ঢাকা, রবিবার ০৬ জুলাই ২০২৫
২২ আষাঢ় ১৪৩২, ১০ মহররম ১৪৪৭

ঢাকা, রবিবার ০৬ জুলাই ২০২৫
২২ আষাঢ় ১৪৩২, ১০ মহররম ১৪৪৭

মুজিবের চেতনায় নারী অধিকার

  • শেখ হাসিনা
অন্যান্য
অন্যান্য
শেয়ার
মুজিবের চেতনায় নারী অধিকার

যুগে যুগে কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী-সমাজসংস্কারকগণ এসেছেন, নারী অধিকারের কথা বলে গেছেন, নারী মুক্তির আন্দোলন করেছেন। সমাজের কুসংস্কার থেকে নারীদের রক্ষার প্রচেষ্টা নিয়েছেন। সমাজকে সচেতন করতে উদ্যোগী হয়েছেন।

এই ভূখণ্ডে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নারীর ক্ষমতায়নে সবচেয়ে সাহসী ভূমিকা পালন করেছেন।

শুধু কথা ও লেখনী দ্বারা নয়, বাস্তব জীবনে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ তিনি সৃষ্টি করে দিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছেন। স্বাধীন দেশের সকল নাগরিকের সম-অধিকারের কথাও তিনি বলেছেন। ‘এই ঘুণে ধরা সমাজ ভেঙে নতুন সমাজ আমরা গড়ব’—এটা ছিল তাঁর আন্তরিক প্রত্যয়।
তাই তিনি সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার সময়োপযোগী উদ্যোগ নিয়েছিলেন, যার সুফল আজ বাংলাদেশের নারীসমাজ পাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে নারীরা আজ নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে সক্ষম হয়েছেন।

‘নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার/কেন নাহি দিবে অধিকার/হে বিধাতা?’... বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ আকুতি করে গেছেন। কারণ তিনি নারী অধিকার সম্পর্কে সচেতন ছিলেন।

কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার আধুনিক চিন্তা ও ভাবধারায় সমৃদ্ধ ছিল। সমাজকে এগিয়ে নিতে এই পরিবারের অনেক অবদান রয়েছে। শিক্ষা-দীক্ষার প্রসার, সাংস্কৃতিক চর্চা এবং কুসংস্কার দূর করার ক্ষেত্রেও সে সময় তারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে।

বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন : ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি, চির কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী/অর্ধেক তার নর।’ সমাজে নারীর যে অবদান রয়েছে সে কথাই তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর কবিতায়।

নারীকে তার অবদানের স্বীকৃতি দিয়েছেন কবি নজরুল ইসলাম এই লেখার মধ্য দিয়ে। এ বার্তাই পৌঁছে দিয়েছেন যে, নারীকে অবহেলার চোখে দেখার সুযোগ নেই। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রেই পুরুষের যেকোনো অর্জনের পেছনে নারীর অবদান রয়েছে। তাঁদের ত্যাগ-প্রেরণা-উৎসাহ পুরুষকে শক্তি ও সাহস জোগায়। সে অবদান ভুলে যাওয়া ঠিক নয়। কবি নজরুল আধুনিক চিন্তা-চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক ভাবধারায় বিশ্বাস করতেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে মা ছেলেকে, বোন ভাইকে, স্ত্রী স্বামীকে যুদ্ধে পাঠিয়েছেন। প্রেরণা দিয়েছেন। ক্ষেত্র বিশেষে সঙ্গী হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে মা-বোনদের অবদান অপরিসীম।

যুদ্ধে বিজয়ের পর জাতির পিতা শেখ মুজিব প্রণীত বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে নারীর সম-অধিকার বিষয়ে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৭, ১৯, ২৮, ২৯-সহ বিভিন্ন ধারায় নারীর শিক্ষা, চাকরি, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির বাধ্যবাধকতা সন্নিবেশ করে নারীর সম-অধিকার নিশ্চিত করেছেন।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজের লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ ও ‘আমার দেখা নয়াচীন’—বইগুলোতে তিনি নারী অধিকারের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। তাঁদের সমস্যা, দুঃখ-কষ্ট সমাধানের কথাও তিনি বলেছেন।

১৯৫২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চীন গিয়েছিলেন শান্তি সম্মেলনে যোগ দিতে। যাওয়ার পথে বার্মা (মিয়ানমার) এবং হংকং হয়ে যেতে হয়েছিল। সেখানে যাত্রাবিরতির সময় তিনি শুধু নতুন জায়গা দেখেননি, সমাজের অবস্থা, সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক-সামাজিক বিষয়গুলোও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। বিশেষ করে নারীদের অর্থনৈতিক দৈন্যের বিষয়গুলো তিনি তাঁর লেখায় তুলে ধরেছেন। সামাজিক বিষয়ে নিজের চিন্তা-ভাবনার কথা উল্লেখ করে সুচিন্তিত মতামত রেখেছেন তাঁর বইগুলোতে।

সমাজে নারীর ওপর যে বৈষম্য ও নির্যাতন চলে সে বিষয়ে নয়াচীন যাওয়ার পথে হংকংয়ে যাত্রাবিরতির সময় সেখানকার সমাজব্যবস্থা বিষয়ে, যা দেখেছেন তার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে : ‘এই মেয়েদের দোষ দিয়ে লাভ কি? এই সমাজব্যবস্থায় বাঁচবার জন্য এরা সংগ্রাম করছে, ইজ্জত দিয়ে পেটের ভাত জোগাড় করছে। হায় রে মানুষ! রাস্তায় রাস্তায় বহু মেয়েকে এইভাবে হংকং শহরে ঘুরতে দেখা যায়।...দেশের মালিক ইংরেজ, জনগণ না।’ (আমার দেখা নয়াচীন, পৃ. ৯৯)

তাঁর হৃদয় ব্যথিত হয়েছে নারীদের এই দুর্দশা দেখে। হংকং তখন ইংরেজদের কলোনি ছিল। জনগণের হাতে ক্ষমতা ছিল না। সেখানকার জনগণ অবর্ণনীয় শোষণ-বঞ্চনার শিকার ছিল। আর তাই সরকারের যে দায়িত্ব রয়েছে—মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করার, সে কথাই তিনি বারবার উল্লেখ করেছেন। সমাজের দায়বদ্ধতার কথা বলেছেন।

চীনে শান্তি সম্মেলনের সময় তিনি সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেছেন। নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়ে তিনি লিখেছেন : ‘আজ নয়াচীনে সমস্ত চাকুরিতে মেয়েরা ঢুকে পড়ছে। পুরুষদের সাথে তাল মিলিয়ে কাজ করছে। প্রমাণ করে দিয়েছে পুরুষ ও মেয়েদের খোদা সমান শক্তি দিয়েই সৃষ্টি করেছেন। সুযোগ পেলে তারাও বৈজ্ঞানিক, ঐতিহাসিক, ডাক্তার, যোদ্ধা সকল কিছুই হতে পারে।’ (আমার দেখা নয়াচীন, পৃ. ৯৯)

