। এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই আবেগতাড়িত হয়ে এবং পেশাগত কারণেও এই সীমান্তবর্তী এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে মানুষের আসা-যাওয়ার সংস্কৃতি আছে। যেটা ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের সীমান্ত বা ভারত-পাকিস্তানের সীমান্তের মধ্যে রয়েছে, সে রকম বাংলাদেশ-ভারতের সংস্কৃতির মধ্যে কিন্তু কোথাও সংঘাতের আবহ নেই। আর এটা না থাকার ফলে অনেক সময় যে খুব উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মানুষ এই দুই দেশে আসা-যাওয়া করে, তেমনটা নয়।

অবৈধভাবে সীমান্ত পেরোতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গিয়েছিল ফেলানী খাতুন।

সীমান্ত পারাপারে অনুশাসন নিশ্চয়ই থাকা উচিত। কিন্তু মানবাধিকারকর্মীদের প্রশ্ন, নিরস্ত্র কিশোরী ফেলানীকে কেন সরাসরি বুকে গুলি করা হলো? মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট এখন এই মামলাটি গ্রহণ করেছেন। তবে কভিড হেতু তা আপাতত স্থগিত। কোনো রকম মৌখিক সতর্কতা ছাড়া কর্তব্যরত প্রহরী সরাসরি ফেলানীর শরীর লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছে—এমনটাই অভিযোগ।

২০১৫ সালে ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ফেলানীর পরিবারকে ভারতীয় মুদ্রায় পাঁচ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিলেও অভিযোগ হচ্ছে, সেটা কার্যকর করা হয়নি। কমিশনের মন্তব্য হলো, দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী সীমান্তে অত্যন্ত সংবেদনশীল দায়িত্ব পালন করে। সেই দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেও তাদের অনেক নিয়ম-বিধি মেনে চলা উচিত।

অনুপ্রবেশের সমস্যা নিশ্চয়ই রয়েছে। এর মধ্যে আর্থিক সমস্যাও জড়িয়ে রয়েছে। ভারতেরও একটা জিনিস বুঝতে হবে যে এটা কিন্তু ভারতের জন্যও উদ্বেগের বিষয়। তার কারণ বাংলাদেশের এই সীমান্ত এখনো কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে সম্পূর্ণ নির্মাণ করা হয়নি। সেখানে বাংলাদেশ সরকারের অজান্তেও পাকিস্তান যদি কোনোভাবে বাংলাদেশের জমিকে ব্যবহার করে, পাকিস্তান যদি কোনোভাবে এই পূর্ব উপকূলবর্তী এলাকা দিয়ে ভারতের মধ্যে জঙ্গিদের অনুপ্রবেশ ঘটায় তবে সেটাও কিন্তু খুবই দুশ্চিন্তার বিষয়।

তবে আশার বিষয় এই যে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর সে ব্যাপারে কড়া ব্যবস্থা নিয়েছেন। সীমান্তে দুই দেশের মধ্যে বোঝাপড়া অনেক বেশি সুদৃঢ় হয়েছে। যার ফলে কোনো রকম পাক-সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটলে শুধু ভারত নয়, বাংলাদেশও সে ব্যাপারে যথোচিত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। অতীতেও নানা ঘটনার মধ্যে তেমনটা দেখা গেছে।

২০১৬ সালের জুলাই মাসে ঢাকা শহরের মধ্যে যে ভয়ংকর টেরর অ্যাটাক হয়েছিল, যেখানে ১৩ জন হোস্টেসকে রক্ষা করতে পারলেও বাংলাদেশের আধাসামরিক বাহিনী ২০ জন হোস্টেসকে রক্ষা করতে পারেনি। সেখানে ভয়াবহ সেই ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে সীমান্তবর্তী এলাকায় সেই টেরর অ্যাটাকের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই বিএসএফ, সাংঘাতিকভাবে সীমান্তকে সিল করার চেষ্টা করে এবং সব রকমের ব্যবস্থা নেয়। তখন দেখা গিয়েছিল, বাংলাদেশ সরকার এবং বাংলাদেশের আধাসামরিক বাহিনী এবং ভারতের আধাসামরিক বাহিনী হাতে হাত মিলিয়ে এই টেরর অ্যাটাকের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার সব দিক মোকাবেলা করার চেষ্টা করেছিল। সুতরাং এমন নয় যে এসব ঘটনা ঘটে না। বাংলাদেশ এবং ভারত—এই দুটো দেশের মধ্যে বোঝাপড়াটা অনেক বেশি জরুরি। যেমন—একবার অভিযোগ উঠেছিল, বিএসএফের একজন কর্মীকে বিজিবি গুলি চালিয়ে হত্যা করেছিল। সেটা নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড হয়েছিল। তখন বলা হয়েছিল এর মূল কারণটা হচ্ছে, একটা শান্তি বৈঠক ছিল, ফ্ল্যাগ মিটিং ছিল। ওখানে মাছ চাষের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় মৎস্য চাষিরা সেখানে যায় এবং তাদের আটক করেছিল বাংলাদেশ সরকার। তাদের মুক্তির দাবিতে যখন ভারত সরকারের পক্ষ থেকে অনেক চেষ্টা চলে, সে সময় একটা সীমান্তবর্তী সংঘর্ষ হয় এবং বিএসএফের এক ব্যক্তি প্রাণ হারায়। তখন সেই পদ্মায় মাছ ধরার ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যে সীমান্তবর্তী একটা টেনশন তৈরি হয়।

