তিন কুমার—ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু ও বিদুর।
রাষ্ট্রকে আঁকড়ে থাকে যে সে-ই ধৃতরাষ্ট্র। সত্যবতীর প্রথম পৌত্র। চক্ষু ছাড়া সর্বাঙ্গসুন্দর।
তিন কুমার—ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু ও বিদুর।
রাষ্ট্রকে আঁকড়ে থাকে যে সে-ই ধৃতরাষ্ট্র। সত্যবতীর প্রথম পৌত্র। চক্ষু ছাড়া সর্বাঙ্গসুন্দর।
পাণ্ডু—অম্বালিকাপুত্র। শ্বেতীরোগগ্রস্ত। ধৃতরাষ্ট্রের মতো সবলদেহী নয়। ধৃতরাষ্ট্রের মতো অহংকারী নয় সে।
বিদুর—দাসীপুত্র। কিন্তু রাজপ্রাসাদে গৃহীত, সম্মানিত। ব্রাহ্মণ পিতা ও শূদ্রামাতার গর্ভজাত।
ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু, বিদুর—একই পিতার ঔরসজাত। মা আলাদা আলাদা—অম্বিকা, অম্বালিকা এবং কুন্তলা।
সত্যবতীর প্রথম প্রথম অস্বস্তি লাগত। তিনজনের সঙ্গে যে তিন-তিনটি ঘটনা জড়িত—অন্ধত্ব, রোগগ্রস্ততা এবং ছলনার ইতিহাস। অন্য দুজনকে না হয় মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু বিদুরের জন্ম হলো কেন? ওর জন্মের সঙ্গে যে প্রতারণা জড়িয়ে আছে। এই প্রতারণার জন্য অবশ্য বিদুর দায়ী নয়, শূদ্রাদাসী কুন্তলাও দায়ী নয়। কিন্তু অম্বিকা কি তার দায় এড়াতে পারবে? ও তো বিদ্রোহ করেছে। সত্যবতীকে অগ্রাহ্য করার বিদ্রোহ। এই শঠতার মধ্য দিয়ে অম্বিকা তাঁকে জানিয়ে দিয়েছে—আপনার শাসন আমি মানতে রাজি নই। আপনি কে আমাকে বাধ্য করার? তা-ও তো ভালো কোনো কাজে নয়। ভাশুরের সঙ্গে সঙ্গমের। যা অন্যায়। সমাজবহির্ভূত সেই অন্যায় কর্মটি করিয়েছেন মা আমাকে দিয়ে। একবার মেনে নিয়েছি, দ্বিতীয়বার মানিনি। উপেক্ষা করেছি। জানিয়ে দিয়েছি এই রাজপ্রাসাদে আপনার ক্ষমতার দিন শেষ। কদিন পর আমার পুত্র ধৃতরাষ্ট্র রাজা হবে। আমি হব রাজমাতা।
এ রকম করে ভেবে গেলেন সত্যবতী। ভাবতে ভাবতে মন শান্ত হয়ে এলো। তিনি ধৃতরাষ্ট্রের ঔদ্ধত্য লক্ষ করেন। পাণ্ডুর অবসাদ তাঁর চোখ এড়ায় না। বিদুরের বুদ্ধি, শান্ত স্বভাব তিনি খেয়াল করেন। কী আশ্চর্য, তিনজনের মধ্যে বিদুরকেই বেশি করে ভালোবাসতে শুরু করেন সত্যবতী।
বৃদ্ধা পিতামহী ভীষ্মকে ডেকে বলেন, ‘তিন রাজকুমারের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করা দরকার পুত্র।’
‘ঠিকই বলেছ মা। ওরা তো শিশুকাল অতিক্রম করেছে। এদের এখন শাস্ত্রজ্ঞান অর্জন করা দরকার।’
‘শুধু শাস্ত্রজ্ঞান কেন বাছা? অস্ত্রবিদ্যা শেখাবে না?’
‘তা তো অবশ্যই শিখবে মা। রাজপুত্র হয়ে ধনুর্বিদ না হলে চলে? আমি অতি শিগগির ওদের গুরুগৃহে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।’
‘আর একটি কথা, পাণ্ডু হস্তিনাপুরের রাজা হবে।’
‘ধৃতরাষ্ট্র নয় কেন? বিদুরই বা কী দোষ করল!’
