সংকটকালে রবীন্দ্রনাথ আরো বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন। তিনি জন্মেছিলেন উনিশ শতকের শেষার্ধে। বেড়ে উঠেছেন বিংশ শতকের প্রথমাংশে। একই সঙ্গে দুটি বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসাবশেষ দেখেছেন।
করোনাকালে রবীন্দ্রনাথকে আরো বেশি প্রাসঙ্গিক মনে হয়
- ড. আতিউর রহমান
অন্যান্য

তবে এত উথালপাথালের মধ্যেও তিনি মাটিতে পা রেখে আকাশ থেকে নির্মল বায়ুর শ্বাস নিতে দ্বিধা করেননি। কিশোরকালেই জমিদারি ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত থেকে তিনি পূর্ব বাংলার মানুষের দুঃখ-বঞ্চনা খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। তাঁর চোখে পল্লী প্রকৃতি এক অপরূপ রূপেও ধরা পড়েছিল। এরই মধ্যে তিনি বছর দেড়েক ইংল্যান্ডে থেকেছেন পড়াশোনার জন্য। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক সে শিক্ষার সুযোগ তাঁকে আন্দোলিত না করলেও পাশ্চাত্যের শিক্ষাব্যবস্থার উদার দৃষ্টিভঙ্গি এবং তরুণ মনে সৃজনশীলতার উদ্দীপনা তৈরির বিষয়গুলো ঠিকই মনে দাগ কেটেছিল। এমন বহুমুখী অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি পূর্ব বাংলার কৃষক প্রজাদের আধুনিক কৃষি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের সুযোগ করে দেওয়ার নানা উদ্যোগ নিয়েছিলেন। অন্যান্য জমিদারের চেয়ে একেবারেই ভিন্ন ছিল তাঁর চলার পথ। তাই স্বদেশি সমাজ গড়ার আশায় কত লেখা ও বক্তৃতাই না তিনি দিয়ে গেছেন। তাঁর চিঠিগুলোতেও সমাজসংস্কারের সুপ্ত বাসনা ফুটে উঠেছে। এসব কথা মনে হয় তাঁর সময়ের চেয়ে শত বছর এগিয়ে। তা-ও আজও তাঁর লেখা, বলা, সংগীত, নৃত্য, চিত্রকলা ও গ্রামীণ উন্নয়ন ভাবনা এতটা প্রাসঙ্গিক মনে হয়। উন্নয়ন কবি। অর্থনীতি তাঁর বিষয় নয়। তবু উন্নয়নের যে সংজ্ঞা তিনি তাঁর লেখা ‘বৈতায়নিকের চিঠি’তে দিয়ে গেছেন তা আজকের দিনের টেকসই উন্নয়ন ধারণার পূর্বসূরি বললে মোটেও ভুল হবে না। তিনি লিখেছেন, ‘... যে জাতি উন্নতির পথে বেড়ে চলেছে তার একটা লক্ষণ এই যে, ক্রমশই সে জাতির প্রত্যেক বিভাগের এবং প্রত্যেক ব্যক্তির অকিঞ্চিৎকরতা চলে যাচ্ছে। যথাসম্ভব তাদের সকলেই মনুষ্যত্বের পুরো গৌরব দাবি করার অধিকার পাচ্ছে। এই জন্যেই সেখানে মানুষ ভাবছে কী করলে সেখানকার প্রত্যেকেই ভদ্র বাসায় বাস করবে, ভদ্রোচিত শিক্ষা পাবে, ভালো খাবে, ভালো পরবে, রোগের হাত থেকে বাঁচতে এবং যথেষ্ট অবকাশ ও স্বাতন্ত্র্য লাভ করবে।’