এখানে একটা জিনিস মনে রাখতে হবে, সম্প্রতি ভারতের ভেতরেও বিএসএফের যে কতটা ভূখণ্ড তারা ব্যবহার করতে পারে, বিভিন্ন রাজ্য সরকারের মধ্যে সেটা নিয়েও ভারতের ভেতরেও কিন্তু কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাত দেখা দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার বিএসএফের এই নিয়ন্ত্রণের জমি বাড়ানোর প্রতিবাদ জানিয়েছে। মমতা সরকার বিএসএফের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগ করেছে। যেখানে গরুপাচার থেকে শুরু করে বিভিন্ন ব্যাপারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকার বলেছে, বিএসএফের একাংশ এই দুর্নীতিতে জড়িয়ে রয়েছে। সুতরাং সেখানে কিন্তু সরষের মধ্যেও ভূত আছে। ফলে সেটা নিয়ে বিএসএফের ভেতরেও অনেক রকমের বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এই বিষয়গুলো নিয়ে অনেক খোলামেলা আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। দুই দেশের মধ্যে আরো অনেক বেশি আলোচনা যদি করা যায় তাহলে হয়তো এই পরিস্থিতির সমাধান হতে পারে। রবীন্দ্রনাথ ‘আমার জগত’ শীর্ষক রচনায় বলেছিলেন, ‘কাছে থেকে কেবল অংশকে দেখা যায়। দূরে না দাঁড়ালে সমগ্রকে দেখা যায় না।’ সুতরাং আমরা যখন ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তে বিএসএফ এবং বিজিবিকে খুব কাছ থেকে দেখার চেষ্টা করি তখন সমগ্রটা দেখা যায় না। সে জন্য ভারত-বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের বৃহৎ প্রেক্ষাপটে একটু দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখতে পারলে, সে সমস্যা সমাধানের রাস্তাটাও বোধ হয় অনেক সহজ হতে পারে। আজকের দিনে আন্তর্জাতিক যে প্রেক্ষাপট, সেদিক থেকে দেখতে গেলে দুই দেশের মধ্যে এই বোঝাপড়াটা অনেক বেশি জরুরি।

 

 লেখক : নয়াদিল্লিতে কালের কণ্ঠের বিশেষ প্রতিনিধি

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

ন্যাটোর বর্ধিত প্রতিরক্ষা ব্যয় ও বৈশ্বিক উদ্বেগ

    ড. সুজিত কুমার দত্ত
শেয়ার
ন্যাটোর বর্ধিত প্রতিরক্ষা ব্যয় ও বৈশ্বিক উদ্বেগ

সম্প্রতি পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য দেশগুলোর প্রতিরক্ষা বাজেট অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধির বিষয়টি বিশ্ব উদ্বেগ নিয়ে দেখছে। ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্রগুলো ২০৩৫ সালের মধ্যে প্রতিরক্ষা ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা দ্বিগুণেরও বেশি বাড়িয়ে তাদের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫ শতাংশ নির্ধারণের ব্যাপারে একমত হয়েছে। এই সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্ত শুধু ন্যাটোর নিজস্ব ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা কৌশলই নয়, বরং সমগ্র বৈশ্বিক নিরাপত্তার প্রেক্ষাপটে এক নতুন সমীকরণ তৈরি করতে যাচ্ছে।

ইউক্রেন যুদ্ধ ন্যাটোর সদস্য দেশগুলোকে তাদের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়ানোর এবং সম্মিলিত প্রতিরক্ষাব্যবস্থার প্রতি আরো বেশি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তীব্রভাবে সচেতন করেছে।

এটি শুধু ইউক্রেনের সীমানায় সংঘটিত একটি যুদ্ধ নয়, বরং ইউরোপের স্থিতিশীলতা এবং ন্যাটো জোটের ভবিষ্যৎ অস্তিত্বের ওপর সরাসরি হুমকি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, মধ্যপ্রাচ্যের চলমান উত্তেজনা, সন্ত্রাসবাদের ক্রমাগত হুমকি এবং চীনের ক্রমবর্ধমান সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তিকেও এই সিদ্ধান্তের পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে। ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্রগুলো মনে করে যে এই বহুমুখী হুমকির মুখে তাদের ঐক্যবদ্ধ এবং শক্তিশালী প্রতিরক্ষা অপরিহার্য।

ন্যাটোর নতুন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, সদস্য রাষ্ট্রগুলো ২০৩৫ সালের মধ্যে তাদের জিডিপির ৫ শতাংশ প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তাসংক্রান্ত মূল খাতে ব্যয় বা বিনিয়োগে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে।

এটি ২০১৪ সালে নির্ধারিত ২ শতাংশের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আড়াই গুণ বেশি। এই ৫ শতাংশের মধ্যে অন্তত ৩.৫ শতাংশ ব্যয় করা হবে সরাসরি প্রতিরক্ষার জন্য। অর্থাৎ সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়, গবেষণা ও উন্নয়ন, সৈন্য প্রশিক্ষণ এবং সামরিক অবকাঠামো নির্মাণে। বাকি ১.৫ শতাংশ ব্যয় করা হবে প্রতিরক্ষাসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো, নাগরিক প্রস্তুতি, উদ্ভাবন এবং প্রতিরক্ষা শিল্প খাতের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য।

ন্যাটোর এই পদক্ষেপ বৈশ্বিক নিরাপত্তার প্রেক্ষাপটে এক নতুন সমীকরণ তৈরি করবে, যার বহুমাত্রিক প্রভাব রয়েছে। প্রথমত, ন্যাটোর সম্মিলিত সামরিক সক্ষমতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে। অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র, উন্নত প্রশিক্ষণ এবং শক্তিশালী সামরিক কাঠামো সম্ভাব্য আগ্রাসীদের জন্য একটি শক্তিশালী প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করবে। ইউরো-আটলান্টিক অঞ্চলে ন্যাটোর উপস্থিতি আরো জোরদার হবে, যা এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে আত্মবিশ্বাস বাড়াবে এবং স্থিতিশীলতা আনতে সাহায্য করবে।

দ্বিতীয়ত, ন্যাটোর এই বিশাল প্রতিরক্ষা বাজেট বৃদ্ধি রাশিয়া, চীন এবং তাদের মিত্রদের তাদের নিজস্ব সামরিক ব্যয় আরো বাড়াতে উৎসাহিত করবে।

এর ফলে একটি নতুন বৈশ্বিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হতে পারে, যা ঠাণ্ডা যুদ্ধের সময়ের চেয়েও দ্রুতগতিসম্পন্ন হতে পারে। কারণ বর্তমানে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি অনেক বেশি দ্রুত। এই প্রতিযোগিতা শুধু প্রচলিত অস্ত্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং পারমাণবিক অস্ত্র, সাইবার নিরাপত্তা, মহাকাশ প্রতিরক্ষা এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো আধুনিক সামরিক প্রযুক্তিগুলোতেও এর প্রভাব দেখা যাবে। এই ধরনের প্রতিযোগিতা বিশ্বজুড়ে উত্তেজনা বাড়াবে এবং ভুল-বোঝাবুঝি বা আকস্মিক সংঘাতের ঝুঁকি বহুগুণে বাড়িয়ে দেবে।