‘ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ। অন্ধের শাসন কেউ মেনে নেবে না। না প্রজারা, না অমাত্যরা।’
‘আর বিদুর?’
‘ও তো দাসীপুত্র। শূদ্রার পেটে জন্মানো কাউকে ক্ষত্রিয়রা কি রাজা হিসেবে মেনে নেবে?’ মায়ের কথা শুনে থতমত খেলেন ভীষ্ম। করুণ কণ্ঠে বললেন, ‘ঠি-ক আছে মা। তোমার আদেশ পালন করব।’
তিন রাজকুমারকে বিদ্বান করে তোলার ব্যাপারে ভীষ্ম মনোযোগী হলেন। এখানেই থামলেন না তিনি। তিনজনকেই অস্ত্রগুরুর গৃহে পাঠালেন। বিদুর অস্ত্রবিদ্ হওয়ার ধারেকাছে গেল না।
ভীষ্মের তত্ত্বাবধানে লালিত তিন রাজপুত্র কালক্রমে বয়ঃপ্রাপ্ত হয়ে উঠল। পরিপূর্ণ যুবক হয়ে উঠল তারা।
সত্যবতী নাতিদের বিয়ের উদ্যোগ নিলেন। প্রথমে ধৃতরাষ্ট্রের বিয়ের আয়োজন করতে বললেন ভীষ্মকে। কিন্তু অন্ধরাজপুত্রকে কে কন্যা বিয়ে দেবেন? একজন রাজি হলেন। তিনি গান্ধার রাজ সুবল। স্বেচ্ছায় রাজি হননি। জোর করে রাজি করানো হয়েছে। ক্ষুদ্ররাজ্যের রাজা সুবল। তাঁর সামরিক শক্তি নিতান্ত ক্ষীণ। এই সুযোগের ভীষ্ম সুবলকে সামরিক শক্তির ভয় দেখালেন। রাজ্য হারানোর ভয়ে রাজা কন্যা গান্ধারীকে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের হাতে তুলে দিলেন। গান্ধারীও প্রতিশোধ নিয়েছেন। স্বামীগৃহে পৌঁছেই চোখে বস্ত্রখণ্ড বেঁধেছে। স্বামীর অন্ধত্বকে নিজের মধ্যে প্রয়োগ করেছে। এ মস্তবড় প্রতিশোধ—পিতার প্রতি, স্বামীর প্রতি।
এরপর পাণ্ডুর বিয়ে। পাণ্ডুর বিয়ে হলো প্রথমে কুন্তিভোজের পালিত কন্যা কুন্তীর সঙ্গে। কুন্তী রাজা শূরের কন্যা। রাজা শূরের সঙ্গে কুন্তিভোজের আত্মীয়তা। রাজা কুন্তিভোজ নিঃসন্তান। রাজা শূর কুন্তিভোজকে নিজ কন্যা দান করেন। দীর্ঘদিন কুন্তীর সন্তান না হওয়ায় সত্যবতী আর ভীষ্ম মিলে পাণ্ডুকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করাতে মনস্থ করেন। রাজা শল্যের বোন মাদ্রীকে পাণ্ডুর দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে নির্বাচন করেন।
সবার শেষে বিদুরকে বিয়ে করানো হলো। সুন্দরী সুশীলা দেবিকার সঙ্গে বিদুরের বিয়ে হলো। দেবিকাও পারসর রাজকন্যা।
অনেক ঘটনা-দ্বন্দ্বের পর পাণ্ডুকে হস্তিনাপুরের রাজা করা হলো। এ নিয়ে ভ্রাতৃবিরোধ উপস্থিত হলো। জ্যেষ্ঠ হিসেবে ধৃতরাষ্ট্রই হস্তিনাপুরের সিংহাসনের দাবিদার। এ নিয়ে দ্বন্দ্ব। কিছু অমাত্য ধৃতরাষ্ট্রের পক্ষ নিলেন। অম্বিকা এই বিরোধে ইন্দন জোগাল। ভীষ্ম আগাগোড়া সত্যবতীকে সমর্থন দিয়ে গেলেন। তাঁদের প্রচেষ্টায় রাজপ্রাসাদের কোন্দল থেমে গেল। পাণ্ডু রাজা হলো।
বছর কয়েক অতিক্রান্ত হলো। গান্ধারী সন্তানসম্ভাবনা। কুন্তী-মাদ্রীর সংবাদ নেই।
এই সময় কুরুরাজ পাণ্ডু ঘোষণা দিল—সে মৃগয়ায় যাবে। সস্ত্রীক। কুন্তী-মাদ্রী সঙ্গে যাবে। কিন্তু কোথায় যাবে পাণ্ডু? কেন, হিমালয়ের অরণ্যভূমিতে।
হিমালয়ের পাদদেশে পৌঁছেই দুই পত্নীকে উদ্দেশ করে বলল, ‘আমি অক্ষম পুরুষ। আমি কখনো তোমাদের গর্ভে পুত্র-উৎপাদন করতে পারব না।’
দুই পত্নী সবিস্ময়ে প্রশ্ন করল, ‘পুত্র-উৎপাদন করতে পারবেন না?’
