স্বাস্থ্য খাতকে সবার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল চলতি অর্থবছরের বাজেট। তবে জীবিকা সংরক্ষণের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের জন্য স্বল্প ও মধ্য মেয়াদি নানা কৌশলও স্থান করে নিয়েছিল চলতি বাজেটে। গত বছর এই সময়ে করোনার ধাক্কায় অনানুষ্ঠানিক খাতসহ আনুষ্ঠানিক খাতেরও অনেক উদ্যোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এমন অবস্থায় আদৌ একটি বাজেট দেওয়া সম্ভব হবে কি না সে ধরনের অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল।
জীবন বাঁচানোর বাজেটের প্রত্যাশায়
- ড. আতিউর রহমান
অন্যান্য

ওই বাজেটের সবচেয়ে উল্লেখ করার মতো দিক ছিল করোনা মোকাবেলায় স্বাস্থ্য খাতের জন্য প্রচলিত বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি ১০ হাজার কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দ।
আমাদের দেখা উচিত স্বাস্থ্য খাতের পুনর্নির্মাণে অন্য যেসব উদ্যোগ এই বাজেটকালেই সম্পূর্ণ করার কথা ছিল সেসবের কী হয়েছে। সব জেলায় হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ ইউনিট খোলার যে নির্দেশনা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দিয়েছিলেন তার বাস্তবায়ন পরিস্থিতি কেমন? সব জেলায় কি আইসিইউ ইউনিট গড়ে উঠেছে? সেখানে কি কেন্দ্রীয় অক্সিজেন বিতরণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে? যদি হয়েই থাকে, তাহলে এখনো কেন এত করোনা রোগী ঢাকামুখী? করোনা সামলাতে গিয়ে হাসপাতালগুলো অন্যান্য চিকিৎসার দিকে মনোযোগ দিতে হিমশিম খাচ্ছে। এসব বাস্তবতা স্বীকার করেই বর্তমান করোনা-সংকট মোকাবেলা করতে হচ্ছে। চলতি বাজেট থেকেই করোনা চিকিৎসায় নিয়োজিত ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী ও সহায়ক কর্মীদের পর্যাপ্ত প্রণোদনা দেওয়ার কথা ছিল। দেখার বিষয় সেসব তাঁরা পাচ্ছেন কি না। এ জন্য বাড়তি খরচ হলে সংশোধিত বাজেট থেকে নিশ্চয়ই মেটানো সম্ভব।
আগামী কয়েক বছর ধরেই আমাদের করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যেতে হবে। এক বছর ধরে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় যেসব ঘাটতি লক্ষ করা গেছে সেসব কী করে পূরণ করা যায়, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে আমাদের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও টারশিয়ারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সংস্কার কী করে করা সম্ভব এবং দীর্ঘ মেয়াদে একটি উপযুক্তমানের স্বাস্থ্য বীমা কাঠামো কী করে গড়ে তোলা সম্ভব—এসব কিছুই আগামী বাজেটে আলোচিত হবে এবং সে জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ মিলবে বলে আশা করছি। আগামী দিনের স্বাস্থ্য খাতের বাজেট ‘গতানুগতিক’ হলে চলবে না। আমরা লক্ষ করেছি দীর্ঘদিন ধরেই স্বাস্থ্য বাজেট মোট বাজেটের ৫ শতাংশের আশপাশেই ঘুরপাক খাচ্ছে। এ বাজেটকে আগামী অর্থবছরেই অন্তত ৭ শতাংশের ওপরে নিয়ে যাওয়া উচিত। পরবর্তী অর্থবছরগুলোতে এই হার আরো বাড়িয়ে অন্তত ১০ শতাংশে পৌঁছানোর উদ্যোগ নিতে হবে। যেহেতু স্বাস্থ্যই জীবন, তাই এ খাতের বাজেটটিই হতে হবে আসন্ন জাতীয় বাজেটের হৃিপণ্ড।
তবে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোতেই সীমাবদ্ধ থাকা যাবে না; লক্ষ রাখতে হবে ওই বাড়তি বরাদ্দ যেন ঠিক জায়গায় বিনিয়োগ করা হয়। সাধারণত স্বাস্থ্য বাজেটের মাত্র এক-চতুর্থাংশ প্রাথমিক স্বাস্থ্যের পেছনে যায়। অথচ স্বাস্থ্য সেবাপ্রার্থীদের বৃহত্তম অংশটিই কিন্তু প্রাথমিক সেবা চায়। কাজেই এই অনুপাত যত দ্রুত সম্ভব এক-তৃতীয়াংশে উন্নীত করা চাই। আমাদের রোগাক্রান্ত মানুষদের মধ্যে ১২ শতাংশ কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিক স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করে না। মহানগরগুলোতে এ অনুপাত প্রায় দ্বিগুণ (২৩ শতাংশ)। যদি ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামাদিতে সরকারি বিনিয়োগ আরো বাড়ানো যায়, তাহলে এ অবস্থার উন্নতি সম্ভব। অথচ মোট স্বাস্থ্য বাজেটের এক-পঞ্চমাংশেরও কম এ বাবদ বরাদ্দ হয়। কাজেই বর্ধিত বাজেটে এদিকটিতে নজর দেওয়া যায়। মোটকথা স্বাস্থ্যে বরাদ্দ বাড়ানোর সময় যথাযথ অগ্রাধিকার স্থির করা চাই।
প্রশ্ন উঠতে পারে এই বাড়তি অর্থায়ন আসবে কোত্থেকে? প্রচলিত অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক উৎস থেকে বাড়তি অর্থায়ন ছাড়াও আমরা ‘বক্সের বাইরে’ চিন্তা করে বাড়তি রাজস্ব সংগ্রহ নিশ্চয়ই করতে পারি। যেমন—তামাকবিরোধী কার্যক্রমে যুক্ত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গবেষকরা হিসাব করে দেখিয়েছেন যে তামাকপণ্যের ওপর যথাযথভাবে করারোপ করা গেলে একদিকে প্রায় ২০ লাখ মানুষকে ধূমপান থেকে বিরত করা যাবে (ফলে স্বাস্থ্য ব্যয় কমবে), অন্যদিকে এর ফলে তিন হাজার ৪০০ কোটি টাকা বাড়তি রাজস্বও আসবে। একইভাবে তামাকপণ্য থেকে যে ১ শতাংশ স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ আহরণ করা হয়, সেটা সরাসরি স্বাস্থ্য খাতে পৌঁছানো গেলেও তা পুরো স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়াতে সহায়ক হবে।