তৃতীয়ত, জিডিপির ৫ শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করা বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতিগুলোর জন্য একটি বিশাল আর্থিক বোঝা। এর ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হতে পারে, মুদ্রাস্ফীতি বাড়তে পারে এবং জনসাধারণকে সামাজিক খাতে (যেমনস্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, অবকাঠামো) কম বরাদ্দ নিয়ে চলতে হতে পারে। এই ব্যয়ভার বৈশ্বিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, বিশেষ করে যদি অন্যান্য দেশও একই পথে হাঁটে। এটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

চতুর্থত, ন্যাটোর এই সামরিকীকরণ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য নতুন উদ্বেগ তৈরি করতে পারে। উন্নত দেশগুলো যখন তাদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে মনোযোগী হয়, তখন উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য উন্নয়ন সহায়তা, মানবিক সাহায্য বা আন্তর্জাতিক সহযোগিতা কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ ছাড়া বৈশ্বিক মেরুকরণ বাড়লে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো বড় শক্তিগুলোর প্রতিযোগিতার শিকার হতে পারে এবং তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের ঝুঁকি বাড়তে পারে। পঞ্চমত,  ন্যাটোর এই পদক্ষেপ বিশ্বকে আরো বেশি সামরিক জোটকেন্দ্রিক ও মেরুকৃত করতে পারে। ন্যাটো একটি শক্তিশালী সামরিক জোটে পরিণত হলে এর বিপরীতে রাশিয়া-চীন অক্ষ আরো শক্তিশালী হওয়ার চেষ্টা করবে, যা বিশ্বকে দুটি প্রধান সামরিক ব্লকে বিভক্ত করার দিকে ঠেলে দিতে পারে।

ন্যাটোর বর্ধিত প্রতিরক্ষা বাজেট বিশ্বকে এক নতুন এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই সিদ্ধান্তকে ন্যাটোর অভ্যন্তরীণ ঐক্য ও নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য মনে করা হলেও এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার জন্য গুরুতর চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। সামরিক শক্তি বৃদ্ধি অবশ্যই জাতীয় নিরাপত্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক, তবে তা যেন বৈশ্বিক শান্তি ও সহযোগিতার মূল্যবোধকে ছাড়িয়ে না যায় তা নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক। এই মুহূর্তে সামরিক ব্যয়ের প্রবণতা থেকে সরে এসে কূটনীতি, আলোচনা এবং পারস্পরিক বোঝাপড়ার ওপর জোর দেওয়া পূর্বের চেয়েও বেশি জরুরি। ন্যাটোর এই সিদ্ধান্ত বৈশ্বিক নিরাপত্তায় কী ধরনের নতুন সমীকরণ নিয়ে আসে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে একটি শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল বিশ্ব গড়ার জন্য সব দেশেরই দায়িত্বশীল আচরণ এবং দূরদর্শী পদক্ষেপ প্রয়োজন।

 

লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

datta.ir@cu.ac.bd

মন্তব্য

জুলাই আন্দোলন : প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

    সাঈদ খান
শেয়ার
জুলাই আন্দোলন : প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

শুধু রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণেশুধু ভিন্নমত পোষণ করলেইএকটি রাষ্ট্র যদি তারই নাগরিকদের ধরে নিয়ে যায়, দিনের পর দিন বন্দি করে রাখে, নির্মম, নিষ্ঠুর, অমানবিক এবং অবর্ণনীয় নির্যাতনে হত্যা করে, তারপর নিথর দেহটি পর্যন্ত গোপনে গুম করে ফেলে, তাহলে প্রশ্ন উঠে এই বর্বরতা থেকে রাষ্ট্র কী আনন্দ পায়? রাষ্ট্রের প্রতিনিধি, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিএতটা নিষ্ঠুর কিভাবে হতে পারে? আয়নাঘরের ইতিহাস আমাদের সামনে এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেযেখানে প্রতিটি গুম, প্রতিটি নিষ্ঠুরতা আর প্রতিটি মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মানবতা বারবার হেরে গেছে রাষ্ট্রীয় পাশবিকতার কাছে। এই ভয়ংকর ইতিহাস থেকে কি আগামী দিনের সরকার ও তার নিরাপত্তা বাহিনী কোনো শিক্ষা নেবে? নাকি আগের মতোই নিষ্ঠুরতার ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে? তবে আমরা সেই খুনি রাষ্ট্র দিয়ে কী করব?

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান ছিল দুঃখ-দুর্দশার বিরুদ্ধে জনতার এক অভূতপূর্ব সংগ্রাম। এটি ছিল গণতন্ত্রের পুনর্জন্ম ও বৈষম্যহীন সমতার বাংলাদেশ গড়ার ডাক। এই আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল মানুষের মৌলিক অধিকার, ন্যায়বিচার, মানবিক মর্যাদা, সুশাসন এবং ন্যায্য সমাজ গড়ার প্রত্যাশা।

২০২৪ সালের জুলাই মাসটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে এক উত্তাল ও ঘটনাবহুল অধ্যায়। মানুষের বিশ্বাস জন্মেছিল, ইতিহাস এবার নতুনভাবে লেখা হবে। কিন্তু বছরের শেষ নাগাদ দেখা গেল সেই বিশ্বাস ও বাস্তবতার মাঝে রয়েছে বিস্তৃত ফারাক।

এই গণ-আন্দোলন হঠাৎ গড়ে ওঠেনি।

দীর্ঘ সাড়ে পনেরো বছরের দুঃশাসন, গুম-খুন, ভোটাধিকার হরণ, বিচারহীনতা, দলীয় দমননীতি, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, দুর্নীতি ও সামাজিক বৈষম্য এই আন্দোলনের ভিত্তি রচনা করে। আন্দোলনের পেছনে ছিল বিএনপি, বামপন্থী রাজনৈতিক দল, ইসলামী দল, পেশাজীবী সংগঠন, মানবাধিকার ও নারী সংগঠন, পরিবেশবাদী, প্রবাসী সমাজ, এমনকি সরকারি চাকরিজীবীদের একাংশ ও আওয়ামী লীগের হতাশ কর্মীদেরও সক্রিয় বা নীরব সমর্থন। এটা সবার আন্দোলন