এই ভাবনাগুলো যখন রবীন্দ্রনাথ ভাবছিলেন তখন পশ্চিমা দুনিয়া বহুমাত্রিক সব পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। বিশ্বায়ন, প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশ, যোগাযোগ ও পরিবহনের অসামান্য উন্নতির সুফল তারা পাচ্ছিল। অন্যদিকে শ্রমিকদের অধিকার সচেতনতাও বাড়ছিল। পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতি নিয়েও পশ্চিমের পণ্ডিতজনরা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলেন। পাশাপাশি বৈষম্যের বিরুদ্ধে সামাজিক গণতন্ত্র, সাম্যবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠছিল।
ভারতবর্ষে, বিশেষ করে বাংলায়ও এসব ভাবনার ঢেউ আছড়ে পড়ছিল। বাঙালির পুনর্জাগরণে স্বাধীনতা ও উন্নয়ন ভাবনা জোর হাওয়া দিচ্ছিল। এখানেও রেল, টেলিফোন, টেলিগ্রাফ, বিদ্যুৎসহ অবকাঠামোর উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বেশ জোরেশোরেই চলছিল। বাংলার জমি বরাবরই উর্বর ছিল। তা সত্ত্বেও বন্যা, খরা এখানেও দুর্ভিক্ষের কারণ হিসেবে দেখা দিত। আর ঔপনিবেশিক একপেশে শাসনব্যবস্থার চাপ তো ছিলই। জমিদারি ব্যবস্থার অমানবিকতা ও সংস্কারহীনতা গরিব কৃষকদের জন্য অসহনীয় বোঝা হিসেবে বিরাজ করছিল। নগরে জন্মেও খুব কাছে থেকে দেখা পূর্ব বাংলার গ্রামীণ মানুষগুলোর দুঃখ-কষ্ট রবীন্দ্রনাথকে ব্যথিত করত। তাদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য তাই তিনি নানামুখী সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। পতিসর, শাহজাদপুর, শিলাইদহে তাঁর সেসব উদ্যোগের নানা চিহ্ন এখনো রয়ে গেছে।
রবীন্দ্রনাথের সময় সারা বিশ্বে ছিল ১০০ কোটি মানুষ। এখন তা বেড়ে ৭০০ কোটিরও বেশি হয়ে গেছে। বাড়তি এই বিপুল জনগোষ্ঠীর চাপ এই পৃথিবী অনেক সময় বহন করে উঠতে পারছে না। মানুষের সীমাহীন লোভ প্রকৃতির ওপর নানা মাত্রিক চাপ সৃষ্টি করছে। প্রকৃতির দানকে মানুষ উপেক্ষা করে তার ওপর জুলুম করছে। তাই প্রকৃতি বিগড়ে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের যে চ্যালেঞ্জ আমরা এখন মোকাবেলা করছি তা প্রকৃতির এই অসন্তুষ্টির কারণেই। প্রকৃতির অসহিষ্ণুতার প্রতিফলন আমরা এখন দেখছি করোনাভাইরাস নামের এই ক্ষুদ্র কণার আক্রমণে ব্যতিব্যস্ত সারা বিশ্বেই। এই যে আকাশচুম্বী দালানকোঠা, শিল্পায়নের ধুম, নগরায়ণের বিশ্রী রূপ, প্রযুক্তির অভাবনীয় বিকাশ, বিশ্বায়নের অপ্রতিরোধ্য গতি—পুরো সমাজকে কতিপয়ের পোয়াবারো করে ফেলেছে। কিন্তু চলমান এই মহামারি উন্নয়নের এত সব প্রাপ্তিকে অর্থহীন করে ফেলেছে। আজ মানুষ মানুষের কাছে গিয়ে দাঁড়াতে অক্ষম। টাকা থাকলেও যেখানে খুশি সেখানে যেতে অপারগ মানুষ। রবীন্দ্রনাথ এমনটি চাননি। তিনি শুধু নগরের নয়, গ্রামীণ সমাজ ও অর্থনীতির উন্নতি চেয়েছিলেন। তিনি অমানবিক বৈষম্যপূর্ণ, কতিপয়ের উন্নয়নের বিরুদ্ধে ছিলেন। সামাজিক বন্ধনকে প্রাণের লক্ষণ মনে করে তিনি সবার জন্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশে মনোযোগী হয়েছিলেন।