ধর্মের নামে মেয়েদের ঘরে বন্দি করে রাখতে চায় একদল। তাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব উল্লেখ করেছেন : ‘মুসলিম দেশ তুরস্ক নারীর স্বাধীনতা স্বীকার করেছে। নারীরা সে দেশে যথেষ্ট অগ্রসর হয়েছে। তুরস্কে অনেক মেয়ে পাইলট আছেন, যাঁরা দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ পাইলটদের মধ্যে অন্যতম। ...আমাদের দেশের শিক্ষিত-অশিক্ষিত লোকের মনে এই ধারণা যে পুরুষের পায়ের নিচে মেয়েদের বেহেশত। পুরুষ যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারে। মেয়েদের নীরবে সব অন্যায় সহ্য করতে হবে বেহেশতের আশায়। তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে মেয়েদের নির্ভর করতে হয় পুরুষদের অর্থের উপর।’

ইসলাম ধর্ম নারীদের পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে। মেয়েরা যে শুধু ঘরে আটকে থাকবে, বাইরে যাবে না, পরনির্ভরশীল বা পুরুষদের উপার্জনের ওপরই কেবল নির্ভরশীল থাকবে, তা কিন্তু নয়। বরং নবীজির যুগেও মেয়েদের যথেষ্ট স্বাধীনতা ছিল।

পুরুষদের পাশাপাশি থেকে দায়িত্ব পালন করতেন, এমনকি রণাঙ্গনেও তাঁদের ভূমিকা ছিল। এ কথাও তিনি লিখেছেন: ‘... কিন্তু ইসলামের ইতিহাস পড়লে জানা যায় যে, মুসলমান মেয়েরা পুরুষদের সাথে যুদ্ধক্ষেত্রে যেত, অস্ত্র এগিয়ে দিত। আহতদের সেবা-শুশ্রূষা করতো। হযরত রসুলে করিম (সা.)-এর স্ত্রী হযরত আয়েশা নিজে বক্তৃতা করতেন। দুনিয়ায় ইসলামই নারীর অধিকার দিয়াছে।’ (আমার দেখা নয়াচীন, পৃ. ১০০)

নারী নেতৃত্ব যাতে গড়ে ওঠে, সে জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলাদেশের সংবিধানে জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা রাখেন। ১৯৭২ সালে মাত্র ৯ মাসের মধ্যে এই সংবিধান অর্থাৎ শাসনতন্ত্র তিনি রচনা করেন। নারীর অধিকার নিশ্চিত করার এক বিরল দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় দোসর আলবদর, রাজাকার, আলশামস বাহিনী গণহত্যা, নারী নির্যাতন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগসহ এমন কোনো মানবতাবিরোধী অপরাধ নেই তারা করেনি। আমাদের দেশের মেয়েদের ধরে নিয়ে পাকিস্তানি সেনাক্যাম্পে তাদের লালসা মেটাতে তুলে দেয়। বিজয়ের পর সেই নির্যাতিত মেয়েদের উদ্ধার করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। সমাজে এই নারীরা যেন মাথা উঁচু করে চলতে পারে, এ জন্য তাঁদের ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাবে ভূষিত করেন। মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের এই আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান দেখান। অনেকের বিয়ের ব্যবস্থা করেন। তাঁদের জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা করেন। যখন বিয়ের ব্যবস্থা হয়, অনেক পিতা সন্তানের পরিচয় দিতে সমাজের ভয়ে পিছিয়ে যায়। তখন তিনি পিতার নামের স্থানে শেখ মুজিবুর রহমান আর বাড়ির ঠিকানা ধানমণ্ডি ৩২ নং সড়কের তাঁর বাড়ির ঠিকানা লিখে দিতে বলেন। এই পরিচয়ে মেয়েদের বিয়ে হয়। এই ঘোষণার পর আর কোনো দ্বিধা কারো মনে ছিল না। বঙ্গমাতা নিজে বিয়ের সব ব্যবস্থা করেন।

সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে নারীদের জন্য ১০% কোটা সংরক্ষণ করেন, যেখানে নির্যাতিতা নারীদের অগ্রাধিকার ছিল। এ সবই ছিল যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

পাকিস্তানি শাসনামলে জুডিশিয়াল সার্ভিসে নারীদের অংশগ্রহণ আইন করে বন্ধ ছিল। মেয়েরা কখনো জজ হতে পারতেন না। স্বাধীনতার পর সে আইন পরিবর্তন করে নারীদের অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। চাকরির ক্ষেত্রে সর্বত্র মেয়েদের অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেন। পুলিশ বাহিনীতে নারী অফিসার নিয়োগ দেন। এর কারণ হলো, তিনি বিশ্বাস করতেন অর্থনৈতিকভাবে একজন নারী যদি স্বাবলম্বী হয়, তাহলে সংসার ও সমাজে তার অবস্থান শক্ত হবে। সংসারে তার মতামত দেওয়ার সুযোগ থাকবে।

তিনি বলেছেন, ‘একজন নারী যদি নিজে উপার্জন করে ১০টা টাকাও কামাই করে তার আঁচলের খুঁটে বেঁধে আনে, তবে সংসারে তার গুরুত্ব বাড়ে।’

এ কথাটা আমি আমার বাবার মুখে বারবার শুনেছি। এ কথার অর্থ হলো অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া। আমাদের সমাজে একজন পুরুষ মানুষ অর্থ উপার্জন করে আর পুরো পরিবার তার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। মুখাপেক্ষী হতে হয় গোটা পরিবারকে। আর এ কারণেই আর্থিক স্বাবলম্বিতা একান্তভাবে অপরিহার্য। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ সে সুযোগ করে দিতে পারে। শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করার জন্য মেয়েদের শিক্ষা তিনি অবৈতনিক করে দেন। পিতা-মাতার কাঁধের বোঝা হালকা করে দেন।

সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৭ (ক)-এ উল্লেখ করা আছে : ‘রাষ্ট্র একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’

এখানে ‘বালিকাদের’ কথাটা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, যাতে মেয়েদের শিক্ষাটা নিশ্চিত হয়; গুরুত্ব পায়—সে চিন্তা থেকেই এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

বেগম রোকেয়া নারীদের শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ‘পদ্মরাগ’ উপন্যাসে তিনি লিখেছেন : ‘তোমাদের কন্যাগুলিকে সুশিক্ষিতা করিয়া কার্যক্ষেত্রে ছাড়িয়া দাও, নিজেরাই নিজেদের অন্ন, বস্ত্র উপার্জন করুক।’

একটি সমাজকে গড়ে তুলতে হলে নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে সকলেরই প্রয়োজন। যে সমাজের অর্ধেকটা নারী, তাদের বাদ দিয়ে উন্নয়ন করা যায় না। একটা দেশ, একটা সমাজ বা সংসারের সবাই যদি পণ করে, তারা সত্যিকারের উন্নতি করতে চায়, তবে অবশ্যই সবাইকে সমান গুরুত্ব দিতে হবে। মেধা, মনন ও শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে।

বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৯(৩)-এ উল্লেখ রয়েছে : ‘জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমতা রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন।’ সংবিধানে সকল নাগরিকের সম-অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। ‘সরকারি নিয়োগ লাভের সুযোগের সমতার’ কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব লিখেছেন : ‘সত্য কথা বলতে গেলে একটা জাতির অর্ধেক জনসাধারণ যদি ঘরের কোণে বসে শুধু বংশবৃদ্ধির কাজ ছাড়া আর কোন কাজ না করে, তা হলে সেই জাতি দুনিয়ায় কোন দিন বড় হতে পারে না।’

