ঢাকা, মঙ্গলবার ০৮ জুলাই ২০২৫
২৪ আষাঢ় ১৪৩২, ১২ মহররম ১৪৪৭

ঢাকা, মঙ্গলবার ০৮ জুলাই ২০২৫
২৪ আষাঢ় ১৪৩২, ১২ মহররম ১৪৪৭

বিএনপির নির্বাচনী ঢোলে কাঠি পড়েছে

  • আবদুল মান্নান
অন্যান্য
অন্যান্য
শেয়ার
বিএনপির নির্বাচনী ঢোলে কাঠি পড়েছে

সব কিছু ঠিক থাকলে ২০২৩ সালের শেষে বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। বাংলাদেশে নির্বাচন মানেই উৎসব। হতে পারে তা স্কুল গভর্নিং বোর্ডের নির্বাচন বা ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন। সংসদ নির্বাচন হলে তো কথাই নেই।

কিন্তু ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনের সময় থেকে সংসদ নির্বাচন জন্ম দিয়েছে এক ভয়াবহ সংস্কৃতির, যার সম্পূর্ণ দায়দায়িত্ব বিএনপি ও তার প্রধান সহযোগী যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতে ইসলামীর। সন্ত্রাস কাকে বলে এ দেশের মানুষ ২০১৪ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে দেখেছে। এর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল সংবিধানবহির্ভূত উপায়ে নির্বাচন করে সরকার গঠন করা, যার অভিজ্ঞতা তাদের আছে। বিএনপির রাজনীতি অন্যান্য রাজনৈতিক দল থেকে আলাদা।
তবে এটি অস্বীকার করার উপায় নেই, বিএনপি এ দেশের রাজনীতিতে অন্যতম একটি বড় দল। জামায়াতকে সঙ্গে নিলে তাদের শক্তি ৩ শতাংশ বাড়ে।

আশির দশকে দেশে ছাত্রদের নেতৃত্বে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল। এরপর এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল দেশের সব জোটবদ্ধ রাজনৈতিক দল এবং পেশাজীবী, সাংস্কৃতিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলো।

রাজনৈতিক জোটগুলো রচনা করেছিল তিন জোটের রূপরেখা, যা ছিল এরশাদ পতনের পর দেশের রাজনীতির জন্য একটি রোডম্যাপ। এর মধ্যে অন্যতম ছিল এরশাদের অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। নির্বাচন হতে হবে একটি কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে, যার প্রধান হবেন দেশের প্রধান বিচারপতি। এরশাদবিরোধী আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠলে তিনি ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পদত্যাগ করেন। পদত্যাগ করার আগে তিনি তাঁর উপরাষ্ট্রপতি ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের হাতে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
ব্যারিস্টার মওদুদ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে উপরাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেন। পরবর্তী ধাপে ব্যারিস্টার মওদুদ বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের কাছে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। সব কিছুই সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা মেনেই করা হয়। যেহেতু তখন দেশে রাষ্ট্রপতির শাসনপদ্ধতি বিদ্যমান ছিল, বিচারপতি সাহাবুদ্দীন তাঁঁর মন্ত্রিসভা (উপদেষ্টা পরিষদ) নিজের পছন্দমতো করে গঠন করেন।

বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ নির্বাচন কমিশনও পুনর্গঠন করেন। সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। মনোনয়নের ঠিক আগমুহূর্তে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৫ দল থেকে আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বাধীন বাকশালসহ আট দল জোট থেকে বের হয়ে যায় এবং তারা ঘোষণা করে কাস্তে মার্কা নিয়ে পৃথক নির্বাচন করবে। এ সময় আবদুর রাজ্জাক ছিলেন বাকশালের শীর্ষ নেতা। তিনি নিজে কিন্তু আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কা নিয়ে নির্বাচন করেন আর কাস্তে মার্কা নিয়ে মোট পাঁচজন বিজয় লাভ করেন। ৪২টি আসনে কাস্তে মার্কার প্রার্থীরা এক থেকে দুই হাজার ভোটে নৌকা মার্কার প্রার্থীদের হারিয়ে দেন। তারা ১০০টির মতো আসনে নৌকার বিপক্ষে প্রার্থী দিয়েছিল। আওয়ামী লীগ নৌকা মার্কা নিয়ে ৮৮টি আসনে বিজয় লাভ করে। বাকশাল বা অন্যরা কাস্তে মার্কা নিয়ে যদি সেই নির্বাচনে অংশ না নিত, তাহলে এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ফল ভিন্ন হতে পারত। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর অনুষ্ঠিত এই অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ক্ষতি করার জন্য নৌকা মার্কার বিরুদ্ধে যারা নির্বাচন করেছিল, তারা কাজটি ভালো করেনি। অন্যদিকে বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে প্রায় ১০০ আসনে আঁতাত করে ১৪০টি আসনে বিজয় লাভ করেছিল আর জামায়াত নিজে ১৮টি আসনে বিজয়ী হয়েছিল। যেখানে জামায়াত কোনো নির্বাচনেই ৩ থেকে ৪ শতাংশের বেশি ভোট পায় না, সেখানে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে তারা আঁতাতের ফলে ১২.১৩ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। যে বিএনপি ৩০০টি আসনে প্রার্থী দেওয়ার মতো প্রার্থী পাচ্ছিল না, তারা সবাইকে অবাক করে দিয়ে ১৯৯১ সালে সরকার গঠন করেছিল। নির্বাচন শেষে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আবার তাঁর আগের কর্মক্ষেত্রে ফিরে গিয়েছিলেন।

