লোবুচেতে ইন্টারনেট সংযোগ পাওয়া মাত্র কভিডবিষয়ক দুটি খবর আমাকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। প্রথমটা হলো, এভারেস্ট শীর্ষে ওঠার পারমিট দেওয়া বন্ধ হয়েছে সেদিন থেকে। তবে ইবিসি ট্রেকিং চলছে। বহু ট্রেকার আমাদের সঙ্গে আছে এই অঞ্চলে।
যেখানে হিমালয়, যেখানে এভারেস্ট ৬
তুষার যেখানে হিমবাহে মেশে
ইফতেখারুল ইসলাম

আমাদের চা শেষ হলে অক্সিমিটার বের করে তেজ।
আমাদের রাতের খাবার চলে আসে সময়মতো। তারপর খাবার আসে অন্য কয়েকজন অতিথির।
ঘুমুতে যাই। আমি স্লিপিং ব্যাগের ভেতরে ঢুকে তার ওপর আরো একটা কম্বল টেনে নিই।
সারা রাত তুষার ঝরে অবিরাম। মধ্যরাতের পর ঘুম ভেঙে গেলে আমি মাঝে মাঝে উঠে জানালার কাছে দাঁড়াই। বাইরে ধূসর অন্ধকার। বাতাসের দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না। আবার ঘুমিয়ে পড়ি। একটু পরেই আবার উঠি জেগে। শেষরাতে জানালার পর্দা সরাতেই মনে হয় এখনো ঘুমিয়ে আছি, আর স্বপ্ন দেখছি। শুভ্র তুষারে ঢেকে গেছে চারপাশ। সামনের পাহাড়গুলোও ঢেকে আছে তুষারে। অদ্ভুত মায়াময় চাঁদ তখনো রুপালি আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে এক টুকরো স্বর্গ হঠাৎ করে পৃথিবীতে নেমে পড়েছে। মনে হয় অনন্তকাল ধরে তাকিয়ে থাকি। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাইরে অস্পষ্ট আলোর রেখা দেখে বুঝতে পারি ভোর হয়ে এলো, সুন্দর একটা দিন শুরু হতে চলেছে। এই ট্রেকে যারা এসেছি, তাদের সবার জন্য আজ একটা বিশেষ দিন। স্বপ্ন পূরণের দিন। সেই উত্তেজনার সঙ্গে মিলেছে পাঁচ হাজার মিটারের উচ্চতাজনিত চাপ। ইবিসির উত্তেজনা আজ আমাদের কাউকেই সারা রাত ঘুমুতে দেয়নি ঠিকভাবে। ভোর হওয়ার অনেক আগেই সবার ঘুম ভেঙে যায়।
আজ ২০ মার্চ। সময়মতো ট্রেকিং শুরু করতে হবেই। পথে নামার প্রস্তুতি মানে শুধু পোশাক পরা আর নাশতা খাওয়াই নয়। রাতে ও ভোরে ব্যবহৃত প্রতিটি জিনিস অল্প সময়ের মধ্যে নিজ ব্যাগে ভরে ফেলার কাজটাও রীতিমতো কঠিন। যথাসম্ভব দ্রুত তৈরি হয়ে নাশতার টেবিলে যাই। কী খাব তা আগেই বলা থাকে। খাবার শেষ করতে সময় লাগে না। তারপর কফি নিয়ে বসেছি। তেজ তার অক্সিমিটার নিয়ে আসে। আমার পালস আর অক্সিজেন আগের মতোই, ঠিক আছে। আর নিম্নির পালস কমে হয়েছে ৬৯, অক্সিজেন বেড়ে ৮৩ শতাংশ। বাহ। সকালটা প্রসন্ন হয়ে ওঠে। আগের দিনের ক্লান্তি আর উদ্বেগ কোথায় হারিয়ে যায়। আমরা দ্রুত কফি শেষ করে বেরিয়ে পড়ি পথে।