ক্ষুধাকে নিবারণের ওপর তিনি খুব জোর দিয়েছিলেন। জমির উর্বরতা বাড়িয়ে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করে কৃষকের উন্নতির কথা তিনি খুবই জোর দিয়ে বলতেন। পাশাপাশি অকৃষি খাতের উন্নয়নের জন্য তিনি শ্রীনিকেতন গড়ে তুলেছিলেন। জীবনের জন্য শিক্ষার ওপর জোর দিতেন রবীন্দ্রনাথ। মাতৃভাষায় শিক্ষার পক্ষে ছিলেন তিনি। যা-ই শিখি না কেন, তা নারী ও পুরুষের সবার জন্য সমান তালে হতে হবে। নারীরা ঘর থেকে বের হয়ে শিক্ষার সুযোগ নিচ্ছে দেখে তিনি খুবই আনন্দিত হয়েছিলেন। তবে মনের পর্দা দূর করার জন্যও আধুনিক নারীশিক্ষার কথা তিনি খুব করে বলতেন। ‘পশ্চাতে রাখিছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে’ বলে বৈষম্য দূর করার ওপর জোর দিতেন। প্রতিটি গ্রাম এমন করে উন্নত করতে হবে যে তা যেন হয় স্বয়ংসম্পূর্ণ। সমাজ যেমন যুগে যুগে নিজেই স্বশাসিতভাবে চলে এসেছে, গ্রামগুলোকেও তিনি তেমন বিকেন্দ্রায়িত স্বশাসিত করার জন্য হিতৈষী সভা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। গ্রামে গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। গ্রামে গ্রামে পুকুর কেটে জলের কষ্ট দূর করার উদ্যোগ নিয়েছেন।
বিশ্বকবি ‘আমাদের’ ও ‘তাহাদের’ সভ্যতায় বিশ্বাসী ছিলেন না। তাঁর মতে, শিল্প সবার জন্য। গ্রামের মানুষের মধ্যেও শিল্প-সংস্কৃতির নানা উপায় তিনি খুঁজে পেতেন। তাঁর কাছে জীবন ও শিল্প আলাদা বিষয় ছিল না। লালন শাহের সংস্পর্শে এসে রবীন্দ্রনাথ বৃহৎ সংস্কৃতির সন্ধান পান। তাঁর গানে, নৃত্যে—পূর্ব-পশ্চিমের সুর ও তাল খুঁজে পেতে তাই অসুবিধা হয়নি। গ্রামের বাউলগান, যাত্রা এবং নগরের নৃত্যনাট্য তাঁর কাছে সমান গুরুত্ব বহন করত।
তিনি মনে করতেন মানুষের আনন্দ নিজের কিছু প্রাপ্তিতে নয়। সমগ্র সমাজ ও মানবতার জন্য কাজই আসল কাজ। মানবধর্মই আসল ধর্ম। সেই দৃষ্টিভঙ্গিতেই বলতে পারি, বর্তমানের এই করোনা সংকটকালে সারা বিশ্বকে একযোগে এই পৃথিবীকে বাঁচানোর চিন্তা করতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইচ্ছা করলেই সারা বিশ্বের মানুষের জন্য টিকা উৎপাদনের দুয়ার খুলে দিতে পারে। অন্যান্য উন্নত দেশও গরিব দেশগুলোর জন্য এগিয়ে আসতে পারে। কিন্তু সেই সর্বজনীনভাবে বিশ্বের সংকটকে নিজের সংকট হিসেবে এক রবীন্দ্রনাথই দেখতে পারতেন। তাই মৃত্যুর আগমুহূর্তেও সভ্যতার সংকট নিয়ে তিনি ভেবেছেন। বিশ্বকে আরো মানবিক ও পারস্পরিক বন্ধনে বাঁধতে চেয়েছিলেন। সে কারণেই বলা যায়, আজকের এই সংকটকালেও রবীন্দ্রনাথ খুবই প্রাসঙ্গিক।
সম্পর্কিত খবর

বই আলোচনা
মাশির হোসেন হিরু স্মারকগ্রন্থ বিস্মৃতি থেকে স্মৃতিতে

