ঢাকা, শনিবার ২৬ জুলাই ২০২৫
১০ শ্রাবণ ১৪৩২, ৩০ মহররম ১৪৪৭

ঢাকা, শনিবার ২৬ জুলাই ২০২৫
১০ শ্রাবণ ১৪৩২, ৩০ মহররম ১৪৪৭

পাখি ভাই দ্য ঘটক

শখের বসে শুরু করেছিলেন। আজ তিনি পথের দিশারি। চার দ
শখের বসে শুরু করেছিলেন। আজ তিনি পথের দিশারি। চার দ
শেয়ার
পাখি ভাই দ্য ঘটক

নতুন সংসার আর চাকরি নিয়ে বেশ কেটে যাচ্ছিল দিন। একদিন গ্রামের একজন তাঁর বোনের জন্য একটি ভালো পাত্র খুঁজে দিতে বলেন। লোকটি ভেবেছিল, আশরাফ যেহেতু নানা জায়গায় যায়, তাই তাঁর হয়তো চেনা থাকবে অনেক। প্রস্তাবটি আন্তরিকতার সঙ্গে নেন আশরাফ-রোজই তো কত জায়গায় যান।

যদি একটু মানুষের উপকার করা যায়! উঠেপড়ে লাগলেন বিয়ের মতো এক পবিত্র সম্বন্ধ তৈরির কাজে। সুপাত্রের সন্ধান পেতে বেশি দেরি হলো না। কদিনের মধ্যে বিয়েও সম্পন্ন হলো। বিয়ে শেষে পাত্রীর বাবা যখন তাঁকে বুকে জড়িয়ে কেঁদেছিলেন, সেদিনই যেন এই কাজের ভালো লাগা তাঁকে পেয়ে বসে।
জানালেন, বিয়ের মতো পবিত্র একটি কাজের সঙ্গে মানুষের দোয়া থাকে। এর পর থেকে তাঁর কাছে একটি-দুটি প্রস্তাব আসতে শুরু করে।

 

হঠাৎ একদিন

খুলনা নিউজপ্রিন্টে চাকরি ছিল। জোড়া মেলানোর কাজও চলছিল।

হঠাৎ একদিন পেটের ব্যথাটা একটু বেশি উঠল। কারখানার স্বাস্থ্য পরীক্ষায় আনফিট ঘোষণা করা হলো তাঁকে। চাকরি হারিয়ে বিষণ্নতায় ভুগলেন। এরপর বরিশাল মেডিক্যাল কলেজে অপারেশন হলো। ভারী কাজ করা তাঁর পক্ষে আর সম্ভব হয়ে উঠছিল না।
তত দিনে ঘটকালির জন্য মানুষ তাঁকে কিছু খরচাপাতি দেওয়া শুরু করেছে। আশরাফ হোসেন জানালেন, প্রথম প্রথম মানুষ কিছু দিত না। নিজের টাকা খরচ করে ছেলেমেয়ের বিয়ের ঘটকালি করতাম। পরে আস্তে আস্তে মানুষ কিছু টাকা-পয়সা দেওয়া শুরু করল। তখন ভাবলেন যেহেতু ভারী কাজ আর সম্ভব না, তাই এটাই মন দিয়ে করি। সেটা ১৯৭৩ সালের ঘটনা। শুরু হয় তাঁর ঘটকালির পেশা-জীবন। তত দিনে ঘটক হিসেবে নিজের এলাকায় বেশ পরিচিত হয়ে উঠছেন তিনি। সকালে এক জায়গায় কেউ তাঁকে যেতে দেখেছিলেন, সে লোকই দুপুরবেলা তাঁকে পাশের গ্রামে দেখে বলে বসলেন, 'আরে! সকালেই না তোমাকে ওখানে দেখলাম! এখানে এলে কখন? তুমি তো দেখি পাখির মতো উইড়্যা বেড়াও।' পাখির সঙ্গে তুলনাটা ভালো লেগে যায় তাঁর। আস্তে আস্তে পাখি ভাই নামটা ছড়িয়ে পড়তে থাকে চারদিকে।