প্রথম গন্তব্য গোরাকশেপ। তেজ আগের রাতেই বলে দিয়েছে আজকের পোশাক কী হবে। ডাউন জ্যাকেট অর্থাৎ হাঁসের পালক দিয়ে ভরা সবচেয়ে ভারী গরম জ্যাকেটটা পরে নিই। উইন্ড জ্যাকেট ব্যাকপ্যাকে রাখি, যেকোনো সময় লাগতে পারে। হাতে পুরু দুই স্তরের এক জোড়া নতুন গ্লাভস। সেই গ্লাভস পরে হাঁটতে শুরু করে একটু পরেই আমার দুই হাতে অসম্ভব ঠাণ্ডা লাগে। কানাডার শীতের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। কিন্তু এখানকার অভিজ্ঞতা আরো ভয়াবহ। আঙুলগুলোতে প্রথমে অনুভব করি তীব্র ব্যথা। তারপর একসময় ব্যথার অনুভূতি কমে গিয়ে আঙুলগুলো নিঃসাড় হয়ে আসে। একটু ভয় পাই। কয়েক মিনিট পর আর সহ্য করতে পারি না। তেজকে বলতেই হয়। তেজ এসে গ্লাভস খুলে আমার হাত তার দুই হাতের মধ্যে নিয়ে ঘষে ঘষে তাতে উষ্ণতা আনার চেষ্টা করে। তাতে কিছুটা কাজ হয়। আবার গ্লাভস পরে নিয়ে হাঁটতে শুরু করি।
সারা রাত তুষার পড়ে লজের সামনের রাস্তা পুরো সাদা হয়ে আছে। তার ওপর দিয়ে হেঁটে যাই। আমাদের আশপাশের নিচু পাহাড় আর তার ওপারের উঁচু পর্বতশিখর—সব পবিত্র শুভ্রতায় ঢাকা। এক ঘণ্টারও বেশি সময় ওই তুষারঢাকা পাথুরে পথের ওপর দিয়ে ট্রেকিং করে চলার পর একটা চড়াইয়ের দিকে এঁকেবেঁকে উঠে যায় আমাদের পথ। চারদিক তুষারঢাকা হলে কী হবে, রোদের তীব্রতা আর হাঁটার পরিশ্রমের কারণে গরম লাগতে শুরু করে। ডাউন জ্যাকেট খুলে আবার পরে নিই উইন্ডপ্রুফ জ্যাকেট। নিচে অন্যান্য স্তর তো আছেই। সেই সঙ্গে আজ পরেছি বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের বিশ্বকাপ খেলার জার্সি। আমার মেয়ে বারবার বলে দিয়েছে বলেই ওটা সঙ্গে এনেছি। আজ সেটা পরবার দিন।
এরপর পুরো পথ আমরা হাঁটি খুমবু গ্লেসিয়ারের কিনার ঘেঁষে। হিমবাহর বয়ে আনা পাথরের ওপর দিয়ে হাঁটি। কখনো হিমবাহের বরফের ওপর দিয়ে হাঁটি। হিমালয়ের বিভিন্ন শৈলশিখরের কাছাকাছি থাকা হিমবাহের কথা শুধু শুনেই এসেছি এতকাল। এর ওপর দিয়ে হাঁটা যায় আর আমি নিজেই কখনো হাঁটব সে কথা কোনো দিন ভাবিনি। এ এক অনন্য অভিজ্ঞতা। ভাবতেই আমার অবসন্ন শরীরে নতুন দোলা লাগে। এরই নাম উদ্দীপনা?
দূর থেকে আমরা যখন অনেক উঁচুতে কোনো তুষারঢাকা সাদা পাহাড় দেখি তখন খুব আনন্দ হয়। সেই মোহনীয় দৃশ্যের ছবি তুলে রাখি আমরা। আর এখন আমরা নিজেরাই সেই সাদা পাহাড়ে হেঁটে বেড়াচ্ছি। নিচের কোনো উপত্যকা থেকে যে কেউ আমাদের দেখতে পাবে দূর পাহাড়ের গায়ে অনেকখানি উঁচুতে কোনো পর্বত অভিযাত্রীর মতো। পাহাড়ের গায়ে পিঠ রেখে দাঁড়িয়ে বড় আনন্দ হয়। সাদা পাহাড়কে দুই হাতে ছুঁয়ে সেই অনুভূতি আর ভালোবাসা জানাতে ইচ্ছা করে। এই বিশালতার কেন্দ্রভূমিতে এসে নিজেকে অনেক ছোট, অনেক সামান্য মনে হয়। আবার বড়র সংস্পর্শে এসে নিজেরও বড় ও উদার হয়ে উঠতে ইচ্ছা করে। এরই মধ্যে হঠাৎ তেজ আমাদের ডেকে তার ডান দিকে হাত বাড়িয়ে বলে সি, দেয়ার ইজ এন এভালাঞ্চ।