তবে শুধু স্বাস্থ্য খাতের বাজেট বাড়িয়ে মানুষকে বাঁচানো সম্ভব নয়। এই প্রাণঘাতী করোনা আমাদের অর্থনীতির প্রায় সব ক্ষেত্রেই আঘাত হেনেছে। আর সে কারণেই কর্মহীনতার পরিমাণ ব্যাপক হারে বেড়েছে। এদের সবাইকে সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীর মধ্যে আনা সম্ভব হয়নি। আমাদের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলো আগের চেয়ে অনেকটাই পরিবর্তন করা গেলেও এখনো তা নিশ্ছিদ্র ও স্মার্ট করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। অর্থ মন্ত্রণালয় একটি ভালো তথ্যভাণ্ডার গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। তারাও স্বীকার করছে যে স্মার্ট সামাজিক সুরক্ষা কাঠামোটি এমনভাবে দাঁড় করাতে হবে, যেখানে সরকারি ও অসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অংশীদারি গড়ে ওঠে। অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, তাঁরা দুর্যোগকালীন স্ট্যান্ডিং অর্ডার সংশোধন করেছেন। জানি না কভিড-১৯ অভিজ্ঞতার আলোকে ওই স্ট্যান্ডিং অর্ডারে স্বাস্থ্য খাতকে আলাদা করে চিহ্নিত করা হয়েছে কি না; যদি হয়ে থাকে তাহলে ভালো। আর না হয়ে থাকলে চলমান স্বাস্থ্য দুর্যোগের পর ফের দুর্যোগ এলে প্রশাসন, সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল, অসরকারি ও ব্যক্তি খাত এবং সংশ্লিষ্ট স্থানীয় সরকার ও সামাজিক উদ্যোগগুলোকে কী করে সুসমন্বিতভাবে সক্রিয় ও দায়বদ্ধ করা যায় সে বিষয়গুলো যুক্ত করা নিশ্চয়ই সম্ভব।
কভিড অভিজ্ঞতার আলোকেই সরকার অনলাইনে ‘ওয়ানস্টপ সার্ভিস’সহ অনেক ব্যবসাবান্ধব উদ্যোগ নিয়েছে। বিডা ও অন্য রেগুলেটরি সংস্থাগুলো এসব নিয়ে কাজ করছে। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষও (বেজা) একই ধারায় কাজ করছে। প্রবাসী বিনিয়োগকারীরা এরই মধ্যে ‘ওয়ানস্টপ সার্ভিসে’র সেবা ভালোভাবেই পেতে শুরু করেছেন। বিডা জানিয়েছে, ৩৫টি প্রধান রেগুলেটরি সেবা একই অনলাইন মঞ্চ থেকে তারা এখন দিতে পারছে। শুনেছি ‘ব্যাংক্রাপসি আইন’ সংশোধনের উদ্যোগ সরকার নিতে যাচ্ছে। এটা তাড়াতাড়ি করা গেলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়বে। ২০১৮ সালের কাস্টম আইনের প্রবিধান এরই মধ্যে চালু করা সম্ভব হয়েছে। আধুনিক ঝুঁকিনির্ভর কাস্টম পদ্ধতির অনুমোদন ও বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এর ফলে বন্দরে মালামাল খালাসে গতি বাড়বে।
চলতি অর্থবছরে ঝুঁকিপূর্ণ অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের দক্ষতা বাড়ানো এবং জীবিকা পুনরুদ্ধারে ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির প্রবর্তন করা হয়েছে। পিকেএসএফ এই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এটি অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবে যে পরিমাণ মানুষ এখন কর্মহীনতার চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছেন সেই তুলনায় এই কর্মসূচি নিতান্তই সামান্য। এ ছাড়া প্রণোদনা কর্মসূচির অধীনে ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগগুলোর জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার যে কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল তার বাস্তবায়নের হার খুবই মন্থর। এখনো প্রায় এক-চতুর্থাংশ ঋণ দেওয়া সম্ভব হয়নি। অথচ এই কভিডকালে অসংখ্য তরুণ ও নারী উদ্যোক্তা ঘরে বসে ডিজিটাল ব্যবসা করছেন। পাড়ায় পাড়ায় ছোটখাটো দোকানদার এই সংকটকালেও আমাদের অর্থনীতি চাঙ্গা রেখেছে। এসব উদ্যোক্তার দরকার চলতি মূলধনের। ট্রেড লাইসেন্স, টিন নম্বর, বাণিজ্যিক ঠিকানা—এমন নানা কাগজ চেয়ে এদের ঋণপ্রাপ্তি থেকে দূরে রাখা হয়। রেগুলেটরি প্রতিষ্ঠানগুলো একটু উদারমনা হলে সহজেই এদের ঋণ বাজারে আনা সম্ভব।
উল্লেখ্য, সিটি ব্যাংক ও বিকাশ বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন সাপেক্ষে এদের নিয়ে একটি পাইলট পরিচালনা করেছিল। মোবাইল আর্থিক সেবায় ও ব্যাংকিং চ্যানেলে তাদের লেনদেন অবলোকন করে আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স ব্যবহার করে ১০ হাজার টাকার মতো স্বল্প ঋণ অল্প সময়ের জন্য চালু করেছিল। এই পাইলটকে সফল বলতে হয়, কারণ প্রদত্ত ঋণের ৯৯.৭ শতাংশই ফিরে এসেছে। এই অভিজ্ঞতার আলোকে এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন পেলেই এই ঋণ কর্মসূচির আওতা বাড়ানো সম্ভব। এমন করে ‘আউট অব বক্স’ চিন্তা করে করেই আমাদের এগোতে হবে। শুনেছি বাংলাদেশ ব্যাংক ১০ হাজার কোটি টাকার আরেকটি নয়া ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ঋণ কর্মসূচি উদ্ভাবন করেছে। আশা করছি খুব দ্রুতই তারা এ কাজটি সম্পন্ন করতে সক্ষম হবে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রণোদনা কর্মসূচিতে ডিজিটাল ড্যাস বোর্ড মনিটরিং ব্যবস্থা দাঁড় করিয়েছে। ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিমও তারা চালু করেছে। ব্যাংক রেট ও কৃষিঋণের সুদের হার কমিয়েছে। আশার কথা, শিগগিরই সব মোবাইল আর্থিক সেবা ইন্টার-অপারেবল হতে যাচ্ছে। সে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচের সংস্কার চলছে। একই সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অঙ্কের ই-কমার্স ও অন্যান্য সেবাও মোবাইল আর্থিক সেবার সঙ্গে যুক্ত করা হবে। কভিড-উত্তর অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে মোবাইল আর্থিক সেবা আরো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আমার বিশ্বাস। ডিজিটাল অর্থায়নের অবকাঠামো বিদ্যমান থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংক অনেক কিছুই করতে পারছে। এখন খেয়াল রাখতে হবে এসব আধুনিক ডিজিটাল অবকাঠামোর মেইনটেন্যান্স, রিপ্লেসমেন্ট ও সংস্কারের দিকে। কারণ মোবাইল আর্থিক সেবাসহ ডিজিটাল আর্থিক সেবার পরিমাণ এতটাই বেড়েছে যে পুরনো ডিজিটাল আর্থিক অবকাঠামো এই চাপ বেশিদিন সইতে পারবে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই এ ব্যাপারে সচেতন আছে।
তবে মানুষের কর্মহীনতার যে পরিস্থিতি তা কিন্তু শুধু ঋণ ও আর্থিক সেবা দিয়ে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। রাজস্ব নীতিকে এ ক্ষেত্রে সমান সক্রিয় হতে হবে। এ ক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে এখনো আমাদের করযোগ্য অনেক নাগরিকই কর জালের বাইরে রয়েছেন। নিশ্চয়ই ডিজিটাল প্রযুক্তির সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে এনবিআর তাঁদের কাছ থেকে কর আহরণের চেষ্টা করবে। তবে এর পাশাপাশি নাগরিকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে জাতীয় প্রচারাভিযান চালাতে হবে, যাতে নাগরিকরা বুঝতে পারেন তাঁরা যথাযথভাবে কর দিলে তা অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় সরকারকে তথা দেশকে সহায়তা করবে। নয়া নয়া খাত থেকে রাজস্ব সংগ্রহ ছাড়াও অর্থ মন্ত্রণালয়কে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে বরাদ্দ ব্যাপক হারে বাড়াতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রাকৃতিক দুর্যোগে পড়া কৃষক ও অনানুষ্ঠানিক খাতের ঝুঁকিপূর্ণ মানুষের জন্য ঈদের আগেই বিশেষ অনুদান নিঃসন্দেহে সময়োপযোগী হয়েছে। তবে এর পরিমাণ ও ব্যাপ্তি বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। প্রয়োজনে সরকারি ঋণ বাড়ে বাড়ুক। তবে কর্মহীন মানুষ যদি আরেকটু বেশি অর্থ পেতেন, তাহলে তা থেকে বাঁচিয়ে টুকটাক কিছু করে খাবার উদ্যোগও নিতে পারতেন, বিশেষ করে বৃষ্টিহীনতার ফলে গরম হাওয়ায় বোরো ফসলের যে ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে তা পুষিয়ে নেওয়ার যে উদ্যোগ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কৃষি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নিয়েছেন, তা প্রশংসনীয়। তবে এর গতি ও আকার দুই-ই বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে। ধান কাটার মেশিনে যে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে তা যেন আগামী বাজেটেও অব্যাহত থাকে। শুধু আমদানীকৃত কৃষিযন্ত্র নয়, এর পাশাপাশি বগুড়ার লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং ক্লাস্টারে দেশীয় যন্ত্র তৈরির সঙ্গে যুক্ত ছোটখাটো উদ্যোক্তাদের জন্যও এ ধরনের প্রণোদনা দেওয়া দরকার। একই সঙ্গে চালের বাজারদর স্থিতিশীল রাখার জন্য উপযুক্ত দামে ধান-চাল সংগ্রহ নীতির পূর্ণ বাস্তবায়ন অপরিহার্য। খাদ্যের মজুদ ঠিকঠাক রাখতে খাদ্য আমদানিও চালিয়ে যেতে হবে। এসবের পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে বাধ্য হওয়ার ফলে যে ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নিতে এবং কভিড-উত্তর বিশ্বের উপযোগী মানবসম্পদ গড়ে তুলতে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে বিনিয়োগকেও যথাযথ অগ্রাধিকার দিতে হবে।
আমাদের কৃষি, প্রবাস আয় ও রপ্তানি খাতই এই সংকটকালে বাঁচিয়ে রেখেছে। আগামী বাজেটে এই তিন খাতের জন্যই বাড়তি প্রণোদনা আশা করছি। সারা বিশ্বের ৫০০ নামকরা অর্থনীতিবিদের ওপর জরিপ চালিয়ে সংবাদ সংস্থা রয়টার্স বলেছে, চলতি বছরেই বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ধারেকাছে চলে যাবে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম হবে না। তবে প্রবৃদ্ধি নিয়ে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তার দরকার নেই। উন্নত দেশে টিকা প্রদান, বাইডেন প্রশাসনের অবকাঠামো উন্নয়ন বাজেট বৃদ্ধি এবং অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে প্রণোদনা অব্যাহত থাকায় তাদের মানুষের আয়-রোজগার বাড়বে। ফলে বিদেশে আমাদের রপ্তানি চাহিদাও বাড়বে। সে জন্য আরএমজিসহ রপ্তানিমুখী শিল্প ইউনিটগুলো চালু রাখার সিদ্ধান্তটি খুবই সুদূরপ্রসারী ছিল। আশা করছি, সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংককেও এ খাতের দিকে ইতিবাচক সমর্থন অব্যাহত রাখতে হবে। পাশাপাশি মেগাপ্রকল্পের অবকাঠামো নির্মাণের সিদ্ধান্তটিও সুবিবেচনাপ্রসূত ছিল। সারা দেশের পূর্তকর্মই এভাবে চালিয়ে যেতে হবে। কেইনসীয় অর্থনীতির ভাবনার আলোকে এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মতো শহরের রাস্তাঘাট, ড্রেন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, মেরামত করা, গ্রামের স্কুল, কলেজ, হাট, রাস্তাঘাট সংস্কার করার মতো যাবতীয় পূর্তকর্ম পূর্ণোদ্যমে চালিয়ে যেতে হবে। কর্মসৃজনই মূল লক্ষ্য। চিকিৎসাসেবা দিয়ে জীবন বাঁচানো এবং কর্মহীনকে কাজ দিয়ে এই করোনাকালে বাঁচিয়ে রাখাই হতে হবে আসন্ন বাজেটের মূল কাজ। মানুষ বাঁচানোর দায় একা শুধু সরকারের নয়। করপোরেট ও বিত্তবানদেরও সামাজিক দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন এক টাকায় ইফতার দিচ্ছে। এমন উদ্যোগ আরো দেখতে চাই। তা সম্ভব, যদি বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ নির্দেশনা (২৬ এপ্রিল ২০২১, বিআরপিডি সার্কুলার নং ০৯) অনুসারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সিএসআর সমর্থন নিয়ে এগিয়ে আসে।
লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর।
dratiur@gmail.com
সম্পর্কিত খবর

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান : চাওয়া-পাওয়ার দাগ-খতিয়ান
- তুহিন খান

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রায় এক বছর উপলক্ষে জুলাই ও আগস্ট মাসজুড়ে বেশ বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানসূচি ঘোষিত হয়েছে ইন্টেরিম সরকারের তরফে। কিন্তু এক বছরে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব কতটা মেলানো গেল? জুলাইয়ের সুফল কার ঘরে কতটা উঠল?
গণ-অভ্যুত্থান নিজেই একটি বড় প্রাপ্তি। যে অভ্যুত্থানের ফলে আওয়ামী লীগের মতো একটি নিকৃষ্ট ফ্যাসিস্ট শাসকগোষ্ঠীর পতন হলো, তার চেয়ে বড় প্রাপ্তি এ দেশের জনগণের জীবনে খুব কমই আছে। এই অভ্যুত্থানের আগে-পরে দেশে যে বিপুল জনসচেতনতা ও সৃষ্টিশীল গণক্ষমতার উদ্বোধন আমরা দেখেছি, তরুণদের মধ্যে যে স্বচ্ছ রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ও দেশ গঠনের দৃঢ় প্রত্যয় জন্ম নিতে দেখেছি, তা এককথায় মহাকাব্যিক।
গত বছর ৮ আগস্ট ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার ভারত পলায়নের পরিপ্রেক্ষিতে যে সরকারটি গঠিত হয়, তার ধরনটি ঠিক কী হবে, কী হলে আরো ভালো হতো, এ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা আছে। অন্তর্বর্তী এই সরকারটি গঠিত হয়েছে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করেই; আবার গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের কেউ কেউ এ সরকারের অংশ হয়েছেন।
জুলাইয়ের বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষা, অন্তর্বর্তী সরকারের এই ধরন ও রাজনৈতিক শক্তিগুলোর অবস্থান—এই তিনের টানাপড়েন শেষমেশ যে জাতীয় আকাঙ্ক্ষায় থিতু হয়েছে, তার আলংকারিক নাম : সংস্কার। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আগ থেকেই বেশ কিছু রাজনৈতিক দল ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্ল্যাটফর্মের কারণে ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ ধারণাটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ফলে সেটির প্রায়োগিক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে এবং কিভাবে ও কতটুকু হবে এই সংস্কার—সেটিই প্রধান আলোচ্য বিষয়। বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন হয়েছে দেশে এবং সেসব কমিশন বড় বড় রিপোর্টও তৈরি করেছে।
রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদের স্বাভাবিক ফলাফল হিসেবেই যে সামাজিক ফ্যাসিবাদ ও ধর্মীয় চরমপন্থা সুপ্তাবস্থায় প্রায় এক যুগ ধরে আস্তে আস্তে গাঢ় হয়ে উঠছিল, তা অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে নিঃশেষিত হয়নি, বরং নানা ধরনের সামাজিক ও ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী প্রবণতা নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন শক্তিতে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে পরাজিত ফ্যাসিস্ট শক্তি ও তার দেশি-বিদেশি এজেন্টরা এই প্রবণতাগুলোকে অনেক রংচং মেখে বাস্তবের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বিকট করে উপস্থাপন করার চেষ্টায় রত। জুলাইয়ের শক্তিগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন ও মেরুকরণও এই পরিস্থিতিটিকে বেশ ঘোলাটে করে তুলছে। সে ব্যাপারে সতর্ক থেকেও বলা যায় যে এই ঘটনাগুলো ঘটছে।
‘মব’ শুনলেই অনেকে খেপে যান আজকাল, তার সংগত কারণও আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু সত্য কথা এটিই যে ৫ আগস্টের পর দেশে নানা রকম মব তৈরি হয়েছে। সামাজিক-নৈতিক পুলিশগিরি বাড়ছে। এসবের সঙ্গে জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা বা বিপ্লবী তৎপরতার যোগ সামান্য। ধর্মীয় চরমপন্থাও এই পরিস্থিতিকে একটি সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করছে।