মনে করা হয়েছিল, পরবর্তী নির্বাচনগুলো স্বাভাবিক নিয়মেই হবে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে তা হয়নি। কারণ খালেদা জিয়া ক্ষমতার লোভে পড়ে গেছেন। ১৯৯৪ সালে মাগুরায় একটি উপনির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীকে বিজয়ী করে আনার জন্য তাঁরা এমন কোনো অপকর্ম নেই, যা করেননি। আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে ঘরছাড়া থেকে শুরু করে লাগামহীন সন্ত্রাস, বুথ দখল, বিনা বাধায় ব্যালট পেপারে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে দেওয়া—সব কিছুই বিএনপি করেছে। তার পরও আওয়ামী লীগ অনেকটা চুপ থেকেছে। একইভাবে ঢাকা-১০ আসনের নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়। তার পরও আওয়ামী লীগ প্রতিবাদ ছাড়া তেমন কিছু করেনি। আওয়ামী লীগ বিএনপির এসব কর্মকাণ্ডের প্রেক্ষাপটে বুঝতে পারে, বিএনপির অধীনে কোনো সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন হওয়া সম্ভব নয়। ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনের আগেই আওয়ামী লীগ ঘোষণা করে, তারা বিএনপির অধীনে আর কোনো নির্বাচনে যাবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া বিএনপির অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না বলে তারা সাফ জানিয়ে দেয়। তাদের সঙ্গে সংসদে থাকা অন্য দলগুলোও একই দাবি তোলে এবং সংসদ থেকে মেয়াদপূর্তির আগেই  খালেদা জিয়া পদত্যাগ করেন। খালেদা জিয়ার আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বেশ চাতুর্যের সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসরের বয়স দুই বছর বাড়িয়ে দেন। সবার বাধা উপেক্ষা করে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি ডামি প্রার্থী নিয়ে একটি প্রহসনের নির্বাচন করে, যাতে কোনো কেন্দ্রে ৪ থেকে ৫ শতাংশের বেশি ভোট পড়েনি, যদিও এই সংসদ মাত্র ১২ দিন স্থায়ী ছিল। তবে এই সংসদেই সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সাংবিধানিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। নির্বাচনে বিজয় লাভ করে আওয়ামী লীগ। তবে সরকার গঠন করতে তাদের সহায়তা নিতে হয় জাসদ ও জাতীয় পার্টির।

১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগের প্রথম সরকার গঠন। প্রশাসনের সর্বত্র বিএনপি আর জামায়াতের কর্মকর্তাদের দিয়ে ঠাসা। এমন বৈরী অবস্থায় দেশ শাসন কত কঠিন, শেখ হাসিনা তা ঠিকই টের পেয়েছিলেন। তার পরও তিনি চেষ্টা করেছেন। সংবিধান থেকে ইনডেমনিটি আইন রহিত করা হয়। জেনারেল জিয়া ক্ষমতা দখল করে এই আইনটি সংবিধানে সংযোজন করেন। এই আইন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যাকারীদের দায়মুক্তি দিয়েছিল। এই দফায় শেখ হাসিনা দেশে আইনের শাসন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মাত্র ৬২টি আসনে বিজয় লাভ করতে সক্ষম হয়। তারা বুঝতেই পারেনি বিএনপি-জামায়াতের আঁতাত আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি লতিফুর রহমানের চরম পক্ষপাতমূলক আচরণ। নির্বাচন শেষে দক্ষিণ বাংলায় নেমে আসে আওয়ামী লীগ সমর্থক আর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর ভয়াবহ এক নির্যাতন, যার ফলে হাজার হাজার মানুষ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। খালেদা জিয়া এই মেয়াদে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারকাজ নানা অজুহাতে বন্ধ করে দেন। তাঁকে সহায়তা করেন তাঁর আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। এই মেয়াদে তিনি আরো একটি কাজ করেন আর তা হচ্ছে বিচারপতিদের অবসরের বয়স বাড়িয়ে দেওয়া, যাতে পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হবেন বিচারপতি হাসান, যিনি একসময় বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। জিয়ার আমলে তিনি রাষ্ট্রদূতও ছিলেন। এমন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানকে আওয়ামী লীগ কেন মেনে নেবে! এরই মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে একটি রিট মামলা করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আবদুল মান্নান খান। সেই মামলায় আবেদনকারীর পক্ষে রায় দেওয়া হয়। এই রায়কে রিভিউ করার জন্য উচ্চ আদালতে ২০০৫ সালে আরেকটি মামলা রুজু করা হয়। সেই মামলার রায়েও বলা হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান যেহেতু সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী, সুতরাং এই ব্যবস্থা বাতিল করা হলো।

সেই বাতিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে না আনলে নাকি বিএনপি সামনের কোনো নির্বাচনে, মানে ২০২৩ সালের অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে অংশ নেবে না। তাহলে তো সংবিধান স্থগিত করতে হয়। কারণ এই ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার আলোচনা অংশে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট বলে দিয়েছেন একটি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় এক মিনিটের জন্যও কোনো অনির্বাচিত সরকারের হাতে দেশের শাসনভার দেওয়া যাবে না। সুতরাং সামনের নির্বাচন বিদ্যমান ব্যবস্থায়ই করতে হবে। আর যদি প্রধানমন্ত্রী মনে করেন তিনি ২০১৪ সালের মতো সংসদের নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে, যেখানে বিএনপির সদস্যরাও আছেন, একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করতে পারেন।

বিএনপি আরো বলে থাকে, নির্বাচনের আগে তাদের চেয়ারপারসন, যিনি অর্থ আত্মসাতের আভিযোগে সাজা খাটছেন, তাঁকে মুক্তি দিতে হবে। তাঁর বিরুদ্ধে তো অনেক মামলা অপেক্ষমাণ। আর এসব বিষয় তো আদালতের এখতিয়ার। সেখানে তো সরকারের কোনো কিছু করার নেই।

আসলে বিএনপি সময় এলে নির্বাচনে ঠিকই অংশ নেবে। কারণ তাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান, যিনি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত আর আইনের দৃষ্টিতে লন্ডনে পলাতক তাঁর মনোনয়ন বাণিজ্যের জন্য নির্বাচনে তাদের যেতে হবে। লন্ডনে বিলাসী জীবন যাপন করতে হলে অনেক টাকা দরকার। তবে মানুষ আশা করে, ২০১৩ ও ২০১৪ সালের মতো বিএনপি আবার যেন দেশের মানুষের জানমালের ক্ষতি করতে মাঠে না নামে।

