লাঠিটিলার গভীর জঙ্গল। সরু একটা পথ দিয়ে পরপর হাঁটছি আমি, মিশুক, মেহেদী আর স্থানীয় দুই তরুণ। ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়ছে। পথ পিছল, তাই ছিলাম হুঁশিয়ার।
বাঘের খোঁজে
বান্দরবান কিংবা সিলেট-যেখানেই যান, আগে বাঘের খবর জ

শক্তপোক্ত গড়ন। উচ্চতা মাঝারি, দুই চোখে ধারালো দৃষ্টি। শুরুতে একটু দোনামনা করলেও একটু পরে ঝাঁপি খুলে দিলেন।
কী শিকার করেন?
হরিণ। বিশাল সম্বর আছে লাঠিটিলায়।
চিতা বাঘ দেখেছেন?
হ্যাঁ, তা তো দেখছি। গত বছরও বড় ডোরা বাঘ দেখছি। একটা ঝোপের মধ্যে বইসা ছিল।
বিশ্বাস হতে চাইছিল না। আমার দেখা সিলেট বিভাগের সেরা জঙ্গল লাঠিটিলা। এখানে চিতা বাঘ আছে, স্থানীয় অনেক লোকের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হয়েছি। কিন্তু তাই বলে ২০১১ সালে লাঠিটিলায় রয়েল বেঙ্গল টাইগার? আরো কিছুক্ষণ জেরা করেও শিকারি সফিককে টলাতে পারলাম না। কথা বলে বুঝলাম, তাঁর ভুল হওয়ার সুযোগ কম।
লাঠিটিলার বাঘের ব্যাপারটা আরো নিশ্চিত হই পরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মৃদুল ভাইয়ের (মনিরুল খান) সঙ্গে কথা বলে। তিনিও সেখানে ২০০৮ সালে বাঘ দেখা যাওয়ার খবর পেয়েছেন। তবে বাঘ এই জঙ্গলের স্থায়ী বাসিন্দা, নাকি সীমানার ওপারের ভারতের জঙ্গল থেকে আসে-এটা পরিষ্কার নয়।
বাংলাদেশের অনেক জায়গাতেই একসময় বাঘ ছিল। আর এখন কিনা আমরা বাঘকে আটকে ফেলেছি সুন্দরবনের মধ্যে, অন্তত অফিশিয়ালি। এটাও ঠিক, সুন্দরবনের বাইরে কোথাও বাঘ থাকলে তা একেবারে হাতে গোনা, তাও বাংলাদেশের স্থায়ী বাঘ কি না, নিশ্চিত নয়।
খুব বেশি পেছন ফিরতে হবে না। পঞ্চাশ-ষাট বছর পিছিয়ে গেলেই বাংলাদেশের অনেক বনেই এদের রাজত্বের খোঁজ মেলে। মধুপুরের জঙ্গলের কথাই ধরুন। সুষঙের জমিদার ১৯৪৫-৪৬ সালের দিকেও শালবনে বাঘ মারেন।
ঢাকা থেকে ট্রেনে সিলেটে গেলে লাওয়াছড়া বনের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় শিহরিত হন অনেকে। এই লাওয়াছড়ায়ও বাঘেরা মহাদর্পে ঘুরে বেড়াত একসময়। প্রকৃতিবিদ নওয়াজেশ আহমদ লাওয়াছড়ায় বাঘ দেখার বর্ণনা দিয়েছেন। রাতে জিপে ভ্রমণের সময় বাঘটা দেখেন তিনি, এটা ষাটের দশকের ঘটনা। ১৯৬২ সালে লাওয়াছড়ায় বাঘ মারেন এক পাকিস্তানি জেনারেল। মাচায় বসার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বাঘটি মারেন ভদ্রলোক। 