এই আন্দোলনের ফলেই গঠিত হয় একটি অন্তর্বর্তী সরকার।

ড. ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত এই সরকার নিয়ে জনমনে আশা ছিল যে এটি হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক, ভারসাম্যপূর্ণ ও দায়িত্বশীল। কিন্তু ক্রমেই এ সরকারের মধ্যে নির্বাচিত এলিটদের নিয়ে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার প্রবণতা স্পষ্ট হয়। উপদেষ্টা পরিষদে বাদ পড়ে গণ-আন্দোলনের চালিকাশক্তি রাজনৈতিক দল, শ্রমিক, কৃষক, নারী, আদিবাসী ও পেশাজীবীদের প্রতিনিধিত্ব। আন্দোলনকে মেটিক্যুলাস ডিজাইন হিসেবে তুলে ধরে জনতার বাস্তব ভূমিকা অস্বীকার করা হয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে একক নেতৃত্বে আন্দোলনের কৃতিত্ব নির্দিষ্ট করা হয়, যা গণ-আন্দোলনের বহুমাত্রিকতাকে সংকুচিত ও বিকৃত করে।

৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পর নতুন করে শুরু হয় হামলা-মামলা, সন্ত্রাস, খুন, নির্যাতনের ধারা।

গুম হওয়া মানুষ ফেরে না, দুর্নীতি বন্ধ হয় না, অর্থপাচারকারী ধরা পড়ে না, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয় না। জনগণের মৌলিক সমস্যা থেকে শুরু করে পরিবেশ, নিরাপত্তা, খাদ্য ও চিকিৎসাসব কিছুতেই ব্যর্থতার ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রশাসনিক সংস্কারের নামে র্যাব-পুলিশ-আনসারের পোশাক পাল্টানো হলেও চরিত্রের কোনো পরিবর্তন হয়নি।

গণ-অভ্যুত্থানের মূল চেতনা ছিল বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়া। কিন্তু আজও সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। এই পরিস্থিতিতে সংস্কার প্রশ্নেও অস্পষ্টতা দেখা দেয়। সংস্কারকে শুধুই একটি টিক দেওয়ার নীতিপত্রে পরিণত করে ধোঁয়াশাপূর্ণ করে তোলা হয়। নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় নিয়ে সংশয় ও বিভ্রান্তি বাড়ে।

২০২৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি নামে একটি রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করলেও তাদের প্রস্তাবনা ও রাজনৈতিক ভাষা সাধারণ মানুষের বাস্তবতা ও চেতনার সঙ্গে মেলেনি। বাংলাদেশ নামবদলের চিন্তা, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ-এর পরিবর্তে ইনকিলাব জিন্দাবাদ’—এসব প্রচেষ্টা বিভ্রান্তি তৈরি করে। দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র, রিসেট বাটন, নতুন সংবিধান ইত্যাদি ধারণা সাধারণ মানুষের জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন এবং বাস্তবতাবিবর্জিত বলে অনেকে মনে করেন।

দলীয় প্রধান ও সংসদ নেতা আলাদা করা, উচ্চকক্ষ গঠন, ১৭ বছর বয়সে ভোটাধিকারএসব প্রস্তাব সাধারণের কাছে দুর্বোধ্য। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য, সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজকে হুমকি, আর নেতাদের প্রতি অবমাননাকর আচরণ তাদের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তারা হয়ে ওঠে শহুরে শ্রেণির কল্পনানির্ভর এক রাজনৈতিক কাঠামো।

অন্যদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিচারহীনতা, গুম-খুন অব্যাহত, মাজার ও সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা বৃদ্ধি এবং নিরাপত্তা রক্ষায় এই সরকারের অবহেলা সমাজে নিরাপত্তাহীনতার বোধ তৈরি করেছে। উগ্রবাদী গোষ্ঠী ও সহিংস কর্মকাণ্ড সরকারের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ব্যর্থতার জ্বলন্ত প্রমাণ। অভ্যুত্থানের পর ১১ মাস ধরে চলা মব কালচার, দমন-পীড়ন, প্রতিহিংসামূলক হামলাএগুলো স্পষ্ট করে জনগণের বিজয়ের পরও শাসনযন্ত্রের ব্যর্থতা। স্বৈরাচার ও তাদের দোসরদের বিচার না হওয়ায় জনগণ বেআইনি পথে ঝুঁকছে। মানুষ বুঝতে পারছে, আন্দোলন সফল হলেও ক্ষমতা কাঠামোর বদল না ঘটলে কোনো অর্থ নেই।

এই পরিস্থিতিতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বারবার বলেছেন, নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই, নির্বাচনই একমাত্র বিকল্প। তিনি অন্তর্ভুক্তিমূলক, গ্রহণযোগ্য এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণে পরিচালিত নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার আহবান জানান। তাঁর মতে, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে একটি বৈধ, জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার প্রয়োজন।

গণতন্ত্র শুধু একটি শাসনব্যবস্থা নয়; এটি মানুষের অধিকার, মর্যাদা এবং নিরাপত্তার প্রতীক। গণতন্ত্রের ভিত্তি হলো জনগণের মতামত এবং অংশগ্রহণ। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্রকে বহুবার বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে। প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পেছনে সাধারণ মানুষের যে ত্যাগ, তা শুধু সুশাসন এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করলেই সার্থক হবে।

২০২৪ সালের এই আন্দোলনের চূড়ান্ত অর্জন হতে পারে স্থায়ী রাজনৈতিক সমঝোতা, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনব্যবস্থা ও গণভিত্তিক সরকার। সংস্কার ছাড়া নির্বাচন নয় কিংবা আগে নির্বাচন তারপর সংস্কারএই বিতর্কের বাইরে বাস্তবতা হলো : সংস্কার ও নির্বাচন উভয়ই জরুরি। কারণ জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত না হলে সুশাসন ও গণতন্ত্র টেকসই হয় না। ১৯৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন ও ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান প্রমাণ করে জনগণই প্রধান শক্তি। তারা ভোট, মতপ্রকাশ ও আন্দোলনের মাধ্যমে নেতৃত্ব বদলায়, জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করে।