৬৯ বছর আগে ১৯৫২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এ কথা উপলব্ধি করেছিলেন; অথচ তখনকার সমাজব্যবস্থা ছিল কুসংস্কারাচ্ছন্ন। এই কুসংস্কারের অচলায়তন ভেঙে সমাজের উন্নয়ন, অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনকেই গুরুত্ব দেওয়া অপরিহার্য। তাই নারী-পুরুষকে একই সঙ্গে কাজ করতে হবে।

বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৮(২)-এ বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন।’

চীন ভ্রমণের সময় কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের সমান অংশগ্রহণ তাঁকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করেছিল। তিনি লিখেছেন : ‘নয়া চীনের মেয়েরা আজকাল জমিতে, ফ্যাক্টরিতে, কলকারখানাতে, সৈন্যবাহিনীতে দলে দলে যোগদান করছে। ...যে সমস্ত ফ্যাক্টরি, কলকারখানা, সরকারি অফিসে আমি গিয়েছি, সেখানেই দেখতে পেয়েছি মেয়েরা কাজ করছে; তাঁদের সংখ্যা স্থানে স্থানে শতকরা ৪০ জনের উপরে।

নয়া চীনের উন্নতির প্রধান কারণ পুরুষ ও মহিলা আজ সমানভাবে এগিয়ে এসেছে দেশের কাজে। সমানভাবে সাড়া দিয়েছে জাতি গঠনমূলক কাজে। তাই জাতি আজ এগিয়ে চলেছে উন্নতির দিকে।’ (আমার দেখা নয়াচীন, পৃ. ৯৯)

কর্মক্ষেত্রে স্বাধীন বাংলাদেশে যাতে নারী ও পুরুষের সমান সুযোগ সৃষ্টি হয় যে বিষয়ে লক্ষ রেখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যে সংবিধান ১৯৭২ সালে জাতিকে উপহার দিয়েছিলেন, সেখানে সম-অধিকারের কথা উল্লেখ রয়েছে।

সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৯(১)-এ বলা হয়েছে : ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদলাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে।’

সমাজের শুধু নারী বা পুরুষ নয়, সমাজের সকল নাগরিক যেমন—ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বা অনগ্রসর শ্রেণি—সকলের জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করার বিধান এই সংবিধানে উল্লেখ করা হয়েছে, যাতে কোনো শ্রেণি-পেশার মানুষ বঞ্চিত না হয়। অনগ্রসর যারা তাদের জন্য বিশেষ সুবিধা দেওয়ার নির্দেশও দিয়েছেন।

সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৯(৩) (ক)-তে উল্লেখ আছে : ‘নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশ যাহাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করতে পারেন সেই উদ্দেশ্যে তাহাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান প্রণয়ন করা হইতে রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।’

৪৯ বছর পূর্বে সংবিধানে যে ক্ষমতা নারীদের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিয়েছেন তা সে সময়ের সমাজব্যবস্থায় একটা সাহসী এবং যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল। সমাজে নারীদের সম্মানজনক অবস্থানের ভিত্তি তিনি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশিত পথেই নারী ক্ষমতায়নের পদক্ষেপ আওয়ামী লীগ সরকার গ্রহণ করে। ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করে নারী উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন করে। সন্তানের পরিচয়ে পিতার সঙ্গে মায়ের নাম যুক্ত করা হয়। মাতৃত্বকালীন ছুটি তিন মাস থেকে বৃদ্ধি করে প্রথমে চার মাস এবং পরে ছয় মাস করা হয়।

উচ্চ আদালতে কোনো নারী বিচারক নিয়োগ পেতেন না। প্রথম নারী সচিব হিসেবে পদোন্নতি আমরাই দিই। জেলা প্রশাসক (ডিসি), পুলিশ সুপার (এসপি), থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার (ওসি)-সহ প্রশাসনের সর্বস্তরে মহিলাদের নিয়োগ দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীতে নারী অফিসার নিয়োগ দেওয়া হয়। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, বাংলাদেশ এয়ারলাইনস বিমানের পাইলট, মেরিন একাডেমিতে ভর্তির ব্যবস্থাসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে মেয়েদের চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে।

প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত দুই কোটি ৫৩ লাখ শিক্ষার্থীকে বৃত্তি বা উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট ফান্ড তৈরি করে উচ্চশিক্ষার জন্য বিশেষ বৃত্তি দেওয়ার যে ব্যবস্থা আমরা নিয়েছি, সেখানে ৭০ ভাগই নারী শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার বৃত্তি পাচ্ছে। মেয়েদের জন্য উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক করা হয়েছে।

সামাজিক সুরক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে বিধবা, স্বামী-পরিত্যক্তা, বয়স্ক নারীদের ভাতা প্রদান করা হচ্ছে। মাতৃত্বকালীন ভাতার প্রচলন করা হয়েছে। মাতৃদুগ্ধদানকারী মায়েরা ভাতা পাচ্ছেন। সংসারে মেয়েদের যাতে কেউ বোঝা না মনে করে, সে ব্যবস্থা আমরা নিয়েছি। চিকিৎসাসেবা, বিনা মূল্যে ওষুধ, বিনা মূল্যে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

নারী সুরক্ষার জন্য অনেক আইন পাস করা হয়েছে। নারী ও শিশুদের অধিকার নিশ্চিত করা হচ্ছে। নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টি করার জন্য স্বল্প সুদে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

সারা বাংলাদেশে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে। সেখানেও নারী উদ্যোক্তাদের জন্য প্লট বরাদ্দের বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। গ্রামের মেয়েরা নিজেদের উৎপাদিত পণ্য যাতে বাজারজাত করতে পারেন তার জন্য ‘জয়িতা ফাউন্ডেশন’ গঠন করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৬০% নারী শিক্ষক নিয়োগ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর ফলে মেয়েদের শিক্ষার পথ উন্মুক্ত হয়েছে। অভিভাবকগণ মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে উৎসাহিত হচ্ছেন।

ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার ফলে ইউনিয়ন পর্যায়ে ডিজিটাল সেন্টারে নারী উদ্যোক্তারা স্বকর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছে। কমিউনিটি ক্লিনিক, তথ্য আপা, আমার বাড়ি আমার খামারসহ বিভিন্ন কর্মমুখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। কৃষি, শিল্প, সেবাসহ সকল ক্ষেত্রে মেয়েদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে।

মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে নারীদের অসামান্য অবদান বিস্মৃত হওয়ার নয়। দেশের মোট জনসংখ্যার যেখানে অর্ধেকই নারী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চাইতেন তাঁরা সমাজ ও দেশ গঠনে ভূমিকা রাখবেন, যাতে দেশের উন্নয়ন দ্রুততর হয়; দারিদ্র্য বিমোচন করে বাংলাদেশকে উন্নত-সমৃদ্ধ করা যায়। আওয়ামী সরকার তাঁর প্রদর্শিত পথেই দেশকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশকে শূন্য থেকে যাত্রা শুরু করে মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে তিনি স্বল্পোন্নত দেশে উন্নীত করেছিলেন। আজকে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে। শিগগিরই বাংলাদেশ উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে উঠবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্বপ্ন পূরণ হবে।

 

লেখক : জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী

 

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান : চাওয়া-পাওয়ার দাগ-খতিয়ান

    তুহিন খান
শেয়ার
জুলাই গণ-অভ্যুত্থান : চাওয়া-পাওয়ার দাগ-খতিয়ান

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রায় এক বছর উপলক্ষে জুলাই ও আগস্ট মাসজুড়ে বেশ বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানসূচি ঘোষিত হয়েছে ইন্টেরিম সরকারের তরফে। কিন্তু এক বছরে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব কতটা মেলানো গেল? জুলাইয়ের সুফল কার ঘরে কতটা উঠল?