'যখন শিকারি ছিলাম' বইয়ে সিলেটের জঙ্গলে বাঘ মারার কাহিনি বলেছেন এনায়েত মওলা। ওটা কানাইঘাটের আশপাশে, পরিত্যক্ত নুনছড়া ও লুভাছড়া চা বাগানের ধারে। সিলেট বিভাগের চুনারুঘাটের রেমা-কালেঙ্গার বনে গিয়েছি বেশ কয়েকবার। অভিজ্ঞ গাইড রুহুল আমিন ভাইকে নিয়ে বারবার খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছি বাঘ-চিতা বাঘেদের। বনের পুরনো বাসিন্দা প্রবীণ ত্রিপুরাদের সঙ্গে কথা বলে যতটুকু মনে হয়েছে, স্বাধীনতাযুদ্ধের পর আর বড় বাঘ দেখা যায়নি এই বনে। ওই সময় বড় একটা যুদ্ধ হয় কালেঙ্গার বনে। গোলাগুলির শব্দে বিরক্ত হয়েই নাকি এই জঙ্গলের বাঘেরা সীমান্ত পেরিয়ে কালা পাহাড়ের দিকে চলে যায়। আর ফিরে আসেনি। আবদুর রহমান চৌধুরীর তিনটি বই পড়েও মুগ্ধ হয়েছি। সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের লাউর ও আশপাশের এলাকায় ১৯৩০-৪০ সালের দিকে মানুষখেকো বা গরুখেকো বাঘ ছিল তখন খুব সাধারণ ঘটনা।
সিলেট বিভাগ থেকে বরং একটু চট্টগ্রামের দিকে যাওয়া যাক। বাঘ বিশেষজ্ঞ খসরু চৌধুরীর একটা লেখায়। ১৯৫৯ সালে কাপ্তাইয়ের বনে শিকার করা একটা বাঘের ছবি দেখেছিলাম। শিকার করেছিলেন একজন মারমা। আশ্চর্যজনকভাবে কাপ্তাইয়ে গিয়ে খুঁজতে খুঁজতে শিলছড়ি মারমাপাড়ায় ওই শিকারির ছেলেকে পেয়ে যাই। ছবিটা দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে পাড়ার লোকেরা। কাপ্তাই বন বিভাগে চাকরি করা মাহফুজ মামার কল্যাণে একসময় কাপ্তাইয়ের রাম পাহাড়, সীতা পাহাড়, কাপ্তাইমুখ খাল এলাকাগুলোতে ঘুরে বেড়িয়েছি। গভীর জঙ্গলের কাঠ কাটতে যাওয়া কাঠুরেরা এখনো দাবি করে হঠাৎ বড় বাঘ দেখার। যদিও এটা আসলেই বাস্তবসম্মত কি না জানি না।
হঠাৎ করেই এনায়েত মওলার 'যখন শিকারি ছিলাম' বইটা হাতে চলে এসেছিল। জীবনে বন নিয়ে যত বই পড়েছি, এতটা ভালো লেগেছে কমই। মনটা হুহু করে ওঠে কাপ্তাই বাঁধ তৈরির জন্য কাসালং রিজার্ভ ফরেস্টের গাছপালা কাটার মহাযজ্ঞের বর্ণনা পড়ে। কাসালং রিজার্ভের মাইনি, মাহিল্লা এসব এলাকায় বাঘ মারার কাহিনিগুলো পড়েও পুরো দিন মন খারাপ করে বসে থেকেছি। ১৯৫৭-৫৮ সালের দিকে বাঘগুলো মারা হয়। বইটি আমাকে এতটাই মোহাচ্ছন্ন করে যে পরে কয়েকবার মাইনি, পাবলাখালি গিয়েছি। পাবলাখালি থেকে নৌকা রিজার্ভ করে কাসালং নদী ধরে মাহিল্লা পেরিয়ে যাওয়ার সময় বারবার মনে হচ্ছিল যেন এনায়েত মওলার সময়কার পরিবেশটা এখনো কল্পনায় দেখতে পাচ্ছি। মাইনি বন বাংলোয় উঠে অবশ্য আশপাশে আর বনের ছিটেফোঁটা দেখিনি। কিন্তু বাংলোর দেয়ালে টাঙানো হাতি খেদার ছবিসহ পুরনো কিছু ছবি দেখে শরীরের রোম দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। তবে রাতে পুরনো ভিজিটরস বুকটা দেখতে গিয়েই চমকেছি। খুঁজতে খুঁজতে ১৯৫০-৬০ সালের মধ্যকার একটি এন্ট্রিতে চোখ আটকে