বরিশাল বিএম কলেজের টিচার্স রুমে বই খুলে বসে আছেন জীবনানন্দ দাশ। একটু পরই ক্লাসে যাবেন। এখানে তিনি ইংরেজি পড়ান। তাঁর সহকর্মীদের অনেকে ক্লাসরুমে, কেউ পরের ক্লাসে যাওয়ার আগে বইপত্র দেখে নিচ্ছেন; হয়তো ভাবছেন, প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
জন্মদিনের শাড়ি
মাসউদ আহমাদ

বই থেকে চোখ তুলে দেয়ালে ঝোলানো ছবির দিকে তাকালেন জীবনানন্দ। খেয়াল করলেন, জ্ঞানেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী মহাশয়ের ছবির ফ্রেমে ধুলোর আস্তরণ পড়েছে।
কেউ পরিষ্কার করে না।
ঠিক তখনই পিয়ন এসে চা দিয়ে গেল।
ভরদুপুরে শুধু চা খেতে ইচ্ছা করছে না। একটা নিমকি বা শিঙ্গাড়া হলে ভালো লাগত। ভাবলেন বটে; কথাটি কাউকে বলতে গেলেন না।
দেয়ালে ঝোলানো ছবির দিকে আর একবার তাকালেন জীবনানন্দ।
ব্রজমোহন কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ জ্ঞানেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী। ১৮৮৯ সালে তিনি যোগ দিয়েছিলেন। বছরখানেকের কিছু বেশি সময় এখানে দায়িত্ব পালন করেছেন। তারপর তিনি কি পলায়ন করেছিলেন, সহকর্মীদের কথা ও ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে?
বহুকাল আগের কথা।
বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হরিচরণ দে এসে জীবনানন্দর পাশে বসলেন। বললেন, কবি সাহেব, দেয়ালে কী দেখছেন?
জীবনানন্দ সে কথার জবাব না দিয়ে বললেন, মানুষ মরে গেলে কেউ তাকে পোছে না, না?
হরিচরণ বিস্মিত; হঠাৎ এ কথা যে?
জীবনানন্দ হরিচরণ দের কৌতূহলের কোনো উত্তর দিলেন না।
জ্ঞানেন্দ্রনাথের পাশের ছবিটি অশ্বিনীকুমার দত্তের। তিনি বরিশালের গর্ব। বিএম কলেজ গড়ে ওঠার পেছনে তাঁর ভূমিকা ও ত্যাগ স্মরণীয়।
অশ্বিনীবাবুর সঙ্গে বারকয়েক দেখা হলেও সেভাবে আলাপ হয়নি জীবনানন্দর।
দ্বিতীয়বার শোধানোতে ছবির প্রতি ইঙ্গিত করলেন জীবনানন্দ। প্রথমবার বুঝতে পারলেন না হরিচরণ। পরে বুঝলেন এবং মুখে আফসোসের ভঙ্গি করলেন। কানের পর্দা কাঁপিয়ে ক্লাসের ঘণ্টা বেজে ওঠে। জীবনানন্দ চমকে উঠলেন।
হরিচরণ বললেন, বড় ভালো লোক ছিলেন।
চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে জীবনানন্দ পাশ ফিরে তাকালেন।
ক্লাসে পড়ানোর সময় কিছু একটা বোঝাতে গিয়ে অন্য জগতে চলে যান জীবনানন্দ। ছাত্র-ছাত্রীদের চোখে-মুখে না তাকিয়ে ছাদের দিকে তাকান। কখনো জানালা গলিয়ে বাইরে ছড়িয়ে দেন দৃষ্টি। এটা তাঁর নিজস্ব ভঙ্গি।
সরাসরি কেউ কিছু বলে না। কিন্তু এসব নিয়ে ক্লাসে ও বাইরে কথা হয়। তিনি টের পান।
মেয়েদের একটু ভয়ই পান জীবনানন্দ। পারতপক্ষে ক্লাসের মেয়েদের কোনো কিছু জিজ্ঞেস করেন না।
দুটি মেয়ে পরস্পর কথা বলছে। জীবনানন্দ লেকচার থামিয়ে বললেন, ক্লাসে একটু মন দাও, বাবারা।
মেয়ে দুটি ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেল।
ছাত্র-ছাত্রীদের তিনি প্রিয় শিক্ষক নন, জীবনানন্দ বুঝতে পারেন। ‘আমারই বা কী দোষ’—আত্মপক্ষ সমর্থন করে ভাবেন। ইংরেজি বিভাগের শিক্ষকরা সহজ ও পড়িয়ে সুবিধা হয়, সেই বিষয়গুলো বেছে নেন। তাঁকে দেওয়া হয় জটিল ও রসকষহীন বিষয়। তিনি পড়িয়ে জুত পান না। ছাত্র-ছাত্রীরাও আগ্রহ পায় না।
ঘণ্টা বেজে উঠল। কোনো দিকে না তাকিয়ে নিজস্ব হাঁটার ভঙ্গিতে ফড়িঙের মতো লাফিয়ে ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে এলেন জীবনানন্দ।
থার্ড পিরিয়ডে জীবনানন্দের কোনো ক্লাস নেই। লাবণ্য বলেছিল, কলেজ থেকে তাড়াতাড়ি ফিরতে। প্রিন্সিপালকে বলে তিনি টিচার্স রুম থেকে বেরিয়ে বাড়ির পথ ধরলেন।
ভাত হয়ে গেছে, তরকারি এখনো চুলায়। জীবনানন্দকে বাড়ি ফিরতে দেখে ঘরে এলো লাবণ্য—চা খাবে?
