ঢাকায় একটি দৈনিকে একই দিনে দুটি খবর দেখলাম। একটি খবর, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় কাউন্সিলের অধিবেশন সম্পর্কে। তাতে বলা হয়েছে, এবার দলটির কেন্দ্রীয় কমিটিতে অনেক নতুন মুখ আসছে। কমিটিতে নারী প্রতিনিধিত্বও আরো বাড়ানো হবে।
কালান্তরের কড়চা
আওয়ামী লীগের অধিবেশন এবং বিএনপির হুমকি
- আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
অন্যান্য

দুটি খবরই আমাদের রাজনীতির অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ।
এক ভারতীয় সাংবাদিকই তাঁর কলামে লিখেছেন, ‘ভারতের কংগ্রেস এখন প্রায় পতিত বৃক্ষ। দেশটাকে গ্রাস করেছে ভয়ংকর হিন্দুত্ববাদ। বাংলাদেশেও পাল্টা ইসলামী জঙ্গিবাদ প্রায় দেশটাকে গ্রাস করতে চলেছিল। তা রুখে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এ দলটিতেও নানা আগাছা জন্মেছে।
আওয়ামী লীগের সদস্য সংগ্রহে কমিউনিস্ট পার্টি বা জামায়াতের মতো কোনো কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলা নেই। দলটি ব্রডচার্চের মতো। তার নীতিমালায় সম্মতি আছে জানিয়ে যে কেউ দলটির সদস্য এবং কর্মকর্তাও হতে পারে। এর ফলে দলটির দরজা সবার জন্য খোলা। এই খোলা দরজা দিয়ে ভালো-মন্দ সব লোকই দলটিতে ঢুকেছে। দলটি একাদিক্রমে তিন টার্ম ক্ষমতায় রয়েছে। তাতে সুবিধাবাদীদের এই দলে ঢোকার আগ্রহ আরো বেশি এবং তারা ঢুকেছে। তাদের কর্মকাণ্ডের জন্যই দলটির এত দুর্নাম।
এই দুর্নাম থেকে দলটিকে রাতারাতি মুক্ত করার সুযোগ শেখ হাসিনার সামনে ছিল না। দলের নেতৃত্ব গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে কখনো ড. কামাল হোসেন, কখনো আব্দুর রাজ্জাক প্রমুখ স্বদলের ক্ষমতালোভী নেতাদের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের বিচার ও দণ্ডদানের কাজে বিএনপির বাধাদান ও চক্রান্তের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে। সবচেয়ে জটিল একাত্তরের ঘাতক ও দালালদের বিচার ও শাস্তিদানের কাজে শেখ হাসিনাকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে হয়েছে দীর্ঘকাল। এই লড়াই চালাতে গিয়ে তাঁর জীবন বিপন্ন হয়েছে বারবার। এমনকি তাঁকে জীবনের ওপর গ্রেনেড হামলার মতো ভয়াবহ হামলার মোকাবেলা করতে হয়েছে।
বিএনপি-জামায়াত বিরোধী দলে অবস্থানের সময় আওয়ামী লীগ সরকারের গণতান্ত্রিক বিরোধিতা করেনি। করেছে হত্যা ও সন্ত্রাস দ্বারা শত্রুতার রাজনীতি। এ সময় বিএনপির একমাত্র স্লোগান ছিল—‘পঁচাত্তরের হাতিয়ার/গর্জে উঠুক আরেকবার।’ ‘শেখ হাসিনা তোমারে/বাপের মতো পাঠাব যমের দুয়ারে।’ শুধু হিংসাত্মক স্লোগান দেওয়া নয়, মাসের পর মাস সরকার উত্খাতের লক্ষ্যে রাজপথে বাস, লরিতে বোমাবাজি করে, আগুনে জীবিত মানুষ পুড়িয়ে মেরে তারা উদ্দেশ্য সিদ্ধি করতে চেয়েছে। আফগানিস্তান থেকে পলাতক সন্ত্রাসীরা পাকিস্তানের সাহায্যে বাংলাদেশে এলে তাদের ধ্বংসাত্মক কাজে লাগিয়ে বিএনপি-জামায়াত স্বাধীন বাংলাদেশের যে সর্বনাশ করতে চেয়েছিল, হাসিনা জীবন বাজি রেখে তা ব্যর্থ করেছেন। দীর্ঘকাল লড়তে হয়েছে এ জন্য।
সবচেয়ে বড় যুদ্ধ তাঁকে করতে হয়েছে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও মানবতার শত্রুদের শাস্তি দেওয়ার কাজে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রচণ্ড বিরোধিতা, মিথ্যা প্রপাগান্ডার বিরুদ্ধে যে শ্রম ও সময় শেখ হাসিনাকে ব্যয় করতে হয়েছে, বছরের পর বছর যে ধৈর্যের পরিচয় তাঁকে দিতে হয়েছে, তার কোনো তুলনা নেই। তার ওপর সাইক্লোন, বন্যা, খরা ও মঙ্গার সঙ্গেও তাঁকে যুদ্ধ করতে হয়েছে। তাঁর আমলেই খাদ্যঘাটতির দেশ হয়েছে উদ্বৃত্ত খাদ্যের দেশ। ঢাকা হয়েছে উড়াল সেতুর শহর। বিশ্বব্যাংকের প্রচণ্ড অসহযোগিতা সত্ত্বেও সম্ভব হয়েছে পদ্মা সেতুর নির্মাণ।