গণ-অভ্যুত্থান নিজেই একটি বড় প্রাপ্তি। যে অভ্যুত্থানের ফলে আওয়ামী লীগের মতো একটি নিকৃষ্ট ফ্যাসিস্ট শাসকগোষ্ঠীর পতন হলো, তার চেয়ে বড় প্রাপ্তি এ দেশের জনগণের জীবনে খুব কমই আছে। এই অভ্যুত্থানের আগে-পরে দেশে যে বিপুল জনসচেতনতা ও সৃষ্টিশীল গণক্ষমতার উদ্বোধন আমরা দেখেছি, তরুণদের মধ্যে যে স্বচ্ছ রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ও দেশ গঠনের দৃঢ় প্রত্যয় জন্ম নিতে দেখেছি, তা এককথায় মহাকাব্যিক।

সেদিন থেকে জুলাই ওয়ান্স ইন আ লাইফটাইম ইভেন্ট এবং এর প্রাপ্তির দিকটি অনেক বড়। কিন্তু জুলাই-পরবর্তী সরকার, রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সাংস্কৃতিক রাজনীতি ও সমাজব্যবস্থার বাস্তব ক্ষেত্রগুলোতে এই মহাকাব্যিক ঘটনা কাঠামোগতভাবে কতটা অনূদিত হতে পারল, আমরা নানা রকম ভাঙার পাশাপাশি কতটা গড়তে পারলামসেদিক বিবেচনায় অপ্রাপ্তিও কম না।

গত বছর ৮ আগস্ট ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার ভারত পলায়নের পরিপ্রেক্ষিতে যে সরকারটি গঠিত হয়, তার ধরনটি ঠিক কী হবে, কী হলে আরো ভালো হতো, এ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা আছে। অন্তর্বর্তী এই সরকারটি গঠিত হয়েছে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করেই; আবার গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের কেউ কেউ এ সরকারের অংশ হয়েছেন।

ফলে এ সরকারের ধরনটি ঠিক কী, তার মেয়াদ ও ম্যান্ডেট কতটুকু হওয়া সংগত, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। যদিও কিছুদিন আগে এক টক শোতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, এই সরকারের সবকিছু করারই ম্যান্ডেট আছে; তবে কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে এই দাবিটি খুব জোরালো বাস্তব ভিত্তি নিয়ে হাজির নেই। গেল বছর ডিসেম্বর থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে যে বহুমুখী জটিলতা ও ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে, তার মূলেও আছে অন্তর্বর্তী সরকারের ধরন নিয়ে এই তর্ক। ঘোষিতভাবে একটি অন্তর্বর্তী সরকার হলেও সরকারের ভেতরে ও বাইরে অনেকেই একে একটি বিপ্লবী সরকার করে তুলতে আগ্রহী, যদিও এর কোনো সুস্পষ্ট রূপরেখা জনসমাজে স্পষ্টভাবে হাজির নেই।
পুরনো ধারার রাজনৈতিক দলগুলো, যারা এই গণ-অভ্যুত্থানের এবং সরকারেরও অন্যতম প্রধান শরিকএই বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষার ব্যাপারে তাদের বেশির ভাগেরই মনোভাব নেতিবাচক, কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত।

জুলাইয়ের বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষা, অন্তর্বর্তী সরকারের এই ধরন ও রাজনৈতিক শক্তিগুলোর অবস্থানএই তিনের টানাপড়েন শেষমেশ যে জাতীয় আকাঙ্ক্ষায় থিতু হয়েছে, তার আলংকারিক নাম : সংস্কার। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আগ থেকেই বেশ কিছু রাজনৈতিক দল ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্ল্যাটফর্মের কারণে রাষ্ট্র সংস্কার ধারণাটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ফলে সেটির প্রায়োগিক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে এবং কিভাবে ও কতটুকু হবে এই সংস্কারসেটিই প্রধান আলোচ্য বিষয়। বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন হয়েছে দেশে এবং সেসব কমিশন বড় বড় রিপোর্টও তৈরি করেছে।

কিন্তু এসব সংস্কার প্রস্তাবের ঠিক কতটুকু বাস্তবায়ন করা যাবে বা গেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন ও অনিশ্চয়তা আছে। তা ছাড়া সংস্কার আর নির্বাচনকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে, সংস্কারের এজেন্ডাটিকে আরো কঠিন করে তোলা হয়েছে।

রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদের স্বাভাবিক ফলাফল হিসেবেই যে সামাজিক ফ্যাসিবাদ ও ধর্মীয় চরমপন্থা সুপ্তাবস্থায় প্রায় এক যুগ ধরে আস্তে আস্তে গাঢ় হয়ে উঠছিল, তা অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে নিঃশেষিত হয়নি, বরং নানা ধরনের সামাজিক ও ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী প্রবণতা নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন শক্তিতে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে পরাজিত ফ্যাসিস্ট শক্তি ও তার দেশি-বিদেশি এজেন্টরা এই প্রবণতাগুলোকে অনেক রংচং মেখে বাস্তবের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বিকট করে উপস্থাপন করার চেষ্টায় রত। জুলাইয়ের শক্তিগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন ও মেরুকরণও এই পরিস্থিতিটিকে বেশ ঘোলাটে করে তুলছে। সে ব্যাপারে সতর্ক থেকেও বলা যায় যে এই ঘটনাগুলো ঘটছে।

মব শুনলেই অনেকে খেপে যান আজকাল, তার সংগত কারণও আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু সত্য কথা এটিই যে ৫ আগস্টের পর দেশে নানা রকম মব তৈরি হয়েছে। সামাজিক-নৈতিক পুলিশগিরি বাড়ছে। এসবের সঙ্গে জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা বা বিপ্লবী তৎপরতার যোগ সামান্য। ধর্মীয় চরমপন্থাও এই পরিস্থিতিকে একটি সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করছে।

বিপ্লবী ছাত্র-জনতা ও সরকারের কাজ ছিল সমাজে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা এই নতুন প্রতিবিপ্লবী, হঠকারী ও ফ্যাসিস্ট তৎপরতাগুলোরও বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, যেখানে মোটাদাগে স্পষ্টতই তারা ব্যর্থ হয়েছে। এতে সমাজে সরকার ও অভ্যুত্থানের নেতৃত্বের ব্যাপারে যে মাত্রারই হোক, একটি নেতিবাচকতা তৈরি হয়েছে।

৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ের একটি প্রধান জনদাবি ও গুরুতর কাজ ছিল বিচার ও আনুষ্ঠানিক রিকনসিলিয়েশন প্রসেস শুরু করা। কিন্তু এই দাবিটি বিদ্যমান কোনো রাজনৈতিক শক্তিই সততার সঙ্গে সামনে আনতে পেরেছে বলে মনে হয় না। নির্বাচনী রাজনীতির হিসাব-নিকাশ, সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর টানাপড়েন, মামলা বাণিজ্যের পলিটিক্যাল ইকোনমি, ঘোলা পানিতে মাছ শিকারিদের নানা রকম অপতৎপরতা, বিচারহীন পুনর্বাসনের বিবিধ উদ্যোগ আর সরকারের অস্পষ্ট ও গতিহীন নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যে বিচারের দাবিটির বহুলাংশ অপচয় হয়েছে। একটি ফ্যাসিস্ট সরকারকে উত্খাত করার পর অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি জাতীয় অখণ্ডতা রক্ষা ও সামাজিক-রাজনৈতিক রিকনসিলিয়েশন নিশ্চিতে যে ধরনের ব্যাপক, বহুমুখী ও কুশলী প্রাতিষ্ঠানিক তৎপরতা প্রয়োজন ছিল, সরকার সেটি করতে বেশ খানিকটা ব্যর্থই হয়েছে বলা যায়।

অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দলটিকে ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে এক ধরনের কৌতূহল, আকাঙ্ক্ষা ও দরদ তৈরি হয়েছে। তবে এই আকাঙ্ক্ষা নিরঙ্কুশ নয়। নির্বাচনী রাজনীতিতে ঢুকে পড়ায় বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামোর অনেক বিষয়ই আত্তীকৃত করতে হয়েছে দলটির, যা তাদের নানাভাবে বিতর্কিত করেছে। আবার এই দলটির গতি-প্রকৃতি কী হবে, তার কল্পনার বাংলাদেশটি ঠিক কেমন হবেএসব বিষয়েও নানা ধরনের অনুমান তৈরি হয়েছে। এসব সত্ত্বেও পরিবর্তনকামী বা সংস্কারবাদীরা এখনো এই দলটির ওপর ভরসা রাখতে চাইছেন বলেই মনে হয়।

প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির এই হিসাব চলবে। কিন্তু জুলাইয়ে ঘটে যাওয়া মহাকাব্যিক অভ্যুত্থানটি আমাদের জাতীয় জীবনে যে বিপুল পরিবর্তনের সম্ভাবনা হাজির করেছে, তা অসামান্য। আমরা এর কতটা কাজে লাগাতে পারব, তা এখনো অনিশ্চিত। তবে বাংলাদেশ যত দিন থাকবে, তত দিন মুক্তির এই অসামান্য সম্ভাবনা এ দেশের মানুষকে অনুপ্রাণিত করে যাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

লেখক : কবি, অনুবাদক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য

মন্তব্য

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করা প্রয়োজন

    ড. নিয়াজ আহম্মেদ
শেয়ার
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করা প্রয়োজন

করোনার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমে যে ছেদ তৈরি হয়েছিল, তা এখনো আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এ ছাড়া গত বছরের গণ-আন্দোলনে তিন-চার মাস আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। বিশ্ব্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত আমাদের এইচএসসি নামক পাবলিক পরীক্ষা। কোনো কারণে এইচএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে গেলে আমাদের ভর্তি কার্যক্রমও পিছিয়ে যায়।

আমরা অনেকে জুলাই মাসেও সেশন শুরু করতে পারছি না। আমাদের যেখানে সচরাচর মাস্টার্সসহ পাঁচটি ব্যাচ থাকার কথা, সেখানে সব সময় ছয়টি ব্যাচ থাকছে। শিক্ষার্থীরা যেমন সেশনজটে পড়ছে, তেমনি আমাদেরও বেশি লোড নিতে হচ্ছে। কার্যত কমবেশি সবার ক্ষতি হচ্ছে।
শিক্ষার্থীদের সময় অপচয় ও আর্থিক ক্ষতি, অভিভাবকদের কষ্ট ও দুচিন্তা, সরকারের আর্থিক ক্ষতি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক সমস্যাসহ অন্য অনেক সমস্যা তৈরি হচ্ছে। অথচ স্বাভাবিক নিয়মে জুলাই মাসে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু এখন আমরা জানুয়ারি মাসেও তা শুরু করতে পারছি না।

আমরা যদি জানুয়ারি মাসে এসএসসি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে এইচএসসি পরীক্ষা নিতে পারি, তাহলে জুলাই মাসে উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা যাবে।

আমাদের কারিকুলাম এবং উত্তরপত্র মূল্যায়ন পদ্ধতি পরিবর্তনসহ আরো কিছু ব্যবস্থা নিতে পারলে আমরা আগাতে পারব। আমাদের সিলেবাস কমানো এবং সিলেবাসের একটি বড় অংশ আগেই মূল্যায়ন করা, যাতে ফাইনাল পরীক্ষা মূল্যায়ন সহজ এবং সময়সাপেক্ষ না হয় তার দিকে নজর দেওয়া। বোর্ডগুলো পরীক্ষককে বোর্ডে এনে সহজে এবং কম সময়ে খাতা মূল্যায়ন করাতে পারলে এক মাসের মধ্যে ফলাফল দেওয়া সম্ভব। মাসব্যাপী পরীক্ষা না নিয়ে আরো কম সময়ে কিভাবে পরীক্ষা নেওয়া যায় তার ব্যবস্থা আমাদের করতে হবে। সরকারের সদিচ্ছা, শিক্ষকদের আগ্রহ এবং শিক্ষার্থীদের সচেতনতা আমাদের দ্রুত সময়ের মধ্যে একটি পাবলিক পরীক্ষা সম্পন্ন করতে সহায়তা করতে পারে।

উচ্চশিক্ষা যেহেতু বহু রকমের, সেহেতু এখানেও অনেক বিষয় রয়েছে। মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার বিষয়টি সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ দ্বারা পরিচালিত হয়। তাই তারা বেশ দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারে। সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যদি একটি পরীক্ষায় ভর্তি নিতে পারত, তাহলেও সময় বাঁচত। কিন্তু তা সম্ভব হয়ে উঠছে না। আমাদের মানে শিক্ষকদের এখানে করণীয় রয়েছে। এইচএসসি পরীক্ষা শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে ভাবতে হবে। আমরা প্রতিবছর একই পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা এবং এর কার্যক্রম সম্পন্ন করি। ফলে দ্রুত কার্যক্রম শুরু করতে সমস্যা নেই। ফলাফল প্রকাশের এক সপ্তাহের মধ্যে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, এক মাসের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা এবং সর্বোচ্চ তিন মাসের মধ্যে পুরো ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করা সম্ভব।

আমাদের কাছে মনে হয়, সরকারের আন্তরিকতা এবং শিক্ষকদের সহযোগিতা এখানে মুখ্য বিষয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, কতটা সহজে এবং দ্রুত আমরা আমাদের ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারি। আমাদের টার্গেট যদি থাকে জানুয়ারি মাসের প্রথম দিন ক্লাস শুরু করা, তাহলে টার্গেট অনুযায়ী কাজটি করতে হবে। একদিকে শিক্ষার্থীরা পাবলিক পরীক্ষা দেবে, অন্যদিকে আমরা ভর্তি পরীক্ষার কার্যক্রম শুরু করব। সরকার যদি পাবলিক পরীক্ষা আগে এবং দ্রুত সম্পন্ন করতে পারে, তাহলে আমরাও দ্রুত ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারব। ধরুন, এখন এইচএসসি পরীক্ষা চলছে। আশা করা যায়, সেপ্টেম্বরে ফলাফল প্রকাশিত হবে। আমরা অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা শেষ করতে পারি। তিন মাসে কি ভর্তি পরীক্ষার যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করা যথেষ্ট নয়? আমাদের দরকার সরকারের ইচ্ছা এবং সবচেয়ে বড় দরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়, শিক্ষকদের মধ্যে সহযোগিতা ও আন্তরিকতা। আমরা আশা করব, আগামী শিক্ষাবর্ষে যেন জানুয়ারি মাসেই শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয়।

লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

nahmed1973@gmail.com

মন্তব্য

কজন জানে জুলাই সনদ কী

    গাজীউল হাসান খান
শেয়ার
কজন জানে জুলাই সনদ কী

সমাজ ও বৃহত্তরভাবে রাষ্ট্র মেরামত কিংবা পরিবর্তনের জন্য যেসব কাঙ্ক্ষিত বা আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়, মূলত সেগুলোকেই সংস্কার বা ‘রিফর্ম’ বলা হয়। দেশের সংবিধান থেকে শুরু করে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নাগরিকরা কিংবা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সেসব সংস্কারের উদ্যোগ নিতে পারেন। তবে শেষ পর্যন্ত জাতীয় কিংবা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সেসব সংস্কার প্রস্তাবকে কার্যকর করতে হলে একটি আইনানুগ ভিত্তি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। বাংলাদেশে চব্বিশ সালের গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর সময়ে অতীত স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী শাসন এবং আর্থ-সামাজিক শোষণ-বঞ্চনার অবসানের জন্য দল-মত-নির্বিশেষে সবাই রাষ্ট্র মেরামতের একটি জোরালো দাবি উত্থাপন করেছে।

দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির পক্ষ থেকে রাষ্ট্র মেরামত ও প্রয়োজনীয় অন্যান্য সংস্কারের প্রশ্নে একটি ৩১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছিল। তবে বিগত জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের মুখে সরকার পতনের পর কথিত রাষ্ট্র মেরামত কিংবা সংস্কারের দাবিগুলো দল-মত-নির্বিশেষে একটি জাতীয় কর্মসূচির রূপ পরিগ্রহ করে। এতে পরবর্তী নির্বাচনের আগেই রাষ্ট্র মেরামত কিংবা প্রয়োজনীয় সংস্কারের ব্যাপারে ঐকমত্যের প্রশ্নে আর কোনো দ্বিমত বা ভিন্নমতের অবকাশ থাকে না। এবং সেভাবেই বিভিন্ন কমিশন গঠনের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সংস্কারের লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রস্তাব লিপিবদ্ধ করার কার্যক্রম শুরু হয়েছিল।
কিন্তু সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে কাঙ্ক্ষিত কাজের ক্ষেত্রে অগ্রগতির তুলনায় অবিলম্বে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে বিএনপির মতো বড় দল দৃশ্যত ধৈর্য হারাতে থাকে এবং ক্রমেই অস্থির হয়ে ওঠে। বারবার একটি কথা অত্যন্ত বড় হয়ে জনসমক্ষে আবির্ভূত হতে শুরু করেছে। তা হলো বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণ যেন গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে অর্জিত কিংবা সঞ্চিত ঐক্য, আকাঙ্ক্ষা এবং পরিকল্পনা থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে। পরিবর্তে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার বাসনাই যেন অনেককে তাড়িয়ে বেড়াতে শুরু করেছে।
এর ফলে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মনে হচ্ছে, জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের আবেদন কিংবা আকাঙ্ক্ষাটি এখন যেন তার কার্যকারিতা সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে না ফেললেও ধূসর গোধূলির মতো ক্রমেই অপসৃত হচ্ছে।

https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/07.july/06-07-2025/kalerkantho-ed-1a.jpgএ কথা ঠিক যে বিগত জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান কোনো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ছিল না। তবু সেটি আমাদের বিগত ৫৩ বছরের স্বাধীনতা-উত্তর আন্দোলনের ইতিহাসে একটি বিরাট মাইলফলক। স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী শাসন-শোষণের কবল থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে একটি বিশাল পদক্ষেপ। সুতরাং কোনো বিবেচনায়ই সে অভ্যুত্থানকে খাটো করে দেখা যাবে না।

আমাদের অতীত গণ-আন্দোলন কিংবা অভ্যুত্থানের ইতিহাসে ২০২৪ সালে সংগঠিত ছাত্র-জনতার সে মহান জাগরণ, আত্মত্যাগ কিংবা সাফল্যকে চিরভাস্বর করে রাখা আমাদের একটি জাতীয় দায়িত্ব বলে তথ্যাভিজ্ঞ মহল মনে করে। কারণ সেটি কোনো অগণতান্ত্রিক সরকার পতনের একটি সাদামাটা আন্দোলন ছিল না। ছিল না কোনো যেনতেন ফ্যাসিবাদী সরকার হটিয়ে তথাকথিত একটি নির্বাচনের মাধ্যমে ভবিষ্যতে নতুন কোনো স্বৈরাচার কিংবা ফ্যাসিবাদ জন্ম দেওয়ার লক্ষ্যে পরিচালিত। এই সত্যটি দেশের কোনো প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল কিংবা রাজনীতিসচেতন জনগণ অস্বীকার করতে পারবে না। তাহলে আমরা কোন যুক্তিতে জুলাই সনদ ঘোষণা কিংবা সংগ্রামী ছাত্র-জনতার একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়কে সজ্ঞানে অগ্রাহ্য করছি? সংগ্রামী ছাত্র-জনতার জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, কৌশল কিংবা কর্মসূচিতে কিছু দুর্বলতা থাকতেই পারে। এতে সম্ভবত সাংগঠনিক দিক ছাড়াও অভিজ্ঞতা ও সময়ের আলোকে ত্রুটিপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্তেরও প্রতিফলন ঘটতে পারে। তবে চূড়ান্ত বিবেচনায় নিঃসংশয়ে একটি কথা বলতে হবে যে সংগ্রামী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীদের মধ্যে দেশের সার্বিক কল্যাণ ও মুক্তির প্রশ্নে মোটামুটি সবাই ছিলেন নিঃস্বার্থ ও বিতর্কের ঊর্ধ্বে। এ ক্ষেত্রে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের বহু ব্যর্থতা থাকা সত্ত্বেও আপসহীন থাকতে হবে। নতুবা এ ক্ষেত্রে শুধু তারা নয়, জুলাই-আগস্টের সব আন্দোলন ও আত্মত্যাগ মূল্যহীন হয়ে পড়বে।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান অধ্যাপক ড. ইউনূসসহ আমাদের রাজনৈতিক মহলের অনেকেই এরই মধ্যে গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। এতে তাঁদের অনেকের মধ্যেই বিগত ১১ মাসে ঘটে যাওয়া অনেক ব্যর্থতার চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে অনেকে দায়ী করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতা ও অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে সমন্বয়ের অভাবকে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সাবেক নেতারা এরই মধ্যে বহুবার অভিযোগ করেছেন যে অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে সময়োচিতভাবে একটি ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণার অভাবে রাজনৈতিক মহলে এখনো অনেক বিভ্রান্তি এবং ভবিষ্যৎ দিকদর্শনের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। ফলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই তাদের নিজ নিজ দলের পতাকাতলে অবস্থান নিয়েছে। ভুলে গেছে সেই মহান গণ-অভ্যুত্থানের জাতীয় প্রেক্ষাপটটি। রাজনৈতিক ঐক্য কিংবা রাজনৈতিক কর্মসূচিগত সমন্বয়ের বিষয়টি। ফলে চারদিকে মাথা তোলার অবকাশ বা সুযোগ পেয়েছে পতিত আওয়ামী সরকারের দোসর কিংবা বশংবদরা। সে পরিস্থিতিতে ড. ইউনূস হতাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘আমাদের একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বিফলে যেতে বসেছে। আমরা মুখে বলছি, সাবেক ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রতিনিধিরা এখনো সর্বত্র বসে রয়েছে। আমরা তাদের সরাতে পারিনি। আমরা তাদের স্বভাব-চরিত্র বদলাতে পারিনি।’ এ অবস্থায় অনতিবিলম্বে সর্বক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে না পারলে এবং সব জায়গায় কাঙ্ক্ষিত সংস্কার কিংবা পরিবর্তন সাধন করতে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতে ক্ষমতার রাজনীতিতে কোনো নির্বাচিত সরকারই স্থিতিশীল হতে পারবে না। এতে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন, উন্নয়ন কিংবা সমৃদ্ধি আশা করা হয়েছিল, তা বিফলে যেতে বাধ্য হবে। এখানেই অতীতে সংঘটিত সব গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের মৌলিক এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিগত কিছু পার্থক্য ছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারটি ছিল গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী একটি ভিন্নধর্মী রাজনৈতিক উদ্যোগের ফসল, কিন্তু তাতে অন্য অনেক কিছু থাকলেও ছিল না রাজনৈতিক দূরদর্শিতা।