যায়। তারিখটাও ভুলে গেছি। এক ইংরেজ মহিলা লিখেছেন, 'আজ একটা বেঙ্গল টাইগার মেরেছি।' বাঘটার মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত মাপও দেওয়া ছিল। ১৯৫০ সালের অক্টোবরে কাসালং রিজার্ভে বাঘ দেখেছেন বন বিভাগের একসময়কার ইন্সপেক্টর জেনারেল ইউসুফ এস আহমেদ। তাঁর 'উইথ দ্য ওয়াইল্ড অ্যানিমেলস অব বেঙ্গল'কে নির্বিচারে বন্য প্রাণী হত্যার এক প্রামাণ্যগ্রন্থ বলা যেতে পারে। কোনো কোনো সূত্র বলছে, কাসালং-সাজেক এলাকায় এখনো কালেভদ্রে বাঘের দেখা পাওয়া যায়। কয়েক মাস আগে যখন সাজেক গিয়েছিলাম তখন কংলাকপাড়ায় মিজোরামের এক লোকের সঙ্গে দেখা। সে হাত দিয়ে মিজোরামের পাহাড় দেখিয়ে ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলল, 'ওখানে অত্ত বড় বাঘ আছে।' পরে ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখলাম, ঠিক সাজেকের সীমান্তে ভারতের ব্যাঘ্র প্রকল্প 'ডামপা রিজার্ভ'। একেবারে সীমান্ত বিন্দুতেই এর অবস্থান দেখাচ্ছে গুগল আর্থ। ওখানের বাঘ যে শুধু ভারতের বনেই নিজেকে আটকে রাখবে এটা ভাবাটা একটু বাড়াবাড়িই হয়ে যাবে। ডামপার জঙ্গলের কোনো কোনো বাঘের টেরিটরি বাংলাদেশ-ভারত মিলিয়ে হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। ড. মনিরুল খান তাঁর 'টাইগারস ইন ম্যানগ্রোভস' বইয়ে ২০১০ সালে কাসালং রিজার্ভে বাঘ দেখা যাওয়ার খবর নিশ্চিত করেছেন।
চট্টগ্রামের বাঘের অবস্থার কিছুটা চিত্র পেয়েছি এরশাদ উল্লা খানের 'চট্টগ্রামের শিকার কাহিনী' বইয়ে। ১৯৫৫ সালে চুনতির ওহাইদ্যা ঘোনায় (আরাকান রোডের পাশের পাহাড়ে) বাঘ শিকারের বর্ণনা করেছেন লেখক। কক্সবাজারের হিমছড়িতে আস্তানা গাড়া বিশাল আকারের একটি বাঘের কাহিনিও শুনিয়েছেন তিনি। 'বড় বাইঘ্যা' নামে পরিচিত ছিল ওটা, ঘটনাটা পঞ্চাশের দশকের। ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে রাঙামাটির ননিয়ারচরের ধারের মরাচেঙ্গির ধূর্ত এক বাঘের কাহিনিও পড়ি তাঁর এ বইয়ে। এদিকে ড. রেজা খানের 'বাংলাদেশের বন্য প্রাণী' (তৃতীয় খণ্ড) পড়ে জানতে পেরেছি ১৯৮১ সালের দিকে গারো পাহাড়ে, নেত্রকোনা ও কক্সবাজারের ফাঁসিয়াখালি রেঞ্জে তিনটি রয়েল বেঙ্গল টাইগার মারা পড়েছে।