 

লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

ইরানের পরমাণু স্থাপনায় আবারও মার্কিন হামলার শঙ্কা

    ড. ফরিদুল আলম
শেয়ার
ইরানের পরমাণু স্থাপনায় আবারও মার্কিন হামলার শঙ্কা

ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলো যুক্তরাষ্ট্রের বোমা হামলায় মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তাঁদের মজুদ করা ইউরেনিয়াম সম্পূর্ণ বা আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কি না বা আদৌ এর কোনো ক্ষতি হয়েছে কি না, সে সম্পর্কে তাঁরা কিছু স্পষ্ট করেননি। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, তাঁরা তাঁদের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে সক্ষম হয়েছেন এবং ইরানের পরমাণু কর্মসূচি কয়েক দশক পিছিয়ে দেওয়া গেছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থা (আইএইএ) জানিয়েছে, ইরানের পরমাণু কর্মসূচির খুব একটা ক্ষতি হয়নি এবং তারা কয়েক মাস বা তারও কম সময়ের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত সেন্ট্রিফিউজগুলো মেরামত করে নতুন করে ইউরেনিয়াম উৎপাদন করতে সক্ষম হবে।

আইএইএর এ ধরনের অবস্থানের ফলে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে, তারা তাদের ৪০০ কেজি ইউরেনিয়ামের মজুদ যদি রক্ষা করতে সক্ষম হয়ে থাকে, তাহলে দ্রুততম সময়ের মধ্যেই তারা পরমাণু অস্ত্র তৈরির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যেতে পারে। আর এ ক্ষেত্রে তাদের দিক থেকে পরমাণু অস্ত্র তৈরির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় তাগিদ হিসেবে কাজ করবে সাম্প্রতিক সময়ের ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের বোমা হামলা, যা অন্ততপক্ষে দেশটির অভ্যন্তরীণ জনসমর্থনকে সরকারের পক্ষে নিতে পারে।

আইএইএ, ইরান বা যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল, কাদের দাবি কতটুকু যৌক্তিক, তা পরিষ্কার নয়। তবে মার্কিন বিমান হামলার পর ইরানের পার্লামেন্ট তাদের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে আইএইএকে আর কোনো ধরনের সহায়তা না করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা সম্প্রতি দেশটির প্রেসিডেন্ট অনুমোদন দিয়েছেন।

ইরানের দিক থেকে আইএইএর নিরপেক্ষতা নিয়ে অভিযোগ করা হয়েছে। তারা ইসরায়েল ও মার্কিন হামলার বিষয়ে নিন্দা জানায়নি, উপরন্তু মার্কিন-ইসরায়েলি চাওয়া অনুযায়ী ইরানের পরমাণু কর্মসূচির লাগাম টানতে চাইছে। ইরানের বক্তব্য থেকে এটিও বোঝা যায় যে তাদের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে আইএইএর তদন্ত মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলকে ভবিষ্যতে ইরানের বিষয়ে এক ধরনের তথ্য পাচারের শামিল, যার মাধ্যমে তারা ভবিষ্যতে তাদের ইরাননীতিকে পুনর্গঠন করবে।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যতই বলুন না কেন যে তাঁর দেশের বিমান হামলায় ইরানের পরমাণু কর্মসূচি গুঁড়িয়ে দেওয়া গেছে, বাস্তবে তিনি যে বিষয়টি নিয়ে চিন্তামুক্ত নন, এর আভাস পাওয়া গেছে তাঁর সাম্প্রতিক বক্তব্যে।

তিনি জানিয়ে দিয়েছেন যে ইরানকে কোনোভাবেই পরমাণু অস্ত্রধর হতে দেওয়া হবে না। আর যদি তারা এই প্রচেষ্টা আবারও করে, তাহলে ইরানে হামলা চালানো হবে বলে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন। একই বক্তব্য ইসরায়েলের। এমন অবস্থায় আইএইএর অবস্থানকে ইরান দেখছে অন্যভাবে। আর তাই সম্প্রতি আইএইএর পর্যবেক্ষকদল ইরান সফর করে তাদের পরমাণু কর্মসূচি তদন্ত করতে চাইলে ইরানের পক্ষ থেকে তাদের ফেরত পাঠানো হয়েছে।
এমন বাস্তবতায় ইরান কী করছে বা করতে যাচ্ছে, তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের জন্য নতুন চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ইরানের পরমাণু সক্ষমতার বিষয়টি এখনো বহাল রয়েছে, এটি প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও ভেতরে ভেতরে যুক্তরাষ্ট্র খুব ভালো করে জানে যে তাদের এমন কিছু সক্ষমতা রয়েছে, যার মধ্য দিয়ে যেকোনো ধরনের ক্ষতি তারা পুষিয়ে ওঠার সামর্থ্য রাখে। সাম্প্রতিক যুদ্ধে নতুন করে প্রমাণিত হয়েছে যে ইরানের বর্তমান সরকারব্যবস্থা নিয়ে দেশটির ভেতরে ব্যাপক জন-অসন্তোষ থাকলেও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা যখন বিপন্ন হতে বসে, তখন ইরানিরা সবাই এক জাতীয়তাবাদী আদর্শের পতাকাতলে সমবেত হয়। ইরানের সাবেক শাহর নির্বাসিত পুত্র রেজা শাহকে নিয়ে ইসরায়েল এবং পশ্চিমারা আবারও ইরানের ভেতরে সরকারবিরোধী আন্দোলনকে চাঙ্গা করতে চাইলেও ইরানে ইসরায়েলের হামলা এবং প্রাণহানি নিয়ে তিনি ইসরায়েলের প্রশংসা করে সরকারবিরোধীদেরও রোষানলে পড়েছেন। পশ্চিমারা রেজা শাহকে সামনে নিয়ে ইরানে নতুন করে কোনো বিপ্লব সংগঠিত করতে চাইলে এ ক্ষেত্রে এর ব্যর্থতা অনিবার্য। তবে ইরানকে আবারও ঘুরে দাঁড়ানো দেখাটাও তাদের জন্য এক চপেটাঘাতের শামিল। আর সে জন্যই ইরানের নীতিনির্ধারকরা পর্যন্ত এটি শঙ্কা করছেন যে আইএইএকে কোনো ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে নাএমন অভিযোগ তুলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল আবারও ইরানে হামলা করে বসতে পারে। 