এ জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় প্রথমেই সংস্কার দরকার, যাতে অবাধ ও গ্রহণযোগ্য ভোট হয়। সুনির্দিষ্ট নির্বাচনী রোডম্যাপ ছাড়া গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও নেতৃত্ব গড়া সম্ভব নয়। অতএব জনগণের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচিত, জবাবদিহিমূলক সরকার ও সংসদ গড়াই হবে অন্তর্বর্তী সরকারের যাবতীয় সংস্কার কার্যক্রমের প্রাথমিক ও প্রধান লক্ষ্য। কারণ রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ছাড়া সংস্কার কখনোই কার্যকর ও টেকসই হয় না।

জুলাই আন্দোলন আমাদের শেখায়গণ-আন্দোলন যদি জনগণের দ্বারা গড়ে ওঠে, তবে তার ফসলও হতে হবে জনগণের হাতে।

 

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সাংগঠনিক সম্পাদক, ডিইউজে

মন্তব্য

উপকূলীয় জনজীবন রক্ষায় জরুরি উদ্যোগ প্রয়োজন

    বিধান চন্দ্র দাস
শেয়ার
উপকূলীয় জনজীবন রক্ষায় জরুরি উদ্যোগ প্রয়োজন

জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেরও উপকূলীয় অঞ্চলে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসছে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত বিভিন্ন গবেষণা প্রবন্ধ ও প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে যে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে, বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে লবণাক্ততা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। সেখানকার কৃষি উৎপাদনের পরিমাণ ১৫ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। এই অঞ্চলের মানুষ চর্মরোগ, ডায়রিয়া এবং অপুষ্টিতে আক্রান্ত হচ্ছে।

মেয়েদের প্রজননগত সমস্যা তৈরি হয়েছে বলে জানা গেছে। উচ্চ লবণাক্ততাযুক্ত পানীয়জল উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে রক্তচাপ বৃদ্ধিজনিত সমস্যা সৃষ্টি করছে। ফলে উপকূলীয় জনজীবন রক্ষায় জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ অনিবার্য হয়ে উঠেছে।

গত বছর জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) লবণাক্ত মাটির বৈশ্বিক অবস্থা শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে প্রায় ১৪০ কোটি হেক্টর ভূমি (মোট ভূমির   ১০ শতাংশেরও কিছু বেশি) এরই মধ্যে লবণাক্ততার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং আরো অতিরিক্ত ১০০ কোটি হেক্টর জমি জলবায়ু সংকট ও মানবিক অব্যবস্থাপনার কারণে ঝুঁকির মুখে পড়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অতিরিক্ত লবণাক্ততা জমির উর্বরতা কমায় এবং মারাত্মকভাবে পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট করে। যেসব দেশ মারাত্মক ধরনের লবণাক্ততার শিকার হয়েছে সেসব দেশে ধান ও শিমজাতীয় ফসল প্রায় ৭০ শতাংশ কম হয়েছে।

সব থেকে বেশি জমি লবণাক্ততায় আক্রান্ত হয়েছে অস্ট্রেলিয়ায় (৩৫.৭ কোটি হেক্টর)। এর পরে আছে আর্জেন্টিনা (১৫.৩ কোটি হেক্টর)।

এরপর কাজাখস্তান (৯.৪), রাশিয়ান ফেডারেশন (৭.৭), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (৭.৩৪), ইরান (৫.৫৬), সুদান (৪.৩৬), উজবেকিস্তান (৪.০৯), আফগানিস্তান (৩.৮২) এবং চীন ৩.৫)।

https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/07.july/09-07-2025/kalerkantho-ed-1a.jpgসাধারণভাবে ভূমির উপরিভাগ, মাটি বা শিলায় কিংবা নদী বা ভূগর্ভস্থ পানিতে স্বাভাবিকের তুলনায় অতিরিক্ত পরিমাণ লবণ থাকলে সেই মাটি, শিলা, নদী বা ভূগর্ভস্থ পানিকে লবণাক্ত বলা হয়ে থাকে। উল্লেখ্য, এই লবণ বলতে সোডিয়াম ও ক্লোরাইড মিলে যে লবণ তৈরি হয় (সোডিয়াম-ক্লোরাইড : রান্নায় কিংবা খাবারে ব্যবহারযোগ্য) শুধু সেই ধরনের লবণ নয়। প্রকৃতপক্ষে লবণাক্রান্ত  মাটি বা পানিতে একাধিক লবণ পাওয়া যায়। সাধারণত ১২ প্রকার লবণ দ্বারা জমি বা পানি লবণাক্ত হয়।

 কোটি কোটি বছর ধরে ভূতাত্ত্বিক বিবর্তনের ধারায় লবণ বা লবণের উপাদানসমূহ ভূতাত্ত্বিক স্তরসমূহে সঞ্চিত হয়েছে। প্রাকৃতিক (বৃষ্টি, নদী, বাষ্পীভবন, সমুদ্রতলের আগ্নেয় ছিদ্র, ভূগর্ভস্থ গ্যাস ও লাভা ইত্যাদি) এবং মানবসৃষ্ট (ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন, খনিজ সম্পদ আহরণ, বনভূমি ধ্বংস ও ভূমির অপরিকল্পিত ব্যবহার ইত্যাদি) কারণে ভূতাত্ত্বিক স্তর থেকে এসব লবণ কিংবা লবণের উপাদান জলাশয় ও মাটির ওপরে এসে পড়ে। কোটি কোটি বছর ধরে পূর্বোল্লিখিত প্রাকৃতিকভাবে সমুদ্রবক্ষে লবণ জমা হওয়ার কারণে সমুদ্রের পানি বেশি পরিমাণে লবণাক্ত হয়। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে সেই লবণাক্ত পানি নানা প্রক্রিয়ায় (জলোচ্ছ্বাস, পানির ঘনত্বে পার্থক্য, শূন্যতা পূরণ ইত্যাদি) সমুদ্রসংলগ্ন ভূমিতে ঢুকে লবণাক্ততা সৃষ্টি করে। সমুদ্র সংযোগহীন দেশগুলোতে ভূস্তরে মিশে থাকা লবণ নানাভাবে বিশেষ করে বৃষ্টি, নদীর স্রোত, সেচ (ভূগর্ভস্থসহ) ইত্যাদির মাধ্যমে জমিতে জমা হয়ে থাকে। রাসায়নিক সার, কীটনাশক, শিল্পবর্জ্যের দ্বারাও জমি লবণাক্ততায় আক্রান্ত হতে পারে।