পাকিস্তানের টেলিভিশনে সম্প্রতি এক টক শোতে এক পাকিস্তানি অর্থনীতিবিদ বলেছেন, ‘পাকিস্তান যদি শেখ হাসিনার মতো একজন প্রধানমন্ত্রী পেত, তাহলে বহু আগে দেশটির অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যেত।’ কলকাতার একটি দৈনিকে এক কলামিস্ট লিখেছেন (লেখাটি আমার হাতের কাছে নেই), একটি দারিদ্র্যক্লিষ্ট অনুন্নত দেশকে কিভাবে ধীর ও মন্থরগতির গণতন্ত্র দ্বারা দ্রুত উন্নয়নশীল দেশে পরিণত করা যায়, বাংলাদেশের শেখ হাসিনা তার উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন।
শেখ হাসিনা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় আছেন বটে; কিন্তু তা ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, রোগ, কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা, বন্যা, খরা, সাইক্লোন থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য যথেষ্ট সময় নয়। উন্নয়নের কাজে তাঁর দরকার ছিল গঠনমূলক সমালোচনার সঙ্গে বিরোধীদের সহযোগিতা। এই সহযোগিতার বদলে তিনি বিরোধিতা পেলেও ক্ষতি ছিল না। কিন্তু বিএনপি-জামায়াতের কাছ থেকে পেয়েছেন শত্রুতা। এই শত্রুতায় হাত মিলিয়েছে দেশের সুধীসমাজ নামধারী আঁতেল শ্রেণি এবং তাদের পোষা একটি মিডিয়া গ্রুপও।
যে বিরোধিতা, শত্রুতা, মিথ্যা প্রচার ও প্রপাগান্ডার ব্যূহ ভেদ করে, একে একে শক্তিশালী শত্রু দমন করে শেখ হাসিনাকে দেশ পরিচালনা করতে হয়েছে এবং হচ্ছে, তা সম্ভবত রামায়ণের রাবণ বধের কাহিনিকে হার মানায়। শেখ হাসিনার মনস্তুষ্টি বা মোসাহেবির জন্য লিখছি না। এ কথাগুলো লিখছি নিজের বিস্ময়াপ্লুত মনের অভিব্যক্তি প্রকাশের জন্য। আওয়ামী লীগের কোনো দোষত্রুটি নেই, এ কথা বলছি না। আওয়ামী লীগের অনেক দোষত্রুটি আছে। দুর্নীতি, অপশাসন আছে। কিন্তু সব কিছুর ঊর্ধ্বে মহা মহীরুহের মতো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছেন শেখ হাসিনা। গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় তাঁর নেতৃত্ব ও ব্যক্তিত্বের ছায়া পড়েছে। আওয়ামী লীগকে এ কথা বুঝতে হবে। শেখ হাসিনার ক্যারিসমেটিক নেতৃত্বের ছায়া আওয়ামী লীগের মাথার ওপর ছাতার মতো আছে। নইলে গোত্র দ্বন্দ্ব, লোভ, দুর্নীতিতে ভরপুর আওয়ামী লীগের বর্তমানে যে অবস্থা, তাতে তাকেও বিএনপির মতো রাজনৈতিক অগস্ত্য যাত্রায় যেতে হতো।
দলের ২১তম জাতীয় সম্মেলন সামনে নিয়ে আওয়ামী লীগের আত্মশোধনের এটাই শেষ সুযোগ ও সময়। হাসিনা তিন টার্ম ক্ষমতায় থেকে প্রায় গোটা সময়টাই সন্ত্রাস ও স্বাধীনতার শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কাটিয়েছেন। তার বিবরণ ওপরে দিয়েছি। এত দিনে তিনি দুর্নীতির মতো পরম শত্রু নিধনে মনোযোগ দিতে পেরেছেন, সময় দিতে পেরেছেন। স্বাধীনতার শত্রুদের মতো দলের ভেতরের-বাইরের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধেও তিনি কঠোর ও আপসহীন। তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণে দয়াদাক্ষিণ্য দেখাননি।
