বলা যায়, ভাগ্য তাঁর তেমন প্রসন্ন ছিল না। ভাগ্য তাঁকে ডাইনিংরুমের সহকারী না বানিয়ে বিলিয়নেয়ার বানিয়েছে; তাঁকে আরো ধনী করেছে। তাঁর দৃষ্টি আকৃষ্ট করে রেখেছে ট্যাবলয়েডের পাতায়। এর পরও তিনি দ্বিধান্বিত—আগন্তুক হিসেবে তিনি বোঝার চেষ্টা করছেন কী ভুল হয়েছে তাঁর। একটা প্রহসন হিসেবে তাঁর প্রেসিডেন্ট জীবন শুরু হয়েছিল, সেটা শেষ হচ্ছে একটা ট্র্যাজেডি হিসেবে।
ভাগ্য সত্যিই নিজেকে ছাপিয়ে গেছে, সে তাঁকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বানিয়েছে। অর্জনের এই সর্বোচ্চ শিখর থেকে তিনি সক্ষম হলেন বিশাল একটি বিশ্ব দেখতে। এটা বেশ নিশ্চিত যে তিনি যেখানে প্রবেশ করেছেন, সেখানে তিনি কার্যত অবস্থান করেন না। তিনি যে অবস্থায় পড়েছেন তাঁর প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করা সহজতর হতো, যদি এর প্রতি তাঁর সাড়া (রেসপন্স) এতটা তিক্ত ও ক্রুদ্ধ না হতো; যদি তাঁর অফিস (প্রেসিডেন্সি) এমন একটি শক্তির প্রতি তাঁর শিশুসুলভ আচরণকে বড় করে না দেখত, এ শক্তি প্রজাতন্ত্রকে অস্থিতিশীল করার সামর্থ্য রাখে।
ক্যাপিটলে হামলা (হয়তো তা প্রতিশোধের শর্ত পূরণ করে) একটা বড় ভুল। ট্রাম্প তাঁর সমর্থকদের আরো একবার বলেছেন যে পুনর্নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে তাঁকে প্রতারণা করা হয়েছে, অতঃপর তিনি সমর্থকদের ক্যাপিটলে পাঠালেন—যেখানে তাঁর পরাজয়কে আইন ও রীতি অনুযায়ী আনুষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হচ্ছিল, চূড়ান্ত করা হচ্ছিল। এগুলো তাঁর জন্য হতাশার মূল দুই উৎস। এগুলো তাঁকে ক্রমেই বিব্রত করছিল ওভাল অফিসে তাঁর প্রথম পা রাখার দিন থেকে। এটা কোনো অর্থেই চমকপ্রদ বা দর্শনীয় বিষয় ছিল না।
ক্যাপিটলে হামলায় ক্ষোভ ছাড়া কিছুই প্রকাশিত হয়নি। এক সিলেবলের একটা শব্দ ‘ট্রাম্প’ (যা এ কয় বছরে নানা পুরনো জায়গায় দেখা গেছে) উচ্চারিত হয়েছে গম্বুজওয়ালা একটি গোল ঘরে। তাঁর নাম ব্যানারে উড়তে দেখা গেছে। কর্তৃত্ববাদী আন্দোলনকে সব সময় পপুলিস্ট হিসেবে পাস করে যেতে দেখা যায়। তাণ্ডব কী, হুমকি কী, পবিত্র স্থানে অপবিত্র বা অশ্রদ্ধার কাজের মানে কী, তা জানার আগে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্রকৃত অপরাধী কারা তা জানা, কারা ফায়দা লোটার চেষ্টায় আছে তা জানা। তাণ্ডবে কাদের সমস্যা হয় তা জানা।
ধরা যাক, হামলাকারীদের মোটিফ সারসংক্ষেপে একটি শব্দে প্রকাশ পেয়েছে, সেটি হলো ট্রাম্প। তাঁর উপহাস ও গলাবজি এবং ধ্বংসাত্মক কথাবার্তার পেছনে যে মিথ্যাচার লুকিয়ে আছে তাঁকে তারা বুঝেছে বলেই মনে হয়। এ ধরনের লোক সব সময় পাওয়া যায় এবং এখন তারা পরস্পরকে ইন্টারনেটে খুঁজে পায়। ট্রাম্প নিজেই একটা শক্ত প্রমাণ যে রাগ-ক্ষোভ-ভীতির তিক্ততার বস্তুগত উপকরণে যে আয়েশি ভাব আছে তা সন্তুষ্টি আনে না। ট্রাম্প সেলফ-পিটিকে চাবুক মারার কাজের সূচনাকারী নন; কিন্তু তিনি এটার প্রতিলিপি, তিনি এটার মহিমান্বিত রূপ।
