একাত্তরের ১৬ এপ্রিল ছিল শুক্রবার। বৈশাখের ২ তারিখ। দূর-দূরান্ত থেকে ক্রেতা-বিক্রেতারা এসেছে। হাট সরগরম।
স্মৃতি একাত্তর
সেদিন ছিল হাটবার
- চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার সরোজগঞ্জ বাজারে প্রতি শুক্র ও সোমবার বড় হাট বসে। একাত্তরেও বসত। পাশের জেলা ঝিনাইদহ থেকেও অনেকে সদাই নিতে আসে। উপজেলা সদর ও আলমডাঙ্গা উপজেলা থেকে তো লোক আসেই। একাত্তরের ১৬ এপ্রিলও এসেছিল। গিয়েছিলেন আজগর আলীও। হানাদার বাহিনী এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়েছিল। মানুষ ছুটেছিল দিগ্বিদিক। মানিক আকবর শুনে এসেছেন সে দিনের কথা
অন্যান্য

সেদিন আজগর আলী
সদর উপজেলার শাহপুর গ্রামে আজগর আলীর বাড়ি। একাত্তরে তাঁর বয়স ১৬ বা ১৭ ছিল। হাটে এসেছিলেন কেনাকাটা করতে। ঘুরে ঘুরে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনছিলেন।
একসময় মনে হলো, গুলি আখের গাদায়ও লাগছে। এ জায়গাও নিরাপদ নয়। পালাতে হবে। দুজন হামাগুড়ি দিয়ে বের হলেন। আবার ছুটলেন। পাশে জলিবিলা গ্রাম। সেই গ্রামের পশ্চিম দিকে চলে গেলেন আজগর আলী ও হানিফ। এ সময়ই গুলি লাগল আজগর আলীর বুকে। মাটিতে পড়ে গেলেন আজগর। জ্ঞান হারালেন।
এখনকার সরোজগঞ্জ বাজার
সাহসী পিতার অভিযান
আজগর আলী পরে জানতে পারেন গোলাগুলির খবর পেয়ে তাঁর বাবা মকছেদ মণ্ডল হাটের দিকে ছুটে আসেন। সবাই যখন হাট ছেড়ে পালাতে ব্যস্ত তখন আজগর আলীর বাবা হাটে এসে পড়ে থাকা গুলিবিদ্ধ লাশের ভেতর তাঁর ছেলেকে খুঁজছেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি পুরো হাট ছুটে বেরিয়েছেন ছেলের খোঁজে। একসময় এক দোকানের ভেতর গুলিবিদ্ধ এক ছেলের লাশ পেলেন। ছেলের লাশ ভেবে তাড়াতাড়ি সেই লাশ টেনে দোকানের বাইরে বের করে দেখেন লাশটি তাঁর ছেলের বয়সী খলিল নামের একজনের। খলিল লেখাপড়ার পাশাপাশি নিজেদের মুদিখানা দোকানে কাজ করতেন। গুলিবিদ্ধ হয়ে দোকানেই মারা যান খলিল।
ছেলের লাশ না পেয়ে মকছেদ মণ্ডল আবার খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। হাটে জীবিত কোনো মানুষ ছিল না। জীবন বাঁচাতে পালিয়েছে সবাই। পরে খবর পান তাঁর ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে আছে জলিবিলা গ্রামের কাছে। গুলিবিদ্ধ ছেলেকে কাঁধে করে বাড়ি ফিরলেন মকছেদ মণ্ডল। গ্রাম্য ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা চলল ছেলের।
আঁচলে সোনার চেন, ডাক্তারবাড়ি ছুটছেন মা
গুলিবিদ্ধ আজগর আলীকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ডাক্তারবাড়ি। আজগর আলীর মা মরিয়ম বেগম ছেলের চিকিৎসা খরচের জন্য ঘরে আড়ার বাঁশের ফোকরে থাকা সোনার চেন তড়িঘড়ি বের করে আঁচলে বাঁধলেন। ছুটলেন দুই কিলোমিটার দূরে ডাক্তারবাড়ি। ডাক্তারের হাতে সোনার চেন তুলে দেওয়ার জন্য আঁচল খুললেন। খুলেই অবাক। সোনার চেন আঁচলে নেই। আছে একটি রসুন। মায়ের মনে পড়ে গেল, যে ফোকরে সোনার চেন রাখা হয়েছিল, সেই ফোকরটি রসুন দিয়ে বন্ধ করে রাখা ছিল। তড়িঘড়ি করে সোনার চেন নিতে গিয়ে তিনি রসুন নিয়ে আঁচলে বেঁধেছেন।
আবদুল্লা শেখ আর মনসুর মণ্ডলও ছিলেন
একাত্তরের সেই বৈশাখে হাটে আবদুল্লা শেখও ছিলেন। তিনি তখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। হাটের পাশেই বাড়ি। হাটে গিয়েছিলেন ঘুরতে। পাকিস্তানি বাহিনী গুলি করলে তিনি দৌড়ে পালাতে থাকেন। একটা লবণের বস্তার খোলা মুখের ওপর একজন মানুষকে তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে থাকতে দেখেন। সাদা লবণ রক্তে লাল হয়ে উঠেছিল। পাকিস্তানি বাহিনী হাটের পাশের মসজিদের সামনে গিয়ে মুসল্লিদেরও লাইন ধরে গুলি করে মারে। মুনসুর মণ্ডল ওই লাইনেই ছিলেন। গুলি শুরু হওয়ার আগেই তিনি মাটিতে শুয়ে পড়েন। গুলিবিদ্ধ লাশও পড়ে তাঁর পাশে। তিনি মরার মতো শুয়ে ছিলেন। সবাই মরে গেছে ভেবে হানাদার বাহিনী চলে যায়। মুনসুরদের বাড়িও হাটের কাছাকাছি। হাটে গুলির শব্দ শুনে গাঁয়ের লোকও পালিয়েছিল। গুলিবর্ষণ থেমে যাওয়ার পর মুনসুর গাঁয়ে ফিরে দেখেন সব ফাঁকা। শুধু তাঁর মা বসে ছিলেন ছেলের অপেক্ষায়।
সম্পর্কিত খবর