এই শুদ্ধি অভিযান আইওয়াশ নয়। কেউ কেউ বলছেন, এই অভিযানে বড় বড় রাঘব বোয়ালকে এখনো ধরা হয়নি। তাদের বলি, তিষ্ঠ ক্ষণকাল। বাংলাদেশে জিয়া-এরশাদ-খালেদার কৃপায় কায়েমি স্বার্থের যে ঘাঁটি গড়ে উঠেছে, তার ভিত্তি অত্যন্ত শক্ত। রাতারাতি ভাঙা যাবে না। রাতারাতি ভাঙতে গেলে যিনি ভাঙতে যাবেন, তাঁকেই নিকেশ হতে হবে। ইতিহাস তা-ই বলে। হাসিনা কুশলী যোদ্ধা। কী করে দু-পা এগোনোর জন্য এক পা পেছাতে হয়, সে কৌশল তিনি জানেন। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তিদানের জন্য তিনি কি ধীরগতির কৌশল গ্রহণ করে জয়ী হননি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধেও তাঁর কৌশল হবে ধীরগতির; কিন্তু অব্যর্থ লক্ষ্যে পৌঁছার।
শেখ হাসিনার এই শুদ্ধি অভিযান সফল করার জন্য তাঁর পেছনে একটি সুসংগঠিত, শক্তিশালী এবং দুর্নীতির কলঙ্কমুক্ত আওয়ামী লীগের অবস্থান দরকার। এবারের ২১তম জাতীয় কাউন্সিলের সম্মেলনে সেই আওয়ামী লীগ গড়ার পদক্ষেপ নিয়েছেন শেখ হাসিনা। তিনি অথর্ব, অকর্মণ্য, লোভী, দুর্নীতিবাজ এবং ক্ষমতার অপব্যবহারকারীদের তাড়িয়ে দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে অনেক নতুন মুখ আনতে চান। খবরে সে কথাই বলা হয়েছে। সম্ভাব্য নতুন মুখের মধ্যে আমার পরিচিত বেশ কয়েকজনের নাম দেখে খুশি হয়েছি। এঁদের মতো লোক দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে এলে শেখ হাসিনা দলটাকে নতুনভাবে সাজাতে পারবেন। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে অসাম্প্রদায়িকতার শক্তি বৃদ্ধি করতে হলে বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের শক্তি বৃদ্ধির জন্য সংগঠনটির পুনর্গঠন প্রয়োজন।
তাই বলে দল পুনর্গঠনের নামে পুরনো সব নেতাকে সরিয়ে দিয়ে শুধু নতুন মুখ আনলে দলে অভিজ্ঞ ও কুশলী রাজনীতির অনটন দেখা দেবে। আওয়ামী লীগকে উপদেশ দেওয়ার অধিকার আমার নেই। তবু বলছি, কেন্দ্রীয় কমিটিতে নতুন মুখ নেওয়ার ব্যাপারেও দেখতে হবে তাঁরা সৎ ও নীতিপরায়ণ চরিত্রের অধিকারী কি না। পুরনোদেরও রাখার ব্যাপারে ক্রাইটেরিয়া হওয়া উচিত, তাঁরা এত দিন সৎ রাজনীতি করেছেন এবং নিজের চরিত্র অবিতর্কিত রেখেছেন কি না। ফেরেশতা খোঁজার দরকার নেই। তাহলে ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে। দেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনার নেতৃত্ব এখন সবচেয়ে বড় মূলধন। এই মূলধন রক্ষা এবং জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য আওয়ামী লীগের যে আত্মশোধনের প্রয়োজন, এবারের জাতীয় কাউন্সিলের পর দলটি সে পথেই পদক্ষেপ নেবে বলে আমার আশা।
বিএনপি তাদের নেত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি রাজপথের আন্দোলনে নামার কথা ভাবছে। আইনি লড়াই তারা অবশ্যই চালাতে পারবে। কারণ তাদের অর্থের জোর আছে। কিন্তু রাজপথে আন্দোলন চালাতে গেলে জনসমর্থনের জোর থাকা দরকার। সেটা তাদের আছে কি না তা সম্ভবত আগে যাচাই করে নেওয়া দরকার। নইলে আগের মতো ফিয়াসকো হতে পারে। আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস চালানোর শক্তিও এখন তাদের নেই। হুমকি আর শক্তি প্রদর্শনের মধ্যে পার্থক্য অনেক।
লন্ডন, সোমবার, ৯ ডিসেম্বর ২০১৯
সম্পর্কিত খবর

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান : চাওয়া-পাওয়ার দাগ-খতিয়ান
- তুহিন খান

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রায় এক বছর উপলক্ষে জুলাই ও আগস্ট মাসজুড়ে বেশ বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানসূচি ঘোষিত হয়েছে ইন্টেরিম সরকারের তরফে। কিন্তু এক বছরে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব কতটা মেলানো গেল? জুলাইয়ের সুফল কার ঘরে কতটা উঠল?
