বলা হয় যে সেনা অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্রের জন্য জিয়ার শাসনকালে সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালতের রায় অনুযায়ী দুই হাজারের মতো সৈনিককে ফায়ারিং স্কোয়াডে প্রাণ হারাতে হয়েছে। মোশতাক ক্ষমতা দখলের পর মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের চার নেতাকে জেলখানায় হত্যা করা হয়। শেষ পর্যন্ত তাঁর পক্ষে ক্ষমতায় থাকা সম্ভব হয়নি। গণ-আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থান অত্যাচারী সরকারের অত্যাচারের কারণে হতে পারে। এতে জনজীবনে বিশেষ সুফল হয় না, সরকার বদল হয় মাত্র, অত্যাচার-অবিচারের ধারা বহমান থাকে।
প্রকৃত গণ-আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থানে জনমনে মহান কিছু অর্জনের সুস্পষ্ট লক্ষ্য থাকে, উন্নত চরিত্রের নেতৃত্ব থাকে, নেতারাই জনমনে আন্দোলন বা অভ্যুত্থানের লক্ষ্য নির্ধারণ করেন এবং তা জনগণের মধ্যে প্রচার করেন। মহান নেতৃত্ব ও মহান লক্ষণ গণ-আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থানের জন্য অপরিহার্য। জনগণের মধ্য থেকে জনগণের চেষ্টা দ্বারাই সর্বজনীন কল্যাণে কাজ করার জন্য মহান নেতৃত্ব সৃষ্টি হয়। সে অবস্থায় জনগণও মহান হয়ে ওঠে। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চে ছাত্রলীগের একটি স্লোগান ছিল—মহান জাতির মহান নেতা—শেখ মুজিব শেখ মুজিব। মহান নেতৃত্ব, মহান জাতি, মহান রাষ্ট্র ও মহান জনজীবন পরস্পর সম্পর্কিত। আজকের বাংলাদেশে এসব কতখানি আছে, তা অনুসন্ধান করে দেখা দরকার।
আধুনিক যুগে রাষ্ট্রের আদর্শ সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্ম—যা-ই হোক, সরকার গঠিত হয় রাজনৈতিক দল দ্বারা। আজকের ইরানে রাজনৈতিক দল দ্বারাই সরকার গঠিত হয়। কয়েক বছর আগেও নেপাল ছিল হিন্দু রাষ্ট্র। এতে রাজা থাকা সত্ত্বেও সরকার গঠিত হতো রাজনৈতিক দল দ্বারাই। পরে দলীয় নেতৃত্বের দ্বারাই নেপাল পরিণত হয় একটি সেক্যুলার রাষ্ট্রে।
বাংলাদেশে গত ৫০ বছরে রাজনীতি যে রূপ নিয়েছে, তার পরিবর্তন ঘটিয়ে সুস্থ-স্বাভাবিক অবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সহজে, স্বল্প সময়ে সম্ভবপর হবে না। জাতির মানসিকতা ও চিন্তা পরিবর্তন করতে হবে। রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ভাষা ও রুচি উন্নত করতে হবে। রাজনৈতিক কর্মধারাকেও উন্নত করতে হবে। আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক ও সাংস্কৃতিক গোটা ব্যবস্থাকে উন্নতিশীল, প্রগতিশীল রূপ ও প্রকৃতি দিতে হবে। এর জন্য উন্নত চরিত্রের রাজনৈতিক দল অপরিহার্য।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান যে ধারায় চলছে সে ধারা অনুসরণ করে চলতে থাকলে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ সুস্থ, স্বাভাবিক, উন্নতিশীল বা প্রগতিশীল অবস্থায় উত্তীর্ণ হতে পারবে না। বৃহৎ শক্তিবর্গ যুদ্ধবিগ্রহ, সাম্রাজ্যবাদী নীতি ও ভোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে যেভাবে চলছে, বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল দুর্বল রাষ্ট্র ও দুর্বল জনগোষ্ঠীগুলোকে যেভাবে চালাচ্ছে, তা সভ্যতার ধারা নয়। গ্রেকো-রোমান-ইউরো-আমেরিকান সভ্যতার প্রগতিশীল অনেক কিছু দুর্বল জনগোষ্ঠী ও জাতিগুলোকে অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু তাদের বর্ণবৈষম্যবাদী, উপনিবেশবাদী, সাম্রাজ্যবাদী, ফ্যাসিবাদী নীতি ও কর্মধারা অবশ্যই এড়িয়ে চলতে হবে। কিন্তু আজকের দুর্বল রাষ্ট্রগুলোতে এ বিষয়ে কোনো সচেতনতা দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশেও রাজনীতিবিদদের মধ্যে কথিত বিশিষ্ট নাগরিকদের মধ্যে, বুদ্ধিজীবী ও শিল্পী-সাহিত্যিকদের মধ্যে সে সচেতনতা দেখা যাচ্ছে না। বিশিষ্ট নাগরিকরা যেসব অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানান, সেগুলো প্রতিষ্ঠা করতে হলে অবশ্যই আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যাগুলোকেও বিবেচনায় ধরতে হবে এবং উন্নতির জন্য বাস্তবসম্মত বাস্তবায়ন সম্ভব কর্মসূচি নিয়ে কাজ করতে হবে। সর্বোপরি উন্নতিশীল, প্রগতিশীল, সেক্যুলার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনৈতিক দল গঠন করতে হবে। বাংলাদেশে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বলে যা বোঝানো হয়, তা ‘অসাম্প্রদায়িকতা’ মাত্র। সেক্যুলারিজম হলো মানুষের ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত চেষ্টায় মানুষ পৃথিবীকেই স্বর্গে উন্নীত করতে পারবে—এমন সংকল্প। সেক্যুলারিজমের জন্য অবশ্যই গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদ ইত্যাদিকে গুরুত্ব দিয়ে বুঝতে হবে এবং যথার্থ রাজনৈতিক দল গড়ে তুলতে হবে। পৃথিবীব্যাপী রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থাকেও পুনর্গঠিত করতে হবে। এর জন্য নৈতিক চেতনা ও আইন-কানুনের উন্নতিশীলতা দরকার। সে রকম কোনো রাজনৈতিক দল বাংলাদেশে নেই। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি, বাসদ সে রকম দল হয়ে ওঠার চেষ্টা করতে পারে। বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো গণতন্ত্র বাদ দিয়ে শুধু নির্বাচনকে অবলম্বন করতে চাইছে। এনজিও এবং সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশনগুলো (সিএসও) নানা কৌশলে বাংলাদেশের রাজনীতির গতি ও প্রকৃতি নির্ধারণ করছে। এই ধারায় বাংলাদেশে এখন সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে না।
গণজাগরণ ও গণ-আন্দোলনের ধারায় কখনো কখনো কোনো মহান লক্ষ্য অর্জনের জন্য রাষ্ট্রের প্রায় সব মানুষ তীব্র আন্দোলনে ফেটে পড়ে বাংলাদেশে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চে এবং ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৬৯-এর মার্চ পর্যন্ত গণ-অভ্যুত্থান ঘটেছিল। এ দেশে গণ-আন্দোলন ও গণজাগরণের সূচনা হয়েছিল বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের (১৯০৫-১১) মধ্য দিয়ে। তখন থেকে ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত এই ভূভাগে জনগণ জাগ্রত ছিল। পরে জনগণের জাগরণের সেই ধারা আর বজায় থাকেনি। আন্দোলন হয়েছে। অনেক আন্দোলনে জনগণ অংশগ্রহণও করেছে। কিন্তু এসব আন্দোলনে গণজাগরণ ও গণ-অভ্যুত্থানের সেই উত্তাপ আর দেখা যায়নি।
ছয় দফা আন্দোলন (১৯৬৬-১৯৭১), স্বাধীনতাযুদ্ধ (১৯৭১) ও পরবর্তী সময়ে আন্দোলন ও সরকারের পতন-উত্থান সম্পর্কে ইতিহাসের দিক থেকে এবং জনস্বার্থের দিক থেকে পরিচ্ছন্ন ধারণা রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে, বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এবং কথিত বিশিষ্ট নাগরিকদের মধ্যে থাকা দরকার। তা কতটা আছে?
