এবার ভোলায় রটনা-ঘটনার পুনরাবৃত্তি। অকুস্থল ভোলা। যে ভোলায় ভারতে বাবরি মসজিদ ধ্বংস উপলক্ষে নিরপরাধ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা চালিয়ে দুর্বৃত্তপনার উদাহরণ সৃষ্টি করা হয়েছিল।
দুই.
ফেসবুক অত্যাধুনিক প্রযুক্তির প্রকাশ ঘটিয়ে যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক অগ্রগতির পরিবেশ তৈরি করে— বিনোদনে, ব্যক্তিগত সম্প্রচারে, কখনো যুক্তিসংগত প্রতিবাদে, সেই ফেসবুককে কেন্দ্র করে অঘটন ঘটায় পরিকল্পিতভাবে দুর্বৃত্তজন। ঘটনা এর আগে একাধিক।
এবারও ভোলায় তেমন ঘটনারই অবাঞ্ছিত পুনরাবৃত্তি। ধর্ম মানুষের ব্যক্তি ও সামাজিক তথা সমষ্টিগত জীবনে একটি স্পর্শকাতর বিষয়। কথিত ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার মতো বক্তব্য বা পঙিক্তমালা তথা পোস্ট অবাঞ্ছিত রক্তঝরা ঘটনারও জন্মদাতা। তা মূলত ষড়যন্ত্রমূলক।
উদ্দেশ্য সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি, বিদ্বেষ-বিরূপতা ও সংঘাত সৃষ্টি—যাতে সামাজিক শান্তি নষ্ট হয়। ফেসবুক অশান্তির আরেকটি নেতিবাচক দিক হলো যে কেউ উদ্দেশ্যমূলকভাবে অন্যের ফেসবুক আইডিকে বিভ্রান্তমূলক পোস্টের মাধ্যমে ব্যক্তি বিশেষকে ফাঁসিয়ে নিজের অপরাধপ্রবণ উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে পারে। অতীতে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে এবং নিরীহ নিরপরাধ ব্যক্তি শাস্তি পেয়েছে।
ফেসবুক প্রযুক্তির দুর্বলতা তথা হ্যাকিং নিয়ে দুর্বোধ্য কারণে আইন-শৃঙ্খলা বা নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কমই মাথা ঘামায়। ফলে সুবিচার ‘দূর-অস্ত্’ হয়ে দাঁড়ায়। ভোলার ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, বিপ্লবচন্দ্র শুভ নামে এক ব্যক্তির ফেসবুকে ধর্মীয় অবমাননামূলক বক্তব্য পোস্ট করার অভিযোগে তুলকালাম কাণ্ড।
অথচ বিষয়টি লক্ষ করে বিপ্লব থানায় গিয়ে তার ফেসবুক হ্যাক করা হয়েছে বলে জানায়। এবং এ কথাও বলে যে এটা উদ্দেশ্যমূলকভাবে করা হয়েছে তাকে ফাঁসানোর জন্য এবং তার কাছে চাঁদা দাবি করা হয়েছে। এ অভিযোগ এনে থানায় জিডি করে বিপ্লব। কিন্তু পুলিশ যে কারণেই হোক বিপ্লবের বক্তব্যে গুরুত্ব না দিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করে।
কিন্তু ঘটনা যে উদ্দেশ্যমূলক—‘রটনা ঘটনা কারবার’, তার প্রমাণ পুলিশের ব্যবস্থা গ্রহণ (ন্যায়-অন্যায় যা-ই হোক) সত্ত্বেও ষড়যন্ত্রকারীরা ঠিকই মাঠে নেমে পড়ে। বিনা অনুমতিতে সভা করে উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান করে, বাধায় হাঙ্গামা, ধর্মান্ধজনতা চালায় যথারীতি প্রথাসিদ্ধ সাম্প্রদায়িক হামলা। সমাজে সাম্প্রদায়িক শান্তি বিঘ্নিত করা হয়, যার প্রভাব পড়তে পারে দেশের বাইরে। নষ্ট হতে পারে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি।
তিন.