‘না। সন্তান উৎপাদনের মতো বীর্যবত্তা আমি নই।’ বলতে বলতে ভেঙে পড়ল পাণ্ডু। কুন্তী স্বামীকে ভেঙে পড়তে দিল না। স্বামীর মাথাটা নিজ কোলে টেনে নিল। বলল, ‘শান্ত হোন রাজা। ধৈর্য ধরুন।’
মাদ্রী বলল, ‘অধৈর্যে অস্থিরতা বাড়ে।’
‘কী করে ধৈর্য ধরি বলো। রাজ্যে আমাদের দুর্নাম ছড়িয়ে পড়বে। তোমরা বাঁঝা হিসেবে নিন্দিত হবে। আর আমাকে সবাই বলবে আঁটকুড়ে রাজা।’
ওদিকে পাণ্ডু সস্ত্রীক মৃগয়ায় চলে আসার পর ধৃতরাষ্ট্র হস্তিনাপুরের রাজা হলো। ভারপ্রাপ্ত নৃপতি। তারই নির্দেশনায় কুরুরাজ্য শাসিত হতে থাকল। একদিন গান্ধারী একদলা মাংসপিণ্ড প্রসব করল। সেখান থেকে দুর্যোধন, দুঃশাসন, বিকর্ণদের জন্ম। একটা কন্যাও জন্মাল ধৃতরাষ্ট্রের—দুঃশলা নাম তার।
ওদিকে রাজা পাণ্ডু কুন্তী-মাদ্রীকে কাছে ডাকল। বলল, ‘আমি তোমাদের কাছে পুত্র চাই। নিজেদের গর্ভে পুত্র উৎপাদন করো তোমরা।’
দুই রানি বলল, ‘কিভাবে! আপনি তো অক্ষম।’
‘কোনো পরপুরুষকে আহ্বান করো শয্যাসঙ্গী হতে।’
‘পরপুরুষকে আহ্বান করব।’ অবাক কুন্তী।
‘কিন্তু কী উপায়ে!’ কুন্তী জিজ্ঞেস করে।
‘দেখো এই অরণ্যে বহু অরণ্যচারী আছে। নানা জায়গা থেকে মৃগয়াতেও আসে অনেকে। তোমরা তাদের সঙ্গে মিলিত হও। সন্তান উৎপাদন করে আমার বাসনা পূরণ করো।’
‘কিন্তু এসব হস্তিনাপুরের মানুষ মেনে নেবে কেন? মহামহী ভীষ্ম মানবেন কেন? রাজপিতামহী সত্যবতী মানবেন কেন?’ এক নিঃশ্বাসে বলে গেল মাদ্রী।
এবার রাজা পাণ্ডু ব্যাকুলতা কমালেন। শান্তস্বরে বললেন, দেখো রানিরা, এই অঞ্চলটি হস্তিনাপুর থেকে বহু দূরে অবস্থিত। ঘোর অরণ্যে ঘেরা। এখানকার ঘটনা কখনো রাজধানী পর্যন্ত পৌঁছবে না। এখানে তোমরা পুত্রবতী হলে রাজ্যবাসীর মনে কোনোভাবেই সন্দেহের উদ্রেক হবে না যে অন্য পুরুষের সঙ্গে মিলিত হয়ে তোমরা গর্ভে সন্তান ধারণ করেছ।’
‘তার পরও।’ আমতা আমতা করে বলল মাদ্রী।
রাজা পাণ্ডু বলল, ‘তোমাদের স্বাধীনতা দিলাম। তোমরা যেকোনো পুরুষের সঙ্গে মিলিত হও। আমার শুধু সন্তান চাই, পুত্রসন্তান।’
ক্ষেত্রজ পুত্র উৎপাদনের অনুমতি পেয়ে দুই রানি সন্তান উৎপাদনে মনোযোগী হলেন।
কালক্রমে কুন্তীর গর্ভে তিনটি পুত্রসন্তান জন্মাল—যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন। মাদ্রীর গর্ভে জন্মাল দুজন—নকুল ও সহদেব। ওরা বড় হতে থাকল।
