<p>আজ ২২ শ্রাবণ। বাংলা কবিতা-গল্প-উপন্যাস-ভ্রমণকাহিনি-প্রবন্ধ-চিত্রকলা-শিশুতোষ রচনা-নাটক সব কিছু একটি মাত্র মানুষ আশি বছরের ঘোরগ্রস্ত জীবনে ভরিয়ে তুলেছেন অকৃপণ ফুলে-ফলে আর তারপর নিজেই জানিয়েছেন যে ‘কণ্ঠে নিলেম গান, আমার শেষ পারানির কড়ি—’</p> <p>পরের প্রজন্মের খেপাটে প্রতিভা নজরুলের গানে যেমন হিন্দুস্তানি রাগসংগীতের খেয়াল ঘরানার আঙ্গিকে গায়ক বা গায়িকার বেশ নড়াচড়া করার স্বাধীনতা আছে, রবীন্দ্রসংগীতে গায়কের স্বাধীনতার পরিসর কিন্তু তত বেশি নয়। রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় রাগ-রাগিণীর নানা সুরে গান সৃজন করলেও তাঁর গান মূলত ধ্রুপদাঙ্গ মেজাজের এবং স্বরলিপির ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য সংগীতে যেমন পিয়ানোর নোটেশন অব্যর্থ মেনে চলা হয়, রবীন্দ্রনাথের গানেও হুবহু তেমনটাই দস্তুর।</p> <p>এ কথা আজ আর কারোরই অবিদিত নেই যে তরুণ রবীন্দ্রনাথ ইংল্যান্ডে ব্যারিস্টারি পড়তে গিয়ে আদালতে কালো গাউন পরে সওয়াল-জবাব করার সনদ অর্জন করতে পারেননি ঠিকই; কিন্তু শিখেছেন পিয়ানো বাদন, নিয়েছেন ইউরোপের মানবধর্মের শিক্ষা আর বাংলা সংগীতে সংযোজন করেছেন স্কটিশ, আইরিশ ও ইংলিশ লোকগীতির সুর। যা হোক, রবীন্দ্রনাথের গানে পাশ্চাত্য প্রভাব নিয়ে প্রথম ধারাবাহিক গবেষণা এবং প্রতিটি স্কটিশ বা আইরিশ গান ধরে ধরে গেয়ে, তার পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের অক্ষরে অক্ষরে না হোক, অনেকটাই ভাবানূদিত গানগুলো গেয়ে বিষয়টি সবার সামনে প্রথম নিয়ে আসেন বরেণ্য সংগীতশিল্পী স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত। স্বাগতালক্ষ্মীই প্রথম রবীন্দ্রনাথের গানে পাশ্চাত্য প্রভাবের দিকটি আমাদের সবার সামনে আনেন। স্বাগতালক্ষ্মীর পরও ইউটিউবে তাঁর দেখাদেখি দুই বাংলার বেশ কিছু তরুণ শিল্পী রবীন্দ্রনাথের একাধিক পশ্চিম প্রভাবিত গান মূল ভাষার লিরিকসসহ গেয়েছেন। কিন্তু আমার আজকের রচনার প্রতিপাদ্য অন্যত্র : সেটা হচ্ছে কিভাবে পশ্চিমা গানের লিরিকস হুবহু অনুবাদ না করে রবীন্দ্রনাথ একদম নিজের মতো করে, ভিন্নভাবে তুলে আনলেন বাংলা ভাষায়? সেটা কি শুধুই হুবহু অনুকৃতি এড়াতে করেছেন, নাকি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য মননের ভেতরকার বিপুল অমিলও এর কারণ?</p> <p>রবীন্দ্রমুগ্ধ হোন রবীন্দ্রনাথ, সেই বিদেশি গানের কথা স্বভাষায় রূপান্তরের সময়ে প্রাচ্যদেশীয় শুদ্ধাচার ও সামাজিক সংরক্ষণশীলতা পুরো মাথায় রেখেছেন তিনি।</p> <p>পত্রিকার পরিসরের কথা মাথায় রেখে আমি আইরিশ বা স্কটিশ লিরিকস ও সুর থেকে ১৮৮০ সালে দেশে ফেরা রবীন্দ্রের ভেতর থেকে মাত্র তিনটি গানের লিরিকস নিয়ে আলোচনা করব :</p> <p>১. ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে/ Ye Banks and Braes</p> <p>জীবনভর দারিদ্র্য ও স্কটল্যান্ডের শৈত্যের সঙ্গে লড়াই করা স্কটিশ কবি রবার্ট বার্নস আজও স্কটদের কাছে রূপকথার নায়ক। প্রবল শীতে অনেক সময় ফায়ার প্লেসের কাঠ জোটাতে না পেরে, ঠাণ্ডা ও দারিদ্র্যে চল্লিশের কোঠায় পা দেওয়ার আগেই মৃত এই কবি ‘Ye Banks and Braes’ রচনা করেছিলেন ১৭৯১ সালে এবং গানটির তিনটি সংস্করণ আছে। রবীন্দ্রনাথ এই গানের প্রভাবে ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’ রচনা করেন ১৮৮২ সালে। মূল গানের সুর হুবহু এক হলেও লিরিকসে অনেকটাই বদল এনেছেন কবি। মূল গানটি অনেক বড়। মূল গানটি যেখানে ষোলো লাইন দীর্ঘ, রবীন্দ্রনাথ সেখানে প্রথম আট লাইনের একটি দূরায়ত অনুবাদ করেছেন মাত্র। মূল গানের আসল দ্যোতনার জায়গাটি আবার একদম শেষ চার পঙক্তিতে : ‘Wi' lightsome heart I pu'd (pulled) a rose,/Fu' (Full) sweet upon its thorny tree!