অদূরে একসঙ্গে অনেক বজগ্লসিয়ারের অপর পারে তুষারঢাকা পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে দেখি ভেঙে গড়িয়ে পড়ছে সাদা বরফের স্তূপ। অনেকখানি জায়গা জুড়ে তুষারকণা ছড়িয়ে সাদা ধোঁয়ার মতো তৈরি হয়েছে। এত কাছে একটা বরফধসের দৃশ্য দেখতে পাব, এটা আমি আশাই করিনি। ধীরে ধীরে সেটা কমে আসে। যেমন হঠাৎ শুরু হয়েছিল তেমনি সেটা থেমেও যায়।
সকাল ১১টার দিকে আমরা পৌঁছে যাই গোরাকশেপে। দূর থেকে কয়েকটি বাড়িঘর দেখা যায়। সব তুষারঢাকা। আমরা এখন চারদিকের পর্বতশিখরের খুব কাছে। এখানকার লজগুলো তুষারঢাকা পর্বতের ঠিক পায়ের কাছে। লজ থেকে এত কাছে পর্বতশিখর এর আগে কোথাও দেখিনি। একটা ছোট্ট ঘরের গায়ে ওয়েলকাম টু গোরাকশেপ লেখা সাইনবোর্ড। এ জায়গাটা পাঁচ হাজার ১৯০ মিটার উঁচুতে। গোরাকশেপে থাকার ব্যবস্থা এভারেস্ট ইন লজে। ওই দিকে হাঁটার সময় তেজের সঙ্গে কথা বলে বুঝে নিই, ওখানে পানির কোনো উৎস নেই। তার ফলে কিছু বাস্তব অসুবিধার সম্মুখীন হব, সেটা মেনে এবং মানিয়ে নিতে হবে আমাদের।
হিমালয়ের বিভিন্ন যাত্রাপথ সম্পর্কে আমার প্রথম ধারণাটি তৈরি হয়েছে ছেলেবেলায়। উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় আর নবনীতা দেবসেনের বই পড়ে। তখন ইবিসির পথ ছিল একটা তীর্থযাত্রার মতো। তখন ট্রেকিং ছিল প্রকৃত অ্যাডভেঞ্চার। বই পড়ে মনে হতো পাহাড়ের পথে-প্রান্তরে যাত্রা মানেই কিছু ত্যাগ ও কিছু কষ্ট স্বীকার করে একটা দুর্গম পারাবার পার হয়ে স্বপ্নের কোনো স্বর্ণশিখরে পৌঁছানোর মতো মধুর একটা বিষয়। এখন সুযোগ-সুবিধা অনেক বেড়েছে।
লজে পৌঁছার একটু পরই দুপুরের খাবার আসে। খাব কিভাবে? অল্প একটু পথ বাকি। আমি এমনিতেই এই স্বপ্নযাত্রা নিয়ে খুব অধীর আর আকুল হয়ে আছি। বালকের মতো সেই চঞ্চলতা। দুপুরে কী খেয়েছি, কতটুকু খেয়েছি এখন কিছুই মনে পড়ে না। একরাজ আর তিলক ডাল-ভাত-সবজি খায়। ডাল-ভাত খাওয়ার সময় ওরা প্রায়ই বলে, ডাল-ভাত পাওয়ার। এই নিয়ে ওরা সবাই দল বেঁধে হাসাহাসি করে। ডাল-ভাত এদের প্রধান খাদ্য বলেই প্রবচনটি তৈরি হয়েছে। তিলক আর একাকে বলতে শুনি, ডাল-ভাত পাওয়ার টোয়েন্টিফোর আওয়ার্স। এই প্রবচন হিমালয় এলাকায় ব্যাপক জনপ্রিয়।
সম্পর্কিত খবর