একদিন পাণ্ডু অসংযমী হয়ে উঠল। তার দেহ-আকাঙ্ক্ষা প্রবল হলো। রানিদের আহ্বান জানাল। কুন্তী রাজি হলো না। কিন্তু মাদ্রী রাজার আকুলতাকে অবহেলা দেখাতে পারল না। পাণ্ডু স্ত্রীগমনে মগ্ন হলো। কিন্তু ব্যর্থ পুরুষের স্ত্রীগমন সফল হলো না। পাণ্ডুর জেদ বেড়ে গেল। রাজা বেপরোয়া হলো। সেই অবস্থায়ই মৃত্যু হলো হস্তিনাপুরের নৃপতি পাণ্ডুর।
মহারাজা পাণ্ডুর মৃতদেহ হস্তিনাপুরের রাজপ্রাসাদে নিয়ে আসা হলো। সঙ্গে দুই স্ত্রী ও পাঁচ পুত্র। রাজার মৃত্যুতে সারা রাজ্যে হাহাকার জাগল। রাজার নিথর দেহ দেখে যেমন সবাই স্তব্ধ হলো, তেমনি দিব্যকান্তির পঞ্চপাণ্ডবকে দেখে উত্ফুল্ল হলো। আনন্দিত হলো না শুধু ধৃতরাষ্ট্র।
মাদ্রী নকুল-সহদেবকে কুন্তীর হাতে গছিয়ে দিয়ে স্বামীর সহমৃতা হলো। পাঁচটি পুত্র তখন নাবালক। পাঁচ পুত্রকে নিয়ে কুন্তী অকূলে ভাসল।
সমস্ত নগরবাসী শোকে মুহ্যমান। পাণ্ডুর প্রৌঢ়া জননী অম্বালিকা পুত্রশোকে মাটিতে গড়াগড়ি যাচ্ছে। তারই চোখের সামনে তার একমাত্র পুত্র পাণ্ডু আর পুত্রবধূ মাদ্রী আগুনে অঙ্গার হচ্ছে।
সত্যবতী পাথর হয়ে গেলেন। তিনি উদাসীন, পৌত্রের শ্মশানভূমিতে গেলেন না।
সত্যবতী বুঝতে পারলেন—পাণ্ডুর মৃত্যুতে একটা ঝড় উঠবে এই রাজপ্রাসাদে। হস্তিনাপুরের রাজনীতি ওলটপালট হবে। কুরুরাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠবে।
পাণ্ডুর মৃত্যুর পর ধৃতরাষ্ট্র নিজেকে হস্তিনাপুরের নৃপতি হিসেবে ঘোষণা করল।
আগামী সংখ্যায় সমাপ্য
সম্পর্কিত খবর
সাংবাদিক মাশির হোসেন, যিনি হিরু ডাকনামে অধিক পরিচিত। তাঁর আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী ও সুধীজনের কাছে তিনি স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। প্রায় দুই দশক পরেও তাঁরা তাঁকে ভুলে যাননি; মনে রেখেছেন। মুস্তাফা মজিদ সম্পাদিত ‘মাশির হোসেন হিরু স্মারকগ্রন্থ : বিস্মৃতি থেকে স্মৃতিতে’ তারই প্রমাণ।
মায়ানমারের ইয়াঙ্গুনে জন্মগ্রহণ করলেও তাঁর শৈশব কাটে ঢাকার আর্মানিটোলায়, পরবর্তীতে শান্তিনগরে। স্বাধীনচেতা মাশির হোসেন তাই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন সাংবাদিকতা। শুরু করেন স্পোর্টস রিপোর্টার হিসেবে। ভাষা আন্দোলনে ছিল তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ।