বিপ্লবী ছাত্র-জনতা ও সরকারের কাজ ছিল সমাজে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা এই নতুন প্রতিবিপ্লবী, হঠকারী ও ফ্যাসিস্ট তৎপরতাগুলোরও বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, যেখানে মোটাদাগে স্পষ্টতই তারা ব্যর্থ হয়েছে। এতে সমাজে সরকার ও অভ্যুত্থানের নেতৃত্বের ব্যাপারে যে মাত্রারই হোক, একটি নেতিবাচকতা তৈরি হয়েছে।
৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ের একটি প্রধান জনদাবি ও গুরুতর কাজ ছিল বিচার ও আনুষ্ঠানিক রিকনসিলিয়েশন প্রসেস শুরু করা। কিন্তু এই দাবিটি বিদ্যমান কোনো রাজনৈতিক শক্তিই সততার সঙ্গে সামনে আনতে পেরেছে বলে মনে হয় না। নির্বাচনী রাজনীতির হিসাব-নিকাশ, সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর টানাপড়েন, মামলা বাণিজ্যের পলিটিক্যাল ইকোনমি, ঘোলা পানিতে মাছ শিকারিদের নানা রকম অপতৎপরতা, বিচারহীন পুনর্বাসনের বিবিধ উদ্যোগ আর সরকারের অস্পষ্ট ও গতিহীন নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যে বিচারের দাবিটির বহুলাংশ অপচয় হয়েছে। একটি ফ্যাসিস্ট সরকারকে উত্খাত করার পর অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি জাতীয় অখণ্ডতা রক্ষা ও সামাজিক-রাজনৈতিক রিকনসিলিয়েশন নিশ্চিতে যে ধরনের ব্যাপক, বহুমুখী ও কুশলী প্রাতিষ্ঠানিক তৎপরতা প্রয়োজন ছিল, সরকার সেটি করতে বেশ খানিকটা ব্যর্থই হয়েছে বলা যায়।
অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দলটিকে ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে এক ধরনের কৌতূহল, আকাঙ্ক্ষা ও দরদ তৈরি হয়েছে। তবে এই আকাঙ্ক্ষা নিরঙ্কুশ নয়। নির্বাচনী রাজনীতিতে ঢুকে পড়ায় বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামোর অনেক বিষয়ই আত্তীকৃত করতে হয়েছে দলটির, যা তাদের নানাভাবে বিতর্কিত করেছে। আবার এই দলটির গতি-প্রকৃতি কী হবে, তার কল্পনার বাংলাদেশটি ঠিক কেমন হবে—এসব বিষয়েও নানা ধরনের অনুমান তৈরি হয়েছে। এসব সত্ত্বেও পরিবর্তনকামী বা সংস্কারবাদীরা এখনো এই দলটির ওপর ভরসা রাখতে চাইছেন বলেই মনে হয়।
প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির এই হিসাব চলবে। কিন্তু জুলাইয়ে ঘটে যাওয়া মহাকাব্যিক অভ্যুত্থানটি আমাদের জাতীয় জীবনে যে বিপুল পরিবর্তনের সম্ভাবনা হাজির করেছে, তা অসামান্য। আমরা এর কতটা কাজে লাগাতে পারব, তা এখনো অনিশ্চিত। তবে বাংলাদেশ যত দিন থাকবে, তত দিন মুক্তির এই অসামান্য সম্ভাবনা এ দেশের মানুষকে অনুপ্রাণিত করে যাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক : কবি, অনুবাদক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করা প্রয়োজন
- ড. নিয়াজ আহম্মেদ

করোনার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমে যে ছেদ তৈরি হয়েছিল, তা এখনো আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এ ছাড়া গত বছরের গণ-আন্দোলনে তিন-চার মাস আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। বিশ্ব্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত আমাদের এইচএসসি নামক পাবলিক পরীক্ষা। কোনো কারণে এইচএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে গেলে আমাদের ভর্তি কার্যক্রমও পিছিয়ে যায়।
আমরা যদি জানুয়ারি মাসে এসএসসি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে এইচএসসি পরীক্ষা নিতে পারি, তাহলে জুলাই মাসে উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা যাবে।
উচ্চশিক্ষা যেহেতু বহু রকমের, সেহেতু এখানেও অনেক বিষয় রয়েছে। মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার বিষয়টি সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ দ্বারা পরিচালিত হয়। তাই তারা বেশ দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারে। সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যদি একটি পরীক্ষায় ভর্তি নিতে পারত, তাহলেও সময় বাঁচত। কিন্তু তা সম্ভব হয়ে উঠছে না। আমাদের মানে শিক্ষকদের এখানে করণীয় রয়েছে। এইচএসসি পরীক্ষা শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে ভাবতে হবে। আমরা প্রতিবছর একই পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা এবং এর কার্যক্রম সম্পন্ন করি। ফলে দ্রুত কার্যক্রম শুরু করতে সমস্যা নেই। ফলাফল প্রকাশের এক সপ্তাহের মধ্যে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, এক মাসের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা এবং সর্বোচ্চ তিন মাসের মধ্যে পুরো ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করা সম্ভব।