সাংবাদিক মাশির হোসেন, যিনি হিরু ডাকনামে অধিক পরিচিত। তাঁর আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী ও সুধীজনের কাছে তিনি স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। প্রায় দুই দশক পরেও তাঁরা তাঁকে ভুলে যাননি; মনে রেখেছেন। মুস্তাফা মজিদ সম্পাদিত ‘মাশির হোসেন হিরু স্মারকগ্রন্থ : বিস্মৃতি থেকে স্মৃতিতে’ তারই প্রমাণ।
মায়ানমারের ইয়াঙ্গুনে জন্মগ্রহণ করলেও তাঁর শৈশব কাটে ঢাকার আর্মানিটোলায়, পরবর্তীতে শান্তিনগরে। স্বাধীনচেতা মাশির হোসেন তাই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন সাংবাদিকতা। শুরু করেন স্পোর্টস রিপোর্টার হিসেবে। ভাষা আন্দোলনে ছিল তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ।
স্মারকগ্রন্থের সম্পাদক মুস্তাফা মজিদ বলেছেন, অন্য অনেক স্মারকগ্রন্থের মতো মাশির হোসেন হিরু স্মারকগ্রন্থও সাদামাটা, যা ভালোবাসার মানুষদের স্মৃতিচারণাই। যদিও কোনো কোনো বৃহৎ ঘটনার পুনরাবৃত্তি করেছেন কেউ কেউ, তা সত্ত্বেও তার ভেতরেই ফুটে উঠেছে এক অনন্য অকৃত্রিম দরদ এবং মাশির হোসেনের চরিত্রের নানা দিক, যা তাঁকে নতুন আলোয় উদ্ভাসিত করেছে বর্তমান প্রজন্মের মানুষদের মাঝে; বিশেষত সাংবাদিকতাজগতে যাঁরা এ প্রজন্মের, যাঁদের অনেকেই মাশির হোসেনকে ব্যক্তিগতভাবে দেখেননি এবং চেনেন না। তিনি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন এই গ্রন্থে যাঁরা লিখেছেন তাঁদের সবাইকে।
এই স্মারকগ্রন্থে লিখেছেন আমানউল্লাহ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, এরশাদ মজুমদার, আবুল কাসেম ফজলুল হক, মুহাম্মদ কামরুজ্জামান, মনোয়ার হোসেন, লুত্ফুর রহমান, সৈয়দ দীদার বখত, দীপা দত্ত (সেন), গোলাম তাহাবুর, ড. মাহবুব উদ্দীন চৌধুরী, ইকবাল সোবহান চৌধুরী, রফিকুর রহমান, কাজিম রেজা, আব্দুল আউয়াল ঠাকুর, এ কে এম মহসিন, এলাহী নেওয়াজ খান, আহমদ আখতার, কাজী রওনাক হোসেন, মমতাজ বিলকিস, মারুফ কামাল খান, খায়রুল আনোয়ার, সৈয়দ আবদাল আহমদ, ফজলুল বারী, মোস্তফা কামাল মজুমদার, শওকত মাহমুদ, বুলবুল আহমেদ, মাহমুদ শফিক, শওকত আনোয়ার প্রমুখ।
এ ছাড়া আছে মাশির হোসেন হিরুর লেখা, জীবনবৃত্তান্ত ও কিছু দুর্লভ আলোকচিত্র, যা এই গ্রন্থকে আরো আকর্ষণীয় করেছে। আশা করি, মাশির হোসেন হিরুকে জানতে স্মারকগ্রন্থটি নতুন প্রজন্মকে সাহায্য করবে।
রিহাম হাসান

পাঠকের প্রিয় বই
যেন কারো একান্ত গোপন চিঠির খাম খুলেছি
- তাওহীদাহ্ রহমান নূভ, বাংলা বিভাগ, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

চিঠিপত্র তো ব্যক্তিমানসের মুকুর। কেবল এই মুকুরকেই কাজে লাগিয়ে রচিত হতে পারে অনবদ্য কোনো উপন্যাস, এটা হয়তো বুদ্ধদেব গুহর আগে ভাবেননি কোনো কথাকার। শুধু আঙ্গিকেই নয়, বহু দিক থেকে নতুন মাত্রা যোগ করেছে ‘সবিনয় নিবেদন’ নামের চমৎকার এই উপন্যাস। শিক্ষিত, স্বাবলম্বী ও উদারমনা এক নারী ঋতার সঙ্গে বেতলার জঙ্গলে এক চরম বিপন্ন মুহূর্তে একঝলক দেখা হয়েছিল ঝকঝকে, ব্যক্তিত্ববান অফিসার রাজর্ষি বসুর।
