পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’-এর অন্যতম নায়িকা পিয়ারী বেগম। ছবিটিতে কিভাবে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছিলেন, জীবদ্দশায় (২০ মে, ২০১৬) কালের কণ্ঠকে জানিয়েছিলেন অভিনেত্রী। সেখান থেকে সংক্ষেপিত
আমরা থাকতাম পুরনো ঢাকার আগামসি লেনে। সমবয়সী পাড়া-প্রতিবেশী মিলে স্টেজ বানিয়ে নাটক করতাম।
সিনেমা দেখতে খুব পছন্দ করতাম। আগামসি লেন থেকে ‘তাজমহল’ আর ‘নিউ পিকচার হাউস’ খুব কাছে ছিল। তাজমহলেই সিনেমা বেশি দেখতাম। মধুবালা, সুরাইয়া, নার্গিসের অভিনয় দেখে মনে মনে আফসোস করতাম, ইশ, যদি এ রকম হতো, ওদের মতো হলে গিয়ে সবাই আমার অভিনয় দেখত।
চিত্রালীতে বিজ্ঞাপন দেখি—পূর্ব পাকিস্তানে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হবে। তারা শিল্পী, নায়িকা খুঁজছে। অফিসের ঠিকানাও আমাদের বাড়ির কাছেই নবাব কাটারায়। একদিন বান্ধবী জহরত আরাকে নিয়ে অন্য বান্ধবীর বাসায় যাব বলে বাসায় মিথ্যা বলে চলে গেলাম।
ইকবাল ফিল্মসের অফিস খুঁজে বের করলাম। ভেতরে যাওয়ার পর দেখি, জব্বার সাহেব, ছবির ক্যামেরাম্যান কিউ এম জামান, শাহজাহান নামে তাঁদের সঙ্গের আরো একজন বসে আছেন। জব্বার সাহেব আমাদের এটা-সেটা জিজ্ঞাসা করলেন। অভিনয় সম্পর্কেও জিজ্ঞাসা করলেন। যেটুকু পারি, জানি, নিজেরা করেছি—বললাম। তারপর বললাম, কার্জন হলে নাটক মঞ্চস্থ হবে, তাতে সেকেন্ড হিরোইনের রোল করছি। কবে হবে জেনে তিনি দেখতে গিয়েছিলেন। বোধ হয় রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ ছিল, চরিত্রের নাম ভুলে গেছি।
নাটক দেখে এসে তিনি বললেন, ‘তোমাকে ভালোই লেগেছে।’ আমাদের তো খুব টেনশন হচ্ছিল, সিলেক্ট হলাম কি হলাম না। তাঁরা আরেক দিন ডেট দিলেন। আমরা আবার গেলাম। গিয়ে দেখি, কিউ এম জামান, জব্বার সাহেব, কলকাতা থেকে আসা ক্যামেরাম্যান মুরলি মোহন, সিনেমায় দাড়িওয়ালা ডাকাতের ভূমিকায় অভিনয় করা ইনাম আহমেদ সাহেব আছেন। তাঁরা আমাদের প্রশ্নের পর প্রশ্ন করলেন। ‘অভিনয় কেমন লাগে, কিভাবে আগ্রহ জন্মেছে?’ আমরা বলেছি, সিনেমা দেখেই আগ্রহ জন্মেছে। এখানে সে রকম সুযোগ ছিল না বলে এত দিন চুপচাপ ছিলাম। জানতে চাইলেন, অভিনয় করতে পারবে? বললাম, নির্বাচিত হলে পারব।
ছবিতে অভিনয়ের জন্য নির্বাচিত হওয়ার পরেও আমরা কিন্তু বাসায় জানাইনি। কিছুদিন পরে চিত্রালী আমার মানে নায়িকা রাশিদার পুরো পাতাজুড়ে ছবি ছাপাল। দেখে আব্বা (আবদুল মালেক) জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ছবিটি তো তোমার! কখন কি করলে না করলে কিছুই তো জানতে পারলাম না। আমাদের সমাজে এ তো কেউ ভালো চোখে দেখে না। কাজটি যে করেছ, আমাকে জানাওনি, ঠিক করোনি। আমি পারমিশন দিচ্ছি না। পড়াশোনাই করো, এ লাইনে যাওয়ার দরকার নেই।’
মহাবিপদে পড়ে দুই বান্ধবী চুপি চুপি জব্বার সাহেবের সঙ্গে দেখা করে বললাম, আব্বা তো রাজি নন। বললাম, ‘আপনি যদি কনভিন্স করতে পারেন, খুব ভালো হয়।’ তিনি আব্বার সঙ্গে দেখা করে বললেন, ‘আপনি যদি ওর অভিনয় বন্ধ করে দেন, তাহলে আমার অনেক ক্ষতি হবে, অনেক পিছিয়ে যাব। আপনার মেয়ে, আমার মেয়ে।’ এ কথার পর তিনি আরো বলেছিলেন, ‘কোনো চিন্তা করবেন না।’ আব্বা আর না করলেন না।
ছবির মহরত হয়েছিল ঢাকার শাহবাগ হোটেলে (পিজি হাসপাতাল)। উদ্বোধন করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক। আমি, আমার বাবা, জহরত আরা, তার বাবা—আমরা এই চারজন কলাকুশলীদের পক্ষ থেকে গিয়েছিলাম। মহরতের পর জব্বার সাহেব শেরেবাংলার সঙ্গে ‘আমাদের সিনেমার নায়িকা’ বলে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এটি ১৯৫৪ সালের কথা। শুটিংয়ের আগে জব্বার সাহেব আমার নাম বদলে রাখলেন নাজমা। টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে প্রথম শুটিং হলো। পুরোপুরি শেষ করতে দুই বছর লেগেছে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম বাংলা ছবি রিলিজ হয়েছে—এটি বেশ ভালোভাবে প্রচার করা হয়েছিল। ১৯৫৬ সালের ৩ আগস্ট মফস্বলের কয়েকটি হল এবং সদরঘাটের রূপমহল সিনেমা হলে ‘মুখ ও মুখোশ’ মুক্তি পেয়েছিল।
(‘কথায় কথায়’ পাতায় পুরো সাক্ষাৎকারটি ছাপা হয় ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৬)