স্বভাবতই চিন্তিত প্রশাসন। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, ‘ভোলায় বোরহানউদ্দিনের সংঘর্ষের ভিডিও ফুটেজে কিছু চেনা মুখের ছবি এসেছে। সেটা ভালো করে দেখা হচ্ছে। ভিডিও ফুটেজ থেকে কিছু তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। তদন্ত শেষ হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘যত দ্রুত সম্ভব তদন্তের কাজ সম্পন্ন করে এ ঘটনায় কোনো ষড়যন্ত্র এবং এখানে সাম্প্রদায়িক শক্তির কোনো দুরভিসন্ধি আছে কি না, সব কিছু খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’ লক্ষ করার বিষয় যে এবার ক্ষমতাসীন দল বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করছে এবং যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রত্যয়ও প্রকাশ করছে। আমরা আশা করছি, তারা তাদের প্রতিশ্রুতিমাফিক তৎপরতার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়বে না, হবে না পক্ষপাতদুষ্ট বিরোধী দলকে ফাঁসানোর চেষ্টায়।
গোটা ঘটনার অন্য পিঠও রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। যদি ধরে নেওয়া হয়, চাঁদাবাজির উদ্দেশ্যে বিপ্লবকে ফাঁসানো হয়েছে এবং মিথ্যা স্ট্যাটাসে একজন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যকে ফাঁসিয়ে দিয়ে গোটা সম্প্রদায়কে স্থানীয়ভাবে হামলার মুখোমুখি করে দেওয়া হয়েছে, তাহলে প্রশ্ন থাকে, হরহামেশা এ ধরনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ওখানকার রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা তাঁদের সামাজিক-রাজনৈতিক দায়িত্ব পালনে এগিয়ে এসেছিলেন কি না।
তাঁরা ক্ষুব্ধ ইসলামী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করতে পারতেন। বলতে পারতেন যুক্তিসহকারে যে সরকার প্রকৃত অপরাধীকে শনাক্ত করা এবং বিচার ও শাস্তির ব্যবস্থা নিচ্ছে। এ কাজটি তাঁরা করেননি। এবং তা না করে জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাঁদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন।
এর আরো একটি দিক হলো, রাজনীতিতে ঘটনার ঘোলাজলে মাছ শিকার গতানুগতিক বিষয় এবং তা কারো অজানা নয়। এ কারণে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাদের সতর্ক হওয়া ও সমঝোতার ব্যবস্থাদি গ্রহণের প্রয়োজন ছিল। একটি দৈনিকে প্রকাশিত শিরোনাম ‘ভোলায় হামলাকারী কারা’? তাদের প্রতিবেদন যদি সত্য হয়, তাহলে বলতে হয় দলীয় স্বার্থ ভেবে সামাজিক শান্তি নষ্ট করা মহা অন্যায় এবং তাতে দলীয় স্বার্থে ইতিবাচক কিছু মেলে না। যা মেলে তা পুরোটাই নেতিবাচক।
অন্য একটি দৈনিকের শিরোনাম : ‘ফেসবুকের সেই হ্যাকার শনাক্ত’। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, দ্রুতই তাকে গ্রেপ্তার করা হবে। বলা বাহুল্য, ঘটনার নিষ্পত্তিতে এটাই এখন প্রশাসনের প্রধান কাজ। তাতে নিরীহ বিপ্লব মুক্তি পাবে। আর উচ্ছৃঙ্খল ঘটনা সৃষ্টির কুশীলবদের শাস্তি হবে। কিন্তু যারা ঘটনার রহস্য ভেদ পর্যন্ত অপেক্ষা না করে সমাবেশ ডেকে উচ্ছৃঙ্খলতার সলতেয় আগুন ধরানোর কাজে সহায়ক হয়েছিলেন, তাঁরা কি অপরাধীভুক্ত হওয়ার বাইরে থেকে যাবেন? গোটা ঘটনায় তাঁদেরও তো দায় রয়েছে।
যে যেমন রাজনীতিই করুন না কেন, সামাজিক শান্তি রক্ষার ক্ষেত্রে তাঁদের দায়বদ্ধতা রয়েছে। রাজনীতির নৈতিকতার বিধানে এটা যুক্তিসংগত সত্য। এ সত্যের বরখেলাপ ন্যায়সংগত নয়। আমাদের সমাজ ও রাজনীতি এজাতীয় কিছু মৌল সত্যের বিধান মেনে চলে না, এটাই দুঃখজনক, দুর্ভাগ্যজনক। এর ফলে নির্দোষ কিছু মানুষের জান-মালের ক্ষতি হয়, প্রাণনাশের ঘটনাও ঘটে।
আমরা চাই, অবিলম্বে প্রশাসন সর্বশক্তি প্রয়োগে সেই অপরাধীকে বিচারের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা নিক। ব্যবস্থা নিক সংশ্লিষ্ট অন্যদেরও। বারবার ফেসবুক মারফত অনর্থ ঘটানো হবে—এটা মানা যায় না। এ ব্যাপারে প্রশাসনকে সমদর্শী হতে হবে।
লেখক : কবি, গবেষক, ভাষা সংগ্রামী