স্মারকগ্রন্থের সম্পাদক মুস্তাফা মজিদ বলেছেন, অন্য অনেক স্মারকগ্রন্থের মতো মাশির হোসেন হিরু স্মারকগ্রন্থও সাদামাটা, যা ভালোবাসার মানুষদের স্মৃতিচারণাই। যদিও কোনো কোনো বৃহৎ ঘটনার পুনরাবৃত্তি করেছেন কেউ কেউ, তা সত্ত্বেও তার ভেতরেই ফুটে উঠেছে এক অনন্য অকৃত্রিম দরদ এবং মাশির হোসেনের চরিত্রের নানা দিক, যা তাঁকে নতুন আলোয় উদ্ভাসিত করেছে বর্তমান প্রজন্মের মানুষদের মাঝে; বিশেষত সাংবাদিকতাজগতে যাঁরা এ প্রজন্মের, যাঁদের অনেকেই মাশির হোসেনকে ব্যক্তিগতভাবে দেখেননি এবং চেনেন না। তিনি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন এই গ্রন্থে যাঁরা লিখেছেন তাঁদের সবাইকে।
এই স্মারকগ্রন্থে লিখেছেন আমানউল্লাহ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, এরশাদ মজুমদার, আবুল কাসেম ফজলুল হক, মুহাম্মদ কামরুজ্জামান, মনোয়ার হোসেন, লুত্ফুর রহমান, সৈয়দ দীদার বখত, দীপা দত্ত (সেন), গোলাম তাহাবুর, ড. মাহবুব উদ্দীন চৌধুরী, ইকবাল সোবহান চৌধুরী, রফিকুর রহমান, কাজিম রেজা, আব্দুল আউয়াল ঠাকুর, এ কে এম মহসিন, এলাহী নেওয়াজ খান, আহমদ আখতার, কাজী রওনাক হোসেন, মমতাজ বিলকিস, মারুফ কামাল খান, খায়রুল আনোয়ার, সৈয়দ আবদাল আহমদ, ফজলুল বারী, মোস্তফা কামাল মজুমদার, শওকত মাহমুদ, বুলবুল আহমেদ, মাহমুদ শফিক, শওকত আনোয়ার প্রমুখ।
এ ছাড়া আছে মাশির হোসেন হিরুর লেখা, জীবনবৃত্তান্ত ও কিছু দুর্লভ আলোকচিত্র, যা এই গ্রন্থকে আরো আকর্ষণীয় করেছে। আশা করি, মাশির হোসেন হিরুকে জানতে স্মারকগ্রন্থটি নতুন প্রজন্মকে সাহায্য করবে।
রিহাম হাসান
চিঠিপত্র তো ব্যক্তিমানসের মুকুর। কেবল এই মুকুরকেই কাজে লাগিয়ে রচিত হতে পারে অনবদ্য কোনো উপন্যাস, এটা হয়তো বুদ্ধদেব গুহর আগে ভাবেননি কোনো কথাকার। শুধু আঙ্গিকেই নয়, বহু দিক থেকে নতুন মাত্রা যোগ করেছে ‘সবিনয় নিবেদন’ নামের চমৎকার এই উপন্যাস। শিক্ষিত, স্বাবলম্বী ও উদারমনা এক নারী ঋতার সঙ্গে বেতলার জঙ্গলে এক চরম বিপন্ন মুহূর্তে একঝলক দেখা হয়েছিল ঝকঝকে, ব্যক্তিত্ববান অফিসার রাজর্ষি বসুর।
‘সবিনয় নিবেদন’-এর মতো বই পড়া যেন এক ধরনের নীরব সাধনা। যেন কারো একান্ত গোপন চিঠির খাম আমি খুলে বসেছি, যার ভাঁজে ভাঁজে জমে আছে অভিমান, ব্যথা, অরণ্যের ঘ্রাণ আর অপ্রকাশিত ভালোবাসা।
