<p><strong>ফকির আলমগীর</strong></p> <p>ছাত্রাবস্থায় প্রতিবছর বৈশাখের প্রথম ভোরে ছায়ানটের অনুষ্ঠানে যেতাম, শিল্পীদের সঙ্গে গলা মেলাতাম—‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো।’ ১৯৮২ সালে তেমনিভাবে রমনার বটমূলে গেলাম, সঙ্গে স্ত্রী-পুত্র। তখন রমনা ছাড়াও শিল্পকলা একাডেমিতে বৈশাখী মেলার আয়োজন করত বিসিক (বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন)। ছায়ানটের অনুষ্ঠান শেষে শিল্পকলা একাডেমিতে গেলাম মেলা দেখতে। ঘুরে ঘুরে পুতুল, বাঁশি, কুলা ইত্যাদি কিনছি। এর মধ্যে দু-একজন ভক্ত-শুভানুধ্যায়ীর সঙ্গে কুশল বিনিময় হচ্ছিল। দেখলাম, কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাকে ঘিরে ছোটখাটো একটা জটলা তৈরি হয়ে গেল। ভক্ত-অনুরাগীরা বারবার অনুরোধ করল—‘ফকির ভাই, গান গাইতে হবে।’ তখন কোলে আমার ছেলে। তাকে ওর মায়ের কাছে দিলাম। পাশের একটা দোকান থেকে নারিকেলের খোলসের সঙ্গে তার দিয়ে বানানো একতারা নিলাম। সেটাতে সুর তুলেই গাওয়া শুরু করলাম। এখনো মনে আছে, প্রথমে গেয়েছিলাম ‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা’। পরে ‘মায়ের একধার দুধের দাম’, ‘ও সখিনা’। আসর জমে গেল। প্রায় আধঘণ্টার মতো গাইতে হলো। শেষে আমার স্ত্রীসহ কয়েকজন ভক্ত বলল, ‘আজ এখানে, কাল ওখানে—এভাবে তো হবে না। আগামী বছর থেকে কোনো একটা নির্দিষ্ট জায়গায় গাওয়া যায় কি না দেখো।’ পরে বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, শিশুপার্কসহ নানা জায়গায় যোগাযোগ করি। শেষমেশ শিশুপার্ক কর্তৃপক্ষ রাজি হয়। আগে পার্কের মূল প্রবেশদ্বারের সামনে ছোট ছোট নারিকেল গাছ ছিল। জায়গাটাকে আমরা নারিকেলবীথি বলে ডাকতাম। সেখানেই শুরু করি পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান।</p> <p><img alt="" src="/ckfinder/userfiles/images/print/2016/Feature -2016/April/14-04-2016/F6B.jpg" style="float:left; height:133px; margin-left:12px; margin-right:12px; width:202px" />প্রথমবারের কথা বেশ মনে আছে। ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর’ দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল। পরে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও লালনের কিছু গান হলো। এরপর গণসংগীত। রমনায় ছায়ানটের অনুষ্ঠানে যেবার বোমা হামলা হয়েছিল সেই সময়ের কথা বেশ মনে পড়ে। আমরা প্রথমে টেরই পাইনি, অনুষ্ঠান চলছিল। পরে খবর শুনে অনুষ্ঠান চালাব, না বন্ধ করে দেব—এ নিয়ে দ্বিধায় ছিলাম। এমন সময় মঞ্চের পেছনে কয়েকজন এসে বললেন, ‘প্লিজ আপনারা অনুষ্ঠান থামাবেন না।’ দেখলাম, দর্শক তখনো বুঝতে পারেনি। অনুষ্ঠান চলেছে। এর মধ্যেই আমরা দর্শকদের জানিয়েছি। আহতদের জন্য রক্তদানের আহ্বান করেছি। আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়েছিল অসংখ্য মানুষ।</p> <p>সকাল সাড়ে ৭টায় শুরু হয়ে প্রায় সাড়ে ১১টা-১২টা পর্যন্ত চলে আমাদের পরিবেশনা। অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ লোকসংগীত ও গণসংগীত। ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠীর দলীয় পরিবেশনা দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান, পরপর তিনটি গান গায় তারা। এরপর থাকে আবৃত্তি, নৃত্য ইত্যাদি। অনুষ্ঠানের আরেকটি বিশেষ দিক হলো ‘হিট-প্যারেড’। বাংলাদেশের জনপ্রিয় গানগুলো গাওয়া হয় এই হিট প্যারেডে। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে প্রতিবছরই একটা স্মরণিকা বের করি। গত কয়েক বছর ধরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের শিল্পী ছাড়াও পার্শ্ববর্তী দেশের শিল্পীদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। এবারও পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও বাংলাদেশি শিল্পীর যৌথ পরিবেশনা থাকবে। এবারের আয়োজন উৎসর্গ করা হয়েছে কবি রফিক আজাদ ও চলচ্চিত্র নির্মাতা খালিদ মাহমুদ মিঠুকে।</p> <p>বাংলাদেশে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান শুরু এবং এই ধারা টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে ছায়ানট পথিকৃৎ। অনেকে বিভিন্ন সময় আমাকে প্রশ্ন করেছেন, ‘রমনার বটমূলে ছায়ানটের এত বড় আয়োজনের পাশে আরেকটা অনুষ্ঠানের কি দরকার?’ এ প্রশ্নের সবচেয়ে ভালো জবাব দিয়েছেন কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক ও শিক্ষাবিদ জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী। লেখায় তাঁরা বলেছেন—‘ছায়ানট আমাদের সংস্কৃতির আত্মার আত্মীয়। একই চেতনায় উদ্ভাসিত হয়ে ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠীর যে আয়োজন, সেটাও আমাদের সংস্কৃতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।’</p> <p>আমি মনে করি, আমাদের আয়োজনটা স্বতন্ত্র। গণসংগীতের প্রতি মানুষের হূদয়ের টান, সেই টানেই আমাদের অনুষ্ঠানে মানুষ আসে। ছায়ানটের সঙ্গে আমাদের অবস্থান সংঘর্ষের নয়, সহযোগিতার। আমাদের অনুষ্ঠান কখন শুরু হবে, মাইক কত দূর থাকবে ইত্যাদি নানা বিষয় ছায়ানটের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেই ঠিক করি। তা না হলে এত বছর ধরে আমরা অনুষ্ঠান চালাতে পারতাম না।</p> <p>অনুলিখন : পিন্টু রঞ্জন অর্ক</p>