গন্তব্য ঢাকা

ঢাকায় মাঝেমধ্যেই আসা পড়ত। সেটাও ঘটকালির কাজে। পাত্রীর বাবা হয়তো কোনো ছেলের সন্ধান পেয়েছেন। তাঁকে ডেকে বললেন, তুমি যাও, গিয়ে দেখে এসো পাত্রটা কেমন। কিংবা ঢাকায় কারো মেয়ে বড় হয়েছে, সে মেয়ের বাবাই তাঁকে ডেকে পাঠালেন নিজের বাসায়। তিনি সে বাসায় এসে কয়েক দিন থেকে-খেয়ে পাত্রীর খোঁজখবর নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন পাত্রের খোঁজে। তত দিনে বেশ পাত্র-পাত্রীর তালিকা তাঁর কাছে জমা পড়ে গেছে। ঢাকায় এসে কোনো আত্মীয় খুঁজে না পেলে হোটেলে উঠতেন। থেকেছেন পুরান ঢাকার আলুবাজার, তাঁতীবাজারের বিভিন্ন মেসেও। আর ঢাকা ঘুরে খোঁজ করতেন পাত্রপাত্রীর।

 

প্রথম বিজ্ঞাপন

১৯৮৩ সালের ঘটনা। হোটেলে শুয়ে আছেন পাখি ভাই। পাশে রাখা মোটা ব্যাগটির দিকে তাকিয়ে ভাবছিলেন, অসংখ্য পাত্রপাত্রীর ছবি আর তাদের তথ্যে ভরে আছে ব্যাগটা। হেঁটে হেঁটে এত পাত্র-পাত্রীর খোঁজ করা বেশ কঠিন। হঠাৎই মাথায় আসে বিজ্ঞাপনের ভাবনা। পাখি ভাই বলেন, আমি পাত্র-পাত্রীদের খুঁজে বেড়াই; কিন্তু পাত্রপাত্রীরা নিজেরাও তো তাদের পাত্রপাত্রী খুঁজে বেড়ায়। যদি জানাই যে আমার কাছে অনেক পাত্র-পাত্রী আছে, তাহলে তো অনেকেই আমার খোঁজ করবে। সে চিন্তা থেকে ইত্তেফাকে একটি বিজ্ঞাপন দিলেন। তাঁর মতে, এটাই ছিল স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম কোনো দৈনিক পত্রিকায় পাত্রপাত্রী চেয়ে বিজ্ঞাপন। তার পরের দিনটা ছিল অভাবনীয়। বিজ্ঞাপনে হোটেলের ফোন নম্বর উল্লেখ করেছিলেন। সে হোটেলে সেদিন এত এত ফোন এসেছিল যে মালিক রেগেমেগে এসে বললেন, হোটেল ছেড়ে যান।

 

প্রথম অফিস

ছোট্ট এক রুমের একটি অফিস খুললেন ইস্টার্ন প্লাজায়। সেটাও আজ থেকে ২৬ বছর আগের ঘটনা। একজন মাত্র পিয়ন ছিল তখন। ২৬ বছর শেষে সেই একরুমের অফিস আজ এসে চার রুমেও কুলাচ্ছে না। একজন পিয়নের জায়গায় এখন তাঁর অফিসে কাজ করেন ছয়-সাতজন কর্মী।

প্রথম প্রথম পায়ে হেঁটে, টেলিফোনে ঘটকালি করলেও এখন আর তা করেন না বললেই চলে। অফিসে বসে ওয়েবসাইট আর ই-মেইলের মাধ্যমে সারেন ঘটকালির কাজ। অফিস ভাড়া চার হাজার থেকে বেড়ে আজ ৫২ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে তাঁর অফিস খরচ এখন তিন লাখ টাকা।

