<p> লাতিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিলে এমন একটা সময়ই বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, যখন লাতিন আমেরিকার অনেক দেশের রাজনৈতিক অবস্থা বিস্ফোরণোন্মুখ। ভেনিজুয়েলা থেকে শুরু করে কিউবার রাস্তায় একটু একটু করে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ দানা বেঁধে উঠছে। ঠিক এ রকমই একটা সময়ে ব্রাজিলের সাদা চামড়ার প্রশাসন প্রায় জোর করেই বিশ্বকাপ ফুটবল অনুষ্ঠান করতে যাচ্ছে। আগামী ১২ জুন থেকে ব্রাজিলে দ্বিতীয়বারের মতো অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ফুটবলের সবচেয়ে বড় আসর বিশ্বকাপ ফুটবল। এর আগে প্রথমবারের মতো ব্রাজিলে বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫০ সালে। এবারের বিশ্বকাপের খেলাগুলো দেশটির মোট ১২টি শহরের বিভিন্ন স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হবে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ফুটবলপ্রেমীরা এসে এরই মধ্যে ভিড় জমাচ্ছে ব্রাজিলে। বাড়তি মানুষের চাহিদা মেটাতে ও গণমাধ্যমের নজর অন্যদিকে সরিয়ে নিতে ব্রাজিলের সরকারকে যে অনেক ছল-চাতুরির আশ্রয় নিতে হচ্ছে, তা খুব সহজেই বোঝা যায়। যৌনব্যবসাকে বৈধ করে একে বিশ্ব পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় এক উপাদান হিসেবে হাজির করেছে দেশটি। অন্যদিকে প্রধান ১২টি শহরের অলিগলি থেকে নিম্ন-আয়ের মানুষের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গুঁড়িয়ে দিয়ে ঝাঁ চকচকে এক ব্রাজিলকে দেখাতে চায় সরকার। কিন্তু কেন দেশটির সরকার লাখো ভুখা মানুষের সঙ্গে এ রকম আচরণ করছে, তা একটু বিশ্লেষণ করলেই সহজে বের হয়ে আসে। দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমা অর্থনীতির অধীনে থাকার কারণে দেশটির অর্থনীতি-রাজনীতিতে এখন পশ্চিমামদদপুষ্ট সংস্কারপন্থীরা ক্ষমতার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। যার কারণে দেশটিতে ক্রমবিকাশমান ধনী-দরিদ্রের বৈষম্যের অন্যতম শিকার হচ্ছে একেবারেই খেটেখাওয়া সাধারণ জনগণ। দেশটির হাজার হাজার তরুণ বেকার, লাখ লাখ মানুষ বস্তিতে বাস করে। এসব সমস্যার সমাধান না করতে পারলেও দেশটির শাসক শ্রেণি ফিফার মনের মতো করে বিশ্বকাপ আয়োজন করার জন্য কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে স্টেডিয়াম তৈরি করেছে। ইউরোপীয় ধাঁচে বিশ্বকাপ আয়োজন করতে গিয়ে অবকাঠামো খাতে ব্যয় হয়েছে আট হাজার কোটি ডলার, যার মধ্যে শুধু স্টেডিয়াম তৈরিতে ব্যয় হয়েছে ৮৪০ কোটি ডলার। আর বিশ্বকাপে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১৪ বিলিয়ন ডলার, যেটা ২০১০ সালের দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপ ছিল চার বিলিয়ন ও ২০০৬ সালে জার্মানিতে ছিল ছয় বিলিয়ন।