চারিদিকে ধু ধু মাঠ খররৌদ্রে যেন নাচছে... চকচকে বালিরাশি রোদ ফিরিয়ে দিচ্ছে... অসহ্য পিপাসায় তিনি চোখে ধোঁয়া-ধোঁয়া দেখতে লাগলেন। মনে হতে লাগলো—একটু ঘন সবুজ মতো কোনো পাতাও যদি পাই তাহলে চুষি...’
এই বিবরণ থেকেই বোঝা যাচ্ছে—এ কোনো আনন্দভ্রমণ নয়; শখ করে নয়, ভালোবেসেও নয়, নিতান্তই প্রয়োজনে তাকে যেতে হচ্ছে। নবাবগঞ্জ থেকে রতনপুর পর্যন্ত সাড়ে চার ক্রোশ (প্রায় ৯ মাইল বা ১৫ কিলোমিটার) পথ তাঁকে যেতে হবে, যে পথ বৃক্ষছায়াহীন, জলহীন, জনমানবহীন। প্রচণ্ড গরমে আর তৃষ্ণায় অস্থির হয়ে তিনি শুধু জলের কথাই ভাবতে লাগলেন। কে না জানে, একবার যদি তৃষ্ণা পায় এবং তা মেটাবার মতো জল যদি না থাকে, তাহলে তৃষ্ণা শুধু বেড়েই চলে। তার তৃষ্ণাও বেড়ে চলল; কিন্তু ফিরে যাওয়ারও উপায় নেই, অনেকটা পথ যে চলে এসেছেন! ক্লান্ত-শ্রান্ত-বিধ্বস্ত অবস্থায় শুধু মনের জোরে পথ চলতে চলতে অনেক দূরে একটা বটগাছ দেখে তাঁর মনে একটা পুকুর থাকার সম্ভাবনা নিদেনপক্ষে গাছের ছায়াটুকুর আশ্রয় কাম্য হয়ে উঠল। একসময় তিনি বটগাছের কাছে পৌঁছে দেখলেন, সেখানে একটা জলসত্র—‘চার-পাঁচটা নূতন জালায় জল, এক পাশে একরাশি কচি ডাব! এক ধামা ভিজে ছোলা, একটা বড় জায়গায় অনেকটা নতুন আখের গুড়, একটা ছোট ধামায় আধধামা বাতাসা!’ রৌদ্রদগ্ধ ধু ধু প্রান্তরে এ রকম চমৎকার ব্যবস্থা থাকবে কেন ভেবে হয়তো অবাক হবেন এ-কালের পাঠকরা; কিন্তু তখনকার দিনে পথচারীদের সেবায় কোনো কোনো মহত্প্রাণ সচ্ছল ব্যক্তি এ রকম আয়োজন করে রাখতেন। তো, জলসত্রের স্বেচ্ছাসেবীরা ব্রাহ্মণকে যথেষ্ট খাতির করল, জানাল—‘ভালো সন্দেশ আছে ব্রাহ্মণদের জন্যে আনা, সেবা করে একটু জল খান, এই রোদে এখন আর যাবেন না—বেলা পড়ুক।’ কিন্তু তিনি যে ব্রাহ্মণ, যেখানে-সেখানে তো খেতে পারেন না! জাতপাতের একটা ব্যাপার তো আছে! তৃষ্ণাকাতর হয়েও তিনি জিজ্ঞেস করে জেনে নিলেন—এ জলসত্র যাঁরা প্রতিষ্ঠা করেছেন তাঁরা বংশে ‘বিশ্বেস’ আর জাতে ‘কলু’। ব্রাহ্মণ দমে গেলেন—‘সর্বনাশ! নতুন মাটির জালাভর্তি জল ও কচি ডাবের রাশি দেখে পিপাসার্ত শিরোমণি মশায় যে আনন্দ অনুভব করেছিলেন, তা তাঁর একমুহূর্তে কর্পূরের মতো উবে গেল। কলুর দেওয়া জলসত্রে তিনি কি করে জল খাবেন? তিনি নিজে এবং তাঁর বংশে চিরদিন অশূদ্রে প্রতিগ্রাহী; আজ কি তিনি—ওঃ!’