গণ-অভ্যুত্থান নিজেই একটি বড় প্রাপ্তি। যে অভ্যুত্থানের ফলে আওয়ামী লীগের মতো একটি নিকৃষ্ট ফ্যাসিস্ট শাসকগোষ্ঠীর পতন হলো, তার চেয়ে বড় প্রাপ্তি এ দেশের জনগণের জীবনে খুব কমই আছে। এই অভ্যুত্থানের আগে-পরে দেশে যে বিপুল জনসচেতনতা ও সৃষ্টিশীল গণক্ষমতার উদ্বোধন আমরা দেখেছি, তরুণদের মধ্যে যে স্বচ্ছ রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ও দেশ গঠনের দৃঢ় প্রত্যয় জন্ম নিতে দেখেছি, তা এককথায় মহাকাব্যিক।
গত বছর ৮ আগস্ট ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার ভারত পলায়নের পরিপ্রেক্ষিতে যে সরকারটি গঠিত হয়, তার ধরনটি ঠিক কী হবে, কী হলে আরো ভালো হতো, এ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা আছে। অন্তর্বর্তী এই সরকারটি গঠিত হয়েছে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করেই; আবার গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের কেউ কেউ এ সরকারের অংশ হয়েছেন।
জুলাইয়ের বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষা, অন্তর্বর্তী সরকারের এই ধরন ও রাজনৈতিক শক্তিগুলোর অবস্থান—এই তিনের টানাপড়েন শেষমেশ যে জাতীয় আকাঙ্ক্ষায় থিতু হয়েছে, তার আলংকারিক নাম : সংস্কার। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আগ থেকেই বেশ কিছু রাজনৈতিক দল ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্ল্যাটফর্মের কারণে ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ ধারণাটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ফলে সেটির প্রায়োগিক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে এবং কিভাবে ও কতটুকু হবে এই সংস্কার—সেটিই প্রধান আলোচ্য বিষয়। বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন হয়েছে দেশে এবং সেসব কমিশন বড় বড় রিপোর্টও তৈরি করেছে।
রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদের স্বাভাবিক ফলাফল হিসেবেই যে সামাজিক ফ্যাসিবাদ ও ধর্মীয় চরমপন্থা সুপ্তাবস্থায় প্রায় এক যুগ ধরে আস্তে আস্তে গাঢ় হয়ে উঠছিল, তা অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে নিঃশেষিত হয়নি, বরং নানা ধরনের সামাজিক ও ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী প্রবণতা নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন শক্তিতে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে পরাজিত ফ্যাসিস্ট শক্তি ও তার দেশি-বিদেশি এজেন্টরা এই প্রবণতাগুলোকে অনেক রংচং মেখে বাস্তবের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বিকট করে উপস্থাপন করার চেষ্টায় রত। জুলাইয়ের শক্তিগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন ও মেরুকরণও এই পরিস্থিতিটিকে বেশ ঘোলাটে করে তুলছে। সে ব্যাপারে সতর্ক থেকেও বলা যায় যে এই ঘটনাগুলো ঘটছে।
‘মব’ শুনলেই অনেকে খেপে যান আজকাল, তার সংগত কারণও আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু সত্য কথা এটিই যে ৫ আগস্টের পর দেশে নানা রকম মব তৈরি হয়েছে। সামাজিক-নৈতিক পুলিশগিরি বাড়ছে। এসবের সঙ্গে জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা বা বিপ্লবী তৎপরতার যোগ সামান্য। ধর্মীয় চরমপন্থাও এই পরিস্থিতিকে একটি সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করছে।
বিপ্লবী ছাত্র-জনতা ও সরকারের কাজ ছিল সমাজে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা এই নতুন প্রতিবিপ্লবী, হঠকারী ও ফ্যাসিস্ট তৎপরতাগুলোরও বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, যেখানে মোটাদাগে স্পষ্টতই তারা ব্যর্থ হয়েছে। এতে সমাজে সরকার ও অভ্যুত্থানের নেতৃত্বের ব্যাপারে যে মাত্রারই হোক, একটি নেতিবাচকতা তৈরি হয়েছে।
৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ের একটি প্রধান জনদাবি ও গুরুতর কাজ ছিল বিচার ও আনুষ্ঠানিক রিকনসিলিয়েশন প্রসেস শুরু করা। কিন্তু এই দাবিটি বিদ্যমান কোনো রাজনৈতিক শক্তিই সততার সঙ্গে সামনে আনতে পেরেছে বলে মনে হয় না। নির্বাচনী রাজনীতির হিসাব-নিকাশ, সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর টানাপড়েন, মামলা বাণিজ্যের পলিটিক্যাল ইকোনমি, ঘোলা পানিতে মাছ শিকারিদের নানা রকম অপতৎপরতা, বিচারহীন পুনর্বাসনের বিবিধ উদ্যোগ আর সরকারের অস্পষ্ট ও গতিহীন নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যে বিচারের দাবিটির বহুলাংশ অপচয় হয়েছে। একটি ফ্যাসিস্ট সরকারকে উত্খাত করার পর অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি জাতীয় অখণ্ডতা রক্ষা ও সামাজিক-রাজনৈতিক রিকনসিলিয়েশন নিশ্চিতে যে ধরনের ব্যাপক, বহুমুখী ও কুশলী প্রাতিষ্ঠানিক তৎপরতা প্রয়োজন ছিল, সরকার সেটি করতে বেশ খানিকটা ব্যর্থই হয়েছে বলা যায়।
অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দলটিকে ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে এক ধরনের কৌতূহল, আকাঙ্ক্ষা ও দরদ তৈরি হয়েছে। তবে এই আকাঙ্ক্ষা নিরঙ্কুশ নয়। নির্বাচনী রাজনীতিতে ঢুকে পড়ায় বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামোর অনেক বিষয়ই আত্তীকৃত করতে হয়েছে দলটির, যা তাদের নানাভাবে বিতর্কিত করেছে। আবার এই দলটির গতি-প্রকৃতি কী হবে, তার কল্পনার বাংলাদেশটি ঠিক কেমন হবে—এসব বিষয়েও নানা ধরনের অনুমান তৈরি হয়েছে। এসব সত্ত্বেও পরিবর্তনকামী বা সংস্কারবাদীরা এখনো এই দলটির ওপর ভরসা রাখতে চাইছেন বলেই মনে হয়।
প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির এই হিসাব চলবে। কিন্তু জুলাইয়ে ঘটে যাওয়া মহাকাব্যিক অভ্যুত্থানটি আমাদের জাতীয় জীবনে যে বিপুল পরিবর্তনের সম্ভাবনা হাজির করেছে, তা অসামান্য। আমরা এর কতটা কাজে লাগাতে পারব, তা এখনো অনিশ্চিত। তবে বাংলাদেশ যত দিন থাকবে, তত দিন মুক্তির এই অসামান্য সম্ভাবনা এ দেশের মানুষকে অনুপ্রাণিত করে যাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক : কবি, অনুবাদক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করা প্রয়োজন
- ড. নিয়াজ আহম্মেদ

করোনার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমে যে ছেদ তৈরি হয়েছিল, তা এখনো আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এ ছাড়া গত বছরের গণ-আন্দোলনে তিন-চার মাস আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। বিশ্ব্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত আমাদের এইচএসসি নামক পাবলিক পরীক্ষা। কোনো কারণে এইচএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে গেলে আমাদের ভর্তি কার্যক্রমও পিছিয়ে যায়।
আমরা যদি জানুয়ারি মাসে এসএসসি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে এইচএসসি পরীক্ষা নিতে পারি, তাহলে জুলাই মাসে উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা যাবে।
উচ্চশিক্ষা যেহেতু বহু রকমের, সেহেতু এখানেও অনেক বিষয় রয়েছে। মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার বিষয়টি সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ দ্বারা পরিচালিত হয়। তাই তারা বেশ দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারে। সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যদি একটি পরীক্ষায় ভর্তি নিতে পারত, তাহলেও সময় বাঁচত। কিন্তু তা সম্ভব হয়ে উঠছে না। আমাদের মানে শিক্ষকদের এখানে করণীয় রয়েছে। এইচএসসি পরীক্ষা শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে ভাবতে হবে। আমরা প্রতিবছর একই পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা এবং এর কার্যক্রম সম্পন্ন করি। ফলে দ্রুত কার্যক্রম শুরু করতে সমস্যা নেই। ফলাফল প্রকাশের এক সপ্তাহের মধ্যে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, এক মাসের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা এবং সর্বোচ্চ তিন মাসের মধ্যে পুরো ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করা সম্ভব।
আমাদের কাছে মনে হয়, সরকারের আন্তরিকতা এবং শিক্ষকদের সহযোগিতা এখানে মুখ্য বিষয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, কতটা সহজে এবং দ্রুত আমরা আমাদের ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারি। আমাদের টার্গেট যদি থাকে জানুয়ারি মাসের প্রথম দিন ক্লাস শুরু করা, তাহলে টার্গেট অনুযায়ী কাজটি করতে হবে। একদিকে শিক্ষার্থীরা পাবলিক পরীক্ষা দেবে, অন্যদিকে আমরা ভর্তি পরীক্ষার কার্যক্রম শুরু করব। সরকার যদি পাবলিক পরীক্ষা আগে এবং দ্রুত সম্পন্ন করতে পারে, তাহলে আমরাও দ্রুত ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারব। ধরুন, এখন এইচএসসি পরীক্ষা চলছে। আশা করা যায়, সেপ্টেম্বরে ফলাফল প্রকাশিত হবে। আমরা অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা শেষ করতে পারি। তিন মাসে কি ভর্তি পরীক্ষার যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করা যথেষ্ট নয়? আমাদের দরকার সরকারের ইচ্ছা এবং সবচেয়ে বড় দরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়, শিক্ষকদের মধ্যে সহযোগিতা ও আন্তরিকতা। আমরা আশা করব, আগামী শিক্ষাবর্ষে যেন জানুয়ারি মাসেই শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয়।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
