<p> সম্প্রতি বিয়ের বয়স কমানো নিয়ে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে সে বিষয়টির গভীরে যাওয়া দরকার। কেননা বাল্যবিয়ের কুফলজনিত সমস্যার চরিত্রটি গভীরভাবে সামাজিক, শুধুই চিকিৎসাসংক্রান্ত বা স্বাস্থ্যগত নয়। তবে কেন বাল্যবিয়ে উচিত নয়, এর কারণগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণটি হলো স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি। অর্থাৎ কম বয়সে বিয়ে মানেই কম বয়সে সন্তান জন্মদান এবং এর পুরো স্বাস্থ্যহানিকর ও মানসিক আঘাতজনিত প্রভাব পড়ে মেয়েটির ওপর। তবে এর সঙ্গে স্বাস্থ্যগত উপাদান ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক উপাদানও জড়িত রয়েছে।</p> <p> ছেলে ও মেয়ের বিয়ের বয়স সুনির্দিষ্ট করে দিয়ে বাংলাদেশে প্রথম আইন প্রণীত হয় আজ থেকে প্রায় ৮৫ বছর আগে। ১৯২৯ সালে প্রণীত এই আইনের নাম 'বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন'। এই আইনে মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স নির্ধারণ করা হয় ১৪ বছর ও ছেলেদের ১৮ বছর। ১৯৮৪ সালে এই আইনে পরিবর্তন এনে বিয়ের ন্যূনতম বয়স নির্ধারণ করা হয় মেয়েদের জন্য ১৮ বছর ও ছেলেদের জন্য ২১ বছর।</p> <p> মেয়েদের কম বয়সে বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা আমাদের সমাজ-মানসের গভীরে প্রোথিত রয়েছে। ফলে অনেকে গোপনে বা কাজির কাছে বয়স লুকিয়ে হলেও মেয়ের বিয়ে দিচ্ছেন। ফলে যে আইন অনুযায়ী বিয়েটি বেআইনি হচ্ছে; কিন্তু সেই একই আইন অনুযায়ী আবার বিয়েটি অবৈধ বা বাতিলযোগ্য হচ্ছে না। কেননা আইনে বলা আছে যে বিয়ের ক্ষেত্রে বয়সের ন্যূনতম সীমা যদি কোনো পক্ষ লঙ্ঘন করে সে জন্য তাদের শাস্তি হবে। কেননা তারা একটি বেআইনি কাজ করেছে। কিন্তু তাই বলে তাদের বিয়েটি বাতিল হয়ে যাবে না। এটাই বর্তমান আইনের বিধান।</p> <p> পত্রিকান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদন মতে, সরকার মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৬ বছর করার চিন্তাভাবনা করছে। বয়স পরিবর্তনের এই উদ্যোগ সরকারের বাল্যবিয়ে কমিয়ে আনার লক্ষ্যের বিপরীতে কাজ করবে। ২০১৪ সালের জুলাইয়ে লন্ডনে অনুষ্ঠিত গার্ল সামিটে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে বাল্যবিয়ে পর্যায়ক্রমে কমিয়ে এনে একেবারে বন্ধ করার অঙ্গীকার করেন। সেখানে তিনি ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে বন্ধ করার অঙ্গীকার করেন। তিনি ২০১৫ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে রোধে একটি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা তৈরির প্রতিশ্রুতি দেন।</p> <p> মেয়েদের বিয়ে করার ন্যূনতম বয়স ১৬ বছর নির্ধারণ করলে তা হবে একটি মারাত্মক রকমের ভুল সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের হার এমনিতেই অনেক বেশি। নতুন আইনটিতে ছেলেমেয়ে উভয়ের জন্য বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ বছর ধার্য করা উচিত এবং খেয়াল রাখা উচিত, যাতে শিশুদের স্বার্থ আইনের সব বিধানের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে।</p> <p> জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীতে নাইজেরিয়ার পরে বাল্যবিয়ে সবচেয়ে বেশি হয় বাংলাদেশে। ২০ থেকে ৪৯ বছর বয়সী বাংলাদেশি নারীদের মধ্যে ৭৪ শতাংশেরই বিয়ে হয়েছে ১৮ বছর বয়সের আগেই, যদিও নারীদের বিয়ের ন্যূনতম বৈধ বয়স হচ্ছে ১৮ বছর। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আইনে নারীর বিয়ের ন্যূনতম বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮ বছর। শিশু অধিকারসংক্রান্ত কনভেনশনে (যা বাংলাদেশ অনুমোদন করে ১৯৯০ সালে) শিশুর সংজ্ঞায় বলা আছে যে ১৮ বছর বয়সের নিচে সব ব্যক্তি শিশু হিসেবে বিবেচিত হবে।