পিপাসায় একটু আগেই যিনি মরতে বসেছিলেন তাঁর জন্য এই চিন্তা কি স্বাভাবিক? আমাদের ‘আধুনিক’ চোখে স্বাভাবিক মনে না হলেও তখনকার দিনে স্বাভাবিকই ছিল। জাতপাতের ভেদাভেদ, ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদ, এমনকি ছোঁয়াছুঁয়ির ঝামেলায় এ অঞ্চলে অনেক রক্তপাতও হয়েছে, সে কথা ভুলে গেলে চলবে না। আর কথাসাহিত্যের একটা বড় কাজ—গল্প বলার ছলে সমকালীন বাস্তবতা আর সামাজিক ইতিহাসকে ধরে রাখা। এখানেও সেটিই ঘটেছে। তো, ব্রাহ্মণ জলপান থেকে বিরত থেকে জলসত্র প্রতিষ্ঠার গল্প শুনতে লাগলেন। তারাচাঁদ বিশ্বাস যখন ছোট তখন তার বাপ মারা যায়, একটা ছোট বোন ছাড়া তার কেউ ছিল না। বাজারে এটা-ওটা বিক্রি করে তাদের সংসার চলত। এক ‘বোশেখ মাসের মাঝামাঝি তারাচাঁদ ছোট বোনকে নিয়ে নবাবগঞ্জের বাজারে তালশাঁস বিক্রি করতে গিয়েছিল।’ ফেরার সময় সে আর বোন সেই অবস্থায় পড়েছিল, একটু আগে ব্রাহ্মণ যে অবস্থা পেরিয়ে এসেছেন। ছোট্ট বোনটি তৃষ্ণায় কাতর হয়ে এলিয়ে পড়েছিল, এই বটগাছের তলায় তখন কোনো জলসত্র ছিল না, বোনকে তবু এখানে রেখে আধক্রোশ দূরে কৈবর্তপাড়া থেকে এক ঘটি জল এনে দেখে, বোনটা মরে পড়ে আছে, তার মুখে একটা কচুর ডগা! তেষ্টায় যন্ত্রণায় মেয়েটা বুনো কচুর ডগা মুখে করে তার রস চুষেছিল।
তারাচাঁদ বিশ্বাস পরে অবস্থাপন্ন হয়েছিল আর তার বোন স্বপ্নে দেখা দিয়ে এই বটগাছতলায় জলসত্র প্রতিষ্ঠা করতে বলেছিল। স্বেচ্ছাসেবীরা বলতে থাকে : ... এমনও শুনেছি যে মাঠের মধ্যে জলতেষ্টায় বেঘোরে পড়ে ঘুরপাক খাচ্ছে, এমন লোক নাকি কেউ কেউ দেখেছে একটা ছোট মেয়ে মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে বলছে, ‘ওগো আমি জল দেব, তুমি আমার সঙ্গে এসো।’
গল্প শুনতে শুনতে ব্রাহ্মণ দেখতে লাগলেন, ধর্ম-বর্ণ-বয়স-পেশা-নির্বিশেষে কত লোক এই জলসত্রে এসে জল খাচ্ছে, ডাব খাচ্ছে, ছোলা-গুড়-বাতাসা খাচ্ছে! যেন এক অদৃশ্য স্নেহময়ী তার মমতা আঁচল বিছিয়ে দিয়েছে এখানে, রৌদ্রদগ্ধ মানুষের শান্তির জন্য। তাঁর মন দ্রবীভূত হয়ে গেল। মনে হলো : ‘বিশ বছর আগে, তাঁর আট বছরের পাগলি মেয়ে উমার মতোই ছোট একটি মেয়ে এই বটতলায় অসহ্য পিপাসায় জল অভাবে বুনো কচুর ডাঁটার কচু রস চুষেছিল, আজ তারই স্নেহ করুণা এই বিরাট বটগাছটার নিবিড় ডালপালায় বেড়ে উঠে এই জলকষ্টপীড়িত পল্লী-প্রান্তরের একধারে পিপাসার্ত পথিকদের আশ্রয় তৈরি করেছে। এরই তলায় আজ বিশ বছর ধরে সে মঙ্গলরূপিণী জগদ্ধাত্রীর মতো দশ হাত বাড়িয়ে প্রতি নিদাঘ-মধ্যাহ্নে কত পিপাসাতুর পল্লী-পথিককে জল জোগাচ্ছে।... তার পৃথিবীর বালিকাজীবনের ইতিহাস সে ভোলেনি।’
নিজের কন্যার কথা মনে পড়ায় বাৎসল্যরস-স্নেহ-মমতা-ভালোবাসায় ছেয়ে গেল ব্রাহ্মণের মন; অতঃপর, যে-লোকটা জল দিচ্ছিল, শিরোমণি মশায় তাকে বললেন, ‘ওহে বাপু, তোমার ওই বড়ো ঘটিটা বেশ করে মেজে এক ঘটি জল আমায় দাও, আর ইয়ে, ব্রাহ্মণের জন্য আনা সন্দেশ আছে বললে না?’
গল্পের এই শেষাংশে এসে মনে হয়, জলসত্র আসলে আর কিছু নয়, এ এমন এক গভীর ভালোবাসার আহ্বান, যে ভালোবাসায় ধুয়ে-মুছে যায় সমস্ত সংস্কার, অন্ধ বিশ্বাস, ধর্ম-বর্ণ-জাতপাত-শ্রেণি-পেশার ভেদজ্ঞান আর আত্মগর্ব-অহংকার।