যেমন বিয়ের বাজনা

৪৪ বছরের ঘটকালি জীবনে প্রায় ১২ হাজারের মতো ছেলেমেয়ের বিয়ের ঘটকালি করেছেন। কখনো নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে ঘটকালি করেছেন। তবে পেশা হিসেবে নেওয়ার পর থেকে তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠানে পাত্রপাত্রীর খোঁজের জন্য নির্দিষ্ট একটি ফি নেন। তবে সবার বেলায় এক রকম ফি নেওয়া হয় না। পাত্র-পাত্রী খোঁজা বাবদ যে খরচ হয়, তা এ ফির মধ্যেই ধরা হয়। বিয়ে হয়ে গেলে দুই পক্ষ খুশি হয়ে যা দেন তাই নেন। তিনি বলেন, 'খরচটা উঠে আসে বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর। আমার আর কোনো চাওয়া থাকে না। আমার মাধ্যমে একটি বিয়ে হয়ে গেলে আনন্দটাই বড় পাওয়া। এরপর দুই পক্ষ খুশি হয়ে যা সম্মানি দেয়, তাই নিয়ে থাকি। এটা নির্ভর করে পাত্র-পাত্রীর অবস্থার ওপর। কেউ ২০ হাজার দেয়, কেউ ৫০ হাজার। যারা কোটি টাকা খরচ করতে পারে, তারা খুশি হয়ে দেড়-দুই লাখও সম্মানি দেয়। এখন পর্যন্ত একটি বিয়েতে সাত লাখ টাকা সম্মানি পাওয়ার রেকর্ড আছে।'

 

পাত্র-পাত্রী খোঁজা

এখন আর মাইলকে মাইল হাঁটেন না। আগে তো সাগরও ডিঙিয়েছেন। এমনও হয়েছে যে কোনো কোনো বাড়িতে রাতও কাটিয়েছেন। আবার এক বিয়ে দিতে গিয়ে বেশ কয়েকটি বিয়ের প্রস্তাব পেয়ে যেতেন। এখন বরং পাত্র-পাত্রীর অভিভাবকরাই তাঁকে খুঁজে বের করেন। এরপর অফিসে এসে নিজের ছেলে বা মেয়ের জন্য চাহিদা মোতাবেক পাত্র বা পাত্রীর খোঁজ দিতে বলেন। তারপর সে চাহিদামতো পাত্র বা পাত্রীর বায়োডাটা ই-মেইলে পাঠিয়ে দেন অভিভাবকদের কাছে। পছন্দ হলে শুরু হয় পরবর্তী প্রক্রিয়া।

 

বিয়েটা সুখের হবে তো!

আদরের ছেলে বা মেয়ের বিয়ের পর সে সুখী হবে তো? কিংবা মেয়ে ভালো থাকবে তো শ্বশুরবাড়িতে?-ঘটককে এ প্রশ্নটাই ফাইনাল বাঁশির মতো করে বসেন অভিভাবকরা। এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর সরাসরি দেন না পাখি ভাই। তাঁর মতে, ছেলে বা মেয়ে আপনার। বিয়েও দেবেন আপনি। পাত্র বা পাত্রীর খোঁজ দেওয়ার দায়িত্ব আমার। কিন্তু তাদের ভালো-মন্দ খুঁজে দেখার দায়িত্ব আপনারই, যার জন্য এখন পর্যন্ত কোনো রকম প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়নি তাঁকে বা তাঁর পাখি ভাই প্রাইভেট লিমিটেডকে।

 