প্রথম থেকেই মনে হয়েছে, উপন্যাস পড়ছি, না একটি রাগপ্রবণ, বেদনাঘন রাগিণী শুনছি। যেন এক পিয়ানো, যার কিছু চাবি বাজে না, কিছু অতিরিক্ত সুর তুলে দেয়। বুদ্ধদেব গুহর ভাষা এতটাই স্বচ্ছ ও জীবন্ত যে চরিত্রের চোখের জলও যেন স্পষ্ট অনুভব করা যায়।
প্রতিটি পৃষ্ঠা যেন একটি কুয়াশাময় সকাল—অস্পষ্ট, কিন্তু অনুভবে পরিপূর্ণ। সম্পর্ক এখানে নদীর মতো—প্রবহমান, বাঁক নেয়, স্রোতের নিচে পাথর লুকিয়ে থাকে। লেখকের অভিজ্ঞতা থেকে উঠে আসা অনুভবগুলো এমনভাবে বিন্যস্ত, যেন পাঠকের আত্মজগতে আয়না ধরে রাখা হয়েছে, যেখানে নিজের ভেতরের চেহারা ধরা পড়ে, যেটা আমরা অনেক সময় এড়িয়ে যাই। ভালোবাসার বর্ণনা এ উপন্যাসে কোনো একপেশে আবেগে সীমাবদ্ধ নয়।
গ্রন্থনা : পিন্টু রঞ্জন অর্ক
সম্প্রতি প্রকাশ করা হয়েছে জার্মান সাংবাদিক, ইতিহাসবিদ ও লেখক সেবাস্টিয়ান হাফনারের উপন্যাস ‘আবসিড’ বা ‘বিদায়’। হাফনারের জন্ম ১৯০৭ সালে, মারা যান ১৯৯৯ সালে। ‘আবসিড’ বা ‘বিদায়’ নামের উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় প্রয়াত লেখকের ড্রয়ার থেকে। উপন্যাসটি লেখা হয় ১৯৩২ সালের ১৮ অক্টোবর থেকে ২৩ নভেম্বরের মধ্যে।
এ বছর এ উপন্যাস প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে জনপ্রিয় হওয়ার কারণ হলো, এখানে ইতিহাসের খুব কঠিন সময়ের সাদামাটা জীবনের গল্প বলা হয়েছে।
ফাহমিদা দ্যুতি
রাত সাড়ে আটটায় ঢাকা শহরের সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায় সরকারি আদেশমতো।
সিটি শপিং মলের আটতলার সব দোকান আটটায় দ্রুত বন্ধ করে দিচ্ছে। ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই লিফট-সিঁড়ি বেয়ে নেমে শপিং মল ত্যাগ করছে। গ্রাউন্ড ফ্লোরে সিকিউরিটি গেটে সবার চলে যাওয়ায় সহযোগিতা করছে।
রাত সাড়ে আটটা বাজার কিছুক্ষণ আগে ছয়তলা থেকে হন্তদন্ত হয়ে মাস্ক পরা এক স্মার্ট যুবক আশিক লিফটে চড়ে ডোর ক্লোজ বাটন টিপে ঘুরে দাঁড়াল। দেখল, লিফটের কোনায় কিছু শপিং ব্যাগ হাতে একটু ঘুরে দাঁড়ানো সালোয়ার-কামিজ হিজাব-নেকাব পরা এক যুবতি।
লিফট নিচে নামতেই সহসা একটা শব্দ করে থেমে গেল।
: কী হলো?
অস্ফুট স্বরে আশিক বলল—
: কারেন্ট চলে গেল।
: লোডশেডিং!