ইরানের অবস্থানকে সুবিধার মনে করছে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অস্থিরতার প্রকাশ ঘটেছে তাঁর নতুন সিদ্ধান্তে। গত ৪ জুলাই ইরানের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। এই নিষেধাজ্ঞা ইরানের ওপর আগেকার নিষেধাজ্ঞার চেয়ে কিছুটা ব্যতিক্রম। এত দিন ধরে চাউর ছিল যে ইরানের তেল ও গ্যাস রপ্তানির ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থাকলেও শ্যাডো ফ্লিটের (গোপন জাহাজ) মাধ্যমে ইরান এই রপ্তানি চালিয়ে যাচ্ছে। নতুন করে জানা গেছে, ইরাকি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ ব্যবসায়ী সালেহ আহমেদ সাঈদীর মালিকানাধীন বিভিন্ন কম্পানির মাধ্যমে ইরানের তেল ইরাকের তেলের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে আরব আমিরাত হয়ে পশ্চিমা দেশগুলোতে রপ্তানি হয়ে আসছে, যার মাধ্যমে বছরে ১০০ কোটি ডলারের বেশি আয় করছে ইরান। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ব্যবসায়ী সালেহর কম্পানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন, যেন ইরান এভাবে বাণিজ্য করে এর থেকে অর্জিত অর্থ দিয়ে তা সামরিক খাতে ব্যয় করতে না করে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মনে করছেন, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি থেকে তাকে বিরত রাখতে হলে সর্বাগ্রে তার অর্থনৈতিক সামর্থ্যের জায়গায় আঘাত করতে হবে। তবে এখানে একটি কথা থেকে যায়, যে ১০০ কোটি ডলার আয়ের কথা বলা হয়েছে, বাস্তবে এটি ইরানের অর্থনীতিতে যে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে তার পারমাণবিক সক্ষমতাকে চালিয়ে নেওয়ার জন্য, সেটি খুব একটা যুক্তিগ্রাহ্য নয়।  

মোটকথা হচ্ছে, ইরান মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ও ইসরায়েলের স্বার্থের পথে সবচেয়ে বড় বাধা। এখন কথা হচ্ছে, ইরান যদি এমনটা মনে করে থাকে যে তারা আবারও সম্ভাব্য হামলা থেকে নিরাপদ নয়, সে ক্ষেত্রে তাদের প্রতিরক্ষার ধরন কেমন হবে? এ ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে কয়েকটি অনুমান করা যেতে পারে। প্রথমত, হরমুজ প্রণালি ঘিরে তারা তাদের কৌশলকে শাণিত করতে পারে, যেন পশ্চিমা বিশ্ব ইরানের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আগাম ধারণা পেতে পারে; দ্বিতীয়ত, তাদের নতুন করে আরো উন্নতমানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সংগ্রহ করে ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করতে হবে; তৃতীয়ত, যুদ্ধাস্ত্রের ক্ষেত্রে ইসরায়েলি প্রযুক্তির বিপরীতে নিজেদের প্রযুক্তি দুর্বলএই বাস্তবতার আলোকে এটিকে আরো উন্নত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে তারা চীন ও রাশিয়ার সহায়তা নিতে পারে এবং চতুর্থত, রাশিয়ার সঙ্গে তাদের চলমান কৌশলগত সম্পর্ককে আরো কার্যকর করার পাশাপাশি চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে উন্নত করা এবং ইসরায়েলের যেমন যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি শক্তি সর্বদা তাদের পাশে রয়েছে, ইরানকেও এমন পাশে থাকার মতো বৃহৎ শক্তিধর রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ককে আরো জোরদার করতে হবে।

আগামী কয়েক দিনের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে গাজায় হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধের আপাত অবসান হতে চলছে বলে মনে হচ্ছে। এটি মানে এই নয় যে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। বরং হামাস, হুতি ও হিজবুল্লাহর মতো সংগঠনগুলোর দুর্বলতার এই সুযোগে ইরানকে আরো পর্যুদস্ত করার নতুন চেষ্টা করতে পারে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র। তারা খুব ভালো করেই জানে এই সময়ে এসে তারা যদি ইরানকে ছাড় দেয়, তাহলে ইরান দ্রুতই আরো শক্তি সঞ্চয় করে তার প্রক্সিদের মাধ্যমে ইসরায়েলকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলবে। এসব যুক্তিতে ইরানে ফের হামলার শঙ্কা থেকেই যায়।

 

লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

mfulka@yahoo.com

মন্তব্য

ব্যাংকিং খাতে মানুষের আস্থা ফেরাতে হবে

    ড. মো. শফিকুল ইসলাম
শেয়ার
ব্যাংকিং খাতে মানুষের আস্থা ফেরাতে হবে

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে কিছু গুরুতর সমস্যা বিদ্যমান। অতীতে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন দেওয়া ব্যাংকগুলো ভালো পারফরম করতে পারছে না। বর্তমানে ব্যাংক খাতের জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে খেলাপি ঋণের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি, যদিও এই সমস্যাটি অতীতের জের ধরেই তৈরি। খেলাপি ঋণের সমস্যার সমাধান করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক উল্লেখযোগ্য কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, যেখানে কিছু ব্যাংকের অতীতের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়াসহ আর্থিক খাত সংস্কারের জন্য টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে তফসিলি ব্যাংকগুলোর মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা মোট ঋণের ২০.২ শতাংশ। ২০২৪ সালের জুনে ছিল দুই লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা, যা ছিল মোট ঋণের ১২ শতাংশ। জুন থেকে ডিসেম্বর সময়ে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে এক লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকা। অনেক ব্যাংক এখন মূলধন ঘাটতিতে ভুগছে, যা তাদের ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতাও কমিয়েছে।

ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের অভাব একটি বড় সমস্যা। এখানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ঘাটতি রয়েছে, যা দুর্নীতি ও অনিয়মকে উৎসাহিত করে। ব্যাংকিং খাতকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। অন্যথায় বিভিন্ন অনিয়ম ও জালিয়াতি বাড়তে থাকবে, যা ব্যাংকের ওপর মানুষের আস্থা কমাবে।

ব্যাংকিং খাতে এখন অনেক ধরনের অনিয়ম ঘটে এবং তা নিয়মিত গণমাধ্যমে আসে। ব্যাংকের কর্মকর্তার টাকা নিয়ে পালিয়ে যাওয়া, ভুয়া রসিদের মাধ্যমে গ্রাহকদের কয়েক কোটি টাকা তুলে নেওয়াএমনই আরো অনেক অভিযোগই পাওয়া যায়।

বিগত এক দশকের খেলাপি ঋণ অনুপাতের চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ব্যাংক সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ঋণ আদায়ে অদক্ষতা এবং ত্রুটিপূর্ণ ঋণ ব্যবস্থার কারণে ওই অনুপাত ২০১৪ সালের ৬.১০ থেকে ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৮ সালে ১০.৩০ শতাংশে পৌঁছে। এরপর অনুপাত একটু কমে ২০২০ সালে হয় ৭.১০ শতাংশ।

তবে ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে আবার তা বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৪ সালে খেলাপি ঋণ অনুপাত ২০.২০ শতাংশে উন্নীত হয়, যা এক বছরে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এই বৃদ্ধি ব্যাংকিং খাতের আর্থিক অবস্থার চরম সংকটেরই বহিঃপ্রকাশ।

উচ্চ খেলাপি ঋণের কারণে আমানতকারীদের আস্থায় ঘাটতি দেখা দিতে পারে। সঞ্চয়ের নিরাপত্তার জন্য বিদেশি ব্যাংক, এমনকি অনানুষ্ঠানিক, অনিয়ন্ত্রিত চ্যানেলে স্থানান্তর বা জমা করতে তাঁরা প্ররোচিত হতে পারেন, যা বেসরকারি ব্যাংকের জন্য চ্যালেঞ্জ। সীমিত ঋণপ্রবাহ শিল্প উৎপাদন, বিনিয়োগ এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে ব্যাহত করে। এ ছাড়া মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক অস্থিরতাকেও বাড়িয়ে তোলে। যখন খেলাপিরা শাস্তি থেকে বেঁচে যায়, তখন এটি ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণের সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করে।

বৈদেশিক বিনিয়োগকারী, ক্রেডিট রেটিং সংস্থা ও উন্নয়ন অংশীদাররা দেশের আর্থিক বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর প্রশ্ন তুলতে পারে, যা ঋণের খরচ বাড়িয়ে দিতে পারে এবং বিদেশি বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। যদি কার্যকর কাঠামোগত সংস্কার, সঠিকভাবে আইন প্রয়োগ এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার মাধ্যমে খেলাপি ঋণ সংকটের সমাধান করা না হয়, তাহলে বাংলাদেশের আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক গতিপথ দুর্বল হয়ে পড়তে পারে, যা কোনোভাবেই দেশের অর্থনীতির জন্য সুখকর নয়। এ জন্য প্রয়োজন ব্যাপক সংস্কার। সরকার ও নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

বছরের পর বছর ধরে অনিয়ম, দুর্নীতি এবং আইন ভঙ্গের চর্চার জন্য ব্যাংকিং খাতের আজকের এই পরিণতি, যা থেকে এ খাতের উত্তরণ অত্যন্ত জরুরি। এ ছাড়া ব্যাংক প্রশাসনকে রাজনীতিমুক্ত করা, ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপিদের নাম প্রকাশের মাধ্যমে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করা এবং স্বাধীন আর্থিক ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করা যেতে পারে। ব্যাংকিং খাতের সমস্যা সমাধানের জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাচালিত ঋণ মূল্যায়ন এবং ডিজিটাল ঋণ পর্যবেক্ষণের মতো প্রযুক্তিগত ব্যবস্থার প্রসার ঘটাতে হবে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে দায়িত্বশীল ঋণগ্রহীতাদের পুরস্কৃত করার পাশাপাশি ঋণখেলাপিদের নানাভাবে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। স্বাধীন ব্যাংকিং সংস্কার কমিশন প্রতিষ্ঠা করা বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য অত্যন্ত জরুরি।

 

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

মন্তব্য

নির্বাচন ব্যবস্থায় উপযুক্ত পরিবেশ জরুরি

    ড. সুলতান মাহমুদ রানা
শেয়ার
নির্বাচন ব্যবস্থায় উপযুক্ত পরিবেশ জরুরি

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন (ইসি) ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি ও এপ্রিলএই দুটি টাইমফ্রেম বা সময়সীমা সামনে রেখে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে তাদের বক্তব্য-বিবৃতি থেকে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। এমনকি এ তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে যে স্থানীয় সরকার নয়, বরং সংসদ নির্বাচন ঘিরে পুরোদমে প্রস্তুতি নিচ্ছে সাংবিধানিক এই সংস্থা। কিন্তু যেমন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এবং তেমনি সরকারের সঙ্গেও বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের এক ধরনের টানাপড়েন চলছে। এমনকি বাংলাদেশের রাজনীতি কোন দিকে যাচ্ছে, সেটিও এখন অনুমান করা কষ্টকর হয়ে পড়েছে।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় নির্ধারণ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে যে উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল, লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠকের পর সেটি কেটেছে বলে মনে করা হচ্ছিল, কিন্তু দুই সপ্তাহ যেতে না যেতেই নতুন করে নির্বাচনকেন্দ্রিক সংশয় তৈরি হয়েছে নানা মহলে। বিশেষ করে ভোটের বিষয়ে সরকারের দিক থেকে এখন পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনকে স্পষ্ট কোনো বার্তা না দেওয়ায় এ নিয়ে জল্পনাকল্পনা বাড়ছে। আবার দু-একটি রাজনৈতিক দলও এমন সব বক্তব্য দিচ্ছে, যা জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় নিয়ে সংশয় সৃষ্টি করছে। এর মধ্যে আছে, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন দাবি করা, গণহত্যার বিচার ও সংস্কার সম্পন্ন করার আগে কোনো নির্বাচন নয় ইত্যাদি।

