ডোনাল্ড ট্রাম্পের রাশিয়াবিষয়ক সাবেক শীর্ষ বিশেষজ্ঞ ফিওনা হিল বলেছেন, ট্রাম্প হচ্ছেন বেদনাকর অস্বস্তির, পতনের এবং ক্ষয়ের লক্ষণ।
অল্প কিছু মার্কিন নির্বাচন বেশ উদ্বেগের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়েছে, এবারের নির্বাচনের মতোই। সারা বিশ্বই সেসব দেখেছে। বাইডেনের জয়ে ব্যাপক স্বস্তি অনুভূত হচ্ছে, এটা প্রমাণিত। পররাষ্ট্রবিষয়ক প্রচুর নীতির বিষয়, অভ্যন্তরীণ নীতির মতো বিষয় নয়—নির্বাহী আদেশে আইনে পরিণত করা যায়, এতে সিনেটের সমর্থন দরকার পড়ে না। মূলত তিনি (বাইডেন) হবেন এমন একজন প্রেসিডেন্ট, যিনি কোনো প্রতিবেদন পড়ার ব্যাপারে যথেষ্ট ধৈর্যশীল এবং সেটা বোঝার যথেষ্ট জ্ঞান তাঁর আছে। তিনি বোঝেন যে আমেরিকা একা সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারে না; তিনি হবেন এমন লোক, যিনি গণতান্ত্রিক মিত্রদের অপদস্থ করে একনায়কদের প্রশংসা করেন না। তিনি ভ্লাদিমির পুতিনের পরামর্শ ছাপিয়ে নিজের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কথা শুনবেন এবং অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্য নীতির বিষয়গুলোতে আস্থা রাখবেন। এ ব্যাপারে তিনি তাঁর মেয়ে-জামাইয়ের ওপর ভরসা করবেন না।
মিস্টার বাইডেন এরই মধ্যে অঙ্গীকার করেছেন, তিনি মিস্টার ট্রাম্পের বেশ কিছু সিদ্ধান্ত অকার্যকর করবেন; প্যারিস জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক চুক্তিতে প্রত্যাবর্তন করবেন; এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত পুনর্বদল করবেন। তিনি পরিকল্পনা করেছেন, অনতিবিলম্বে মেয়াদোত্তীর্ণ হতে যাওয়া রাশিয়ার সঙ্গে নতুন স্টার্ট চুক্তির মেয়াদ বাড়াবেন, শেষ অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি বহাল রাখবেন। আন্তর্জাতিক কূটনীতির জন্য চলমান মহামারি মোকাবেলা করা খুব সম্ভবত তাঁর অগ্রাধিকারের বিষয় হতে পারে। তিনি কভেক্স-এ সই করবেন। কভেক্স হচ্ছে একটি বৈশ্বিক, এ উদ্যোগের ফলে দরিদ্র দেশগুলো করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিনের একটি শেয়ার পাবে। কভেক্স একটি শক্তিশালী বার্তা দিচ্ছে। ১৮০টিরও বেশি দেশ এরই মধ্যে এটা করেছে, তাদের মধ্যে চীনও আছে।
হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করার জন্য অপেক্ষা এখন, সেটার নিজস্ব বিপদ আছে। যুক্তরাষ্ট্র যে বিতিকিচ্ছি দশায় পড়েছে তার সুযোগ হয়তো অন্যান্য দেশ নেওয়ার চেষ্টা করবে। প্রেসিডেন্ট-ইলেক্ট কোনো ইন্টেলিজেন্স ব্রিফিং গ্রহণ করছেন না; অফিসে বসার প্রস্তুতি নেওয়ার সময় তিনি নিজেকে অন্ধকারে রেখেছেন। ট্রাম্পের বদল করা লোকজন যেমন—প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক এসপার এবং অন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হয়তো পুরস্কৃত করা হবে না; তবে ঘরে-বাইরে তাঁদের কাজে লাগানোর পথ করা হচ্ছে। নির্বাচনের সময় থেকেই প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তারা ইসরায়েল, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরব সফর করেছেন ইরান বিষয়ে আলোচনা করার জন্য। এটা হয়তো তেহরানের ওপর চাপ তৈরির জন্য; তাতে ইরানের পরমাণুচুক্তি বলবৎ করার কাজ আরো কঠিন হবে।
