ঢাকা, শনিবার ১২ জুলাই ২০২৫
২৮ আষাঢ় ১৪৩২, ১৬ মহররম ১৪৪৭

ঢাকা, শনিবার ১২ জুলাই ২০২৫
২৮ আষাঢ় ১৪৩২, ১৬ মহররম ১৪৪৭

অষ্টগ্রামের ঈনির

  • অষ্টগ্রামের পনিরের কথা ব্রিটেনের রানিরও জানা। কেন এত ভালো পনির তৈরি হয় কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামে তার সুলুকসন্ধান করেছেন নাসরুল আনোয়ার
অন্যান্য
অন্যান্য
শেয়ার
অষ্টগ্রামের

ঈনির

 শুকনো মৌসুমে বিস্তীর্ণ হাওর ঘাসে সবুজ হয়ে থাকত। এখনকার মতো এত ধান ফলত না তখন। বড় গেরস্তরা গরু-মহিষ পালতেন। একেকটি গোয়ালে গাভি আর মহিষ থাকত শতখানেক।

দুধ খেয়ে শেষ করা যেত না। তাই বাড়তি দুধ ফেলে দিতে হতো বাড়ির পাশের খালে। ওই সময়েই মোগলদের একটি দল অষ্টগ্রামের কাস্তুলে ছাউনি ফেলে। আনুমানিক তিন-সাড়ে তিন শ বছর তো হবেই।
অষ্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আহাদ মাস্টার বলছিলেন সেদিনের কথা। তিনি শিক্ষক মানুষ। এক দিন কাস্তুল ছাউনির এক মোগলসেনা বড় হাওরে গিয়ে গরু-মহিষের পাল দেখেন। দুধের বিস্তর উত্পাদন তাঁকে বিস্মিত করে।
স্থানীয়দের দুগ্ধজাত খাবার তৈরি করতে দেখে তিনিও তাঁর অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চান। গবেষণা করে একদিন ওই মানুষটি দুধের ছানা দিয়ে নতুন একটি খাবার তৈরি করে ফেলেন। একে আমরা এখন পনির নামে চিনি। অনেকে বলেন, মোগলদের দেওয়ান পনির খাঁর নাম থেকে খাবারটির নাম হয়েছে। অষ্টগ্রাম কিশোরগঞ্জ জেলার একটি হাওর উপজেলা।

 

হাওরবাসীর নাশতায়

কাঁচাগোল্লা, ক্ষীর, সন্দেশ, বরফি, রসগোল্লা ইত্যাদি তৈরি করা হয় ছানা থেকেই। অনেকটা একই প্রক্রিয়ায় তৈরি হলেও পনিরের স্বাদ সম্পূর্ণ ভিন্ন। পনির হয় দানাদার এবং স্বাদ নোনতা। পনির মিষ্টান্ন নয়, কিন্তু উপাদেয়। জানা যায়, একসময় হাওরবাসীর সকালের নাশতায় পনির থাকত। হাওরজুড়ে থাকা গো-চারণভূমির তাজা ঘাস খেয়ে হূষ্টপুষ্ট হওয়া মহিষের দুধ হতো ঘন ননীযুক্ত। সেই দুধ থেকে উত্কৃষ্ট মানের পনির তৈরি হতো।

সেকালে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অতিথি আপ্যায়নে পনির পরিবেশন করা হতো। বাড়িতে আসা অতিথিদের গরম ভাতের সঙ্গে দেওয়া হতো কুচি কুচি করে কাটা পনির। আর ভাঁপ ওঠা চিতই পিঠার ওপরভাগে পনিরের টুকরো দিয়ে দিলে হয় অতুলনীয়। তবে এ প্রজন্মের সঙ্গে পনিরের পরিচয় ভিন্নভাবে। আজকাল পিত্জা, বার্গার বা হরেক রকম বিস্কুটে পনির দেওয়া হয়। এ ছাড়া সমুচা, পরোটা বা সালাদেও পনির দেওয়ার চল হয়েছে অধুনা।

 

পনির মেলে

ঢাকার বহু এলাকায় তাজা বা কাঁচা পনির মেলে, বিশেষ করে পুরান ঢাকার অনেক স্থানেই রাস্তার মোড়ে পনির বিক্রি হয়। অলিগলিতেও অনেকে ফেরি করে পনির বিক্রি করেন। ফেরিওয়ালারা হাঁক দিয়ে বলেন, ‘রাখবাইন অষ্টগ্রামের পনির!’