খাদ্য নিরাপত্তা এবং বৈশ্বিক মাটির স্বাস্থ্যের ওপর বড় ধরনের হুমকির মোকাবেলায় এফএও তাদের গ্লোবাল সয়েল পার্টনারশিপ-এর মাধ্যমে ২০২১ সালে লবণাক্ত মাটিবিষয়ক এক আন্তর্জাতিক  নেটওয়ার্ক, ইন্টারন্যাশনাল নেটওয়ার্ক অব সল্ট-অ্যাফেক্টেড সয়েলস (ইনসাস) গঠন করে। গ্লোবাল সয়েল পার্টনারশিপ খাদ্য নিরাপত্তা এবং পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য লবণাক্ত মাটি ব্যবস্থাপনায় জরুরি ও সমন্বিত বৈশ্বিক পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করেছে। লবণাক্ত জমিতে লবণসহিষ্ণু ফসল ও হ্যালোফাইট (লবণপ্রিয় উদ্ভিদ) চাষ বৃদ্ধি করা এবং এসব ফসলের বাজার গড়ে তোলাসহ তাতে আর্থিক সহায়তা দানের ব্যাপারে জোর দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশে ২৬ লাখ একরেরও বেশি জমি লবণাক্ততার শিকার (এফএও, ২০২৪)। বাংলাদেশ মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই) থেকে বলা হয়েছে যে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৮টি জেলার ৯৩টি উপজেলা বিভিন্ন মাত্রায় লবণাক্ততায় আক্রান্ত। গত বছর প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মাটিতে সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ লবণের পরিমাণ দেখানো হয়েছে যথাক্রমে ০.০৫ মিলিসিমেন্স/সেন্টিমিটার ও ৯.০৯ মিলিসিমেন্স/সেন্টিমিটার (সরকার ও অন্যান্য, ২০২৪)।  সাধারণত মার্চ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত এই অঞ্চলে সব থেকে বেশি লবণাক্ততা বিরাজ করে।

সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত বিভিন্ন গবেষণা প্রবন্ধ ও প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে যে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের লবণাক্ততা সেখানকার কৃষি উৎপাদনের পরিমাণ ১৫ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস করছে। দেশের দক্ষিণ-মধ্য-উপকূলীয় অঞ্চলে উচ্চ লবণাক্ততায় আক্রান্ত জমিতে নিম্ন লবণাক্ততায় আক্রান্ত জমির তুলনায় ৮০ শতাংশের বেশি পরিমাণ বোরো ধান কম উৎপাদন হতে পারে (ভূঁইয়া ও অন্যান্য ২০২৩)। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিরাজমান লবণাক্ততা সেখানকার জনস্বাস্থ্যের জন্যও হুমকি তৈরি হয়েছে। এই অঞ্চলের মানুষ চর্মরোগ, ডায়রিয়া এবং অপুষ্টিতে আক্রান্ত হচ্ছে। মেয়েদের প্রজননগত সমস্যা তৈরি হয়েছে বলে জানা গেছে। কয়েক বছর আগে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে বলা হয়েছিল যে উচ্চ লবণাক্ততাযুক্ত পানীয়জল উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে রক্তচাপ বৃদ্ধিজনিত সমস্যা সৃষ্টি করছে (নাহিয়ান ও অন্যান্য, ২০১৮)।

বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাসের সময় জমি ও পুকুরে নোনা পানি ঢুকে পড়া, ভূগর্ভে নোনা পানির অনুপ্রবেশ, চিংড়ি চাষ, লবণ চাষ, নদীতে পলি জমা, নদীর স্রোত কমে যাওয়া ইত্যাদিসহ জলবায়ু পরিবর্তনের সম্মিলিত অভিঘাত। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে সমুদ্রের পানির স্তর বৃদ্ধি এবং উজানে মিঠা পানির প্রবাহ পরিবর্তনের সম্মিলিত প্রভাবের কারণে নদীর পানির লবণাক্ততা বাড়ছে বলে বলা হচ্ছে (বিশ্বব্যাংক, ২০২৫)।

এসআরডিআই থেকে ২০১০ সালে প্রকাশিত লবণাক্ততা রিপোর্টে লবণাক্ততা সমস্যা মোকাবেলায় গবেষণাউন্নয়ন’—এই দুটি উপ-শিরোনামের অধীনে অনেকগুলো সুপারিশ করা হয়েছিল। রিপোর্টে পানি ও মাটি ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তির উন্নয়ন, লবণসহিষ্ণু ফসলের জাত উন্নয়ন, ভূ-উপরিস্থিত লবণ ধুয়ে ফেলা, মাটি ও পানির লবণাক্ততা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ, অপ্রচলিত লবণসহিষ্ণু ফসলের সম্প্রসারণ, মৃত/মৃতপ্রায় নদী-খাল খননের মাধ্যমে পানি সংরক্ষণ, ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন সীমিত রাখা ইত্যাদিসহ মোট সুপারিশ সংখ্যা ছিল ২২টি।