ঘরের ভেতর পায়চারি করার ছলে কিছু ভাবছিলেন জীবনানন্দ। —না। একটু লেবুর শরবত করে দিতে পারো।
লেবুর শরবত?
লেবু নেই? তাহলে থাক। ঘরের পেছনের গাছে পাকা পেঁপে আছে।
আচ্ছা, বানিয়ে দিচ্ছি।
লাবণ্য দাঁড়িয়ে রইল। কোনো কথা নয়, প্রসঙ্গ নয়, গল্প নয়। তবু।
জীবনানন্দ একবার মুখ তুলে তাকালেন, কিছু বললেন না।
লাবণ্য বলল, এই শোনো, এ মাসে একটা শাড়ি কিনে দেবে?
শাড়ি? কোথাও বেড়াতে যাবে বুঝি?
না।
জীবনানন্দ অবাক; তাহলে?
পরে বলব।
পরে কেন, এখনই বলো। রহস্য করো না।
কোনো রহস্য নেই।
তাহলে?
কথার উত্তর না দিয়ে লাবণ্য ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
বিশ মিনিট পরে পেঁপের শরবত নিয়ে লাবণ্য আবার ঘরে এলো।
জীবনানন্দ শরবতের গ্লাসে চুমুক দিলেন—বাহ, পেঁপেটা খুব মিষ্টি।
লাবণ্য মৃদু হাসল—পাখিতে একটা পেঁপের অর্ধেকটা খেয়ে গেছে।
তুমিও এক গ্লাস খাও। পেঁপে পেটের জন্য খুব ভালো।
লাবণ্য বেরিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর আবারও সে ঘরে এলো। বলল, একটু পুরুষ হও, বুঝলে? সারা জীবন ভেজা বিড়াল হয়ে থেকো না।
খানিকটা আনমনা হয়ে পড়েছিলেন জীবনানন্দ।
লাবণ্য কথাটি আর একবার শোনাল—একটু পুরুষ হও, বুঝলে?
তোমার কথার মানেটা ঠিক বুঝতে পারলাম না।
তুমি তো অকর্মা কোনো লোক নও। ইংরেজিতে পাস করা পণ্ডিত মানুষ। কলেজের অধ্যাপক। কবি হিসেবেও তোমার ভালো পরিচিতি আছে।
তা একটু আছে।
কিন্তু তোমাকে দেখে তা মনে হয় না।
কী মনে হয়?
লাবণ্য বলল, তোমাকে দেখে মনে হয়, বউ মরা অসহায় একজন মানুষ। সারাক্ষণ গম্ভীর মুখ। হাসি নেই। কথা নেই। ঘরে ও বাইরে কোনো বিষয়ে তেজ নেই।
ওহ, এই কথা?
এটা কোনো সাধারণ কথা নয়।
নিশ্চয়ই। আমি তোমার কথা সিরিয়াসলি নিচ্ছি তো।
খবরদার, হাসবে না বলছি।
জীবনানন্দ এবার সত্যিই হেসে ফেললেন।
পাজি লোক। সময়ে মুখে হাসি থাকে না, আর এখন হি হি।
জীবনানন্দ তবু হাসছিলেন।
লাবণ্য বলল, তুমি তো মানুষের সঙ্গে সহজভাবে মেশো না। কথা বলো না। দু-একটা কথা বলেই কেমন গম্ভীর হয়ে যাও। এসব তো ঠিক নয়।
জীবনানন্দ হেঁয়ালি করলেন, কী জানি, আমার মুখটাই হয়তো এমন।
না, এটা তুমি ঠিক বলোনি।
এবার যদি তোমাকে দেখি যে গম্ভীর হয়ে আছ, তোমার মাথায় আমি বাঁশ মারব।
বাঁশ মারলে তো মাথা ফেটে যাবে।
তোমার একটু মাথা ফাটাই দরকার।
জীবনানন্দ হা হা করে হাসতে লাগলেন।
শোনো, এত হেসো না। দুপুরে স্নানের আগে শাড়িটা নিয়ে আসবে।
শাড়ি দিয়ে কী করবে?