</p> <p> নারী ও পুরুষ উভয়ের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ বছর করার সঙ্গে সঙ্গে 'বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন' (চাইল্ড ম্যারেজ রেস্ট্রেইন্ট অ্যাক্ট) যুগোপযোগী করতে আরো কিছু স্থানে সংশোধনের প্রয়োজন আছে। আইন সংশোধনকালে যে বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখতে হবে :</p> <p> <strong>১. প্রতিরোধ ও সহযোগিতার সুযোগ বৃদ্ধি</strong> <strong>:</strong> আইনটিতে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সামাজিক সহযোগিতা ও সমর্থন বৃদ্ধির সুযোগ থাকা প্রয়োজন। সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির পরিকল্পনা, বাধ্যতামূলক সর্বজনীন জন্মনিবন্ধন, সর্বজনীন বিবাহ নিবন্ধনের প্রক্রিয়া তৈরি ও তা বাস্তবায়ন, শিক্ষা লাভের পথ প্রশস্ত ও মেয়েদের শিক্ষাক্ষেত্রে ধরে রাখার বিধান রাখতে হবে। বাল্যবিয়ের শিকার শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য আইনি ও সামাজিক সহায়তার ব্যবস্থা রাখতে হবে। ক্রিমিনাল জাস্টিস ও স্থানীয় সরকারের কর্মকর্তাদের বাল্যবিয়ে, তা প্রতিরোধ এবং আইন ভঙ্গ হলে কী করতে হবে সে-সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ পেতে হবে।</p> <p> <strong>২. আক্রান্ত ব্যক্তিদের বিভিন্ন আইনি বিকল্প দিতে হবে</strong> <strong>:</strong> বাংলাদেশে প্রচলিত বিয়ে, বিয়েবিচ্ছেদ-বিষয়ক আইন নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক। এ ধরনের আইনকে এমনভাবে সংশোধন করতে হবে, যাতে নারীর সমতা নিশ্চিত হয় এবং তা নির্যাতনকারী স্বামীর হাত থেকে তাদের রক্ষা করে। যারা বাল্যবিয়ে করেছে বা করতে বাধ্য হয়েছে তাদের কেউ যদি এই বিয়ে থেকে মুক্তি পেতে চায়, তাদের আইনি বিচ্ছেদ, বিয়ে রদ, বিয়েবিচ্ছেদ, সন্তানের হেফাজত, ভরণপোষণ বৈবাহিক সম্পত্তি ভাগ-বণ্টন এবং শিশুদের সহায়তার সঙ্গে জড়িত সব আইনি বিষয় সম্পর্কে জানতে হবে। তা ছাড়া তাদের আর্থিক ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞ সামাজিক সহায়তার বিষয়গুলো সংশোধিত আইনে সন্নিবেশিত করা দরকার।</p> <p> <strong>৩. অভিযোগ দায়ের করার প্রক্রিয়া সহজতর করা</strong> <strong>:</strong> সংশোধিত আইনে তেমন বিধান রাখা, যাতে যেকোনো ব্যক্তি অর্থ প্রদান না করে বা অন্য কোনো বাধার সম্মুখীন না হয়েই বাল্যবিয়ে-সংক্রান্ত অভিযোগ দাখিল করতে পারে। আইনে এমন বিধান রাখা দরকার, যাতে পুলিশ বা ফৌজদারি আদালতে অভিযোগ দায়েরের পর সঙ্গে সঙ্গে একটি তদন্ত প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়।</p> <p> <strong>৪. আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা করা</strong> <strong>:</strong> এ আইনটি সংশোধনকালে সরকারকে খেয়াল রাখতে হবে, যাতে পরিবর্তিত আইনে নিয়মানুযায়ী দায়ী ব্যক্তিদের (যেমন বিয়েপ্রক্রিয়া পরিচালনা ও নিবন্ধন করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) জবাবদিহির আওতায় এনে বাল্যবিয়ে বন্ধ করা যায়। নতুন আইনে কঠোর বিধান রাখা, যাতে উল্লিখিত দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের কার্যক্রম পর্যালোচনা করা যায় এবং তাঁরা যদি ইচ্ছাকৃত বা দুর্নীতির মাধ্যমে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ না করে থাকেন, তাহলে তাঁদের শাস্তি দেওয়া যায়।</p> <p> <strong>৫. আইনকে কার্যকরভাবে প্রয়োগ এবং তা বাস্তবায়নের জন্য পরিকল্পনা করা</strong> <strong>:</strong> প্রচলিত আইনে নিষিদ্ধ হওয়ার পরও বাল্যবিয়ে সমাজে চালু রয়েছে যতটা না পুরনো আইনের কারণে, তার চেয়ে বেশি প্রয়োগের অভাবে। ২০৪১ সালের মধ্যে সরকারের বাল্যবিয়ে বন্ধ করার লক্ষ্যকে সমর্থন করতে হলে নতুন আইনটিকে সম্পূর্ণভাবে প্রয়োগ করতে হবে। নতুন আইন তৈরির সময় সরকারের পর্যালোচনা করতে হবে, কোন কোন বাধার কারণে বর্তমান আইনের সঠিক প্রয়োগ ঘটেনি। বাধাগুলোর মধ্যে রয়েছে-আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের আইনটিকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ না করা, ত্রুটিপূর্ণ জন্ম এবং বিয়েনিবন্ধন-প্রক্রিয়া, জন্ম ও বিয়েনিবন্ধনের বিধান অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়া, বাল্যবিয়ে সংঘটনে স্থানীয় কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণ, দুর্নীতি, অপর্যাপ্ত সামাজিক সচেতনতা এবং শিক্ষাক্ষেত্রে মেয়েদের ধরে রাখার জন্য কার্যকর কর্মসূচির অভাব ইত্যাদি। 'বাল্যবিবাহ নিরোধ' আইনটি সংশোধনপ্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সরকারের উচিত নতুন আইনের বিধানের মাধ্যমে বাধাগুলোকে অতিক্রম করা এবং আইনের প্রয়োগ করা।</p> <p> 'বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন'টি যুগোপযোগী করার ক্ষেত্রে নারী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সরকার একটি সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।</p> <p> লেখক : উন্নয়নকর্মী</p> <p>  </p>