বৃহৎ শক্তিবর্গ, বিশ্বব্যাংক ও বর্তমান জাতিসংঘ মানবজাতিকে যেভাবে চালাচ্ছে তার পরিবর্তন দরকার। পৃথিবীর সব ভূভাগে সর্বজনীন কল্যাণে উন্নত রাজনৈতিক চিন্তা অবলম্বন করে প্রতিটি জাতির রাষ্ট্রব্যবস্থাকে পুনর্গঠিত করতে হবে। পাশাপাশি আন্তঃরাষ্ট্রিক সম্পর্ক ও বিশ্বব্যবস্থাকেও পুনর্গঠিত করতে হবে। জাতিসংঘ হয়ে আছে বৃহৎ শক্তিবর্গের সংঘে। এটাকে সর্বজনীন কল্যাণে বিশ্বসরকারে উন্নীত করতে হবে। বিশ্বসরবার কাজ করবে আন্তঃরাষ্ট্রিক সম্পর্ক উন্নয়ন, যুদ্ধের আশঙ্কাকে দূর করা, বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা, বিশ্বজনীন কল্যাণ ইত্যাদি লক্ষ্যে। জাতিরাষ্ট্র থাকবে, জাতীয় ভাষা ও জাতীয় সরকার থাকবে।
বর্তমান উদার গণতন্ত্র হলো প্রকৃতপক্ষে ধনিক-বণিক ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর গণতন্ত্র। এই গণতন্ত্রের জায়গায় দরকার সর্বজনীন গণতন্ত্র। সর্বজনীন গণতন্ত্রে শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্তের স্বার্থ যথোচিত গুরুত্ব পায়। রাষ্ট্রে সব মানুষই যাতে সম্মানজনক জীবন যাপন করতে পারে, খাওয়া-পরার সুযোগ যাতে সবার সামনে উন্মুক্ত থাকে তার নিশ্চয়তা বিধান করা। অসাম্য থাকবে, কারণ সব মানুষকে প্রকৃতি সমান করে সৃষ্টি করেনি। তবে প্রকৃতি সৃষ্ট অসাম্য যাতে বৃদ্ধি না পায়, রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থাকে সেই লক্ষ্যে বিকাশশীল রাখতে হবে—এসব জটিল বিষয়ে ব্যাপক ও গভীর চিন্তা-ভাবনা ও বিচার-বিবেচনা দরকার। সর্বজনীন গণতন্ত্রের জন্য দলভিত্তিক আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের সরকার দরকার। এর জন্য গভীর চিন্তা-ভাবনা দরকার। দলভিত্তিক আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের সরকার সম্পর্কে ১৯৮০-র দশক থেকেই কেউ কেউ আলোচনা করেছেন। কেউ কেউ তা নিয়ে পুস্তিকা ও বই লিখেছেন। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অবস্থা বিবেচনা করে দলভিত্তিক আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের সরকার গঠনের উপায় স্থির করতে হবে। জনগণের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক উন্নতির কর্মসূচি প্রচার করে রাজনৈতিক দলগুলো জনপ্রিয়তা লাভ করবে।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলো এখন জাতীয় সংসদের আগামী নির্বাচন নিয়ে চিন্তা করছে। বিএনপি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানাচ্ছে। নির্বাচনের জন্য সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশনগুলো মানবাধিকার নিশ্চিত করার জন্য প্রচারকার্য চালাচ্ছে। দেখা যাক কী হয়।
যাঁরা জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের এবং জনজীবনের সমাধানযোগ্য সমস্যাগুলোর সমাধান কামনা করেন এবং প্রগতির ধারায় অগ্রযাত্রা আশা করেন, তাঁদের ভিন্ন ধারায় নতুনভাবে চিন্তা করতে হবে এবং সাংগঠনিক অগ্রযাত্রার নতুন ধারা সৃষ্টি করতে হবে। বর্তমান বাস্তবতায় গণজাগরণের উপায় উদ্ভাবন করতে হবে।
লেখক : আহমদ শরীফ চেয়ার অধ্যাপক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়