হরেক রকম পাত্র-পাত্রী

জীবনে অসংখ্য ছেলেমেয়ের বিয়ে দিয়েছেন তিনি। সে তালিকায় যেমন আছে মন্ত্রীপুত্র-কন্যা, সচিব, এমপির ছেলেমেয়ে, ব্যাংক কর্মকর্তা, চার্টার্ড অ্যাকাউন্টট্যান্ট, পুলিশ কর্মকর্তা, সামরিক অফিসার, স্বল্প বেতনের চাকুরে, তেমনি এই তালিকায় রয়েছে রুপালি জগতের অভিনেতা-অভিনেত্রী থেকে শুরু করে খবর পাঠক-পাঠিকারাও। বিদেশ-ফেরত ছেলেমেয়ে তো আছেই। এখনো এ রকম শত শত ছেলেমেয়ের বিয়ের জন্য পাত্র-পাত্রীর খোঁজ রয়েছে পাখি ভাই প্রাইভেট লিমিটেডে।

 

বাংলাদেশের লাভগুরু

তাঁকে নিয়ে কয়েক বছর আগে আল জাজিরা টেলিভিশন একটি প্রতিবেদন প্রচার করে। আল জাজিরার রিপোর্টার চার দিন অফিসে এসে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। বাসায়ও গেছেন। খোঁজ নিয়েছেন অফিসের আশপাশের মানুষের কাছ থেকেও। তারপর বাংলাদেশের লাভগুরু নামে তাঁর ওপর প্রতিবেদন প্রচার করে তারা। গার্ডিয়ান পত্রিকা, বিবিসি, বিটিভিসহ সিঙ্গাপুরের একটি পত্রিকায় তাঁকে নিয়ে প্রতিবেদন হয়েছে।

 

প্রাপ্তির খাতায় যত যোগ

৪৪ বছরের ঘটকালি জীবন শেষে এখন প্রাপ্তির খাতায় অনেক কিছুই যোগ হয়েছে পাখি ভাইয়ের কাছে। তাঁর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে অনেকে তাঁর মতো খুলেছেন ঘটকালির অফিস। সারা দেশের মানুষ এক নামে তাঁকে চেনে। এ ছাড়া দেশের বাইরে ছড়িয়ে থাকা বাংলাভাষীদের কাছেও তিনি পরিচিত পাখি ভাই নামে। পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর পাত্র চেয়ে বিজ্ঞাপনের কারণে অনেক বেশি জনপ্রিয় তিনি। তিনি বলেন, 'আমার আগে ঘটকালিকে পেশা হিসেবে নিতে কেউ সাহস করেনি। আমার এই পেশায় সফলতা দেখে এখন অনেকেই ঘটকালিকে পেশা হিসেবে নিচ্ছেন। দেশব্যাপী আমি পরিচিতি পেয়েছি এই পেশাতেই। বড় বড় পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে আমার সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়েছে।'

 

মনে রাখি গুরুজনদের কথা

গুরুজনরা বলতেন, ঘটকালি একটি মহৎ কাজ, সওয়াবের কাজ। সে কারণেও আমার কাজে আমি আত্মতৃপ্তি খুঁজে পাই। সবচেয়ে বড় যে কথা, দীর্ঘদিন ধরে বিয়ে হচ্ছে না-এমন কোনো মেয়ের যখন বিয়ে দিতে পারি, তার মা-বাবা জড়িয়ে ধরে যখন হাউমাউ করে কাঁদেন, সে স্মৃতি কখনোই ভুলতে পারি না। মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে এ জন্য আমি ভীষণ কৃতজ্ঞ। যত দিন সুস্থভাবে বেঁচে থাকি এ কাজটাই করে যেতে চাই।

 

ব্যক্তিজীবন

পাখি ভাইয়ের বাড়ি বরিশাল। দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি বড়। পড়াশোনা বেশি দূর করতে পারেননি, টেনেটুনে ক্লাস নাইন। ১৭ বছর বয়সে বিয়ে করেন। চাকরিও ছিল একটা। স্ত্রী, চার ছেলে আর দুই মেয়ে নিয়ে পাখি ভাইয়ের সংসার। ছেলেমেয়েরা বিয়ে করে নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। এখন নিজের ছোট মেয়ে আর স্ত্রী নিয়ে থাকেন।

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