nahmed1973@gmail.com

কজন জানে জুলাই সনদ কী
- গাজীউল হাসান খান

সমাজ ও বৃহত্তরভাবে রাষ্ট্র মেরামত কিংবা পরিবর্তনের জন্য যেসব কাঙ্ক্ষিত বা আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়, মূলত সেগুলোকেই সংস্কার বা ‘রিফর্ম’ বলা হয়। দেশের সংবিধান থেকে শুরু করে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নাগরিকরা কিংবা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সেসব সংস্কারের উদ্যোগ নিতে পারেন। তবে শেষ পর্যন্ত জাতীয় কিংবা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সেসব সংস্কার প্রস্তাবকে কার্যকর করতে হলে একটি আইনানুগ ভিত্তি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। বাংলাদেশে চব্বিশ সালের গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর সময়ে অতীত স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী শাসন এবং আর্থ-সামাজিক শোষণ-বঞ্চনার অবসানের জন্য দল-মত-নির্বিশেষে সবাই রাষ্ট্র মেরামতের একটি জোরালো দাবি উত্থাপন করেছে।
এ কথা ঠিক যে বিগত জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান কোনো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ছিল না। তবু সেটি আমাদের বিগত ৫৩ বছরের স্বাধীনতা-উত্তর আন্দোলনের ইতিহাসে একটি বিরাট মাইলফলক। স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী শাসন-শোষণের কবল থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে একটি বিশাল পদক্ষেপ। সুতরাং কোনো বিবেচনায়ই সে অভ্যুত্থানকে খাটো করে দেখা যাবে না।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান অধ্যাপক ড. ইউনূসসহ আমাদের রাজনৈতিক মহলের অনেকেই এরই মধ্যে গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। এতে তাঁদের অনেকের মধ্যেই বিগত ১১ মাসে ঘটে যাওয়া অনেক ব্যর্থতার চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে অনেকে দায়ী করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতা ও অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে সমন্বয়ের অভাবকে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সাবেক নেতারা এরই মধ্যে বহুবার অভিযোগ করেছেন যে অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে সময়োচিতভাবে একটি ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণার অভাবে রাজনৈতিক মহলে এখনো অনেক বিভ্রান্তি এবং ভবিষ্যৎ দিকদর্শনের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। ফলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই তাদের নিজ নিজ দলের পতাকাতলে অবস্থান নিয়েছে। ভুলে গেছে সেই মহান গণ-অভ্যুত্থানের জাতীয় প্রেক্ষাপটটি। রাজনৈতিক ঐক্য কিংবা রাজনৈতিক কর্মসূচিগত সমন্বয়ের বিষয়টি। ফলে চারদিকে মাথা তোলার অবকাশ বা সুযোগ পেয়েছে পতিত আওয়ামী সরকারের দোসর কিংবা বশংবদরা। সে পরিস্থিতিতে ড. ইউনূস হতাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘আমাদের একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বিফলে যেতে বসেছে। আমরা মুখে বলছি, সাবেক ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রতিনিধিরা এখনো সর্বত্র বসে রয়েছে। আমরা তাদের সরাতে পারিনি। আমরা তাদের স্বভাব-চরিত্র বদলাতে পারিনি।’ এ অবস্থায় অনতিবিলম্বে সর্বক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে না পারলে এবং সব জায়গায় কাঙ্ক্ষিত সংস্কার কিংবা পরিবর্তন সাধন করতে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতে ক্ষমতার রাজনীতিতে কোনো নির্বাচিত সরকারই স্থিতিশীল হতে পারবে না। এতে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন, উন্নয়ন কিংবা সমৃদ্ধি আশা করা হয়েছিল, তা বিফলে যেতে বাধ্য হবে। এখানেই অতীতে সংঘটিত সব গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের মৌলিক এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিগত কিছু পার্থক্য ছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারটি ছিল গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী একটি ভিন্নধর্মী রাজনৈতিক উদ্যোগের ফসল, কিন্তু তাতে অন্য অনেক কিছু থাকলেও ছিল না রাজনৈতিক দূরদর্শিতা।