সেটা সময় হলেই জানতে পারবে।
জীবনানন্দ পেঁপের শরবতটা শেষ করলেন।
শাড়ি কেনা নিয়ে লাবণ্য রহস্য করায় বহুদিন আগের একটি ঘটনা মনে পড়ে যায় জীবনানন্দর। বিয়ের বছর দুয়েক পরের ঘটনা। এক সকালে লাবণ্য বলল, আমাকে একটা শাড়ি কিনে দাও।
জীবনানন্দ বললেন, এখন তো হাতে কোনো টাকা নেই।
সে আমি জানি। তুমি বাবার কাছে যাও। তাঁকে বলো, আমাদের বাড়িতে যে দোকান থেকে কাপড় আসে, সেখানে যেন বাবা চিরকুট লিখে দেন।
এখন তোমার শাড়ির দরকার হলো কেন?
আছে দরকার। তুমি বাবাকে বলো।
তোমার কাপড়ের জন্য বাবাকে বলতে হবে? এটা কেমন কথা? আমার নিজের কোনো প্রয়োজনেও বাবাকে কখনো বলি না।
লাবণ্য বলল, আমি যদি বাবাকে বলি, তিনি কি রাগ করবেন?
তা বলে দেখতে পারো।
আচ্ছা, আমিই যাচ্ছি বাবার কাছে।
জীবনানন্দ বললেন, কিন্তু...
কিন্তু কী?
জীবনানন্দ বিব্রত; তুমি এ বাড়ির নতুন বউ। ব্যাপারটা কি ভালো দেখাবে?
লাবণ্য হাতের তালুতে কিল মেরে বলল, দেখাই যাক, কী হয়।
সত্যানন্দ নিজের ঘরে শুয়ে বই পড়ছিলেন।
লাবণ্য কোনো ভূমিকা না করেই বলল, বাবা, আমি কাপড় কিনতে চাই। দোকানে একটা চিঠি লিখে দিন।
সত্যানন্দ বই থেকে চোখ তুলে উঠে বসলেন। বললেন, নিশ্চয়ই কাপড় কিনবে। তুমি আমার একমাত্র পুত্রবধূ।
লাবণ্য আনত মুখে দাঁড়িয়ে রইল।
তুমি কখানা কাপড় চাও মা, বলো। আমি লিখে দিচ্ছি।
সত্যানন্দর চিরকুট পেয়ে অল্প সময়েই কাপড়ের দোকানের কর্মচারী কয়েকটি দামি ও কম দামি শাড়ি নিয়ে হাজির হলো।
এত কাপড় দেখে জীবনানন্দ বিস্মিত। লাবণ্যকে আড়ালে ডেকে বললেন, কাপড় তুমি সত্যি সত্যি আনিয়ে নিলে? বাবাকে তুমি সরাসরি কাপড়ের কথা বলতে পারলে? আমি ভেবেছিলাম, তুমি হয়তো শেষ পর্যন্ত বলতে পারবে না।
লাবণ্য মৃদু হাসল।
তোমার তো এখনো বেশ কখানা শাড়ি আছে। নাহ, তুমি আমাকে আর বরিশালে থাকতে দেবে না দেখছি।
লাবণ্য শাড়িতে চোখ রেখে বলল, হুম।
জীবনানন্দ ভাবলেন, কী অদ্ভুত মেয়ে রে বাবা। শ্বশুরকে এ ধরনের আবদার কেউ করে? বাবাকে কাপড়ের দাম দিতে হবে, ভাবতেই লজ্জায় তিনি যেন নুয়ে পড়লেন।
লাবণ্য হাসছে। দোকানের কর্মচারীকে বলছে, এটা নয়, ওটা দেখান। পাড়টা ভালো করে দেখান।
অনেক দেখেশুনে একটা সুন্দর সাদা ঢাকাই শাড়ি বেছে রেখে বাকি কাপড় ফেরত দিল।
বিকেলে বাড়িভর্তি মানুষ। দূর থেকেও এসেছেন আত্মীয়। জীবনানন্দ বুঝতে পারলেন না ব্যাপারটা কী? লাবণ্য বেশ ব্যস্ত। বাড়িতে ভালো-মন্দ রান্নাও হচ্ছে। পোলাও, পায়েস, মিষ্টি।
একফাঁকে জীবনানন্দ লাবণ্যকে ডাকলেন; ব্যাপারটা কী, বলো তো?