আমাদের কাছে মনে হয়, সরকারের আন্তরিকতা এবং শিক্ষকদের সহযোগিতা এখানে মুখ্য বিষয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, কতটা সহজে এবং দ্রুত আমরা আমাদের ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারি। আমাদের টার্গেট যদি থাকে জানুয়ারি মাসের প্রথম দিন ক্লাস শুরু করা, তাহলে টার্গেট অনুযায়ী কাজটি করতে হবে। একদিকে শিক্ষার্থীরা পাবলিক পরীক্ষা দেবে, অন্যদিকে আমরা ভর্তি পরীক্ষার কার্যক্রম শুরু করব। সরকার যদি পাবলিক পরীক্ষা আগে এবং দ্রুত সম্পন্ন করতে পারে, তাহলে আমরাও দ্রুত ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারব। ধরুন, এখন এইচএসসি পরীক্ষা চলছে। আশা করা যায়, সেপ্টেম্বরে ফলাফল প্রকাশিত হবে। আমরা অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা শেষ করতে পারি। তিন মাসে কি ভর্তি পরীক্ষার যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করা যথেষ্ট নয়? আমাদের দরকার সরকারের ইচ্ছা এবং সবচেয়ে বড় দরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়, শিক্ষকদের মধ্যে সহযোগিতা ও আন্তরিকতা। আমরা আশা করব, আগামী শিক্ষাবর্ষে যেন জানুয়ারি মাসেই শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয়।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
nahmed1973@gmail.com

কজন জানে জুলাই সনদ কী
- গাজীউল হাসান খান

সমাজ ও বৃহত্তরভাবে রাষ্ট্র মেরামত কিংবা পরিবর্তনের জন্য যেসব কাঙ্ক্ষিত বা আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়, মূলত সেগুলোকেই সংস্কার বা ‘রিফর্ম’ বলা হয়। দেশের সংবিধান থেকে শুরু করে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নাগরিকরা কিংবা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সেসব সংস্কারের উদ্যোগ নিতে পারেন। তবে শেষ পর্যন্ত জাতীয় কিংবা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সেসব সংস্কার প্রস্তাবকে কার্যকর করতে হলে একটি আইনানুগ ভিত্তি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। বাংলাদেশে চব্বিশ সালের গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর সময়ে অতীত স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী শাসন এবং আর্থ-সামাজিক শোষণ-বঞ্চনার অবসানের জন্য দল-মত-নির্বিশেষে সবাই রাষ্ট্র মেরামতের একটি জোরালো দাবি উত্থাপন করেছে।
এ কথা ঠিক যে বিগত জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান কোনো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ছিল না। তবু সেটি আমাদের বিগত ৫৩ বছরের স্বাধীনতা-উত্তর আন্দোলনের ইতিহাসে একটি বিরাট মাইলফলক। স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী শাসন-শোষণের কবল থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে একটি বিশাল পদক্ষেপ। সুতরাং কোনো বিবেচনায়ই সে অভ্যুত্থানকে খাটো করে দেখা যাবে না।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান অধ্যাপক ড. ইউনূসসহ আমাদের রাজনৈতিক মহলের অনেকেই এরই মধ্যে গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। এতে তাঁদের অনেকের মধ্যেই বিগত ১১ মাসে ঘটে যাওয়া অনেক ব্যর্থতার চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে অনেকে দায়ী করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতা ও অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে সমন্বয়ের অভাবকে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সাবেক নেতারা এরই মধ্যে বহুবার অভিযোগ করেছেন যে অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে সময়োচিতভাবে একটি ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণার অভাবে রাজনৈতিক মহলে এখনো অনেক বিভ্রান্তি এবং ভবিষ্যৎ দিকদর্শনের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। ফলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই তাদের নিজ নিজ দলের পতাকাতলে অবস্থান নিয়েছে। ভুলে গেছে সেই মহান গণ-অভ্যুত্থানের জাতীয় প্রেক্ষাপটটি। রাজনৈতিক ঐক্য কিংবা রাজনৈতিক কর্মসূচিগত সমন্বয়ের বিষয়টি। ফলে চারদিকে মাথা তোলার অবকাশ বা সুযোগ পেয়েছে পতিত আওয়ামী সরকারের দোসর কিংবা বশংবদরা। সে পরিস্থিতিতে ড. ইউনূস হতাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘আমাদের একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বিফলে যেতে বসেছে। আমরা মুখে বলছি, সাবেক ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রতিনিধিরা এখনো সর্বত্র বসে রয়েছে। আমরা তাদের সরাতে পারিনি। আমরা তাদের স্বভাব-চরিত্র বদলাতে পারিনি।’ এ অবস্থায় অনতিবিলম্বে সর্বক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে না পারলে এবং সব জায়গায় কাঙ্ক্ষিত সংস্কার কিংবা পরিবর্তন সাধন করতে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতে ক্ষমতার রাজনীতিতে কোনো নির্বাচিত সরকারই স্থিতিশীল হতে পারবে না। এতে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন, উন্নয়ন কিংবা সমৃদ্ধি আশা করা হয়েছিল, তা বিফলে যেতে বাধ্য হবে। এখানেই অতীতে সংঘটিত সব গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের মৌলিক এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিগত কিছু পার্থক্য ছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারটি ছিল গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী একটি ভিন্নধর্মী রাজনৈতিক উদ্যোগের ফসল, কিন্তু তাতে অন্য অনেক কিছু থাকলেও ছিল না রাজনৈতিক দূরদর্শিতা।