পিয়াস মজিদ
খুচরা আষাঢ়

আসকাল আজ
মেঘের মনের গায়ে
কেউ কাক
চুপচাপ।
ভিজে যেতে চেয়ে আমি
বহুকালের শুকনো সরোদ;
বাজনারা ঝরে গিয়ে
পাহাড়ের চুল চুইয়ে।
আকাশ বাজারের ব্যাগ হাতে ফিরবে ঘরে।
কেনাবেচার রিমঝিম শব্দে বধির মাটিতে
থেকে থেকে ঠিক তোমার মতো
প্রয়াত জ্বরেদের স্মৃতি মনে আসে!
।
নাসির আহমেদ
পাঁচটি আঙুল

কিছুই বলোনি, শুধু রুপালি আঙুল, নখ-ছবি
পাঠিয়ে দিয়েছ এই লেখার সম্মানে। মুগ্ধ কবি!
অনামিকা থেকে কনিষ্ঠায় দ্যুতিময় রাঙা হাত
হঠাৎ জানাল যেন প্রথম দিনের সুপ্রভাত!
তীব্র, তীক্ষ এই মুগ্ধ মৌন অনুভব
কতটা প্রকাশযোগ্য! ভাষায় কতটা তাকে ধারণ সম্ভব!
বর্ষার বৃষ্টির মতো রুপালি সৌন্দর্যে রিমঝিম
সবুজ পাতায় জ্বলে পাঁচটি আঙুল। ব্যাখ্যাও সম্ভব নয় কবিতার থিম।
।

দিলারা মেসবাহ
পাথরে ফুটুক ফুল

তুমি সেই প্রত্নপাথর!
মরমি সান্নিধ্যের সাধন ভজন
‘সুপ্রভাত’ বলার সাধুবাদ, শেখোনি কস্মিন।
তুমি এক অচিন পাথর
দেখো আজ অনামিকায় ওপাল ঝলক
খোঁপায় তারার ফুল!
তুমি সেই অন্ধ পাথর।
দেখো আজ জোড়া চোখ বিহ্বল বিজন
অপার মায়ার বশে বেদনাবিধুর।
তুমি সেই নির্বোধ পাথর,
শুনলে না কলকণ্ঠ পাখির গোপন।
তুমি এক পাইথন শীতনিদ্রা স্বভাব
তুমি সেই প্রত্নপাথর।
খোলস খসাও—
দেখাও ফণার সার্কাস!
চেয়ে দেখো হাত দুটো বিজন ব্যাকুল
জেগে ওঠো, পাথরে ফোটাও ফুল।

প্রদর্শনী
গ্যালারি কায়ায় মাস্টার শিল্পীদের কাজ
- মোহাম্মদ আসাদ

গ্যালারি কায়া মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে ২১ বছর ধরে। প্রতিনিয়ত উপহার দিচ্ছে বৈচিত্র্যময় শিল্পকলা প্রদর্শনীর। প্রায় আট দশকের দেশের শিল্পকলার সংগ্রহ নিয়ে এবারের প্রদর্শনী। দেশের চারুকলা শিক্ষার শুরুটা হয় ১৯৪৮ সালে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের হাত ধরে।
ঈদমেলা থেকে বাড়ি ফেরা। শিল্পী : মুর্তজা বশীর
আরো আছে সমরজিৎ রায়চৌধুরী, হাশেম খান, রফিকুন নবী, হামিদুজ্জামান খান, আবদুস শাকুর শাহ, মাহমুদুল হক, আবুল বারক আলভী, মোহাম্মদ ইউনুস, জামাল আহমেদ, চন্দ্র শেখর দে, মোস্তাফিজুল হক, রণজিৎ দাস, রতন মজুমদার, ফরিদা জামান, কনক চাঁপা চাকমা, শেখ আফজাল, আহমেদ শামসুদ্দোহা, শিশির ভট্টাচার্য্য, মোহাম্মদ ইকবাল, গৌতম চক্রবর্তীর মতো গুরুত্বপূর্ণ শিল্পীদের কাজ। প্রদর্শনীতে রয়েছে প্রতিশ্রতিশীল শিল্পীদের কাজও। গৌতম চক্রবর্তী গ্যালারিটির প্রতিষ্ঠাতা।
প্রদর্শনীতে গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ মুর্তজা বশীরের ‘ঈদমেলা থেকে বাড়ি ফেরা’। ১৯৫৬ সালে তিনি এই ছবিটি এঁকেছেন ছাত্রজীবনে। রাজধানীর চকবাজারের ঈদমেলার ঐতিহ্য আছে।
কামরুল হাসানের প্রিন্ট দুটি দেখে ভালো লাগবে। কাইয়ুম চৌধুরীর একটি মিছিলের ছবি। ব্যানারে লেখা ‘নিপাত যাক’। কাজী আবদুল বাসেতের দুই বৃদ্ধার গল্প বলা। এই প্রদর্শনীতে একটি কাজ আছে মাহমুদুল হকের। মাহমুদুল হক গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী। তিনি জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ২০২২ সালে তিনি নীরবে চলে যান আমাদের ছেড়ে।
২১ বছরের গ্যালারি কায়া দেখাচ্ছে প্রায় আট দশকের শিল্পকলা ইতিহাস। এই গুরুত্বপূর্ণ প্রদর্শনীতে শিল্পাচার্যের একটি কাজ থাকলে ষোলো কলা পূর্ণ হতো। আবার যা আছে তা-ও কম কিসের। প্রদর্শনী চলবে ১২ জুলাই পর্যন্ত।