লাবণ্য না বোঝার ভান করে বলল, কিসের ব্যাপার?
এই যে এত লোক আসছে বাড়িতে?
লাবণ্য রহস্যময় হাসি হাসল।
আহা, বলো না।
আজ মায়ের জন্মদিন।
জীবনানন্দ জিভে কামড় দিলেন। আহা, আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। বেকার মানুষ। মায়ের জন্মদিন মনে রেখেই বা আমি কী করতে পারতাম।
তোমাকে কিছু করতে হবে না। এ জন্য তোমার কাছে আবদার করিনি। জানি, তুমি দুঃখ পাবে। আজ সকালে মায়ের জন্যই শাড়িটা কিনলাম। বাবাকে না বলে উপায় ছিল না।
জীবনানন্দ হাত বাড়িয়ে লাবণ্যকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।
লাবণ্য লজ্জা পাওয়া গলায় বলল, এই কী করো? ছাড়ো। বাড়িভর্তি মানুষ।
সর্বানন্দ ভবনে জন্মদিন পালনের রেওয়াজ অনেক পুরনো। লাবণ্য এ বাড়িতে এসেই জেনেছে এবং নিজেও পালন করে। মুশকিল হলো, কুসুমকুমারী নিজের জন্মদিনে আনন্দ করবে, মানুষকে ভালো-মন্দ খাওয়াবে; কিন্তু পুরনো মলিন শাড়ি পরে ঘুরে বেড়াবে। জন্মদিনে মা আধময়লা শাড়ি পরে ঘুরছে, দৃশ্যটা দেখে লাবণ্যর বুকে বেঁধে।
জীবনানন্দ বললেন, তুমি ঠিকই বলেছ। মা নিজের দিকে খেয়াল রাখেন না। মানুষের সেবা করাতেই তাঁর আনন্দ।
সে জন্যই এমন একটা রহস্য করতে হলো। তুমি কি রাগ করেছ?
আরে নাহ।
জন্মদিনে মায়ের একটা নতুন শাড়ি জুটবে না, বিষয়টা কেমন দেখায় বলো?
তুমি খুব ভালো কাজ করেছ।
জীবনানন্দ একটা স্নেহের হাত লাবণ্যর মাথায় রাখলেন।
কুসুমকুমারী সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় আর খাবার পরিবেশন করছেন। লাবণ্য শাশুড়ির আঁচল ধরে টেনে আনল। বলল, মা, আপনি এই বেশে মানুষজনের সামনে যেতে পারবেন না।
কেন, কী হলো মা লাবু?
দেখি, আপনি এদিকে আসুন। এখানে বসুন।
ঘর থেকে চিরুনি এনে কুসুমকুমারীর মাথাটা ভালো করে আঁচড়ে দেয় লাবণ্য। কুসুমকুমারী অবাক। তিনি কপোট বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন, আমার কি আর সাজবার বয়স আছে রে, মা।
লাবণ্য শাশুড়ির কথায় কান দিল না। বলল, নিন, এই শাড়িটা পরুন।
কুসুমকুমারী বললেন, এত লোকের সামনে এমন সেজেগুজে কেমন করে বের হই বলো তো?
কী আর করবেন, মা। না হয় একটু বেশি করে ঘোমটা টেনে দিয়ে যাবেন। কিন্তু এই শাড়িটা না পরলে আমি কিছুতেই আপনাকে আর বের হতে দেব না।
অবশেষে কুসুমকুমারী শাড়িটা পরলেন। লাবণ্য পেছন ফিরে জীবনানন্দকে ডাকলেন; এই, এদিকে এসো। একবার দেখে যাও মাকে।
জীবনানন্দ মায়ের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলেন। বললেন, মা, সত্যি তোমাকে শাড়িটাতে খুব সুন্দর লাগছে। বেশ মানিয়েছে।
উপস্থিত মানুষজন এসে কুসুমকুমারীকে ঘিরে ধরল।
...কালীবাড়ি রোডের এক দোকান থেকে শাড়ি কিনে ফেরার সময় ঝুম বৃষ্টি নামল। বাড়ি ফিরতে ফিরতে জীবনানন্দ প্রায় ভিজে গেলেন।
বিকেলে ছেলে-মেয়ে নিয়ে লাবণ্যর বড় বোন প্রমীলা বেড়াতে এলো।
জামাইবাবু, কেমন আছেন?