<br /> <a name=\"RIMG0\"></a></p> <p> ব্রাজিলের সাধারণ মানুষের কাছে পেলে-কাকা-রোনালদোরা এখন জাতীয় বেইমান। পশ্চিমা বাণিজ্যের সঙ্গে সায় দিয়ে তারাও ক্ষুদ্র অর্থনীতির দেশটিতে বৃহৎ পুঁজি প্রবেশ করিয়ে ব্যক্তি ফায়দা লুটছে, তা সাধারণ জনগণ মেনে নিতে পারছে না। সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের করা এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ব্রাজিলের ফুটবল তারকা রোনালদো তাঁর বিলাসবহুল বাড়িটি বিশ্বকাপের সময়ের জন্য ভাড়া দিচ্ছেন। আর যদি কোনো ধনকুবের এই বাড়িটি ভাড়া নিতে চান, তাহলে তাঁকে প্রতিদিন গুনতে হবে প্রায় ২৫ লাখ টাকা। তবে যদি পুরো বাড়িতে চারজনের অতিরিক্ত কেউ থাকতে চায় তাহলে প্রতিদিনের অর্থের সঙ্গে তাকে আরো বাড়তি এক লাখ টাকা গুনতে হবে। শুধু লাতিন আমেরিকার একটা দরিদ্র দেশের জন্য নয়, বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের সাধারণ মানুষের কাছে রোনালদোর বাড়ির বিষয়টি স্রেফ আরব্য উপন্যাস কিংবা স্বপ্ন ছাড়া কিছুই মনে হবে না। কিন্তু বাস্তবের ঘটনা ঠিক তাই। লাখ লাখ বেকারের কর্মসংস্থানের ওপর দাঁড়িয়ে ফুটবলসংশ্লিষ্টরা দেদারছে কামিয়ে নিচ্ছেন কাড়ি কাড়ি টাকা। আর রিওডি জেনিরোর 'মারে' বস্তির মতো অনেক বস্তির গঞ্জালেসদের চোখে প্রতিশোধ আর প্রতিরোধের আগুন জ্বলে। তবে দিলমা রৌসেফ গঞ্জালেসদের চোখের আগুন নিভিয়ে দিতে কিন্তু একটুও দেরি করেননি। গত বছরের মাঝামাঝি থেকেই বড় বস্তিগুলোতে কম্বিং অপারেশন শুরু করে দিয়েছেন। বস্তিগুলোকে মাদক ও অস্ত্রের আখড়া আখ্যা দিয়ে একের পর এক অভিযান চালাচ্ছে দেশটির নিরাপত্তারক্ষীরা। শুধু বিক্ষোভ করার অধিকারই বন্ধ করেনি দেশটির শাসক শ্রেণি, বিশ্বকাপ চলাকালে স্টেডিয়ামসংলগ্ন অঞ্চলে রাস্তার পাশে যেসব খাবারের দোকান ছিল, তা তুলে দেওয়া হয়েছে। এসব খাবারের দোকান কালো দরিদ্র নারীরা চালাত। সমালোচকরা বলছেন, এ ধরনের দোকানে দক্ষিণ আফ্রিকায় বছরের পর বছর ধরে চলে আসা খাবার বিক্রি হতো। মূলত ফিফার স্পনসরশিপ কম্পানিগুলোর চাপে এটা করা হয়েছে। ওই অঞ্চলে শুধু তাদেরই খাবার বিক্রি হবে, এ কারণে দেশটির পুলিশ জোর করে অন্য দোকানিদের তুলে দিয়েছে। এখন সেসব স্থানে ম্যাকডোনাল্ডসের মতো নামি-দামি কম্পানি বিক্রি করছে ব্যয়বহুল সব খাবার। তার পরও ব্রাজিলে বিক্ষোভ অব্যাহত আছে। মানুষ হাতে হাত মিলিয়ে স্টেডিয়ামগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করছে। কোটি কোটি মানুষ রাস্তায় নেমেছে। সবার এক দাবি-এক মত, ফুটবল বিশ্বকাপ কিছুতেই তাদের দেশে হতে পারবে না। কারণ ব্রাজিলে এখন চরম দারিদ্র্য বিরাজ করছে, দেশটিতে বহু লোক খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা, বাসস্থান, পড়ালেখার মতো মৌলিক সুবিধা পাচ্ছে না। সেখানে খেলাধুলার নামে এত টাকার অপচয় কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না তারা। তাই ভয়ানক খেলা পাগল ও পাঁচবারের বিশ্বকাপ চাম্পিয়ন ব্রাজিল এখন খেলার বিরুদ্ধে নেমেছে। শুধু তাই নয়, যাঁরা ব্রাজিলের সেরা ফুটবলনায়ক, সেই পেলে ও রোনালদোকে পর্যন্ত বিশ্বাসঘাতক বলে গালি দিচ্ছে জনগণ। কারণ বিশ্বকাপ আয়োজনের নামে বড় দুর্নীতির ফাঁদ পেতেছে সরকার, আর পেলে-রোনালদো তাতেই সায় দিয়ে যাচ্ছেন। ব্রাজিলের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের এক হিসাবমতে, ব্রাজিল বিশ্বকাপ উপলক্ষে দেশটিতে ৩৭ লাখ পর্যটকের আগমন ঘটবে। আর যেসব পর্যটক বিশ্বকাপের চারটি ম্যাচ উপভোগ করবে, তারা গড়ে খরচ করবে দুই হাজার ৪৮৮ ডলার। পর্যটকদের এই ব্যয় থেকে ব্রাজিলের আয় হবে ৩.০৩ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে এবার টেলিভিশন স্বত্ব বিক্রি নিয়ে ব্রাজিলে হয়েছে লঙ্কাকাণ্ড। ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে টেলিভিশন স্বত্ব বিক্রি করে আয় হয়েছিল দুই হাজার ৪০৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ও মার্কেটিং স্বত্ব্ব বিক্রি করে আয় করেছে এক হাজার ৭২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। চলতি বিশ্বকাপে এই আয়ের হার ও পরিমাণ অনেক বেড়ে যাবে বলেই দাবি আয়োজকদের। আর ব্রাজিল বিশ্বকাপে টেলিভিশন স্বত্ব বিক্রি করা হয়েছে চার বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। যা দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপের প্রায় দ্বিগুণ। এর বাইরে আরো ব্রাজিলকে বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য ইউরোপিয়ান টেলিভিশন দেবে ১.৭ বিলিয়ন ডলার। মার্কেটিং থেকে আয়ের তালিকা সুনির্দিষ্ট করা না গেলেও এ খাত থেকেও বড় আয়ের সম্ভাবনা দেখছে আয়োজক ব্রাজিল ও ফিফা। এবারের বিশ্বকাপের অফিসিয়াল স্পন্সর কোকাকোলা। কোকাকোলা কেবল আয়োজক ব্রাজিলকে অর্থ প্রদান করবে না, একই সঙ্গে ২০১৮ সালের রাশিয়া বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য ফান্ড গঠন করতে হবে। রাশিয়াকে বিশ্বকাপ আয়োজনে ফিফাকে দিতে হবে পাঁচ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ফিফাকে লাভের ভাগ, রাশিয়াকে অনুদান ও ব্রাজিলকে অর্থ দিতে হলে কোকাকোলাকে বিশাল অঙ্কের মুনাফা করতে হবে। বিশ্বকাপ উপলক্ষে কোকাকোলা সেই পরিমাণ অর্থ মুনাফা করতে পারবে বলেই মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়া ব্রাজিলের আয়ের খাতে রয়েছে বিভিন্ন স্পন্সর কম্পানির কাছ থেকে প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণ। ব্রাজিল বিশ্বকাপের সহ-স্পন্সর এডিডাস, এমিরিটাস, হুন্দাই, সনি, ভিসা ২০১১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর ব্রাজিলকে দিয়েছে ৭০৮.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ ছাড়া ব্রাজিল বিশ্বকাপের সঙ্গে যুক্ত ম্যাকডোনাল্ড, ময়ি পার্ক, ওই, ইংলিও প্রতিবছর মিলিতভাবে ব্রাজিলকে দিয়েছে ৫২৪ মিলিয়ন ডলার। চার বছর তারা এই পরিমাণ অর্থ ব্রাজিলকে দিয়েছে। একই সঙ্গে ২০১১-১৩ সালে নিজ দেশের খেলার স্বত্ব বিক্রি করে ব্রাজিলের আয় হয়েছে ১২০ মিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া পর্যটক ভিসা প্রদানের ক্ষেত্রে কর, বিভিন্ন পণ্যের কর থেকে ব্রাজিল সরকারের বিশাল অর্থ আয় হবে। ফলে ব্রাজিল বিশ্বকাপ কেবল ব্যয়ে নয়, মুনাফার দিক দিয়েও অন্য যেকোনো বিশ্বকাপকে ছাড়িয়ে যাবে।<br /> <a name=\"LIMG1\"></a></p> <p> আন্তর্জাতিক ফুটবল ফেডারেশন 'ফিফা' আদতে একটি অলাভজনক সেবা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এই সেবা খাতটিতে দিনে দিনে আয় বেড়েছে বহু গুণ। আর সেই আয়ের অর্থে বিপুল পুঁজির মালিক এখন খোদ ফিফা নিজেই। তবু কেন ব্রাজিলকে অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য সাধারণ মানুষের গলা কাটতে হলো, এ প্রশ্ন খুবই স্বাভাবিক। ফিফাকে ব্রাজিলের সাধারণ মানুষের গলা কাটতে হয়েছে কারণ সাধারণ মানুষের গলা না কাটলে সংগঠনসংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রাতারাতি ফুলে-ফেঁপে উঠবে না। পাশাপাশি বৃহৎ করপোরেট কম্পানিগুলোর সঙ্গে ফিফার যে