লবণাক্ততা ব্যবস্থাপনা ও গবেষণা কেন্দ্র নামে খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা উপজেলায় এসআরডির একটি প্রতিষ্ঠান ২০০১ সাল থেকে পূর্ণাঙ্গভাবে লবণাক্ততা মোকাবেলায় কাজ করছে। এরই মধ্যে এই কেন্দ্র থেকে কলস সেচ প্রযুক্তি, লবণাক্ত এলাকায় ডিবলিং পদ্ধতিতে ভুট্টা চাষ, খামার পুকুর প্রযুক্তি, দুই স্তর মালচিং পদ্ধতি ইত্যাদি উদ্ভাবন করা হয়েছে। এসব কৌশলের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয় বলে জানা গেছে। জাভা (ইন্দোনেশিয়া)-র সর্জন নামক একটি চাষ পদ্ধতি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে জনপ্রিয় হচ্ছে। এই পদ্ধতিতে উঁচু বেড এবং গভীর খাত পর্যায়ক্রমে তৈরি করা হয় এবং এর মাধ্যমে লবণাক্ততা, বন্যা ও জলাবদ্ধতা মোকাবেলা করা সম্ভব হচ্ছে বলে বিভিন্ন গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়েছে। পানীয়জলের জন্য বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, পুকুর বালু ফিল্টার পদ্ধতি জনপ্রিয়করণ, লবণমুক্তকরণ ইউনিট স্থাপন, ভূ-উপরিস্থিত পানি শোধন প্লান্ট স্থাপন ইত্যাদি কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে।

 দেশের লবণাক্ততা মোকাবেলার জন্য এসআরডিআই-এর সুপারিশমালা ও উপরোক্ত কৌশলসমূহ একটি সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার অধীনে প্রয়োগ করা প্রয়োজন। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে লবণাক্ততা মোকাবেলায় অভিযোজন কৌশলও পরিবর্তন দরকার। উল্লেখ্য, অস্ট্রেলিয়ার লবণাক্ততা মোকাবেলার সামগ্রিক ও অভিযোজিত কৌশল বহু দশকের অভিজ্ঞতা ও সরকারের উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগের ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য

ইরানের পরমাণু স্থাপনায় আবারও মার্কিন হামলার শঙ্কা

    ড. ফরিদুল আলম
শেয়ার
ইরানের পরমাণু স্থাপনায় আবারও মার্কিন হামলার শঙ্কা

ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলো যুক্তরাষ্ট্রের বোমা হামলায় মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তাঁদের মজুদ করা ইউরেনিয়াম সম্পূর্ণ বা আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কি না বা আদৌ এর কোনো ক্ষতি হয়েছে কি না, সে সম্পর্কে তাঁরা কিছু স্পষ্ট করেননি। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, তাঁরা তাঁদের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে সক্ষম হয়েছেন এবং ইরানের পরমাণু কর্মসূচি কয়েক দশক পিছিয়ে দেওয়া গেছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থা (আইএইএ) জানিয়েছে, ইরানের পরমাণু কর্মসূচির খুব একটা ক্ষতি হয়নি এবং তারা কয়েক মাস বা তারও কম সময়ের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত সেন্ট্রিফিউজগুলো মেরামত করে নতুন করে ইউরেনিয়াম উৎপাদন করতে সক্ষম হবে।

আইএইএর এ ধরনের অবস্থানের ফলে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে, তারা তাদের ৪০০ কেজি ইউরেনিয়ামের মজুদ যদি রক্ষা করতে সক্ষম হয়ে থাকে, তাহলে দ্রুততম সময়ের মধ্যেই তারা পরমাণু অস্ত্র তৈরির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যেতে পারে। আর এ ক্ষেত্রে তাদের দিক থেকে পরমাণু অস্ত্র তৈরির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় তাগিদ হিসেবে কাজ করবে সাম্প্রতিক সময়ের ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের বোমা হামলা, যা অন্ততপক্ষে দেশটির অভ্যন্তরীণ জনসমর্থনকে সরকারের পক্ষে নিতে পারে।

আইএইএ, ইরান বা যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল, কাদের দাবি কতটুকু যৌক্তিক, তা পরিষ্কার নয়। তবে মার্কিন বিমান হামলার পর ইরানের পার্লামেন্ট তাদের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে আইএইএকে আর কোনো ধরনের সহায়তা না করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা সম্প্রতি দেশটির প্রেসিডেন্ট অনুমোদন দিয়েছেন।

ইরানের দিক থেকে আইএইএর নিরপেক্ষতা নিয়ে অভিযোগ করা হয়েছে। তারা ইসরায়েল ও মার্কিন হামলার বিষয়ে নিন্দা জানায়নি, উপরন্তু মার্কিন-ইসরায়েলি চাওয়া অনুযায়ী ইরানের পরমাণু কর্মসূচির লাগাম টানতে চাইছে। ইরানের বক্তব্য থেকে এটিও বোঝা যায় যে তাদের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে আইএইএর তদন্ত মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলকে ভবিষ্যতে ইরানের বিষয়ে এক ধরনের তথ্য পাচারের শামিল, যার মাধ্যমে তারা ভবিষ্যতে তাদের ইরাননীতিকে পুনর্গঠন করবে।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যতই বলুন না কেন যে তাঁর দেশের বিমান হামলায় ইরানের পরমাণু কর্মসূচি গুঁড়িয়ে দেওয়া গেছে, বাস্তবে তিনি যে বিষয়টি নিয়ে চিন্তামুক্ত নন, এর আভাস পাওয়া গেছে তাঁর সাম্প্রতিক বক্তব্যে।