: ভয় পাবেন না। জেনারেটর ছাড়লেই লিফট চলবে।
সিঁড়ি বেয়ে সবাই নেমে শপিং মল ত্যাগ করল। মার্কেট শূন্য। শুধু অন্ধকার লিফটের ভেতরে আটকা পড়ে আছে আশিক আর একটি রক্ষণশীল নারী।
আশিক তার মাস্ক খুলে মোবাইলের লাইট অন করল। বেশ আলোকিত হলো লিফট।
: হ্যালো। হ্যালো লিফটম্যান। হ্যালো হ্যালো।
আশিক ইন্টারকম বক্সে কারো কোনো সাড়াশব্দ পেল না। সিকিউরটি রমিজ শপিং মলের আন্ডারগ্রাউন্ড কার পার্কিং থেকে একজনের গাড়ি বিদায় করছে। লিফটে বন্দি আশিক চিৎকার করে বলছে—
: কে আছ, লিফটের দরজা খোলো। আমরা আটকা পড়েছি।
সিকিউরিটির কানে তখনো আওয়াজ পৌঁছেনি। আশিক লিফটের দরজায় ডান হাতে অনবরত ঘুষি মারছে আর বলছে—
: আমরা লিফটে আটকা পড়েছি। কে আছ, জেনারেটর চালু করো। নয়তো লিফট ভেঙে ফেলব। ভেঙেই ফেলব।
আশিকের এই আর্তচিৎকারে বিমর্ষ মেয়েটি। সিকিউরিটির কানে আওয়াজ পৌঁছল। দ্রুত সিকিউরিটি লিফট ইন্টারকম বাটন টিপে বলে—
স্যার স্যার, আমি মার্কেট সিকিউরিটি রমিজ।
: তোমাদের লিফটম্যানকে বলো জেনারেটর চালু করতে।
: স্যার, লিফটম্যান করিম ভাই তো সন্ধ্যাবেলা বাইত চইলা গেছে।
: তুমি তাড়াতাড়ি জেনারেটর চালু করো।
: কেমনে চালু করুম স্যার, সারা দিন তিনবার কারেন্ট গেছে। জেনারেটরে তেল নাই।
: লিফটের চাবি নিয়ে, তুমি লিফট ফ্লোর লেভেলে এনে দরজা খুলে আমাদের দুজনকে বের করো।
: স্যার লিফটের চাবি তো লিফটম্যান করিম ভাইয়ের কাছে থাকে। যাইবার সময় কইলো, মার্কেট বন্ধ হইলে লিফটের কারেন্ট পাওয়ার যেন আমি অফ কইরা দেই।
তোমার করিম ভাইকে ফোন করে লিফটের চাবি নিয়ে আসতে বলো।
: আইচ্ছা, ফোন দিতাছি স্যার। চিন্তা কইরেন না।
আশিক লক্ষ করল, মেয়েটি গরমে ঘামছে। আশিক একা মনেই বলল—
: উহ্! এই গরমে টিকব কী করে?
মেয়েটি আঁতকে উঠল—
: অ্যাঁ! তাহলে?
লিফটের ইন্টারকম বেজে উঠল। আশিক দ্রুত ঘুরে তাকল লিফটের সাউন্ড বক্সের দিকে।
: হ্যাঁ, করিম মিয়া আসছে তো?
সিকিউরিটি রমিজ বলল—
: না স্যার। ম্যালা চেষ্টা করলাম, করিম ভাইয়ের মোবাইল বন্ধ।
আশিক উদ্বিগ্ন স্বরে বলল—
: হোয়াট!
শব্দ শুনে মেয়েটি আচমকা বলে উঠল—
: হায় আল্লাহ, এখন উপায়!