এ দেশের ভালো ঐতিহ্যগুলো আত্মসংবরণের নীতির ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে। সংবিধানকে রক্ষা করার মানে একটা ‘কোড অব ল’কে মান্য করা—ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো, বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করা। এ বিষয়গুলো বিভিন্ন সরকার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতারা একটা বিষয়কে বিবেচনায় নিয়েছেন যে তাঁরা এবং তাঁদের মতো লোকজন সরকার পরিচালনা করবেন। তাঁরা একটা দারুণ কাজ করেছেন, নিজেদের হাত বেঁধে রেখেছেন অর্থাৎ আত্মসংবরণের ব্যবস্থা করেছেন। মার্কিন সংবিধান সংক্ষিপ্ততার একটা মাস্টারপিস, ব্যতিক্রমী জিনিস। পরের প্রজন্ম এটাকে সংশোধন করার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী সংবরণ দেখিয়েছে। একটা বিশাল ও অনন্য সভ্যতার বোধ থেকে এর উৎপত্তি। এর কারণে একটা চেক অ্যান্ড ব্যালান্সের সিস্টেম টিকে আছে।
এখন আমাদের মনে পড়ছে যে আমাদের ব্যবস্থাটা নির্ভরশীল অর্ধেক জনসংখ্যার বা প্রায়ই অর্ধেকের চেয়ে বেশি ইলেকটোরেটের ওপর। গণতান্ত্রিক নাগরিকত্ব হয়তো একটা আর্ট, এটা কিভাবে চর্চা করতে হয় আমরা সেটা ভুলে গেছি এবং ট্রাম্প এর সীমাই দেখতে পান না। তিনি সেটা কখনো বুঝবেন না।
আমাদের চরমপন্থীদের আর্লি ইউরোপিয়ান ফ্যাসিস্টদের সঙ্গে তুলনা করাই ভালো। একসোঁ ফ্রঁসেজ ও নাজিরা চোর-ডাকাতদের ব্যবহার করত সাংবাদিক ও সিভিল অফিশিয়ালদের সন্ত্রস্ত করার জন্য, হত্যা করার জন্য। এটা তারা করত মানুষের মনে দাগ কাটার জন্য। তারা এমন ধারণা তৈরি করে নিয়েছিল যে তারাই সত্য, তারাই সত্যিকারের ফ্রেঞ্চমেন এবং জার্মান।
ট্রাম্প তাঁর সমর্থকদের বলেছেন, তোমরাই আসল লোক, তোমরাই সেই লোক, যারা এই দেশটাকে গড়েছ। আমেরিকান বলতে যা বোঝায় সেই অর্থকে সংকীর্ণ করে (তিনি সেটা লাগাতারভাবে করেন) তিনি একটা একটা মাইনরিটি কনসেপ্ট তৈরি করেন; তাঁর প্রতি সহানুভূতিশীল শ্বেতাঙ্গদের একটা স্বতন্ত্র গ্রুপ মনে করেন। এভাবে তাদের একটা ফোকে (জনতায়) পরিণত করেন। তারা ভাবে যে ভোট চুরি করা হয়েছে। এভাবে তারা তাদের দাবিকে সত্য মনে করে। যদিও প্রমাণাদি অন্য কথা বলে।
ট্রাম্প দ্বিতীয় ইমপিচমেন্টের বিষয়টিতে মজা পান হয়তো। তিনি ওয়াশিংটনের ফাঁদে পড়েছেন। একজন আউটসাইডার নিজেকে ভাবছে ইনসাইডার। তিনি বুঝতে পারেন না যে একান্ত অনুসারীদের দ্বারা তিনি ভূতে পরিণত হবেন। তিনি বন্ধুহীন নন, রুডি গিউলিয়ানি এবং এমন আরো সহস্র লোক তাঁর সঙ্গে আছে। ক্যাপিটলে সরকারে সিটে তোপ দাগার সময় তারা তাঁর নামে জয়োল্লাস করেছে। তারা হয়তো সিনেট চেম্বারে ঢুকে পড়তে পারে; কিন্তু কখনো তারা লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে না।
লেখক : আমেরিকান ঔপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক
সূত্র : দ্য গার্ডিয়ান ইউকে
ভাষান্তর ও সংক্ষেপণ : সাইফুর রহমান তারিক
মন্তব্য