সাঙ্গু-মাতামুহুরি রিজার্ভ সব সময় আমাকে টানে। বিশেষ করে এনাম তালুকদারের একটি ভ্রমণ কাহিনি পড়ে বেশি আগ্রহী হয়ে পড়ি জায়গাটা সম্পর্কে। এরপর মৃদুল ভাই যখন বললেন আন্ধারমানিকের পর থেকে শুরু করে লিকরি কিংবা সাঙ্গু রিজার্ভের আরো গভীরে বাঘ থাকার সম্ভাবনা প্রবল তখন আশার বাতিটা দপ দপ করে জ্বলতে থাকে। কয়েকজন সঙ্গীসহ বেরও হয়েছিলাম সাঙ্গু রিজার্ভ জয় করতে। কিন্তু সীমান্তরক্ষীদের বাধার কারণে বড় মোদক পর্যন্ত গিয়েই ফিরে আসতে হয়। এদিকে মনিরুল খানের 'টাইগারস ইন দ্য ম্যানগ্রোভস' বইয়ে ২০১১ সালে তাজিংডং পাহাড়ে বাঘ শিকারের কথা বলা হয়েছে। বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা বলে যতটুকু বুঝতে পেরেছি সাঙ্গু রিজার্ভের বেশ বড় এলাকা এখনো বাঘ বাসবাসের উপযোগী। বাঘের শিকার হরিণও আছে প্রচুর। অ্যাডভেঞ্চারার সালেহীন জানিয়েছে শেষবার সাঙ্গু রিজার্ভে যখন যায় হরিণের বিস্তর ডাক শুনেছে। আর সীমানার ওপারে মিয়ানমারের জঙ্গল হওয়ায় বাঘেদের জন্য চলাফেরা আরো সহজ।
আমার দাদির বয়স এখন নব্বইয়ের বেশি। বছর সাত-আট আগে তাঁর স্মৃতিশক্তি যখন আরো ভালো ছিল তখন চট্টগ্রাম আর কক্সবাজারে কাটানো ছোটবেলার গল্প শোনাতেন। কক্সবাজার, টেকনাফ, নীলা এসব জায়গায় যখন বাঘের গর্জন শোনার কাহিনি বলতেন আমার মনে হতো যেন আমিও ডাকটা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। নানার বাড়ি হবিগঞ্জের ভারতীয় সীমান্তঘেঁষা মাধবপুরে গিয়েও বাঘে গরু ধরে নিয়ে যাওয়ার পুরনো কাহিনি শুনে রোমাঞ্চিত হই। মাঝে মাঝেই মনে হয়, কোনোভাবে যদি সময়টাকে অন্তত ৫০-৬০ বছর পিছিয়ে দেওয়া যেত তবে হয়তো পার্বত্য চট্টগ্রাম আর সিলেট বিভাগের অনেক জায়গাতেই বাঘদের খুঁজে পেতাম। শুধু গল্প শুনেই খুশি থাকতে হতো না। এর পরও যখনই কারো কাছে সিলেট আর পার্বত্য চট্টগ্রামের কোথাও বাঘ দেখা যাওয়ার কোনো ঘটনা শুনি, আশায় বুক বাঁধি। চোরাশিকারি আর নিষ্ঠুর মানুষের অত্যাচারের পরও এদের দু-চারটি এখনো সাঙ্গু, কাসালং কিংবা পাথারিয়া পাহাড়ে টিকে আছে বলেই মনে হয়। বন বিভাগের পক্ষ থেকে অনুসন্ধান চালিয়ে বিষয়টা নিশ্চিত করে সংরক্ষণে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত এখনই।
১৯৫৭ সালের দিকে কাসালংয়ে এক বাঘিনীর সঙ্গে দুটো মোটামুটি বড় বাঘের বাচ্চা দেখেছিলেন এনায়েত মওলা। এর একটির লেজ ছিল কাটা। এর ঠিক দেড় বছরের মাথায় পার্বত্য চট্টগ্রামের তখনকার ডেপুটি কমিশনার আফজাল আগা একটি বড় বাঘ মারেন। পরে পরীক্ষা করতেই দেখা গেল ওটার লেজ কাটা। কিশোর বয়সী সেই লেজ কাটা বাঘটাই বড় হয়ে মারা পড়েছে শিকারির হাতে সন্দেহ নেই। মনের চোখে যেন লেজ কাটা সেই বাঘটিকে দেখতে পাই। দেড় বছর আগে শিকারির সামনে পড়ে বেঁচে গেলেও আবার শিকারির হাতেই মারা পড়তে হলো। বাঘটা বড্ড বোকা! যদি মানুষের মতো ধূর্ত হতো! তাহলে হয়তো কোনো ছলচাতুরি করে ঠিকই টিকে যেত। আর কাসালংয়ের জঙ্গলে-পাহাড়ে ঘুরে বেড়াতে পারত মনের আনন্দে।