‘সবিনয় নিবেদন’-এর মতো বই পড়া যেন এক ধরনের নীরব সাধনা। যেন কারো একান্ত গোপন চিঠির খাম আমি খুলে বসেছি, যার ভাঁজে ভাঁজে জমে আছে অভিমান, ব্যথা, অরণ্যের ঘ্রাণ আর অপ্রকাশিত ভালোবাসা।
প্রথম থেকেই মনে হয়েছে, উপন্যাস পড়ছি, না একটি রাগপ্রবণ, বেদনাঘন রাগিণী শুনছি। যেন এক পিয়ানো, যার কিছু চাবি বাজে না, কিছু অতিরিক্ত সুর তুলে দেয়। বুদ্ধদেব গুহর ভাষা এতটাই স্বচ্ছ ও জীবন্ত যে চরিত্রের চোখের জলও যেন স্পষ্ট অনুভব করা যায়।
প্রতিটি পৃষ্ঠা যেন একটি কুয়াশাময় সকাল—অস্পষ্ট, কিন্তু অনুভবে পরিপূর্ণ। সম্পর্ক এখানে নদীর মতো—প্রবহমান, বাঁক নেয়, স্রোতের নিচে পাথর লুকিয়ে থাকে। লেখকের অভিজ্ঞতা থেকে উঠে আসা অনুভবগুলো এমনভাবে বিন্যস্ত, যেন পাঠকের আত্মজগতে আয়না ধরে রাখা হয়েছে, যেখানে নিজের ভেতরের চেহারা ধরা পড়ে, যেটা আমরা অনেক সময় এড়িয়ে যাই। ভালোবাসার বর্ণনা এ উপন্যাসে কোনো একপেশে আবেগে সীমাবদ্ধ নয়।
গ্রন্থনা : পিন্টু রঞ্জন অর্ক

বিশ্বসাহিত্য
জার্মান লেখক সেবাস্টিয়ান হাফনারের উপন্যাসের চমক

সম্প্রতি প্রকাশ করা হয়েছে জার্মান সাংবাদিক, ইতিহাসবিদ ও লেখক সেবাস্টিয়ান হাফনারের উপন্যাস ‘আবসিড’ বা ‘বিদায়’। হাফনারের জন্ম ১৯০৭ সালে, মারা যান ১৯৯৯ সালে। ‘আবসিড’ বা ‘বিদায়’ নামের উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় প্রয়াত লেখকের ড্রয়ার থেকে। উপন্যাসটি লেখা হয় ১৯৩২ সালের ১৮ অক্টোবর থেকে ২৩ নভেম্বরের মধ্যে।
এ বছর এ উপন্যাস প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে জনপ্রিয় হওয়ার কারণ হলো, এখানে ইতিহাসের খুব কঠিন সময়ের সাদামাটা জীবনের গল্প বলা হয়েছে।
ফাহমিদা দ্যুতি

এক ঘণ্টা
- জামান আখতার

রাত সাড়ে আটটায় ঢাকা শহরের সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায় সরকারি আদেশমতো।
সিটি শপিং মলের আটতলার সব দোকান আটটায় দ্রুত বন্ধ করে দিচ্ছে। ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই লিফট-সিঁড়ি বেয়ে নেমে শপিং মল ত্যাগ করছে। গ্রাউন্ড ফ্লোরে সিকিউরিটি গেটে সবার চলে যাওয়ায় সহযোগিতা করছে।
রাত সাড়ে আটটা বাজার কিছুক্ষণ আগে ছয়তলা থেকে হন্তদন্ত হয়ে মাস্ক পরা এক স্মার্ট যুবক আশিক লিফটে চড়ে ডোর ক্লোজ বাটন টিপে ঘুরে দাঁড়াল। দেখল, লিফটের কোনায় কিছু শপিং ব্যাগ হাতে একটু ঘুরে দাঁড়ানো সালোয়ার-কামিজ হিজাব-নেকাব পরা এক যুবতি।
লিফট নিচে নামতেই সহসা একটা শব্দ করে থেমে গেল।
: কী হলো?
অস্ফুট স্বরে আশিক বলল—
: কারেন্ট চলে গেল।
: লোডশেডিং!