রমিজ মিয়া বলল—
আল্লাহ ভরসা। এক ঘণ্টার মধ্যেই কারেন্ট চইলা আসবো। তার পরেও আমি বিদ্যুৎ অফিসে খবর লইতাছি।
আশিকের মোবাইল আলোয় কী অদ্ভুত ঐন্দ্রজালিক অন্ধকার লিফটের চার দেয়ালের ভেতরে চৈত্রদাহে পুড়ছে, দুজন অচেনা-অজানা লিফটযাত্রী।
এক ঘণ্টার লোডশেডিং হলে বিদ্যুৎ আসতে এখনো চল্লিশ মিনিট বাকি। কতক্ষণ আর লিফটে দাঁড়িয়ে থাকা যায়। মেয়েটি শপিং ব্যাগগুলো নিয়ে লিফটে বসে পড়ল। আশিকও বসে লম্বা করে পা মেলে দিল। আশিক লক্ষ করল, মেয়েটি শপিং ব্যাগ থেকে একটি পণ্যের প্যাকেট বোর্ড ছিঁড়ে হাতপাখা করে বাতাস তুলে নিচ্ছে তার গায়ে। গরমে হিজাব-নেকাব ভিজে একাকার। আশিক তার কাঁধে ঝোলানো লেদার সাইড ব্যাগ থেকে মিনারেল ওয়াটারের বোতলটা বের করে মেয়েটির দিকে এগিয়ে দিল। মেয়েটি হাত বাড়িয়ে দিয়ে, কী যেন ভেবে হাতটা সরিয়ে নিল। আশিক ব্যাপারটা বুঝে বোতলের কক খুলে সামান্য পানি নিজে মুখে ঢেলে নিল। মেয়েটির মনে যেন একটা বিশ্বস্ততা ফুটে উঠল অজানা আশিকের প্রতি। এবার মেয়েটি হাত বাড়িয়ে মিনারেল বোতলটি ধরতেই চমকে উঠল, আশিকের হাতের আঙুল ফেটে তরতর করে রক্ত ঝরে পড়ছে। মেয়েটি পানির বোতলটা নিয়ে লিফটের ফ্লোরে রেখে দ্রুত তার মুখে আবৃত সাদা নেকাবটা টান দিয়ে খুলে আশিকের রক্ত ঝরা আঙুলে পেঁচিয়ে দিতে উদ্যত হলে আশিক হাত সরিয়ে নিয়ে খুব বিনয়ের সুরে বলে—
: য়ু হু। আগে আপনার গলাটা ভিজিয়ে নিন।
মেয়েটি বোতল তুলে ঢকঢক করে পানি খেয়ে নেকাব দিয়ে আশিকের রক্ত ঝরা আঙুল পেঁচিয়ে বেঁধে দিল। আশিক এক অনন্যা অপ্সরী সুন্দরী নারীর রূপে অভিভূত হলো।। সহসা একটা নিষ্পাপ সুন্দর যেন আশিকের মনকে এই বন্দিত্বের কথা ভুলিয়ে দিল। মেয়েটিকে বলল—
: আমি আশিক। আপনি?
: নাজমা!
: তো, এত প্যাকেট, কী শপিং করলেন?
: গায়েহলুদের কিছু সামগ্রী।
: ও! আপনার গায়েহলুদ?
: জি না। ছোট বোন সূচনার কাল হলুদসন্ধ্যা।
: তো, সাথে কেউ আসেনি?
: বাবা নেই। মা বুড়ো মানুষ!
: সূচনা?
: সামান্য ক’টা আইটেম, ভাবলাম একাই পারব।
: আপনার হাজব্যান্ড?
: জি!
নাজমা আঁতকে উঠল। আশিক বলল—
: চমকে উঠলেন যে!
: এমনি।
: না...বলছিলাম, ছোট বোনের বিয়ে, আপনার হাজব্যান্ডকে নিয়ে...
: নেই।
: নেই, মানে ছোট বোনকে বিয়ে দিয়ে তারপর...
: বিয়ে, ঘর-সংসার—এসব নিয়ে আর ভাবছি না।
: কেন?
: ব্যাপারটা কোথায় যেন একটু কমপ্লিকেটেড মনে হচ্ছে। তাহলে কি আপনার হাজব্যান্ড...
: ছিল।
: তো, এখন উনি...
আশিক লক্ষ করল, নাজমার চোখ ভিজে যাচ্ছে। যেন জীবনের কোনো একটা অতৃপ্ত গল্প লুকানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। সহসা আশিকের মোবাইল বেজে উঠল। রিসিভ করল—
: হ্যালো, মা। এইতো একটা জায়গায়। কারেন্ট এলেই চলে আসব। জি। জি মা।
আশিক মোবাইল বন্ধ করল—
: বিপদে আছেন, মাকে বুঝতে না দিয়ে ভালোই করেছেন। আমার মা আর সূচনা হয়তো আমাকে ফোন দিয়ে পাচ্ছে না।
: সঙ্গে মোবাইল আনেননি।
: চার্জ নেই।