ফরাসি বিপ্লব রাশিয়ায় সংঘটিত সমাজতান্ত্রিক (বলশেভিক) বিপ্লবের মতো ছিল না। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রায় শেষ দশকে (১৭৮৯-১৭৯৯) ফ্রান্সে সংঘটিত সে বিপ্লব ছিল একটি ‘দশক স্থায়ী সামাজিক-রাজনৈতিক অভ্যুত্থান’। ফ্রান্সের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের উল্লেখযোগ্য সময়। সে অভ্যুত্থানের শুরুতেই অর্থাৎ ১৭৮৯ সালে তার নেতারা ফ্রান্সের নাগরিক কিংবা মানুষের অধিকার নিয়ে ফ্রেঞ্চ চার্টার নামে একটি সনদ ঘোষণা করেন। সে সনদই ফরাসি বিপ্লবের মৌলিক চরিত্র বা বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরে। তাদের মুক্তি, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের নীতি প্রকাশ করে। এর পাশাপাশি মানুষের মৌলিক অধিকার ও দায়দায়িত্বের পথনির্দেশ প্রদান করে। সেদিক থেকে পর্যালোচনা করলে বাংলাদেশে সংঘটিত জুলাই-আগস্টের বিপ্লবও ছিল মূলত একটি গণ-অভ্যুত্থান। কিন্তু সে সফল অভ্যুত্থানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতাদের কী প্রত্যাশা ছিল, সেগুলো তাঁরা একটি সনদ আকারে নিজেরা প্রকাশ করেননি। তাঁরা অপেক্ষা করেছেন এই দায়িত্বটি সম্পন্ন করার ব্যাপারে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য, যাদের সঙ্গে সে গণ-অভ্যুত্থান কিংবা রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। সে কারণেই জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান সম্পর্কিত ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণা কিংবা নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়টি অনিশ্চিতভাবে ঝুলে রয়েছে। জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের কোনো কিছু উদযাপনের ক্ষেত্রেই কোনো গুরুত্ব দেখা যাচ্ছে না। এ রকম একটি রাজনীতিগত দোদুল্যমান অবস্থায় কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান আমাদের জীবনে কী পরিবর্তন এনেছে? যদি কোনো পরিবর্তন না-ই হয়ে থাকে, তাহলে দেশে ফ্যাসিবাদের পতন বা তাদের উত্খাত করা হলো কিভাবে? কেন এত বিশাল গণ-আন্দোলন ও সাধারণ মানুষের এত আত্মত্যাগ? অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান বলেছেন, ‘অতীতের অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন বদলাতে আমরা রাষ্ট্র মেরামতসহ সর্বত্র সংস্কার সাধনের যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছি, সেগুলো আমাদের প্রস্তাবিত জুলাই সনদে স্থান পেতে হবে।’ দল-মত-নির্বিশেষে জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে প্রস্তাবিত ঘোষণাগুলো বাস্তবায়িত করতে হবে। কিন্তু কী সে প্রস্তাবিত ঘোষণা, তা এখনো জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেক দলই জানে না। বিএনপিসহ বিভিন্ন দেশপ্রেমিক দলের নেতাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কোনো আলোচনায়ই এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বসা হয়নি। কারা কারা হবেন এই প্রস্তাবিত সনদে স্বাক্ষরকারী? এ পর্যন্ত তারও কোনো হদিস নেই। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং দেশি-বিদেশি আধিপত্যকে প্রতিরোধ করে আমরা কিভাবে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করব—প্রস্তাবিত সনদে আমরা সে ব্যাপারে সবার সম্মিলিত প্রতিশ্রুতি চাই।

 

লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক

gaziulhkhan@gmail.com

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

বাবনপুরে জেগে আছেন শহীদ আবু সাঈদ

    ড. মো. ফখরুল ইসলাম
শেয়ার
বাবনপুরে জেগে আছেন শহীদ আবু সাঈদ

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে জুলাই ২০২৪ মাসটি এক অনন্য মর্যাদার দাবিদার। এই মাসে বারবার রক্ত ঝরেছে, শিক্ষার্থী-শ্রমিক-জনতার আহ্বানে কেঁপে উঠেছে শাসকের প্রাসাদ। সেই উত্তাল জুলাইয়ের সূচনা ঘটেছিল রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) মাটি রঞ্জিত করে আবু সাঈদ নামের এক শিক্ষার্থীর রক্তে। পীরগঞ্জের বাবনপুর নামক গ্রামে একটি বাঁশের বেড়া দেওয়া কবরে তিনি শুয়ে আছেন নীরবে, নিঃশব্দে।

তিনিই জুলাই বিপ্লবের প্রথম শহীদ। তাঁর মৃত্যু কেবল একটি প্রাণহানির ঘটনা নয়, বরং তা ছিল রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের নগ্ন প্রকাশ এবং ছাত্ররাজনীতির নতুন পর্বের সূচনাবিন্দু।

রংপুরে শিক্ষার বাতিঘর হয়ে উঠেছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের অব্যবস্থাপনা, নিয়োগ বাণিজ্য, রাজনৈতিক দখল ও অবমূল্যায়নের কারণে নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বারবার পরিণত হয়েছে ক্ষোভের আগ্নেয়গিরিতে।