: ভয় পাবেন না। জেনারেটর ছাড়লেই লিফট চলবে।
সিঁড়ি বেয়ে সবাই নেমে শপিং মল ত্যাগ করল। মার্কেট শূন্য। শুধু অন্ধকার লিফটের ভেতরে আটকা পড়ে আছে আশিক আর একটি রক্ষণশীল নারী।
আশিক তার মাস্ক খুলে মোবাইলের লাইট অন করল। বেশ আলোকিত হলো লিফট।
: হ্যালো। হ্যালো লিফটম্যান। হ্যালো হ্যালো।
আশিক ইন্টারকম বক্সে কারো কোনো সাড়াশব্দ পেল না। সিকিউরটি রমিজ শপিং মলের আন্ডারগ্রাউন্ড কার পার্কিং থেকে একজনের গাড়ি বিদায় করছে। লিফটে বন্দি আশিক চিৎকার করে বলছে—
: কে আছ, লিফটের দরজা খোলো। আমরা আটকা পড়েছি।
সিকিউরিটির কানে তখনো আওয়াজ পৌঁছেনি। আশিক লিফটের দরজায় ডান হাতে অনবরত ঘুষি মারছে আর বলছে—
: আমরা লিফটে আটকা পড়েছি। কে আছ, জেনারেটর চালু করো। নয়তো লিফট ভেঙে ফেলব। ভেঙেই ফেলব।
আশিকের এই আর্তচিৎকারে বিমর্ষ মেয়েটি। সিকিউরিটির কানে আওয়াজ পৌঁছল। দ্রুত সিকিউরিটি লিফট ইন্টারকম বাটন টিপে বলে—
স্যার স্যার, আমি মার্কেট সিকিউরিটি রমিজ।
: তোমাদের লিফটম্যানকে বলো জেনারেটর চালু করতে।
: স্যার, লিফটম্যান করিম ভাই তো সন্ধ্যাবেলা বাইত চইলা গেছে।
: তুমি তাড়াতাড়ি জেনারেটর চালু করো।
: কেমনে চালু করুম স্যার, সারা দিন তিনবার কারেন্ট গেছে। জেনারেটরে তেল নাই।
: লিফটের চাবি নিয়ে, তুমি লিফট ফ্লোর লেভেলে এনে দরজা খুলে আমাদের দুজনকে বের করো।
: স্যার লিফটের চাবি তো লিফটম্যান করিম ভাইয়ের কাছে থাকে। যাইবার সময় কইলো, মার্কেট বন্ধ হইলে লিফটের কারেন্ট পাওয়ার যেন আমি অফ কইরা দেই।
তোমার করিম ভাইকে ফোন করে লিফটের চাবি নিয়ে আসতে বলো।
: আইচ্ছা, ফোন দিতাছি স্যার। চিন্তা কইরেন না।
আশিক লক্ষ করল, মেয়েটি গরমে ঘামছে। আশিক একা মনেই বলল—
: উহ্! এই গরমে টিকব কী করে?
মেয়েটি আঁতকে উঠল—
: অ্যাঁ! তাহলে?
লিফটের ইন্টারকম বেজে উঠল। আশিক দ্রুত ঘুরে তাকল লিফটের সাউন্ড বক্সের দিকে।
: হ্যাঁ, করিম মিয়া আসছে তো?
সিকিউরিটি রমিজ বলল—
: না স্যার। ম্যালা চেষ্টা করলাম, করিম ভাইয়ের মোবাইল বন্ধ।
আশিক উদ্বিগ্ন স্বরে বলল—
: হোয়াট!
শব্দ শুনে মেয়েটি আচমকা বলে উঠল—
: হায় আল্লাহ, এখন উপায়!