জীবনানন্দ বললেন, আমরা ভালো। আপনি কেমন আছেন?
হ্যাঁ, ভালো।
আপনার সাহিত্যচর্চা কেমন চলছে?
এই তো, চলছে আর কি।
প্রমীলার বাচ্চাটা উঠোনে খেলছিল, দৌড়াতে গিয়ে পড়ে গেছে। আচমকা কেঁদে উঠল।
প্রমীলা বাচ্চাকে সামলাতে উঠে গেল। জীবনানন্দ খেয়াল করলেন, দুপুরে যে শাড়ি তিনি নিয়ে এসেছেন, সেই শাড়িটা পরে আছে প্রমীলা।
সম্পর্কিত খবর

বই আলোচনা
মাশির হোসেন হিরু স্মারকগ্রন্থ বিস্মৃতি থেকে স্মৃতিতে

সাংবাদিক মাশির হোসেন, যিনি হিরু ডাকনামে অধিক পরিচিত। তাঁর আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী ও সুধীজনের কাছে তিনি স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। প্রায় দুই দশক পরেও তাঁরা তাঁকে ভুলে যাননি; মনে রেখেছেন। মুস্তাফা মজিদ সম্পাদিত ‘মাশির হোসেন হিরু স্মারকগ্রন্থ : বিস্মৃতি থেকে স্মৃতিতে’ তারই প্রমাণ।
মায়ানমারের ইয়াঙ্গুনে জন্মগ্রহণ করলেও তাঁর শৈশব কাটে ঢাকার আর্মানিটোলায়, পরবর্তীতে শান্তিনগরে। স্বাধীনচেতা মাশির হোসেন তাই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন সাংবাদিকতা। শুরু করেন স্পোর্টস রিপোর্টার হিসেবে। ভাষা আন্দোলনে ছিল তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ।
স্মারকগ্রন্থের সম্পাদক মুস্তাফা মজিদ বলেছেন, অন্য অনেক স্মারকগ্রন্থের মতো মাশির হোসেন হিরু স্মারকগ্রন্থও সাদামাটা, যা ভালোবাসার মানুষদের স্মৃতিচারণাই। যদিও কোনো কোনো বৃহৎ ঘটনার পুনরাবৃত্তি করেছেন কেউ কেউ, তা সত্ত্বেও তার ভেতরেই ফুটে উঠেছে এক অনন্য অকৃত্রিম দরদ এবং মাশির হোসেনের চরিত্রের নানা দিক, যা তাঁকে নতুন আলোয় উদ্ভাসিত করেছে বর্তমান প্রজন্মের মানুষদের মাঝে; বিশেষত সাংবাদিকতাজগতে যাঁরা এ প্রজন্মের, যাঁদের অনেকেই মাশির হোসেনকে ব্যক্তিগতভাবে দেখেননি এবং চেনেন না। তিনি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন এই গ্রন্থে যাঁরা লিখেছেন তাঁদের সবাইকে।
এই স্মারকগ্রন্থে লিখেছেন আমানউল্লাহ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, এরশাদ মজুমদার, আবুল কাসেম ফজলুল হক, মুহাম্মদ কামরুজ্জামান, মনোয়ার হোসেন, লুত্ফুর রহমান, সৈয়দ দীদার বখত, দীপা দত্ত (সেন), গোলাম তাহাবুর, ড. মাহবুব উদ্দীন চৌধুরী, ইকবাল সোবহান চৌধুরী, রফিকুর রহমান, কাজিম রেজা, আব্দুল আউয়াল ঠাকুর, এ কে এম মহসিন, এলাহী নেওয়াজ খান, আহমদ আখতার, কাজী রওনাক হোসেন, মমতাজ বিলকিস, মারুফ কামাল খান, খায়রুল আনোয়ার, সৈয়দ আবদাল আহমদ, ফজলুল বারী, মোস্তফা কামাল মজুমদার, শওকত মাহমুদ, বুলবুল আহমেদ, মাহমুদ শফিক, শওকত আনোয়ার প্রমুখ।
এ ছাড়া আছে মাশির হোসেন হিরুর লেখা, জীবনবৃত্তান্ত ও কিছু দুর্লভ আলোকচিত্র, যা এই গ্রন্থকে আরো আকর্ষণীয় করেছে। আশা করি, মাশির হোসেন হিরুকে জানতে স্মারকগ্রন্থটি নতুন প্রজন্মকে সাহায্য করবে।
রিহাম হাসান

পাঠকের প্রিয় বই
যেন কারো একান্ত গোপন চিঠির খাম খুলেছি
- তাওহীদাহ্ রহমান নূভ, বাংলা বিভাগ, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