https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/07.july/08-07-2025/kalerkantho-ed-1a.jpgবাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ইতিহাসে সংকট ও অনাস্থার পরিবেশ নতুন নয়। অনাস্থার বেড়াজাল থেকে রাজনৈতিক দলগুলো কখনোই বের হতে পারেনি। গণতন্ত্রের নামে এবং গণতন্ত্র রক্ষার অঙ্গীকারে রাজনৈতিক দলগুলো বারবারই রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। সাম্প্রতিককালে এমনই এক অনিশ্চয়তার দোলাচলে ঘুরপাক খাচ্ছে বিদ্যমান রাজনীতি।

দেশে আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এখনো অনেক সংশয় রয়েছে। নির্বাচনের সময় ও অন্যান্য বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পথনির্দেশ থাকতে হবে। নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা, স্বচ্ছতা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে আস্থার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। তা না হলে দেশে সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলে নানা মহল থেকে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ জন্য একটি সুশৃঙ্খল গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে বর্তমানে সরকার, নির্বাচন কমিশন ও সব রাজনৈতিক দলকে আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে।

বর্তমানে বিশিষ্টজনরা নির্বাচনমুখী আলোচনায় ব্যস্ত। কারণ সবাই একটি নির্বাচনী টাইমফ্রেম চায়।

আমরা লক্ষ করছি, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সংস্কার এবং বিচারের আগে নির্বাচন না দেওয়ার বিষয়ে কথা বলে যাচ্ছে। এমনকি এনসিপির আহবায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, জুলাই ঘোষণাপত্র না দিলে তাঁরা নির্বাচনে অংশ নেবেন না। কয়েকটি দলের নেতাদের বক্তব্য-বিবৃতি শুনে মনে হচ্ছে, তাঁরা নির্বাচন বিষয়ে ধীরগতিতে আগাতে চান। কারণ তাঁদের উপলব্ধি হচ্ছে নবগঠিত দলের ৩০০ আসনে প্রার্থিতা নিশ্চিত করা এবং ভোটারদের কাছে তাঁদের নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা কিংবা জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে তুলতে কিছুটা সময় প্রয়োজন। অন্যদিকে বিএনপি দ্রুত নির্বাচনের দিকে আগাতে চায়। জামায়াত সংস্কার প্রসঙ্গে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।

রাজনৈতিক দলগুলোর মূল লক্ষ্য হলো নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া। আর এই লক্ষ্য সামনে রেখে প্রতিটি রাজনৈতিক দলই নিজস্ব কৌশল প্রয়োগে ব্যস্ত থাকবে, সেটি স্বাভাবিক। কৌশল প্রয়োগের লক্ষ্যে সব দলই নিজ নিজ জায়গা থেকে সামনে এগিয়ে যাবে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মেরুকরণ ঘটবেএটি অস্বাভাবিক কিছু না। মূলত নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য রাজনৈতিক মেরুকরণে পরিবর্তন হতে পারে। তবে কোনো দল যদি রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিজ নির্বাচনী আয়োজনের পক্ষে কাজে লাগানোর সুযোগ পায় অথবা কাজে লাগায়, তাহলে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সেটি উপযুক্ত হবে না। নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে সামনে আসবে। আর নির্বাচন কমিশনও যদি প্রভাবিত না হয়ে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারে, তাহলেই নির্বাচন ও রাজনীতি দুটিই গ্রহণযোগ্য মাত্রা পাবে। আর এ কারণেই সব পক্ষকে সমান সুযোগের আওতায় নিয়ে আসার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশন ও সরকারের।

বাংলাদেশ সংবিধানের ১২০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালনের জন্য যেরূপ কর্মচারীদের প্রয়োজন হইবে, নির্বাচন কমিশন অনুরোধ করিলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনকে সেইরূপ কর্মচারী প্রদানের ব্যবস্থা করিবেন। কাজেই নির্বাচন কমিশনই প্রশাসনকে ঢেলে সাজিয়ে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করতে পারে। মূলত নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের উপযুক্ত ভূমিকার ওপরই সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়টি বহুলাংশে নির্ভর করে।

আসন্ন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে তিনটি চ্যালেঞ্জ দৃশ্যমান হতে পারে। প্রথমত, নির্বাচনে বেশির ভাগ ভোটারের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা; দ্বিতীয়ত, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান; তৃতীয়ত, ভবিষ্যতে সাধারণ জনগণের ভোটে অংশ নেওয়ার বিষয়ে আগ্রহ সৃষ্টি করা। কারণ নির্বাচন যদি ভালো হয়, তাহলে নির্বাচনী রাজনীতিতে জনগণের আস্থা তৈরি হবে আর ভালো না হলে তৈরি হবে স্থায়ী অনাস্থা।

অবশ্য রাজনীতিতে কিছু গুণগত পরিবর্তন আনাও জরুরি। আর তা করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরাই নিজেদের পথের কাঁটা হওয়া থেকে সরে আসতে হবে। দেশ ও জাতির উন্নয়ন করতে হলে রাষ্ট্রক্ষমতার চাবি হাতে থাকা যেহেতু জরুরি, সেহেতু রাজনৈতিক দলগুলোর মূল লক্ষ্য থাকে ক্ষমতায় যাওয়া। ক্ষমতায় যেতে অর্থাৎ আগামী নির্বাচনে বিজয়ী হতে রাজনৈতিক দলগুলো এখন মরিয়া হয়ে উঠবেএমনটাই স্বাভাবিক। তবে শিষ্টাচারসম্মত রাজনীতির জন্য জনপ্রতিনিধিদের গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি।