যোগসাজশ, তা যাতে ভেস্তে না যায় সে জন্যও দেশটির সাধারণ জনগণের রক্ত ঝরিয়েছে। আর খেলাকে ঘিরে ক্রমবর্ধমান এই অর্থনৈতিক রাজনীতির কারণে বিশ্বকাপ তার খেলার নান্দনিকতা হারিয়ে পরিণত হয়েছে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে। ফিফার অর্থ আয়ের ক্রমবর্ধমান এই ক্ষুধা বিগত বছরগুলোর পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই স্পষ্ট হয়ে যায়। ২০০৬ সালের বিশ্বকাপে ফিফা স্পন্সর থেকে যত অর্থ আয় করেছে দক্ষিণ আফ্রিকার বিশ্বকাপে আয় বেড়েছে ৮০ শতাংশ। আর এবারের বিশ্বকাপে আয় বেড়েছে বহু শতাংশ। তবে ফিফার এই অতিরিক্ত আয় ও করদ সুবিধা ফাঁকি দেওয়ার মধ্যে অনেক ছোট ছোট বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানকে তারা অর্থ লগ্নি করতে দেয়নি। যারা মূলত একটা নির্দিষ্ট সময়কে কেন্দ্র করে বিজ্ঞাপন বাণিজ্য করে। সেই জায়গায় ফিফা জায়গা করে দিয়েছে বিশ্বের সব বড় বড় ব্রান্ডকে। আর ফিফার এই নির্বুদ্ধিতার কারণে ক্রমশ না চাইলেও এক অদৃশ্য করপোরেট গলিতে আবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে তারা সময়ের প্রয়োজনেই। দক্ষিণ আফ্রিকার বিশ্বকাপের উদাহরণ টেনে বলা যায়, দক্ষিণ আফ্রিকায় নতুন নতুন স্টেডিয়াম বানাতে ৮৪০ কোটি ডলার ব্যয় করেছিল দেশটির সরকার। যার সিংহভাগ চেটেপুটে নিয়েছে দেশটির নির্মাণ ব্যবসায়ীরা। নির্মাণ শিল্পে বিনিয়োগের এই হার বিগত এক দশকের মধ্যে সব থেকে বেশি। ২০০৫-০৬ সালে নির্মাণ শিল্পে মুনাফা বাড়ে ৫৬ শতাংশ। এ কারণে ওই শিল্পে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের বেতন বাড়ে ৩৯ শতাংশ। কর্মকর্তাদের বেতন বাড়ার হারে শ্রমিকদের বেতন বাড়েনি। আর এ কারণে বিশ্বকাপ উপলক্ষে নির্মাণকাজের সময় পর্যন্ত মোট ২৬টি ধর্মঘট সংঘটিত হয়েছিল।<br /> <a name=\"RIMG2\"></a></p> <p> ২০০২ সালের সাধারণ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো বিজয় অর্জন করেন দেশটির শ্রমিক দলের নেতা লুইস ইনাসিও লুলা দা সিলভা। শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থরক্ষায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তৃণমূল থেকে উঠে আসা এই বামপন্থী নেতা রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর দেয়ালের লিখন পড়তে ভুল করেননি। তিনি অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় প্রচলিত উদারনীতি যেমন চালু রাখেন, তেমনি সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণে সুদূরপ্রসারী ও অভিনব ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ২০০৩ সালে 'বলসা ফ্যামিলিয়া' বা 'পরিবারভিত্তিক আয়ের তহবিল' নামে একটি বিশাল ব্যবস্থার প্রবর্তন করে রাষ্ট্রপতি লুলা ব্রাজিলের নিম্ন-আয়ের দরিদ্র মানুষের আর্থসামাজিক উত্তরণের একটি সফল উদাহরণ সৃষ্টি করেন। যার ফলে আজ ব্রাজিল দাবি করতে পারে যে ২০০৩ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে প্রায় চার কোটি মানুষ মধ্য আয়ের শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত হতে পেরেছে। একই সময়ে প্রায় দুই কোটি ৩০ লাখ লোক দারিদ্র্যসীমা অতিক্রম করেছে। তবে এই যে উন্নতি, তা কি সার্বিক ব্রাজিলবাসীর? লুলার এই তহবিল মাত্র কয়েকটি বড় শহরের কিছু এলাকায় পাইলট