চিঠিপত্র তো ব্যক্তিমানসের মুকুর। কেবল এই মুকুরকেই কাজে লাগিয়ে রচিত হতে পারে অনবদ্য কোনো উপন্যাস, এটা হয়তো বুদ্ধদেব গুহর আগে ভাবেননি কোনো কথাকার। শুধু আঙ্গিকেই নয়, বহু দিক থেকে নতুন মাত্রা যোগ করেছে ‘সবিনয় নিবেদন’ নামের চমৎকার এই উপন্যাস। শিক্ষিত, স্বাবলম্বী ও উদারমনা এক নারী ঋতার সঙ্গে বেতলার জঙ্গলে এক চরম বিপন্ন মুহূর্তে একঝলক দেখা হয়েছিল ঝকঝকে, ব্যক্তিত্ববান অফিসার রাজর্ষি বসুর।
‘সবিনয় নিবেদন’-এর মতো বই পড়া যেন এক ধরনের নীরব সাধনা। যেন কারো একান্ত গোপন চিঠির খাম আমি খুলে বসেছি, যার ভাঁজে ভাঁজে জমে আছে অভিমান, ব্যথা, অরণ্যের ঘ্রাণ আর অপ্রকাশিত ভালোবাসা।
প্রথম থেকেই মনে হয়েছে, উপন্যাস পড়ছি, না একটি রাগপ্রবণ, বেদনাঘন রাগিণী শুনছি। যেন এক পিয়ানো, যার কিছু চাবি বাজে না, কিছু অতিরিক্ত সুর তুলে দেয়। বুদ্ধদেব গুহর ভাষা এতটাই স্বচ্ছ ও জীবন্ত যে চরিত্রের চোখের জলও যেন স্পষ্ট অনুভব করা যায়।
প্রতিটি পৃষ্ঠা যেন একটি কুয়াশাময় সকাল—অস্পষ্ট, কিন্তু অনুভবে পরিপূর্ণ। সম্পর্ক এখানে নদীর মতো—প্রবহমান, বাঁক নেয়, স্রোতের নিচে পাথর লুকিয়ে থাকে। লেখকের অভিজ্ঞতা থেকে উঠে আসা অনুভবগুলো এমনভাবে বিন্যস্ত, যেন পাঠকের আত্মজগতে আয়না ধরে রাখা হয়েছে, যেখানে নিজের ভেতরের চেহারা ধরা পড়ে, যেটা আমরা অনেক সময় এড়িয়ে যাই। ভালোবাসার বর্ণনা এ উপন্যাসে কোনো একপেশে আবেগে সীমাবদ্ধ নয়।
গ্রন্থনা : পিন্টু রঞ্জন অর্ক

বিশ্বসাহিত্য
জার্মান লেখক সেবাস্টিয়ান হাফনারের উপন্যাসের চমক

সম্প্রতি প্রকাশ করা হয়েছে জার্মান সাংবাদিক, ইতিহাসবিদ ও লেখক সেবাস্টিয়ান হাফনারের উপন্যাস ‘আবসিড’ বা ‘বিদায়’। হাফনারের জন্ম ১৯০৭ সালে, মারা যান ১৯৯৯ সালে। ‘আবসিড’ বা ‘বিদায়’ নামের উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় প্রয়াত লেখকের ড্রয়ার থেকে। উপন্যাসটি লেখা হয় ১৯৩২ সালের ১৮ অক্টোবর থেকে ২৩ নভেম্বরের মধ্যে।
এ বছর এ উপন্যাস প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে জনপ্রিয় হওয়ার কারণ হলো, এখানে ইতিহাসের খুব কঠিন সময়ের সাদামাটা জীবনের গল্প বলা হয়েছে।
ফাহমিদা দ্যুতি

এক ঘণ্টা
- জামান আখতার

রাত সাড়ে আটটায় ঢাকা শহরের সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায় সরকারি আদেশমতো।
সিটি শপিং মলের আটতলার সব দোকান আটটায় দ্রুত বন্ধ করে দিচ্ছে। ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই লিফট-সিঁড়ি বেয়ে নেমে শপিং মল ত্যাগ করছে। গ্রাউন্ড ফ্লোরে সিকিউরিটি গেটে সবার চলে যাওয়ায় সহযোগিতা করছে।
রাত সাড়ে আটটা বাজার কিছুক্ষণ আগে ছয়তলা থেকে হন্তদন্ত হয়ে মাস্ক পরা এক স্মার্ট যুবক আশিক লিফটে চড়ে ডোর ক্লোজ বাটন টিপে ঘুরে দাঁড়াল। দেখল, লিফটের কোনায় কিছু শপিং ব্যাগ হাতে একটু ঘুরে দাঁড়ানো সালোয়ার-কামিজ হিজাব-নেকাব পরা এক যুবতি।
লিফট নিচে নামতেই সহসা একটা শব্দ করে থেমে গেল।
: কী হলো?