ফরাসি বিপ্লব রাশিয়ায় সংঘটিত সমাজতান্ত্রিক (বলশেভিক) বিপ্লবের মতো ছিল না। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রায় শেষ দশকে (১৭৮৯-১৭৯৯) ফ্রান্সে সংঘটিত সে বিপ্লব ছিল একটি ‘দশক স্থায়ী সামাজিক-রাজনৈতিক অভ্যুত্থান’। ফ্রান্সের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের উল্লেখযোগ্য সময়। সে অভ্যুত্থানের শুরুতেই অর্থাৎ ১৭৮৯ সালে তার নেতারা ফ্রান্সের নাগরিক কিংবা মানুষের অধিকার নিয়ে ফ্রেঞ্চ চার্টার নামে একটি সনদ ঘোষণা করেন। সে সনদই ফরাসি বিপ্লবের মৌলিক চরিত্র বা বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরে। তাদের মুক্তি, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের নীতি প্রকাশ করে। এর পাশাপাশি মানুষের মৌলিক অধিকার ও দায়দায়িত্বের পথনির্দেশ প্রদান করে। সেদিক থেকে পর্যালোচনা করলে বাংলাদেশে সংঘটিত জুলাই-আগস্টের বিপ্লবও ছিল মূলত একটি গণ-অভ্যুত্থান। কিন্তু সে সফল অভ্যুত্থানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতাদের কী প্রত্যাশা ছিল, সেগুলো তাঁরা একটি সনদ আকারে নিজেরা প্রকাশ করেননি। তাঁরা অপেক্ষা করেছেন এই দায়িত্বটি সম্পন্ন করার ব্যাপারে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য, যাদের সঙ্গে সে গণ-অভ্যুত্থান কিংবা রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। সে কারণেই জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান সম্পর্কিত ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণা কিংবা নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়টি অনিশ্চিতভাবে ঝুলে রয়েছে। জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের কোনো কিছু উদযাপনের ক্ষেত্রেই কোনো গুরুত্ব দেখা যাচ্ছে না। এ রকম একটি রাজনীতিগত দোদুল্যমান অবস্থায় কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান আমাদের জীবনে কী পরিবর্তন এনেছে? যদি কোনো পরিবর্তন না-ই হয়ে থাকে, তাহলে দেশে ফ্যাসিবাদের পতন বা তাদের উত্খাত করা হলো কিভাবে? কেন এত বিশাল গণ-আন্দোলন ও সাধারণ মানুষের এত আত্মত্যাগ? অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান বলেছেন, ‘অতীতের অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন বদলাতে আমরা রাষ্ট্র মেরামতসহ সর্বত্র সংস্কার সাধনের যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছি, সেগুলো আমাদের প্রস্তাবিত জুলাই সনদে স্থান পেতে হবে।’ দল-মত-নির্বিশেষে জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে প্রস্তাবিত ঘোষণাগুলো বাস্তবায়িত করতে হবে। কিন্তু কী সে প্রস্তাবিত ঘোষণা, তা এখনো জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেক দলই জানে না। বিএনপিসহ বিভিন্ন দেশপ্রেমিক দলের নেতাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কোনো আলোচনায়ই এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বসা হয়নি। কারা কারা হবেন এই প্রস্তাবিত সনদে স্বাক্ষরকারী? এ পর্যন্ত তারও কোনো হদিস নেই। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং দেশি-বিদেশি আধিপত্যকে প্রতিরোধ করে আমরা কিভাবে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করব—প্রস্তাবিত সনদে আমরা সে ব্যাপারে সবার সম্মিলিত প্রতিশ্রুতি চাই।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
gaziulhkhan@gmail.com

বাবনপুরে জেগে আছেন শহীদ আবু সাঈদ
- ড. মো. ফখরুল ইসলাম

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে জুলাই ২০২৪ মাসটি এক অনন্য মর্যাদার দাবিদার। এই মাসে বারবার রক্ত ঝরেছে, শিক্ষার্থী-শ্রমিক-জনতার আহ্বানে কেঁপে উঠেছে শাসকের প্রাসাদ। সেই উত্তাল জুলাইয়ের সূচনা ঘটেছিল রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) মাটি রঞ্জিত করে আবু সাঈদ নামের এক শিক্ষার্থীর রক্তে। পীরগঞ্জের বাবনপুর নামক গ্রামে একটি বাঁশের বেড়া দেওয়া কবরে তিনি শুয়ে আছেন নীরবে, নিঃশব্দে।
রংপুরে শিক্ষার বাতিঘর হয়ে উঠেছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের অব্যবস্থাপনা, নিয়োগ বাণিজ্য, রাজনৈতিক দখল ও অবমূল্যায়নের কারণে নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বারবার পরিণত হয়েছে ক্ষোভের আগ্নেয়গিরিতে।
জুলাই বিপ্লব তাই কেবল রংপুরের বা বেরোবির নয়।
এই শহীদ যেন আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, বাংলাদেশে ছাত্ররাই বারবার যুগ পরিবর্তনের সূচনা করেন। হোক তা ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার সংগ্রাম কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী লড়াই। আমরা চাই, এই শহীদের রক্ত বৃথা না যাক।
জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদের স্মরণে রাষ্ট্র কি আরো একটু নত হবে, নাকি আবারও চলবে এড়িয়ে যাওয়ার নীলনকশা? যদি তা-ই হয়, তবে আগামী দিনগুলো আরো অস্থির, আরো উত্তাল হবে।
‘যেখানে বাধাগ্রস্ত হবে, সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে’—এই চেতনা দেরিতে এলো কেন? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে রাষ্ট্রযন্ত্রের চেহারার ভেতরে, যা দিন দিন হয়ে উঠছে আরো দুর্বিনীত, অসহনশীল ও জনবিচ্ছিন্ন। যখন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা পাস করার পর চাকরির জন্য ঘুরে বেড়ান, তাঁদের দাবি উপেক্ষা করে, বিরোধিতা করে, এমনকি দমন করতে গিয়েই সরকার তার আসল চেহারা উন্মোচন করে। ঠিক এখানেই জুলাই এসে দাঁড়িয়েছিল প্রতিবাদের ভাষা হয়ে। এটি কেবল একটি মাস নয়, এটি একটি ধারণা, একটি রাজনৈতিক চেতনা, একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার নাম, যা শেখায় জুলুমের বিরুদ্ধে চুপ থাকা মানেই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া। তাই যখনই কোথাও প্রতিবাদ বাধাগ্রস্ত হবে, যখনই মত প্রকাশের অধিকার পদদলিত হবে, তখনই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে প্রতিরোধের এক ছায়াছবির মতো।
বাবনপুরে শায়িত জুলাই বিপ্লবের প্রথম শহীদ, তাঁর জীবন দিয়ে আমাদের আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, প্রতিবাদের মুখ বন্ধ করে রাখা যায় না। তাই তাঁর মৃত্যু আর দশটি মৃত্যুর মতো নয়, বরং এটি এক বিস্মৃত সময়কে জাগিয়ে তোলার মুহূর্ত, যেখানে জুলাই আবার ফিরে এসেছে জনতার পাশে দাঁড়াতে।
এখন বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনে, কর্মক্ষেত্রে, সংবাদমাধ্যমে, এমনকি সংসদের ভেতরেও যদি অন্যায় চাপিয়ে দেওয়া হয়, তবে সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে। কারণ এই মাস শেখায় শুধু স্মৃতিচারণা নয়, স্মৃতি দিয়ে বাস্তব পরিবর্তনের দাবিও তোলা যায়।
তাই আমাদের দায়িত্ব এই শহীদের মৃত্যু যেন অন্ধকারে হারিয়ে না যায়। রাষ্ট্র যদি কখনো ন্যায়ের পথ ছেড়ে নিপীড়নের দিকে হাঁটে, তাহলে প্রতিটি গ্রামে বাবনপুরের মতো একেকটি জুলাই জন্ম নিতে পারে।
এমন সময় হয়তো আবারও প্রশ্ন উঠবে, জুলাই-জুলাই বলে এত মাতামাতি কেন? আমরা তখন উত্তর দেব, এর কারণ আমাদের প্রতিবাদের জায়গাগুলো একে একে নিঃশব্দ হয়ে যাচ্ছে। আর যেখানে হাতে মুষ্টি তুলে পথে নেমে সমস্বরে চিৎকার করা নিষিদ্ধ, সেখানে জুলাই-ই হয়ে উঠতে পারে একমাত্র ভাষা।
শহীদ আবু সাঈদের মৃত্যু কেবল একটি গুলি বা একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল না। এটি একটি সাবধানবাণীও ছিল। বেরোবির পার্কের মোড়ের অদূরে যা ঘটেছিল, তা ছিল আসলে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। যেখানে কথা বলা মানেই অপরাধ, দাবি জানানো মানেই রাষ্ট্রদ্রোহ মনে করা হয়েছিল।
সেদিন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা যখন শান্তিপূর্ণভাবে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন রাষ্ট্র কী করেছিল? তারা কেন সেদিন তাঁদের দিকে বন্দুক তাক করল? সেদিন যে তরুণ শহীদ হলেন, তিনি যেন গোটা বাংলাদেশের হয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন, তৎকালীন ক্ষমতাধরদের কাছে তা অনুধাবন করা কি খুব জটিল বিষয় ছিল?
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রতিবাদের ঐতিহ্য খুব গর্বের। ভাষা আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন—সবখানেই ছাত্রসমাজ পথ দেখিয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালে এসেও ছাত্রসমাজের কণ্ঠ রোধ করতে গুলি ব্যবহার করতে হয়, এটি কি রাষ্ট্রের দুর্বলতা নয়? আগামী দিনে আমরা এ ধরনের আর কোনো রাষ্ট্রীয় দুর্বলতা ও ভয় দেখতে চাই না।
জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদ শব্দটি যেন আমাদের সবার কাঁধে নতুন দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়। এর মানে, আরো অনেক শহীদ আসতে পারেন, যদি রাষ্ট্র তার দমননীতি থেকে ফিরে না আসে। যদি কথা বলার জায়গা, ভিন্নমতের জায়গা একে একে নিঃশব্দ হয়ে যায়, তাহলে শেষ ভরসা হয় রক্ত। বেরোবির ইংরেজি পড়ুয়া অকুতোভয় ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের তাক করা বন্দুকের নলের সামনে বুক উঁচিয়ে গুলি খেতে দ্বিধাহীন না থাকলে আজ কী করতাম আমরা, তা কি কেউ ভেবে দেখেছেন?
জন্ম নিলেই সবাইকে একদিন না একদিন নির্বাক হতে হয়। কিন্তু সবার কথা কি সব মানুষের অনন্তকালব্যাপী মনে থাকে? শহীদ আবু সাঈদ বাবনপুরে শুয়ে আমাদের শিখিয়ে দিচ্ছেন, দেশের যেকোনো প্রয়োজনে যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্বাক থাকার দিন শেষ।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন
fakrul@ru.ac.bd