<p>বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বাংলাদেশের ইতিহাসের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়গুলোর ধারাবাহিক বর্ণনা, ছোট-বড় অসংখ্য মন্তব্যের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চরিত্র, নেতৃত্বের ধরন, একজন নেতার কাজ করার কিংবা সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর সুচিন্তিত মতামত প্রদান করেছেন। এ সমস্ত মতামত বঙ্গবন্ধুর নিজস্ব অভিজ্ঞতালব্ধ অর্থাৎ ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু জীবন থেকে যা শিখেছেন, এ সমস্ত মতামতে তারই প্রতিফলন ঘটেছে।</p> <p>সিদ্ধান্ত গ্রহণ একজন রাষ্ট্রনায়ক কিংবা রাজনীতিবিদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, বিশেষ করে একজন রাষ্ট্রনায়কের জন্য সঠিক ও দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ কত যে গুরুত্বপূর্ণ তা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে মহামারি, যুদ্ধ কিংবা অস্বাভাবিক সময়ে উপলব্ধি করা যায়। বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে সিদ্ধান্ত গ্রহণ নিয়ে স্বগতোক্তির মতো করে কিছু মূল্যবান কথা খুব সহজভাবে বলে গেছেন, যা আধুনিক ব্যবস্থাপনাবিজ্ঞানও এত প্রাঞ্জলভাবে উপস্থাপন করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর এ রকম একটি মতামত পড়লে বিস্মিত হতে হয়, একজন মানুষ জীবনের কতটুকু গভীরে পৌঁছলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্পর্কে এ ধরনের দার্শনিক ও বাস্তবসম্মত উক্তি করে যেতে পারেন। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র পঁচিশ নম্বর পরিচ্ছেদে এ রকম একটি উক্তি পড়লে তাঁর ধারণাকে শুধু আধুনিক বললে ভুল হবে, মনে হবে ধারণাটি উত্তর-আধুনিক কোনো দার্শনিকের উপদেশ। বঙ্গবন্ধু খুব সহজভাবে গল্পের মতো করে তাঁর ধারণাটি পাঠকদের জন্য এভাবে লিখে গেছেন।</p> <p>বলা হয়ে থাকে, আধুনিক ব্যবস্থাপনাবিজ্ঞানে একজন নেতা প্রধানত দুভাবে কাজ করে। দীর্ঘ চিন্তা ও পরিকল্পনা প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এক ধরনের নেতা সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করে থাকেন। আরেক ধরনের নেতা প্রথমে কিছুটা চিন্তা করেন এবং তারপর কাজ করে করে ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে এগোতে থাকেন। বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় আমরা দুই ধরনেরই একটি চমৎকার সমন্বয় দেখতে পাই। তাঁর সমন্বয়বাদী ধারায় কাজ করার আগে চিন্তা করার কথা বলা আছে এবং ভুল হলে তা থেকে শিক্ষা নিয়ে দ্রুত সংশোধন করার কথাও বলা আছে। কী অসাধারণ, কী কার্যকর, কী বাস্তবসম্মত মতামত।</p> <p>সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া ও ধরন সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর এই অসামান্য মতামতের কথা হঠাৎ করে মনে আসেনি। বৈশ্বিক মহামারির এই ক্রান্তিকালে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সাহসী পদক্ষেপ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া আমাকে তাঁর পিতার সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার অসাধারণ মতামতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় আমরা অকারণে বিলম্ব কিংবা চোখে পড়ার মতো ভুলের সন্ধান পাই না। পৃথিবীর সফল রাষ্ট্রনায়কদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণে পারদর্শিতা। আমরা বিস্মিত হয়ে যাই, মার্চে করোনা আমাদের দেশে আঘাত হানার পরপরই বর্তমান সরকার একটি চমৎকার ও কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সরকার শুরু থেকেই জীবন ও জীবিকার ভারসাম্য রক্ষার নীতি অনুসরণ করে। এ ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকরা চরমপন্থা অবলম্বন করেননি। করোনাকালের প্রথম পর্ব যখন আমরা অতিক্রম করছি, তখন ভাবলে অবাক লাগে—সরকার কত দ্রুত এ রকমের সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পেরেছিল। পার্শ্ববর্তী অনেক দেশের মতো আমরা অতি রক্ষণশীল ছিলাম না অথবা ইউরোপ, আমেরিকার দেশগুলোর মতো অতি আক্রমণাত্মক কৌশলও অবলম্বন করেনি বাংলাদেশ।