অস্ফুট স্বরে আশিক বলল—
: কারেন্ট চলে গেল।
: লোডশেডিং!
: ভয় পাবেন না। জেনারেটর ছাড়লেই লিফট চলবে।
সিঁড়ি বেয়ে সবাই নেমে শপিং মল ত্যাগ করল। মার্কেট শূন্য। শুধু অন্ধকার লিফটের ভেতরে আটকা পড়ে আছে আশিক আর একটি রক্ষণশীল নারী।
আশিক তার মাস্ক খুলে মোবাইলের লাইট অন করল। বেশ আলোকিত হলো লিফট।
: হ্যালো। হ্যালো লিফটম্যান। হ্যালো হ্যালো।
আশিক ইন্টারকম বক্সে কারো কোনো সাড়াশব্দ পেল না। সিকিউরটি রমিজ শপিং মলের আন্ডারগ্রাউন্ড কার পার্কিং থেকে একজনের গাড়ি বিদায় করছে। লিফটে বন্দি আশিক চিৎকার করে বলছে—
: কে আছ, লিফটের দরজা খোলো। আমরা আটকা পড়েছি।
সিকিউরিটির কানে তখনো আওয়াজ পৌঁছেনি। আশিক লিফটের দরজায় ডান হাতে অনবরত ঘুষি মারছে আর বলছে—
: আমরা লিফটে আটকা পড়েছি। কে আছ, জেনারেটর চালু করো। নয়তো লিফট ভেঙে ফেলব। ভেঙেই ফেলব।
আশিকের এই আর্তচিৎকারে বিমর্ষ মেয়েটি। সিকিউরিটির কানে আওয়াজ পৌঁছল। দ্রুত সিকিউরিটি লিফট ইন্টারকম বাটন টিপে বলে—
স্যার স্যার, আমি মার্কেট সিকিউরিটি রমিজ।
: তোমাদের লিফটম্যানকে বলো জেনারেটর চালু করতে।
: স্যার, লিফটম্যান করিম ভাই তো সন্ধ্যাবেলা বাইত চইলা গেছে।
: তুমি তাড়াতাড়ি জেনারেটর চালু করো।
: কেমনে চালু করুম স্যার, সারা দিন তিনবার কারেন্ট গেছে। জেনারেটরে তেল নাই।
: লিফটের চাবি নিয়ে, তুমি লিফট ফ্লোর লেভেলে এনে দরজা খুলে আমাদের দুজনকে বের করো।
: স্যার লিফটের চাবি তো লিফটম্যান করিম ভাইয়ের কাছে থাকে। যাইবার সময় কইলো, মার্কেট বন্ধ হইলে লিফটের কারেন্ট পাওয়ার যেন আমি অফ কইরা দেই।
তোমার করিম ভাইকে ফোন করে লিফটের চাবি নিয়ে আসতে বলো।
: আইচ্ছা, ফোন দিতাছি স্যার। চিন্তা কইরেন না।
আশিক লক্ষ করল, মেয়েটি গরমে ঘামছে। আশিক একা মনেই বলল—
: উহ্! এই গরমে টিকব কী করে?
মেয়েটি আঁতকে উঠল—
: অ্যাঁ! তাহলে?
লিফটের ইন্টারকম বেজে উঠল। আশিক দ্রুত ঘুরে তাকল লিফটের সাউন্ড বক্সের দিকে।
: হ্যাঁ, করিম মিয়া আসছে তো?
সিকিউরিটি রমিজ বলল—
: না স্যার। ম্যালা চেষ্টা করলাম, করিম ভাইয়ের মোবাইল বন্ধ।
আশিক উদ্বিগ্ন স্বরে বলল—
: হোয়াট!
শব্দ শুনে মেয়েটি আচমকা বলে উঠল—
: হায় আল্লাহ, এখন উপায়!