ফরাসি বিপ্লব রাশিয়ায় সংঘটিত সমাজতান্ত্রিক (বলশেভিক) বিপ্লবের মতো ছিল না। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রায় শেষ দশকে (১৭৮৯-১৭৯৯) ফ্রান্সে সংঘটিত সে বিপ্লব ছিল একটি ‘দশক স্থায়ী সামাজিক-রাজনৈতিক অভ্যুত্থান’। ফ্রান্সের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের উল্লেখযোগ্য সময়। সে অভ্যুত্থানের শুরুতেই অর্থাৎ ১৭৮৯ সালে তার নেতারা ফ্রান্সের নাগরিক কিংবা মানুষের অধিকার নিয়ে ফ্রেঞ্চ চার্টার নামে একটি সনদ ঘোষণা করেন। সে সনদই ফরাসি বিপ্লবের মৌলিক চরিত্র বা বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরে। তাদের মুক্তি, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের নীতি প্রকাশ করে। এর পাশাপাশি মানুষের মৌলিক অধিকার ও দায়দায়িত্বের পথনির্দেশ প্রদান করে। সেদিক থেকে পর্যালোচনা করলে বাংলাদেশে সংঘটিত জুলাই-আগস্টের বিপ্লবও ছিল মূলত একটি গণ-অভ্যুত্থান। কিন্তু সে সফল অভ্যুত্থানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতাদের কী প্রত্যাশা ছিল, সেগুলো তাঁরা একটি সনদ আকারে নিজেরা প্রকাশ করেননি। তাঁরা অপেক্ষা করেছেন এই দায়িত্বটি সম্পন্ন করার ব্যাপারে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য, যাদের সঙ্গে সে গণ-অভ্যুত্থান কিংবা রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। সে কারণেই জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান সম্পর্কিত ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণা কিংবা নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়টি অনিশ্চিতভাবে ঝুলে রয়েছে। জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের কোনো কিছু উদযাপনের ক্ষেত্রেই কোনো গুরুত্ব দেখা যাচ্ছে না। এ রকম একটি রাজনীতিগত দোদুল্যমান অবস্থায় কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান আমাদের জীবনে কী পরিবর্তন এনেছে? যদি কোনো পরিবর্তন না-ই হয়ে থাকে, তাহলে দেশে ফ্যাসিবাদের পতন বা তাদের উত্খাত করা হলো কিভাবে? কেন এত বিশাল গণ-আন্দোলন ও সাধারণ মানুষের এত আত্মত্যাগ? অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান বলেছেন, ‘অতীতের অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী কিংবা ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন বদলাতে আমরা রাষ্ট্র মেরামতসহ সর্বত্র সংস্কার সাধনের যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছি, সেগুলো আমাদের প্রস্তাবিত জুলাই সনদে স্থান পেতে হবে।’ দল-মত-নির্বিশেষে জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে প্রস্তাবিত ঘোষণাগুলো বাস্তবায়িত করতে হবে। কিন্তু কী সে প্রস্তাবিত ঘোষণা, তা এখনো জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেক দলই জানে না। বিএনপিসহ বিভিন্ন দেশপ্রেমিক দলের নেতাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কোনো আলোচনায়ই এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বসা হয়নি। কারা কারা হবেন এই প্রস্তাবিত সনদে স্বাক্ষরকারী? এ পর্যন্ত তারও কোনো হদিস নেই। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং দেশি-বিদেশি আধিপত্যকে প্রতিরোধ করে আমরা কিভাবে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করব—প্রস্তাবিত সনদে আমরা সে ব্যাপারে সবার সম্মিলিত প্রতিশ্রুতি চাই।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
gaziulhkhan@gmail.com

বাবনপুরে জেগে আছেন শহীদ আবু সাঈদ
- ড. মো. ফখরুল ইসলাম

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে জুলাই ২০২৪ মাসটি এক অনন্য মর্যাদার দাবিদার। এই মাসে বারবার রক্ত ঝরেছে, শিক্ষার্থী-শ্রমিক-জনতার আহ্বানে কেঁপে উঠেছে শাসকের প্রাসাদ। সেই উত্তাল জুলাইয়ের সূচনা ঘটেছিল রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) মাটি রঞ্জিত করে আবু সাঈদ নামের এক শিক্ষার্থীর রক্তে। পীরগঞ্জের বাবনপুর নামক গ্রামে একটি বাঁশের বেড়া দেওয়া কবরে তিনি শুয়ে আছেন নীরবে, নিঃশব্দে।
রংপুরে শিক্ষার বাতিঘর হয়ে উঠেছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের অব্যবস্থাপনা, নিয়োগ বাণিজ্য, রাজনৈতিক দখল ও অবমূল্যায়নের কারণে নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বারবার পরিণত হয়েছে ক্ষোভের আগ্নেয়গিরিতে।
জুলাই বিপ্লব তাই কেবল রংপুরের বা বেরোবির নয়।
এই শহীদ যেন আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, বাংলাদেশে ছাত্ররাই বারবার যুগ পরিবর্তনের সূচনা করেন। হোক তা ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার সংগ্রাম কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী লড়াই। আমরা চাই, এই শহীদের রক্ত বৃথা না যাক।
জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদের স্মরণে রাষ্ট্র কি আরো একটু নত হবে, নাকি আবারও চলবে এড়িয়ে যাওয়ার নীলনকশা? যদি তা-ই হয়, তবে আগামী দিনগুলো আরো অস্থির, আরো উত্তাল হবে।