 

পনিরের দিনকাল

পনির ব্যবসায়ীরা জানান, ১৫-২০ বছর আগেও হাওরে প্রচুর গো-চারণভূমি ছিল। এলাকার কৃষকদের শত শত গরু ও মহিষ সেখানে চড়ানো হতো। ওই সময় অষ্টগ্রামের ৫০-৬০টি অথবা তার চেয়েও বেশি পরিবার পনির তৈরির কাজে সম্পৃক্ত ছিল। কয়েক শ মানুষ পনির তৈরি বা বিপণন পেশায় যুক্ত ছিলেন। আর পনির নিতে বাইরের এলাকার পাইকাররা সে সময় অষ্টগ্রামে ভিড় করতেন। এ ছাড়া অষ্টগ্রামের পনির কারবারিরা সিলেট, সুনামগঞ্জ, তাহিরপুর, জামালগঞ্জ, মৌলভীবাজার, কুলাউড়াসহ এ অঞ্চলের বহু এলাকায় অবস্থান করে পনির বানাতেন।

ধীরে ধীরে হাওরে ধানচাষ  বাড়লে গো-চারণভূমি কমতে শুরু করে। কমে যায় দুধের যোগান। ওই অবস্থায় পনিরের দুধের চাহিদা মেটাতে পনির কারবারিরা ময়মনসিংহের ত্রিশাল, নেত্রকোনা, গাজীপুরসহ উজান এলাকা থেকে দাদনে (অগ্রিম মূল্যে) গরু ও মহিষের পাল নিয়ে আসতেন। শুকনো মৌসুমে হাওরে প্রচুর চাইল্যাসহ বিভিন্ন ধরনের ঘাস জন্মাত। এ ঘাস খেয়ে হূষ্টপুষ্ট হয়ে ওঠা গবাদি পশু থেকে ঘন ননিযুক্ত দুধ মিলত। আর বেশি উত্পাদন হওয়ায় দুধও পাওয়া যেত সস্তায়। ২০-২৫ বছর আগেও ৮-১০ টাকা লিটারে দুধ পাওয়া যেত। মাঝখানে ছেদ পড়লেও ওই সময়টাতে আবারও অষ্টগ্রামে পনির তৈরির ধুম পড়ে যায়। বিক্রি হতো ১৫০-১৬০ টাকা কেজি দরে। একপর্যায়ে হালের জায়গা দখল করে ট্রাক্টর। ধানের ফলনও আশাতীত বেড়ে যায়। তাই নতুন করে ফসল আবাদের দিকে হাওরের কৃষক ঝুঁকে পড়ে। দিনে দিনে পতিত জমি কমে যেতে থাকে। গরু-মহিষের  হাওরে আসা কমে যায়। দুধের ঘাটতি দেখা দিলে পনিরের কারবারও ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে।

আব্দুল আহাদ মাস্টার জানান, তাঁর বাবার নানা ছিলেন বড় গেরস্ত। শয়ে শয়ে গাভি ও মহিষ ছিল তাঁদের। তাঁর বাবার আমলেও তাঁদের গোয়ালে ২০-২৫টির মতো গাভি ছিল। সে সময়ে বড় গেরস্তরা খাওয়ার জন্য পনির বানাত। এক পয়সা ছিল দুধের সের। ছোটবেলায় তিনি নিজে দেখেছেন, চার-পাঁচ পয়সা থেকে এক আনায় এক সের দুধ মিলত। ধীরে ধীরে দাম বেড়ে দু-তিন বা চার আনা হয়। আর তখন চার আনায় মিষ্টি পাওয়া যেত। ওই সময় ৮-১০ পয়সায় এক সের পনির মিলত। তিনি নিজে অষ্টগ্রামের ৫০-৬০টি পরিবারকে পনির বানাতে দেখেছেন।

 

পনির যেভাবে

অষ্টগ্রাম সদরের খানঠাকুর দিঘিরপারের মফিজ চৌধুরী প্রায় ৩৬ বছর ধরে পনির তৈরি করেন। তিনি জানান, বড় গামলায় পরিমাণমতো দুধ ঢেলে কাঁচা দুধেই মাওয়া (ছানার পানি) ঢালা হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই দুধ জমাট বাঁধতে শুরু করে। তারপর হাত দিয়ে এবং পরে ছোরার মতো তীক্ষ বাঁশের চিলতে দিয়ে জমাট বাঁধা ছানা কেটে কুচি কুচি করে দানায় রূপান্তর করা হয়। গামলা থেকে দানা তুলে বাঁশের টুকরিতে রাখার পর টুকরি থেকে জলীয় অংশ চুইয়ে পড়তে থাকে। পানি ছাঁকা চলার সময় ভেতরে ছোট ছোট ছিদ্র করে লবণ প্রবেশ করানো হয়। এরপর চাপ প্রয়োগ করে পনিরের চূড়ান্ত রূপ দেওয়া হয়। 

তিনি জানান, এখন গাভির দুধই তাঁদের ভরসা। এ দুধে ননি কম হয় বলে পনিরও কম হয়। ৪০ লিটার দুধে এখন চার কেজির মতো পনির পাওয়া যায়। পৌষ থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত  দুধ মেলে। তখনই অষ্টগ্রামে পনির তৈরির ধুম পড়ে। ওই মৌসুমে প্রতিদিনই তিনি ছয়-সাত কেজি পনির বানাতে পারেন। তাঁর মতে, অষ্টগ্রামের পনিরশিল্প বাঁচাতে হলে সরকারিভাবে দুধের খামার গড়তে হবে। এতে দুধের উত্পাদন বাড়ার পাশাপাশি দাম কমে আসবে।

ছবি : লেখক

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