আমাদের নিজেদের বিবেক এবং চিন্তা যদি পরিশীলিত বা মার্জিত না হয়, তাহলে কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক উত্তরণের ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তনের প্রত্যাশা সফল হবে না। আমরা বাংলাদেশে যে কাঠামোই চয়েস করি না কেন কিংবা যেমন আইনই তৈরি করি না কেন অথবা যেমন সংস্কারই হোক না কেন, এগুলো বাস্তবায়নের মূলে রয়েছে নাগরিক এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মানসিকতার পরিবর্তন। মানসিকতা পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই একটি গ্রহণযোগ্য মানের উদার নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা পেতে পারে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, দেশের সাধারণ মানুষ রাজনীতির একটি গুণগত পরিবর্তন প্রত্যাশা করে। আর এ কারণে নতুন রাজনৈতিক দলসহ বিদ্যমান সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের উদ্দেশে বলব, আপনারা যদি দেশের রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন চান, তাহলে অতীতের অনেক আচরণ বদলানোর প্রয়োজন হবে। মনে রাখবেন, রাজনীতি মানে উগ্রতা বা প্রতিহিংসা নয়। রাজনীতি মানে ভদ্রতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং সহনশীলতা। আর এসব গুণের মধ্য দিয়ে জনগণের মনে স্থান করে নিতে হবে। রাগ, হিংস্রতা কিংবা প্রতিহিংসাপরায়ণ আচরণ দিয়ে রাজনীতি করলে কখনোই রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আসবে না। আমরা অপেক্ষাকৃত উন্নত, ভালো এবং নতুন কিছু প্রত্যাশা করি। আর এ জন্য পরিবর্তন শুধু মুখে নয়, আচরণে এবং কার্যক্রমে প্রমাণ করা এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।

 

লেখক : অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

sultanmahmud.rana@gmail.com

মন্তব্য

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান : চাওয়া-পাওয়ার দাগ-খতিয়ান

    তুহিন খান
শেয়ার
জুলাই গণ-অভ্যুত্থান : চাওয়া-পাওয়ার দাগ-খতিয়ান

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রায় এক বছর উপলক্ষে জুলাই ও আগস্ট মাসজুড়ে বেশ বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানসূচি ঘোষিত হয়েছে ইন্টেরিম সরকারের তরফে। কিন্তু এক বছরে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব কতটা মেলানো গেল? জুলাইয়ের সুফল কার ঘরে কতটা উঠল?

গণ-অভ্যুত্থান নিজেই একটি বড় প্রাপ্তি। যে অভ্যুত্থানের ফলে আওয়ামী লীগের মতো একটি নিকৃষ্ট ফ্যাসিস্ট শাসকগোষ্ঠীর পতন হলো, তার চেয়ে বড় প্রাপ্তি এ দেশের জনগণের জীবনে খুব কমই আছে। এই অভ্যুত্থানের আগে-পরে দেশে যে বিপুল জনসচেতনতা ও সৃষ্টিশীল গণক্ষমতার উদ্বোধন আমরা দেখেছি, তরুণদের মধ্যে যে স্বচ্ছ রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ও দেশ গঠনের দৃঢ় প্রত্যয় জন্ম নিতে দেখেছি, তা এককথায় মহাকাব্যিক।

সেদিন থেকে জুলাই ওয়ান্স ইন আ লাইফটাইম ইভেন্ট এবং এর প্রাপ্তির দিকটি অনেক বড়। কিন্তু জুলাই-পরবর্তী সরকার, রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সাংস্কৃতিক রাজনীতি ও সমাজব্যবস্থার বাস্তব ক্ষেত্রগুলোতে এই মহাকাব্যিক ঘটনা কাঠামোগতভাবে কতটা অনূদিত হতে পারল, আমরা নানা রকম ভাঙার পাশাপাশি কতটা গড়তে পারলামসেদিক বিবেচনায় অপ্রাপ্তিও কম না।

গত বছর ৮ আগস্ট ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার ভারত পলায়নের পরিপ্রেক্ষিতে যে সরকারটি গঠিত হয়, তার ধরনটি ঠিক কী হবে, কী হলে আরো ভালো হতো, এ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা আছে। অন্তর্বর্তী এই সরকারটি গঠিত হয়েছে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করেই; আবার গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের কেউ কেউ এ সরকারের অংশ হয়েছেন।

ফলে এ সরকারের ধরনটি ঠিক কী, তার মেয়াদ ও ম্যান্ডেট কতটুকু হওয়া সংগত, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। যদিও কিছুদিন আগে এক টক শোতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, এই সরকারের সবকিছু করারই ম্যান্ডেট আছে; তবে কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে এই দাবিটি খুব জোরালো বাস্তব ভিত্তি নিয়ে হাজির নেই। গেল বছর ডিসেম্বর থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে যে বহুমুখী জটিলতা ও ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে, তার মূলেও আছে অন্তর্বর্তী সরকারের ধরন নিয়ে এই তর্ক। ঘোষিতভাবে একটি অন্তর্বর্তী সরকার হলেও সরকারের ভেতরে ও বাইরে অনেকেই একে একটি বিপ্লবী সরকার করে তুলতে আগ্রহী, যদিও এর কোনো সুস্পষ্ট রূপরেখা জনসমাজে স্পষ্টভাবে হাজির নেই।
পুরনো ধারার রাজনৈতিক দলগুলো, যারা এই গণ-অভ্যুত্থানের এবং সরকারেরও অন্যতম প্রধান শরিকএই বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষার ব্যাপারে তাদের বেশির ভাগেরই মনোভাব নেতিবাচক, কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত।