রমিজ মিয়া বলল—
আল্লাহ ভরসা। এক ঘণ্টার মধ্যেই কারেন্ট চইলা আসবো। তার পরেও আমি বিদ্যুৎ অফিসে খবর লইতাছি।
আশিকের মোবাইল আলোয় কী অদ্ভুত ঐন্দ্রজালিক অন্ধকার লিফটের চার দেয়ালের ভেতরে চৈত্রদাহে পুড়ছে, দুজন অচেনা-অজানা লিফটযাত্রী।
এক ঘণ্টার লোডশেডিং হলে বিদ্যুৎ আসতে এখনো চল্লিশ মিনিট বাকি। কতক্ষণ আর লিফটে দাঁড়িয়ে থাকা যায়। মেয়েটি শপিং ব্যাগগুলো নিয়ে লিফটে বসে পড়ল। আশিকও বসে লম্বা করে পা মেলে দিল। আশিক লক্ষ করল, মেয়েটি শপিং ব্যাগ থেকে একটি পণ্যের প্যাকেট বোর্ড ছিঁড়ে হাতপাখা করে বাতাস তুলে নিচ্ছে তার গায়ে। গরমে হিজাব-নেকাব ভিজে একাকার। আশিক তার কাঁধে ঝোলানো লেদার সাইড ব্যাগ থেকে মিনারেল ওয়াটারের বোতলটা বের করে মেয়েটির দিকে এগিয়ে দিল। মেয়েটি হাত বাড়িয়ে দিয়ে, কী যেন ভেবে হাতটা সরিয়ে নিল। আশিক ব্যাপারটা বুঝে বোতলের কক খুলে সামান্য পানি নিজে মুখে ঢেলে নিল। মেয়েটির মনে যেন একটা বিশ্বস্ততা ফুটে উঠল অজানা আশিকের প্রতি। এবার মেয়েটি হাত বাড়িয়ে মিনারেল বোতলটি ধরতেই চমকে উঠল, আশিকের হাতের আঙুল ফেটে তরতর করে রক্ত ঝরে পড়ছে। মেয়েটি পানির বোতলটা নিয়ে লিফটের ফ্লোরে রেখে দ্রুত তার মুখে আবৃত সাদা নেকাবটা টান দিয়ে খুলে আশিকের রক্ত ঝরা আঙুলে পেঁচিয়ে দিতে উদ্যত হলে আশিক হাত সরিয়ে নিয়ে খুব বিনয়ের সুরে বলে—
: য়ু হু। আগে আপনার গলাটা ভিজিয়ে নিন।
মেয়েটি বোতল তুলে ঢকঢক করে পানি খেয়ে নেকাব দিয়ে আশিকের রক্ত ঝরা আঙুল পেঁচিয়ে বেঁধে দিল। আশিক এক অনন্যা অপ্সরী সুন্দরী নারীর রূপে অভিভূত হলো।। সহসা একটা নিষ্পাপ সুন্দর যেন আশিকের মনকে এই বন্দিত্বের কথা ভুলিয়ে দিল। মেয়েটিকে বলল—
: আমি আশিক। আপনি?
: নাজমা!
: তো, এত প্যাকেট, কী শপিং করলেন?
: গায়েহলুদের কিছু সামগ্রী।
: ও! আপনার গায়েহলুদ?
: জি না। ছোট বোন সূচনার কাল হলুদসন্ধ্যা।
: তো, সাথে কেউ আসেনি?
: বাবা নেই। মা বুড়ো মানুষ!
: সূচনা?
: সামান্য ক’টা আইটেম, ভাবলাম একাই পারব।
: আপনার হাজব্যান্ড?
: জি!
নাজমা আঁতকে উঠল। আশিক বলল—
: চমকে উঠলেন যে!
: এমনি।
: না...বলছিলাম, ছোট বোনের বিয়ে, আপনার হাজব্যান্ডকে নিয়ে...
: নেই।
: নেই, মানে ছোট বোনকে বিয়ে দিয়ে তারপর...
: বিয়ে, ঘর-সংসার—এসব নিয়ে আর ভাবছি না।
: কেন?
: ব্যাপারটা কোথায় যেন একটু কমপ্লিকেটেড মনে হচ্ছে। তাহলে কি আপনার হাজব্যান্ড...
: ছিল।
: তো, এখন উনি...
আশিক লক্ষ করল, নাজমার চোখ ভিজে যাচ্ছে। যেন জীবনের কোনো একটা অতৃপ্ত গল্প লুকানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। সহসা আশিকের মোবাইল বেজে উঠল। রিসিভ করল—
: হ্যালো, মা। এইতো একটা জায়গায়। কারেন্ট এলেই চলে আসব। জি। জি মা।
আশিক মোবাইল বন্ধ করল—
: বিপদে আছেন, মাকে বুঝতে না দিয়ে ভালোই করেছেন। আমার মা আর সূচনা হয়তো আমাকে ফোন দিয়ে পাচ্ছে না।
: সঙ্গে মোবাইল আনেননি।
: চার্জ নেই।