ট্রাম্প প্রশাসন চীনের বিষয়ে ধারণার চেয়ে বেশি কঠোর হয়েছে এবং শিনচিয়াংয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে চীনা কর্মকর্তাদের ওপর অবরোধ আরোপের মতো সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট একই সঙ্গে অনিশ্চিত ও অভব্য লেনদেনমূলক আচরণ করেছেন, সব জায়গায়ই তিনি এটা করেন। তিনি প্রমাণ করেছেন মানবাধিকার একটি গ্রহণযোগ্য বাণিজ্যচুক্তির সঙ্গে বিনিময়যোগ্য। চীনের বিষয়ে এ বিরোধিতা বাস্তবে এসেছে রাজনৈতিকভাবে হংকংয়ে, শিনচিয়াংয়ে এবং আন্তর্জাতিকভাবে চীন যা করেছে তার পরিপ্রেক্ষিতে। এ ধরনের আচরণের বিপরীতে পদক্ষেপ নিতে হলে ইন্টেলিজেন্স দরকার, অভিজ্ঞতার দরকার (পররাষ্ট্র দপ্তর এখন মগজশূন্য, অতিমাত্রায় রাজনৈতিক হয়ে পড়েছে) ও ধারাবাহিকতা দরকার; আন্তর্জাতিক জোট গঠন জরুরি। তাইওয়ানের জন্য সমর্থনের ব্যবস্থা করা (তারা বেইজিং ট্রিগার টিপলে সাড়া দিতে পশ্চাদপসরণ করে না) জরুরি হবে এবং সে কাজটি অনেক কঠিন হবে।
ট্রাম্পের সমালোচকরা কখনো কখনো ট্রাম্পের আগের মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিকে অনেক বেশি আশাবাদী নীতি হিসেবে দেখেছেন। মিস্টার বাইডেন সারগতভাবে যেমন নীতি তার আগে ছিল, সেভাবেই দেখে যাবেন বলে মনে হয়; কিন্তু মিস্টার ট্রাম্প যদি এ কথা স্বীকার করেন যে বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিবর্তন হচ্ছে, তাহলে বলতে হয়, তিনি এর পতনও তরান্বিত করেছেন। এমন একটি লোক যদি প্রেসিডেন্ট হতে পারেন, তিনি যেমন চান তেমন প্রশাসন চালাতে পারেন, তাহলে তিনি মৌলিকভাবেই মার্কিন অবস্থানকে খাটো করেছেন। বিস্ময়ের সঙ্গে বিশ্ববাসী লক্ষ করেছে, প্রেসিডেন্ট করোনাভাইরাসে দেশকে নাকাল হতে দিয়েছেন এবং এখন তিনি পরাজয় মানতে অস্বীকার করছেন। গত সপ্তাহে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও হংকংয়ে গণতন্ত্রকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য বেইজিংয়ের সমালোচনা করেছেন, তার পরই অবোধের মতো বলেছেন, স্বদেশে দ্বিতীয় ট্রাম্প প্রশাসনের মসৃণ উত্তরণ ঘটবে।
দুনিয়ার বিশাল একটি অংশ যদি ভাবে, যুক্তরাষ্ট্র বদ হয়ে গেছে অথবা আগে অন্তত একটা গভীর খুঁত ছিল, তাহলে তারা এ-ও ভেবেছে, রাষ্ট্রটি মোটামুটি কার্যকর রয়েছে, প্রতিযোগিতা-সক্ষম রয়েছে এবং প্রায়ই এটি ঈর্ষাযোগ্য। ধ্বংস করা গড়ে তোলার চেয়ে সহজ। মিস্টার বাইডেন গত চার বছরের কিছু বাজে কাজ অকার্যকর করবেন বলেছেন; কিন্তু তিনি সেগুলো রেকর্ড থেকে মুছে ফেলতে পারবেন না।
সূত্র : দ্য গার্ডিয়ান ইউকে
ভাষান্তর : সাইফুর রহমান তারিক
মন্তব্য