‘যেখানে বাধাগ্রস্ত হবে, সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে’—এই চেতনা দেরিতে এলো কেন? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে রাষ্ট্রযন্ত্রের চেহারার ভেতরে, যা দিন দিন হয়ে উঠছে আরো দুর্বিনীত, অসহনশীল ও জনবিচ্ছিন্ন। যখন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা পাস করার পর চাকরির জন্য ঘুরে বেড়ান, তাঁদের দাবি উপেক্ষা করে, বিরোধিতা করে, এমনকি দমন করতে গিয়েই সরকার তার আসল চেহারা উন্মোচন করে। ঠিক এখানেই জুলাই এসে দাঁড়িয়েছিল প্রতিবাদের ভাষা হয়ে। এটি কেবল একটি মাস নয়, এটি একটি ধারণা, একটি রাজনৈতিক চেতনা, একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার নাম, যা শেখায় জুলুমের বিরুদ্ধে চুপ থাকা মানেই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া। তাই যখনই কোথাও প্রতিবাদ বাধাগ্রস্ত হবে, যখনই মত প্রকাশের অধিকার পদদলিত হবে, তখনই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে প্রতিরোধের এক ছায়াছবির মতো।
বাবনপুরে শায়িত জুলাই বিপ্লবের প্রথম শহীদ, তাঁর জীবন দিয়ে আমাদের আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, প্রতিবাদের মুখ বন্ধ করে রাখা যায় না। তাই তাঁর মৃত্যু আর দশটি মৃত্যুর মতো নয়, বরং এটি এক বিস্মৃত সময়কে জাগিয়ে তোলার মুহূর্ত, যেখানে জুলাই আবার ফিরে এসেছে জনতার পাশে দাঁড়াতে।
এখন বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনে, কর্মক্ষেত্রে, সংবাদমাধ্যমে, এমনকি সংসদের ভেতরেও যদি অন্যায় চাপিয়ে দেওয়া হয়, তবে সেখানেই জুলাইকে তুলে ধরতে হবে। কারণ এই মাস শেখায় শুধু স্মৃতিচারণা নয়, স্মৃতি দিয়ে বাস্তব পরিবর্তনের দাবিও তোলা যায়।
তাই আমাদের দায়িত্ব এই শহীদের মৃত্যু যেন অন্ধকারে হারিয়ে না যায়। রাষ্ট্র যদি কখনো ন্যায়ের পথ ছেড়ে নিপীড়নের দিকে হাঁটে, তাহলে প্রতিটি গ্রামে বাবনপুরের মতো একেকটি জুলাই জন্ম নিতে পারে।
এমন সময় হয়তো আবারও প্রশ্ন উঠবে, জুলাই-জুলাই বলে এত মাতামাতি কেন? আমরা তখন উত্তর দেব, এর কারণ আমাদের প্রতিবাদের জায়গাগুলো একে একে নিঃশব্দ হয়ে যাচ্ছে। আর যেখানে হাতে মুষ্টি তুলে পথে নেমে সমস্বরে চিৎকার করা নিষিদ্ধ, সেখানে জুলাই-ই হয়ে উঠতে পারে একমাত্র ভাষা।
শহীদ আবু সাঈদের মৃত্যু কেবল একটি গুলি বা একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল না। এটি একটি সাবধানবাণীও ছিল। বেরোবির পার্কের মোড়ের অদূরে যা ঘটেছিল, তা ছিল আসলে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। যেখানে কথা বলা মানেই অপরাধ, দাবি জানানো মানেই রাষ্ট্রদ্রোহ মনে করা হয়েছিল।
সেদিন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা যখন শান্তিপূর্ণভাবে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন রাষ্ট্র কী করেছিল? তারা কেন সেদিন তাঁদের দিকে বন্দুক তাক করল? সেদিন যে তরুণ শহীদ হলেন, তিনি যেন গোটা বাংলাদেশের হয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন, তৎকালীন ক্ষমতাধরদের কাছে তা অনুধাবন করা কি খুব জটিল বিষয় ছিল?
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রতিবাদের ঐতিহ্য খুব গর্বের। ভাষা আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন—সবখানেই ছাত্রসমাজ পথ দেখিয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালে এসেও ছাত্রসমাজের কণ্ঠ রোধ করতে গুলি ব্যবহার করতে হয়, এটি কি রাষ্ট্রের দুর্বলতা নয়? আগামী দিনে আমরা এ ধরনের আর কোনো রাষ্ট্রীয় দুর্বলতা ও ভয় দেখতে চাই না।
জুলাই বিপ্লবের এই প্রথম শহীদ শব্দটি যেন আমাদের সবার কাঁধে নতুন দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়। এর মানে, আরো অনেক শহীদ আসতে পারেন, যদি রাষ্ট্র তার দমননীতি থেকে ফিরে না আসে। যদি কথা বলার জায়গা, ভিন্নমতের জায়গা একে একে নিঃশব্দ হয়ে যায়, তাহলে শেষ ভরসা হয় রক্ত। বেরোবির ইংরেজি পড়ুয়া অকুতোভয় ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের তাক করা বন্দুকের নলের সামনে বুক উঁচিয়ে গুলি খেতে দ্বিধাহীন না থাকলে আজ কী করতাম আমরা, তা কি কেউ ভেবে দেখেছেন?
জন্ম নিলেই সবাইকে একদিন না একদিন নির্বাক হতে হয়। কিন্তু সবার কথা কি সব মানুষের অনন্তকালব্যাপী মনে থাকে? শহীদ আবু সাঈদ বাবনপুরে শুয়ে আমাদের শিখিয়ে দিচ্ছেন, দেশের যেকোনো প্রয়োজনে যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্বাক থাকার দিন শেষ।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন
fakrul@ru.ac.bd