প্রকল্প হিসেবে চালু করা হয়েছিল; কিন্তু তা পরবর্তী সময়ে সফলতার মুখ দেখতে পারেনি। আর এর মূলে রয়েছে দেশটির অভ্যন্তরে দিনে দিনে গড়ে ওঠা বর্ণবৈষম্যের বীজ। দেশটির সংখ্যগরিষ্ঠ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সিংহভাগই কৃষ্ণকায়। তাদের কেউ কেউ, এমন কি সর্বোচ্চ বিচারালয়ের বিচারকের মর্যাদায় আসীন হয়েছেন, যা ব্যতিক্রম বলে ধরা হয়। ইউরোপীয় বংশোদ্ভূত শেতবর্ণের সংখ্যালঘু অধিবাসীরা আর্থসামাজিক মর্যাদায় ওপরের দিকে। এরপর মিশ্র বর্ণের যাদের 'মুলাটো' বলা হয়, তারা ও কৃষ্ণকায় মানুষরা অধিকাংশই দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। আদমশুমারিতে প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, ব্রাজিলের ২০০ মিলিয়ন জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি নিজেদের আফ্রিকা থেকে আগত কৃষ্ণকায় মানুষের বংশধর হিসেবে উল্লেখ করে এবং প্রায় ৩০ শতাংশ ব্রাজিলীয় নিজের বর্ণের বাইরে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে। কিন্তু দেশটির যে অংশটির হাতে অর্থনীতির বেশির ভাগ অংশটিই জিম্মি হয়ে আছে, তাদের প্রতিনিধিত্বই করছেন বর্তমান দিলমা রৌসেফ। রৌসেফের পরিষদের বেশির ভাগ সভ্যই পশ্চিমা বিভিন্ন দেশে ব্যবসা ও ভূমিতে বিনিয়োগ করছেন। যার কারণে ব্রাজিলের সাধারণ মানুষ না খেয়ে মরুক বা বাঁচুক তাতে কিছুই আসে যায় না এই সরকারের।<br /> <a name=\"LIMG3\"></a></p> <p> দেশটির সাও পাওলো, রিও ডি জেনেরিওসহ অন্য শহরগুলোতে পুলিশের সঙ্গে প্রতিবাদকারীদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে কয়েকবার। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনে জড়ো হয়ে বিশ্বকাপ আয়োজনের প্রতিবাদ জানায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষ। প্রতিটি প্রতিবাদ থেকেই তারা ব্রাজিল সরকার ও ফিফার বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকে। আর সেখানে পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠি, কাদুনে গ্যাস এমনকি গুলিও ব্যবহার করেছে। যে সংবাদ আমাজনের গহিন বনের পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকে বিশ্বের সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছায় না। এবারের বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন দলকে দেওয়া হবে ৩৫ মিলিয়ন ডলারের প্রাইজমানি ও রানার্স আপ ২৫ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু ব্রাজিলের সাধারণ মানুষ কী পাবে, এর হিসাব কি কেউ জানে! কয়েকদিন আগেই আমাজনের গহিন থেকে একদল আদিবাসী তীর-ধনুক হাতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের মুহুর্মুহু ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় ব্রাসিলিয়ার রাজপথ অচল করে রাখে দেড় হাজার বিক্ষোভকারী। আদিবাসী বিক্ষোভকারীরা এ সময় উঠে পড়ে ব্রাজিলিয়ান সংসদ ভবনের ছাদে। আদিবাসী বিক্ষোভকারীদের আক্রমণে পায়ে তীরবিদ্ধ এক পুলিশকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে ঘন ঘন টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে পুলিশ। জঙ্গলের আদিবাসীরাও যে বাস্তবতা বুঝতে পেরে নগর সভ্যতায় ছুটে আসছে, সেই বাস্তবতা ব্রাজিলের ধনিক শ্রেণি বুঝতে পারছে না।</p>