</p> <p>করোনাকালে যেখানে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের প্রবৃদ্ধি ক্রমাগত নিচে নেমে যাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশ তার প্রবৃদ্ধির গতি ধরে রেখেছে। এ খবর সম্প্রতি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং ওয়াশিংটন পোস্টের মতো সংবাদপত্র তাদের প্রতিবেদন ও মতামতের মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি মহামারি কাটিয়ে বাংলাদেশকে ঘুরে দাঁড়ানোর সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে আশা দেখাচ্ছে মূল রপ্তানিপণ্য পোশাক খাত ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক অতি সম্প্রতি জানিয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর গতি বেশ উৎসাহব্যঞ্জক। তারা আভাস দিয়েছে, বর্তমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে আগামী জুনে শেষ হতে যাওয়া অর্থবছরে এ দেশের অর্থনীতিতে ৬.৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে। এ তথ্যটি এরই মধ্যে আমরা সবাই জেনে গেছি। এপ্রিল-মে মাসের তুলনায় বর্তমানে পোশাক খাতের ঊর্ধ্বমুখী সূচক আমাদের অনেক ইতিবাচক বার্তা দেয়। মহামারির শুরুর দিকে পোশাকের বৈশ্বিক ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশে ৩০০ কোটি ডলারের বেশি মূল্যমানের পোশাকের ক্রয়াদেশ স্থগিত কিংবা বাতিল করে দিয়েছিল, যা ৪০ লাখ শ্রমিক ও হাজার হাজার কারখানাকে অনিশ্চয়তার মুখে ফেলে দেয়। তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি বৈশ্বিক ব্র্যান্ডগুলো থেকে আবার ক্রয়াদেশ পাওয়াকে আশার আলো হিসেবে বিবেচনা করছেন, তাঁর ভাষায় ‘এই মুহূর্তে আমরা বলতে পারি যে তৈরি পোশাক শিল্প মার্চ-মে সময়ের খারাপ সময় কাটিয়ে আবার প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরে আসতে সক্ষম হয়েছে।’</p> <p>প্রবৃদ্ধির গতি ধরে রেখে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সংবাদটি বাংলাদেশের জন্য আনন্দ ও গৌরবের। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন যে একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল, নজিরবিহীন মহামারিকালে প্রবৃদ্ধির গতি ধরে রাখা সেই প্রক্রিয়া ও কৌশলেরই যথার্থতা প্রমাণ করে। সম্প্রতি করোনাকালে বাংলাদেশের পরিস্থিতি জানতে ‘জীবিকার ওপর ধারণা জরিপ ২০২০’ পরিচালনা করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো। এই জরিপের ফলাফল বাংলাদেশ সরকারকে অনেক আত্মবিশ্বাসের উপকরণ জোগান দিয়েছে। করোনা-পূর্ব অর্থনৈতিক নীতি ও করোনাকালীন অর্থনৈতিক পদক্ষেপ দুটিই যে সুদূরপ্রসারী চিন্তার ফসল ছিল তা পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের পূর্বাভাস ও ওয়াশিংটন পোস্টের মতামত সুস্পস্টভাবে প্রমাণ করে দেয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এই জরিপ অনুযায়ী সরকার এতটাই আত্মবিশ্বাস পেয়েছে যে করোনার ভয়াল থাবা যদি আবার আমাদের বিধ্বস্ত করে না দেয়, তাহলে আগের অবস্থায় অচিরেই ফিরে যাওয়া সম্ভব।</p> <p>বাংলাদেশ দুর্যোগ মোকাবেলায় যে দক্ষতা অর্জন করেছে, বিষয়টি আজ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। করোনা মহামারি সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশকেও কিছুটা ভড়কে দিতে সক্ষম হয়। এ রকম অভূতপূর্ব মহামারি কিভাবে মোকাবেলা করতে হয় সে বিষয়ে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে বাংলাদেশ অভিজ্ঞতা অর্জনের মধ্য দিয়ে শিক্ষা নিতে থাকে।</p> <p>এই যে সমস্যার ধরন অনুযায়ী দ্রুত সাড়া দেওয়া, এ কারণেই মহামারি করোনা বাংলাদেশকে এখন পর্যন্ত অপ্রস্তুত করতে পারেনি, কারণ করোনা মোকাবেলায় আমাদের প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত গ্রহণে অস্থিরতা, অপ্রস্তুত ভাব না দেখিয়ে দূরদর্শী পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হয়েছেন; তাই বন্যা, সাইক্লোন—এ ধরনের দুর্যোগের মতো মহামারি মোকাবেলায়ও বাংলাদেশ কিছুটা দক্ষতা অর্জন করতে পেরেছে। দ্রুত ও চিন্তাপ্রসূত সাড়া দেওয়ার জন্যই আমরা পুব আকাশে এখন সোনালি আভা দেখতে পাচ্ছি। ইংরেজি সাহিত্যের কবি শেলি যে রকম করে বলেছিলেন, ‘যদি শীত আসে, তবে বসন্ত কি খুব দূরে থাকে?’ সব কিছু মিলিয়ে তাই এখন মনে হচ্ছে—শীতের হিমেল হাওয়ার রাত বোধ হয় আমরা দৃঢ় ও সাহসী পদক্ষেপে অতিক্রম করতে যাচ্ছি অচিরেই।</p> <p> লেখক : উন্নয়ন গবেষক ও কলামিস্ট</p>