তিনি জানিয়ে দিয়েছেন যে ইরানকে কোনোভাবেই পরমাণু অস্ত্রধর হতে দেওয়া হবে না। আর যদি তারা এই প্রচেষ্টা আবারও করে, তাহলে ইরানে হামলা চালানো হবে বলে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন। একই বক্তব্য ইসরায়েলের। এমন অবস্থায় আইএইএর অবস্থানকে ইরান দেখছে অন্যভাবে। আর তাই সম্প্রতি আইএইএর পর্যবেক্ষকদল ইরান সফর করে তাদের পরমাণু কর্মসূচি তদন্ত করতে চাইলে ইরানের পক্ষ থেকে তাদের ফেরত পাঠানো হয়েছে।
এমন বাস্তবতায় ইরান কী করছে বা করতে যাচ্ছে, তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের জন্য নতুন চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ইরানের পরমাণু সক্ষমতার বিষয়টি এখনো বহাল রয়েছে, এটি প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও ভেতরে ভেতরে যুক্তরাষ্ট্র খুব ভালো করে জানে যে তাদের এমন কিছু সক্ষমতা রয়েছে, যার মধ্য দিয়ে যেকোনো ধরনের ক্ষতি তারা পুষিয়ে ওঠার সামর্থ্য রাখে। সাম্প্রতিক যুদ্ধে নতুন করে প্রমাণিত হয়েছে যে ইরানের বর্তমান সরকারব্যবস্থা নিয়ে দেশটির ভেতরে ব্যাপক জন-অসন্তোষ থাকলেও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা যখন বিপন্ন হতে বসে, তখন ইরানিরা সবাই এক জাতীয়তাবাদী আদর্শের পতাকাতলে সমবেত হয়। ইরানের সাবেক শাহর নির্বাসিত পুত্র রেজা শাহকে নিয়ে ইসরায়েল এবং পশ্চিমারা আবারও ইরানের ভেতরে সরকারবিরোধী আন্দোলনকে চাঙ্গা করতে চাইলেও ইরানে ইসরায়েলের হামলা এবং প্রাণহানি নিয়ে তিনি ইসরায়েলের প্রশংসা করে সরকারবিরোধীদেরও রোষানলে পড়েছেন। পশ্চিমারা রেজা শাহকে সামনে নিয়ে ইরানে নতুন করে কোনো বিপ্লব সংগঠিত করতে চাইলে এ ক্ষেত্রে এর ব্যর্থতা অনিবার্য। তবে ইরানকে আবারও ঘুরে দাঁড়ানো দেখাটাও তাদের জন্য এক চপেটাঘাতের শামিল। আর সে জন্যই ইরানের নীতিনির্ধারকরা পর্যন্ত এটি শঙ্কা করছেন যে আইএইএকে কোনো ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে নাএমন অভিযোগ তুলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল আবারও ইরানে হামলা করে বসতে পারে। 

ইরানের অবস্থানকে সুবিধার মনে করছে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অস্থিরতার প্রকাশ ঘটেছে তাঁর নতুন সিদ্ধান্তে। গত ৪ জুলাই ইরানের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। এই নিষেধাজ্ঞা ইরানের ওপর আগেকার নিষেধাজ্ঞার চেয়ে কিছুটা ব্যতিক্রম। এত দিন ধরে চাউর ছিল যে ইরানের তেল ও গ্যাস রপ্তানির ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থাকলেও শ্যাডো ফ্লিটের (গোপন জাহাজ) মাধ্যমে ইরান এই রপ্তানি চালিয়ে যাচ্ছে। নতুন করে জানা গেছে, ইরাকি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ ব্যবসায়ী সালেহ আহমেদ সাঈদীর মালিকানাধীন বিভিন্ন কম্পানির মাধ্যমে ইরানের তেল ইরাকের তেলের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে আরব আমিরাত হয়ে পশ্চিমা দেশগুলোতে রপ্তানি হয়ে আসছে, যার মাধ্যমে বছরে ১০০ কোটি ডলারের বেশি আয় করছে ইরান। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ব্যবসায়ী সালেহর কম্পানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন, যেন ইরান এভাবে বাণিজ্য করে এর থেকে অর্জিত অর্থ দিয়ে তা সামরিক খাতে ব্যয় করতে না করে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মনে করছেন, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি থেকে তাকে বিরত রাখতে হলে সর্বাগ্রে তার অর্থনৈতিক সামর্থ্যের জায়গায় আঘাত করতে হবে। তবে এখানে একটি কথা থেকে যায়, যে ১০০ কোটি ডলার আয়ের কথা বলা হয়েছে, বাস্তবে এটি ইরানের অর্থনীতিতে যে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে তার পারমাণবিক সক্ষমতাকে চালিয়ে নেওয়ার জন্য, সেটি খুব একটা যুক্তিগ্রাহ্য নয়।  

মোটকথা হচ্ছে, ইরান মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ও ইসরায়েলের স্বার্থের পথে সবচেয়ে বড় বাধা। এখন কথা হচ্ছে, ইরান যদি এমনটা মনে করে থাকে যে তারা আবারও সম্ভাব্য হামলা থেকে নিরাপদ নয়, সে ক্ষেত্রে তাদের প্রতিরক্ষার ধরন কেমন হবে? এ ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে কয়েকটি অনুমান করা যেতে পারে। প্রথমত, হরমুজ প্রণালি ঘিরে তারা তাদের কৌশলকে শাণিত করতে পারে, যেন পশ্চিমা বিশ্ব ইরানের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আগাম ধারণা পেতে পারে; দ্বিতীয়ত, তাদের নতুন করে আরো উন্নতমানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সংগ্রহ করে ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করতে হবে; তৃতীয়ত, যুদ্ধাস্ত্রের ক্ষেত্রে ইসরায়েলি প্রযুক্তির বিপরীতে নিজেদের প্রযুক্তি দুর্বলএই বাস্তবতার আলোকে এটিকে আরো উন্নত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে তারা চীন ও রাশিয়ার সহায়তা নিতে পারে এবং চতুর্থত, রাশিয়ার সঙ্গে তাদের চলমান কৌশলগত সম্পর্ককে আরো কার্যকর করার পাশাপাশি চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে উন্নত করা এবং ইসরায়েলের যেমন যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি শক্তি সর্বদা তাদের পাশে রয়েছে, ইরানকেও এমন পাশে থাকার মতো বৃহৎ শক্তিধর রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ককে আরো জোরদার করতে হবে।

আগামী কয়েক দিনের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে গাজায় হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধের আপাত অবসান হতে চলছে বলে মনে হচ্ছে। এটি মানে এই নয় যে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। বরং হামাস, হুতি ও হিজবুল্লাহর মতো সংগঠনগুলোর দুর্বলতার এই সুযোগে ইরানকে আরো পর্যুদস্ত করার নতুন চেষ্টা করতে পারে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র। তারা খুব ভালো করেই জানে এই সময়ে এসে তারা যদি ইরানকে ছাড় দেয়, তাহলে ইরান দ্রুতই আরো শক্তি সঞ্চয় করে তার প্রক্সিদের মাধ্যমে ইসরায়েলকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলবে। এসব যুক্তিতে ইরানে ফের হামলার শঙ্কা থেকেই যায়।

 

লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

mfulka@yahoo.com

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