রমিজ মিয়া বলল—
আল্লাহ ভরসা। এক ঘণ্টার মধ্যেই কারেন্ট চইলা আসবো। তার পরেও আমি বিদ্যুৎ অফিসে খবর লইতাছি।
আশিকের মোবাইল আলোয় কী অদ্ভুত ঐন্দ্রজালিক অন্ধকার লিফটের চার দেয়ালের ভেতরে চৈত্রদাহে পুড়ছে, দুজন অচেনা-অজানা লিফটযাত্রী।
এক ঘণ্টার লোডশেডিং হলে বিদ্যুৎ আসতে এখনো চল্লিশ মিনিট বাকি। কতক্ষণ আর লিফটে দাঁড়িয়ে থাকা যায়। মেয়েটি শপিং ব্যাগগুলো নিয়ে লিফটে বসে পড়ল। আশিকও বসে লম্বা করে পা মেলে দিল। আশিক লক্ষ করল, মেয়েটি শপিং ব্যাগ থেকে একটি পণ্যের প্যাকেট বোর্ড ছিঁড়ে হাতপাখা করে বাতাস তুলে নিচ্ছে তার গায়ে। গরমে হিজাব-নেকাব ভিজে একাকার। আশিক তার কাঁধে ঝোলানো লেদার সাইড ব্যাগ থেকে মিনারেল ওয়াটারের বোতলটা বের করে মেয়েটির দিকে এগিয়ে দিল। মেয়েটি হাত বাড়িয়ে দিয়ে, কী যেন ভেবে হাতটা সরিয়ে নিল। আশিক ব্যাপারটা বুঝে বোতলের কক খুলে সামান্য পানি নিজে মুখে ঢেলে নিল। মেয়েটির মনে যেন একটা বিশ্বস্ততা ফুটে উঠল অজানা আশিকের প্রতি। এবার মেয়েটি হাত বাড়িয়ে মিনারেল বোতলটি ধরতেই চমকে উঠল, আশিকের হাতের আঙুল ফেটে তরতর করে রক্ত ঝরে পড়ছে। মেয়েটি পানির বোতলটা নিয়ে লিফটের ফ্লোরে রেখে দ্রুত তার মুখে আবৃত সাদা নেকাবটা টান দিয়ে খুলে আশিকের রক্ত ঝরা আঙুলে পেঁচিয়ে দিতে উদ্যত হলে আশিক হাত সরিয়ে নিয়ে খুব বিনয়ের সুরে বলে—
: য়ু হু। আগে আপনার গলাটা ভিজিয়ে নিন।
মেয়েটি বোতল তুলে ঢকঢক করে পানি খেয়ে নেকাব দিয়ে আশিকের রক্ত ঝরা আঙুল পেঁচিয়ে বেঁধে দিল। আশিক এক অনন্যা অপ্সরী সুন্দরী নারীর রূপে অভিভূত হলো।। সহসা একটা নিষ্পাপ সুন্দর যেন আশিকের মনকে এই বন্দিত্বের কথা ভুলিয়ে দিল। মেয়েটিকে বলল—
: আমি আশিক। আপনি?
: নাজমা!
: তো, এত প্যাকেট, কী শপিং করলেন?
: গায়েহলুদের কিছু সামগ্রী।
: ও! আপনার গায়েহলুদ?
: জি না। ছোট বোন সূচনার কাল হলুদসন্ধ্যা।
: তো, সাথে কেউ আসেনি?
: বাবা নেই। মা বুড়ো মানুষ!
: সূচনা?
: সামান্য ক’টা আইটেম, ভাবলাম একাই পারব।
: আপনার হাজব্যান্ড?
: জি!
নাজমা আঁতকে উঠল। আশিক বলল—
: চমকে উঠলেন যে!
: এমনি।
: না...বলছিলাম, ছোট বোনের বিয়ে, আপনার হাজব্যান্ডকে নিয়ে...
: নেই।
: নেই, মানে ছোট বোনকে বিয়ে দিয়ে তারপর...
: বিয়ে, ঘর-সংসার—এসব নিয়ে আর ভাবছি না।
: কেন?
: ব্যাপারটা কোথায় যেন একটু কমপ্লিকেটেড মনে হচ্ছে। তাহলে কি আপনার হাজব্যান্ড...
: ছিল।
: তো, এখন উনি...
আশিক লক্ষ করল, নাজমার চোখ ভিজে যাচ্ছে। যেন জীবনের কোনো একটা অতৃপ্ত গল্প লুকানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। সহসা আশিকের মোবাইল বেজে উঠল। রিসিভ করল—
: হ্যালো, মা। এইতো একটা জায়গায়। কারেন্ট এলেই চলে আসব। জি। জি মা।
আশিক মোবাইল বন্ধ করল—
: বিপদে আছেন, মাকে বুঝতে না দিয়ে ভালোই করেছেন। আমার মা আর সূচনা হয়তো আমাকে ফোন দিয়ে পাচ্ছে না।
: সঙ্গে মোবাইল আনেননি।
: চার্জ নেই।