কাজী নজরুল ইসলাম মানুষের প্রতি অঙ্গীকার নিয়ে কবিতা লিখেছেন। সেই সময়ে শিল্প-সাহিত্যের পক্ষে যে ভূমিকা রাখার কথা ছিল তিনি ঠিক সেই ভূমিকায়ই আবির্ভূত হয়েছিলেন। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক যে পরিস্থিতি রয়েছে তাতে নজরুলের সৃষ্টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
অবিভক্ত বাংলার বৈরী সময়ে তিনি বলেছিলেন, “‘মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান’।
নজরুলকে তাই আমাদের বাঁচিয়ে রাখা দরকার।”
গতকাল শুক্রবার জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে এই মন্তব্য করেছেন ইংরেজি দৈনিক নিউ এজের সম্পাদক নুরুল কবির। ‘দ্রোহীর বিচার উত্তর-আধুনিক পরিপ্রেক্ষিত’ শীর্ষক সেমিনারে তিনি এই মন্তব্য করেন। ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী মিলনায়তনে সেমিনারটির আয়োজন করে ছোটকাগজ অনন্য।
এতে প্রবন্ধ পাঠ করেছেন অনন্যর সম্পাদক ড. মাহবুব হাসান। আলোচক ছিলেন নুরুল কবির, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম, কবি ও কথাশিল্পী মজিদ মাহমুদ। কবি জাহাঙ্গীর ফিরোজের সভাপতিত্বে এ আয়োজন উপস্থাপনায় ছিলেন কবি জাকির আবু জাফর।
সেমিনারে নুরুল কবির বলেন, বরাবর উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে ছিলেন নজরুল।
তাঁকে পূর্ব বাংলার মানুষ যত ভালোবাসে পশ্চিম বাংলার মানুষ তত পছন্দ করে না। এটা সম্প্রদায়গত কারণে নয়। ব্রিটিশকাল থেকে ঐতিহাসিকভাবে পশ্চিম বাংলা নানাভাবে ক্ষমতার সুবিধাভোগী। তারা ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির সুবিধা ভোগ করেছে। অন্যদিকে পূর্ব বাংলার কৃষকরা আক্ষরিক অর্থে রক্তাক্ত হয়েছেন, লড়াই করেছেন। তাই দ্রোহী সত্তার কারণে নজরুল পূর্ব বাংলার মানুষের ভালোবাসা বেশি পেয়েছেন।
নুরুল কবির আরো বলেন, নজরুলের কাব্যপ্রতিভা নিপীড়িত মানুষের পক্ষে ব্যবহার হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গে নিজের বসবাস হলেও পূর্ববাংলার মানুষের আকাঙ্ক্ষা তাঁর মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। যে ইতিহাসের পথ দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ এসেছে, সে পথে তিনিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
মোহাম্মদ আজম বলেন, ‘নজরুল যখন সাহিত্যচর্চা করছেন তখন উত্তাল সময় ছিল। রাজনৈতিকতাই ছিল তাঁর প্রধান তৎপরতা। আমাদের অভ্যুত্থানে নজরুলই এককভাবে ব্যবহৃত কবি। তাঁর লেখাপত্রই সবচেয়ে বেশি উদ্বুদ্ধ করেছে। দেয়ালে তাঁর পঙক্তি দিয়ে চিকামারা হয়েছে। নানা কারণে তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি।’
উত্তরাধুনিকতা আজ থেকে অর্ধশত বছর আগে ইউরোপে আবির্ভাব হয়েছে। নজরুলকে উত্তরাধুনিক ধরনে পাঠ করার অনেক সুযোগ আছে মন্তব্য করে মোহাম্মদ আজম বলেন, নজরুলকে বুঝতে ভিন্ন নন্দনতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন হয়।
এ কারণে বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসের বইগুলোতে নজরুলপাঠের জন্য খুব অল্প কয়েক পৃষ্ঠাই বরাদ্দ করা হয়েছে। নীতি ও সমাজ পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষায়ও
নজরুল ছিলেন দ্রোহী। এ কারণে তাঁর কবিতায় শান্ত, সৌম্যতার পরিবর্তে বীভৎস ও বিদ্রোহ রস বেশি। আধুনিকতায় কবিতায় চিত্রকর্মের প্রাধান্য। নজরুলের কবিতা উচ্চকণ্ঠে পড়তে
হয় এবং অনেক কবিতা বহুজনে মিলে পড়ত হয়।
নজরুল গবেষক ও কবি মজিদ মাহমুদ বলেন, ‘নজরুলের বিদ্রোহী সত্তা যত দিন বাঙালি লালন করবে তত দিন আমরা সবাই বাঙালি। তিনি বাঙালির আকাঙ্ক্ষার ধন। তাঁর মাঝেই রয়েছে কাঙ্ক্ষিত বাংলা। আমাদের সংঘাত, বিরোধ, বণ্টন সব ক্ষেত্রে নজরুল দার্শনিক পথ দেখাতে পারেন। নজরুল ছাড়া আমাদের মুক্তি নেই। তাঁকেই আমাদের রাজনৈতিক দার্শনিক হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।’
সভাপতির বক্তব্যে কবি জাহাঙ্গীর ফিরোজ বলেন, যত দিন যুদ্ধ, সংঘাত, নিপীড়ন থাকবে, তত দিন নজরুল প্রাসঙ্গিক থাকবেন।