চারটি ১০ তলা ভবনের নির্মাণ ব্যয় প্রায় দুই শ কোটি টাকা। কিন্তু এই ভবন যারা নির্মাণ করবেন, সেই শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তার জন্য একটি পয়সাও খরচ করা হয়নি। নিরাপত্তা সরঞ্জাম যেমন ঠিকাদার সরবরাহ করেননি, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও নিশ্চিত করতে পারেনি, যা শ্রম আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
২০০৬ সালের শ্রম আইনের ৭৮ ক ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘শ্রমিকের ব্যক্তিগত সুরক্ষা যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও ব্যবহার নিশ্চিত করা ব্যতীত কাউকে নিয়োগ দেওয়া যাবে না।
এ বিষয়ে মালিক একটি রেকর্ড বুক সংরক্ষণ করবেন।’
ক্যাম্পাস সূত্রে জানা যায়, গত বুধবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্র হল ভবনের আটতলা থেকে পড়ে শ্রমিক মো. হাসানের (২০) মৃত্যু হয়েছে। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রধান রেজুয়ান আহমেদ শুভ্র ফেসবুকে লিখেছেন, ‘প্রতিটি দরপত্র দাখিলের সময় ঠিকাদাররা কাজের নিরাপত্তার জন্য টাকা রাখেন। কিন্তু পরবর্তীতে সেই টাকাটা খরচ করেন না, অতিরিক্ত লাভের জন্য। যার ফলে একের পর এক শ্রমিকের মৃত্যু। এর সঙ্গে একটি পরিবারের স্বপ্ন, আশার মৃত্যু হয়, তার সন্তানরা এতিম হয়।
অথচ যারা এ জন্য দায়ী তারা সব সময় অধরা থেকে যায়। প্রয়োজনে এই ধরনের ঠিকাদারদের কালো তালিকাভুক্ত করতে হবে।’
ক্যাম্পাস সূত্র আরো জানায়, গত বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ নির্মাণাধীন ১০ তলা ভবনের ৯ তলায় কাজ করার সময় পড়ে শ্রমিক বাহার তরফদার (৫০) মারা যান। এর কয়েক দিনের ব্যবধানে একই ভবনে ঢালাইয়ের কাজ করার সময় ওপর থেকে পড়ে আরেক শ্রমিক মারা যান।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, শ্রমিকদের জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম ছাড়াই নির্মিত হচ্ছে একের পর এক বহুতল ভবন।
শ্রম আইনে উল্লেখ করা কোনো রেকর্ড বুকও দেখা যায়নি।
নির্মাণ শ্রমিকরা জানান, রাজমিস্ত্রি ও রঙ মিস্ত্রিদের কাজ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। আস্তর ও রং করার ক্ষেত্রে বাঁশের মাচায় দাঁড়িয়ে কাজ করতে হয় দেয়ালের বাইরে। নিচে জাল দেওয়া না থাকায় পিছলে বা মাচা ভেঙে পড়ে গেলে নিশ্চিত মৃত্যু। আবার রডের কাজ করার সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান অনেকে। অনেক সময় নিরাপত্তা সরঞ্জাম ছাড়া উঁচু ভবনে কাজ করতে না চাইলে বেতন আটকে কাজ করতে বাধ্য করেন ঠিকাদাররা, যা শ্রম আইনের লঙ্ঘন। দুর্ঘটনায় মারা গেলে যে সাহায্য-সহযোগিতা করা হয়, সে ক্ষেত্রেও শ্রম আইন মানা হয় না।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশলীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নিরাপত্তার প্রথম বিষয় হচ্ছে প্রতিটি শ্রমিকের হেলমেট। এরপর সেফটি বেল্ট ও গামবুট। আর পুরো ভবনটি এমনভাবে নিরাপত্তা জাল দিয়ে ঢেকে ফেলতে হবে, যাতে অসাবধানে কোনো শ্রমিক পড়ে গেলে যেন সেই জালে আটকে যান। আশপাশে বৈদ্যুতিক স্থাপনা বা তার আছে কি না, সে সম্পর্কেও সতর্ক থাকতে হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী (সিভিল) স্বপন কুমার শীল বলেন, ‘ঠিকাদারদের দরপত্র দেওয়ার সময় বারবার শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়গুলো বলে দেওয়া হয়। এমনকি আমরা যখন ভবন পরিদর্শনে যাই, তখন শ্রমিকদের সতর্ক করি।’
ত্রিশাল উপজেলা নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. সুমান মিয়া বলেন, ‘বহুতল ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হলে ভালো শ্রমিক ছাউনি, খাবার, পানি, বিশ্রাম ও ঘুমানোর ব্যবস্থা থাকা বাধ্যতামূলক। প্রথম তলা থেকেই প্রতি তলায় সুরক্ষা জাল দেওয়ার বিধান রয়েছে। যাতে একজন শ্রমিক ওপর থেকে পড়ে গেলেও মারা না যায়। তবে ৯০ শতাংশ ভবনের নির্মাণকাজে এসব খেয়াল রাখা হয় না। হেমলেট, সেফটি বেল্ট, গামবুট, হাতমোজার মতো নিরাপত্তা সরঞ্জামগুলো ঠিকাদারদের কিনে দেওয়ার কথা। সেগুলো কিনে দেওয়া হয় না। কেউ শ্রম আইন মানেন না।’
ক্যাম্পাস সূত্রে আরো জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণাধীন সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ ভবন, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ ভবন, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছাত্রীহল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রহল। এ চারটি ১০ তলা ভবনের ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা। এ চারটি ভবন নির্মাণে পাঁচটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে।
বঙ্গবন্ধু হল ভবনটির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স ম্যাল্টিপ্ল্যাক্স এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. রিয়াজ খান বলেন, ‘আমরা এখন থেকে সব শ্রমিককে বাধ্য করব সরঞ্জাম পরে কাজ করার জন্য।’
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর উজ্জ্বল কুমার প্রধান বলেন, ‘সেফটি ম্যানুয়াল তৈরি করা হবে। নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ও শ্রমিকদের তা মানতে বাধ্য করে দেওয়া হবে। তাহলে দুর্ঘটনা কমবে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এইচ এম মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত ছাড়া কোনো ভবনে কাজ করতে দেব না।’