জুলাইয়ের বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষা, অন্তর্বর্তী সরকারের এই ধরন ও রাজনৈতিক শক্তিগুলোর অবস্থানএই তিনের টানাপড়েন শেষমেশ যে জাতীয় আকাঙ্ক্ষায় থিতু হয়েছে, তার আলংকারিক নাম : সংস্কার। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আগ থেকেই বেশ কিছু রাজনৈতিক দল ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্ল্যাটফর্মের কারণে রাষ্ট্র সংস্কার ধারণাটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ফলে সেটির প্রায়োগিক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে এবং কিভাবে ও কতটুকু হবে এই সংস্কারসেটিই প্রধান আলোচ্য বিষয়। বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন হয়েছে দেশে এবং সেসব কমিশন বড় বড় রিপোর্টও তৈরি করেছে।

কিন্তু এসব সংস্কার প্রস্তাবের ঠিক কতটুকু বাস্তবায়ন করা যাবে বা গেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন ও অনিশ্চয়তা আছে। তা ছাড়া সংস্কার আর নির্বাচনকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে, সংস্কারের এজেন্ডাটিকে আরো কঠিন করে তোলা হয়েছে।

রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদের স্বাভাবিক ফলাফল হিসেবেই যে সামাজিক ফ্যাসিবাদ ও ধর্মীয় চরমপন্থা সুপ্তাবস্থায় প্রায় এক যুগ ধরে আস্তে আস্তে গাঢ় হয়ে উঠছিল, তা অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে নিঃশেষিত হয়নি, বরং নানা ধরনের সামাজিক ও ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী প্রবণতা নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন শক্তিতে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে পরাজিত ফ্যাসিস্ট শক্তি ও তার দেশি-বিদেশি এজেন্টরা এই প্রবণতাগুলোকে অনেক রংচং মেখে বাস্তবের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বিকট করে উপস্থাপন করার চেষ্টায় রত। জুলাইয়ের শক্তিগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন ও মেরুকরণও এই পরিস্থিতিটিকে বেশ ঘোলাটে করে তুলছে। সে ব্যাপারে সতর্ক থেকেও বলা যায় যে এই ঘটনাগুলো ঘটছে।

মব শুনলেই অনেকে খেপে যান আজকাল, তার সংগত কারণও আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু সত্য কথা এটিই যে ৫ আগস্টের পর দেশে নানা রকম মব তৈরি হয়েছে। সামাজিক-নৈতিক পুলিশগিরি বাড়ছে। এসবের সঙ্গে জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা বা বিপ্লবী তৎপরতার যোগ সামান্য। ধর্মীয় চরমপন্থাও এই পরিস্থিতিকে একটি সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করছে।

বিপ্লবী ছাত্র-জনতা ও সরকারের কাজ ছিল সমাজে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা এই নতুন প্রতিবিপ্লবী, হঠকারী ও ফ্যাসিস্ট তৎপরতাগুলোরও বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, যেখানে মোটাদাগে স্পষ্টতই তারা ব্যর্থ হয়েছে। এতে সমাজে সরকার ও অভ্যুত্থানের নেতৃত্বের ব্যাপারে যে মাত্রারই হোক, একটি নেতিবাচকতা তৈরি হয়েছে।

৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ের একটি প্রধান জনদাবি ও গুরুতর কাজ ছিল বিচার ও আনুষ্ঠানিক রিকনসিলিয়েশন প্রসেস শুরু করা। কিন্তু এই দাবিটি বিদ্যমান কোনো রাজনৈতিক শক্তিই সততার সঙ্গে সামনে আনতে পেরেছে বলে মনে হয় না। নির্বাচনী রাজনীতির হিসাব-নিকাশ, সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর টানাপড়েন, মামলা বাণিজ্যের পলিটিক্যাল ইকোনমি, ঘোলা পানিতে মাছ শিকারিদের নানা রকম অপতৎপরতা, বিচারহীন পুনর্বাসনের বিবিধ উদ্যোগ আর সরকারের অস্পষ্ট ও গতিহীন নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যে বিচারের দাবিটির বহুলাংশ অপচয় হয়েছে। একটি ফ্যাসিস্ট সরকারকে উত্খাত করার পর অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি জাতীয় অখণ্ডতা রক্ষা ও সামাজিক-রাজনৈতিক রিকনসিলিয়েশন নিশ্চিতে যে ধরনের ব্যাপক, বহুমুখী ও কুশলী প্রাতিষ্ঠানিক তৎপরতা প্রয়োজন ছিল, সরকার সেটি করতে বেশ খানিকটা ব্যর্থই হয়েছে বলা যায়।

অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দলটিকে ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে এক ধরনের কৌতূহল, আকাঙ্ক্ষা ও দরদ তৈরি হয়েছে। তবে এই আকাঙ্ক্ষা নিরঙ্কুশ নয়। নির্বাচনী রাজনীতিতে ঢুকে পড়ায় বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামোর অনেক বিষয়ই আত্তীকৃত করতে হয়েছে দলটির, যা তাদের নানাভাবে বিতর্কিত করেছে। আবার এই দলটির গতি-প্রকৃতি কী হবে, তার কল্পনার বাংলাদেশটি ঠিক কেমন হবেএসব বিষয়েও নানা ধরনের অনুমান তৈরি হয়েছে। এসব সত্ত্বেও পরিবর্তনকামী বা সংস্কারবাদীরা এখনো এই দলটির ওপর ভরসা রাখতে চাইছেন বলেই মনে হয়।

প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির এই হিসাব চলবে। কিন্তু জুলাইয়ে ঘটে যাওয়া মহাকাব্যিক অভ্যুত্থানটি আমাদের জাতীয় জীবনে যে বিপুল পরিবর্তনের সম্ভাবনা হাজির করেছে, তা অসামান্য। আমরা এর কতটা কাজে লাগাতে পারব, তা এখনো অনিশ্চিত। তবে বাংলাদেশ যত দিন থাকবে, তত দিন মুক্তির এই অসামান্য সম্ভাবনা এ দেশের মানুষকে অনুপ্রাণিত করে যাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

লেখক : কবি, অনুবাদক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