যখন সারা দেশে শিক্ষার্থীরা চাকরিতে কোটা সংস্কার ও নিজেদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষার দাবিতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন শুরু করেন, তখন এখানেও জুলাই ২০২৪-এর বিস্ফোরণ ঘটে যায়। কিন্তু শান্তিপূর্ণ সেই কর্মসূচির জবাব এসেছিলি উগ্র পুলিশের রাইফেলের নির্মম গুলিতে। এই শহীদ শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্রোহের জোয়ার উঠেছিল।

https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/07.july/05-07-2025/kalerkantho-ed-1a.jpgজুলাই বিপ্লব তাই কেবল রংপুরের বা বেরোবির নয়।

এটি সর্বজনীন এক ছাত্র আন্দোলনের রূপরেখা। শাহবাগ থেকে রাজশাহী, চট্টগ্রাম থেকে খুলনাপ্রতিটি প্রাঙ্গণে যে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছিল, তার কেন্দ্রে রয়েছে বাবনপুরে শহীদ হওয়া সেই অজানা নামটি, যে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জাগিয়ে তুলেছে একটি জাতিকে।

এই শহীদ যেন আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, বাংলাদেশে ছাত্ররাই বারবার যুগ পরিবর্তনের সূচনা করেন। হোক তা ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার সংগ্রাম কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী লড়াই। আমরা চাই, এই শহীদের রক্ত বৃথা না যাক।

আমরা চাই, বাবনপুর হোক সতর্কবার্তা, রাষ্ট্র যেন আর কখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গুলির ট্রিগারে আঙুল না তোলে।

জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদের স্মরণে রাষ্ট্র কি আরো একটু নত হবে, নাকি আবারও চলবে এড়িয়ে যাওয়ার নীলনকশা? যদি তা-ই হয়, তবে আগামী দিনগুলো আরো অস্থির, আরো উত্তাল হবে।

যেখানে বাধাগ্রস্ত হবে, সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে’—এই চেতনা দেরিতে এলো কেন? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে রাষ্ট্রযন্ত্রের চেহারার ভেতরে, যা দিন দিন হয়ে উঠছে আরো দুর্বিনীত, অসহনশীল ও জনবিচ্ছিন্ন। যখন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা পাস করার পর চাকরির জন্য ঘুরে বেড়ান, তাঁদের দাবি উপেক্ষা করে, বিরোধিতা করে, এমনকি দমন করতে গিয়েই সরকার তার আসল চেহারা উন্মোচন করে। ঠিক এখানেই জুলাই এসে দাঁড়িয়েছিল প্রতিবাদের ভাষা হয়ে। এটি কেবল একটি মাস নয়, এটি একটি ধারণা, একটি রাজনৈতিক চেতনা, একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার নাম, যা শেখায় জুলুমের বিরুদ্ধে চুপ থাকা মানেই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া। তাই যখনই কোথাও প্রতিবাদ বাধাগ্রস্ত হবে, যখনই মত প্রকাশের অধিকার পদদলিত হবে, তখনই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে প্রতিরোধের এক ছায়াছবির মতো।

বাবনপুরে শায়িত জুলাই বিপ্লবের প্রথম শহীদ, তাঁর জীবন দিয়ে আমাদের আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, প্রতিবাদের মুখ বন্ধ করে রাখা যায় না। তাই তাঁর মৃত্যু আর দশটি মৃত্যুর মতো নয়, বরং এটি এক বিস্মৃত সময়কে জাগিয়ে তোলার মুহূর্ত, যেখানে জুলাই আবার ফিরে এসেছে জনতার পাশে দাঁড়াতে।

এখন বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনে, কর্মক্ষেত্রে, সংবাদমাধ্যমে, এমনকি সংসদের ভেতরেও যদি অন্যায় চাপিয়ে দেওয়া হয়, তবে সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে। কারণ এই মাস শেখায় শুধু স্মৃতিচারণা নয়, স্মৃতি দিয়ে বাস্তব পরিবর্তনের দাবিও তোলা যায়।

তাই আমাদের দায়িত্ব এই শহীদের মৃত্যু যেন অন্ধকারে হারিয়ে না যায়। রাষ্ট্র যদি কখনো ন্যায়ের পথ ছেড়ে নিপীড়নের দিকে হাঁটে, তাহলে প্রতিটি গ্রামে বাবনপুরের মতো একেকটি জুলাই জন্ম নিতে পারে।

এমন সময় হয়তো আবারও প্রশ্ন উঠবে, জুলাই-জুলাই বলে এত মাতামাতি কেন? আমরা তখন উত্তর দেব, এর কারণ আমাদের প্রতিবাদের জায়গাগুলো একে একে নিঃশব্দ হয়ে যাচ্ছে। আর যেখানে হাতে মুষ্টি তুলে পথে নেমে সমস্বরে চিৎকার করা নিষিদ্ধ, সেখানে জুলাই-ই হয়ে উঠতে পারে একমাত্র ভাষা।

শহীদ আবু সাঈদের মৃত্যু কেবল একটি গুলি বা একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল না। এটি একটি সাবধানবাণীও ছিল। বেরোবির পার্কের মোড়ের অদূরে যা ঘটেছিল, তা ছিল আসলে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। যেখানে কথা বলা মানেই অপরাধ, দাবি জানানো মানেই রাষ্ট্রদ্রোহ মনে করা হয়েছিল।

সেদিন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা যখন শান্তিপূর্ণভাবে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন রাষ্ট্র কী করেছিল? তারা কেন সেদিন তাঁদের দিকে বন্দুক তাক করল? সেদিন যে তরুণ শহীদ হলেন, তিনি যেন গোটা বাংলাদেশের হয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন, তৎকালীন ক্ষমতাধরদের কাছে তা অনুধাবন করা কি খুব জটিল বিষয় ছিল?

বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রতিবাদের ঐতিহ্য খুব গর্বের। ভাষা আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসবখানেই ছাত্রসমাজ পথ দেখিয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালে এসেও ছাত্রসমাজের কণ্ঠ রোধ করতে গুলি ব্যবহার করতে হয়, এটি কি রাষ্ট্রের দুর্বলতা নয়? আগামী দিনে আমরা এ ধরনের আর কোনো রাষ্ট্রীয় দুর্বলতা ও ভয় দেখতে চাই না।

জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদ শব্দটি যেন আমাদের সবার কাঁধে নতুন দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়। এর মানে, আরো অনেক শহীদ আসতে পারেন, যদি রাষ্ট্র তার দমননীতি থেকে ফিরে না আসে। যদি কথা বলার জায়গা, ভিন্নমতের জায়গা একে একে নিঃশব্দ হয়ে যায়, তাহলে শেষ ভরসা হয় রক্ত। বেরোবির ইংরেজি পড়ুয়া অকুতোভয় ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের তাক করা বন্দুকের নলের সামনে বুক উঁচিয়ে গুলি খেতে দ্বিধাহীন না থাকলে আজ কী করতাম আমরা, তা কি কেউ ভেবে দেখেছেন?

জন্ম নিলেই সবাইকে একদিন না একদিন নির্বাক হতে হয়। কিন্তু সবার কথা কি সব মানুষের অনন্তকালব্যাপী মনে থাকে? শহীদ আবু সাঈদ বাবনপুরে শুয়ে আমাদের শিখিয়ে দিচ্ছেন, দেশের যেকোনো প্রয়োজনে যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্বাক থাকার দিন শেষ।

 

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন

fakrul@ru.ac.bd

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