/And may fause Luver staw my rose (And my false lover stole my rose)/ But ah! She left the thorn wi' (with) me.’ রবীন্দ্রনাথ কিন্তু ‘ফুলে ফুলে’তে এমন গোলাপ চুরি করে, কাঁটা রেখে যাওয়া কোনো দয়িতার কথা ঘুণাক্ষরেও জানাচ্ছেন না। বার্নসের গানে অষ্টম থেকে দ্বাদশ পঙক্তিতে প্রেমকাতর নায়ক পাহাড়ি হ্রদে নৌকা চালিয়ে গোলাপকুঞ্জ দেখা, স্কটল্যান্ডের বিশেষ প্রজাতির পাখি ‘ইলকা’র ঠোঁটে ভালোবাসার গান এবং উত্তরে তাঁর নিজের প্রেমের কথাও বলছেন : ‘Aft hae I rov'd by Bonie Doon,/To see the rose and woodbine twine:/And ilka bird sang o' its Luve/And fondly sae did I o' mine.’ এসব ঠাকুরের গানে নেই।</p> <p>২. পুরনো সেই দিনের কথা/ Auld Lang Szne</p> <p>এই গানটিরও রচয়িতা ছিলেন কবি রবার্ট বার্নস। মূল গানটি অনেক বড় যেটা রবীন্দ্রনাথ অনেকটাই কাটছাঁট করেছেন। বার্নসের কবিতায় নায়ক তাঁর বাল্যপ্রেমের কথা মনে করছেন... পাহাড়ের ঢালে বালক বয়সে কোনো বালিকার সঙ্গে ডেইজি কুড়ানোর স্মৃতি মনে পড়ছে তাঁর : ‘We twa hae run about the braes (slopes)/And pu'd (picked) the gowans (daisies) fine/But we've wander'd mony (many) a weary fit/Sin days of auld lang syne!’ রবীন্দ্রনাথের অনুবাদে সেটা হয়ে উঠছে : ‘মোরা ভোরের বেলা ফুল তুলেছি/দুলেছি দোলায়/বাজিয়ে বাঁশি গান গেয়েছি/বকুলের তলায়।’ এখানে অনুবাদ মোটের ওপর মূলানুগ।</p> <p>৩. কতবার ভেবেছিনু/ Drink to me only with thine eyes</p> <p>মূল গানটির গীতিকার বেন জনসন। ‘টু সেলিয়া’ বা ‘সেলিয়া’ নামে এক তরুণীকে উদ্দেশ করে লেখা এই গানের শুরুর স্তবক হচ্ছে : ‘Drink to me only with thine eyes/And I will pledge with mine/Or leave a kiss within the cup/And I'll not ask for wine.’ বোঝা কঠিন যে কী করে এই বাণী রবীন্দ্রনাথের হাতে হয়ে উঠল, ‘কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া/তোমার চরণে দিব হৃদয় খুলিয়া।’</p> <p>বেন জনসন, খাঁটি পশ্চিমা নির্বেদের সঙ্গেই আরো লিখছেন, ‘I sent thee late a rosy wreath/Not so much hon'ring thee/As giving it a hope that there/It could not withered be.’ নায়ক তাঁর দয়িতাকে ‘খুব একটা সম্মান না করেই’ গোলাপের স্তবক পাঠাচ্ছেন। এটাই খাঁটি পশ্চিমি সততা। পশ্চিমের কাব্য বা সাহিত্যের নায়ক-নায়িকা কেউই দেবী বা দেবতা নয়। ভালোবাসার মেয়েটিকে খুব সম্মান করতে পারছেন না কবি। কেন? মেয়েটির কোনো আচরণে তাকে নিয়ে কি ছেলেটির হৃদয়ে সংশয় জেগেছে? আবার তাই বলে প্রেম পুরো খারিজও করছেন না। তাই খুব ভক্তি গদগদ না হয়েও তাকে গোলাপ স্তবক পাঠানো হয়েছে, যেন সবটাই এখানে শেষ না হয়ে যায়। মেয়েটিও তার উত্তরে গোলাপের একটু ঘ্রাণ নিয়েই সেই ফুল ফেরত পাঠিয়েছে। পুরোই লাগাতার মান-অভিমানের বিষয়। কিন্তু বাংলার কবি কী করলেন? ‘ভেবেছিনু কোথা তুমি স্বর্গের দেবতা/কেমনে তোমারে কব প্রণয়ের কথা’ ইত্যাদি হয়ে গান শেষ হলো ‘আপনি আজিকে যবে শুধাইছ আসি/কেমনে তোমারে কব কত ভালোবাসি!’</p>