প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০২০ সাল থেকেই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত প্রচলিত পরীক্ষা, যা সাধারণত সামেটিভ অ্যাসেসমেন্ট নামে পরিচিত, তা না রাখার ব্যাপারে কাজ শুরু করেছে। এই তিনটি শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক মূল্যায়ন করা হবে। নিঃসন্দেহে এটি চমৎকার একটি উদ্যোগ। এরই মধ্যে এ ব্যাপারে একটি ধারণাপত্র তৈরি করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড।
তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত ধারাবাহিক মূল্যায়ন কিভাবে
- মাছুম বিল্লাহ
notdefined

এই পদ্ধতি প্রচলনের লক্ষ্যে ১০ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে।
বেশি বেশি খাতা দেখে নম্বর প্রদান করার চেয়ে প্রত্যেক শিশুর প্রবৃত্তি, অভ্যাস, জানার কৌশল, সামাজিক হওয়ার পর্যায়গুলো একজন শিক্ষক পর্যবেক্ষণ করবেন। এটি তাঁর গবেষণার বিশাল এবং প্রকৃত ক্ষেত্র। শিক্ষাবিদ জাফর ইকবাল বলেছেন, ‘ছেলে-মেয়েরা যখন যেটি শেখার কথা, সেটি শিখছে কি না, তা অবশ্যই নজরে আনতে হবে। এটি বোঝার জন্য কোনো একটি পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে। শিক্ষকরা যদি টের পান কোনো একটি শিশু পিছিয়ে পড়েছে, তাকে আলাদাভাবে একটু সাহায্য করতে হবে। যদি দেখা যায় কোনো একটি শিশু এগিয়ে গেছে, তার মনের ক্ষুধা মেটানোর ব্যবস্থা করতে হবে। সবাই পাশাপাশি বসে একসঙ্গে শিখবে, কারো সঙ্গে কোনো প্রতিযোগিতা নেই। আমাদের সত্যিকার জীবনে আমরা যখন সত্যিকারের কাজ করি, তখন কিন্তু আমরা কখনোই একজনের সঙ্গে আরেকজনের প্রতিযোগিতা করি না। সবাই মিলেমিশে দায়িত্ব ভাগাভাগি করে কাজ করি। যে যেটি ভালো করতে পারে তাকে সেই কাজটি করতে দিই। তাহলে কেন একটি ছোট শিশুকে প্রতিযোগতাি করে একজন আরেকজনকে হারিয়ে দিতে শেখাব? অবশ্যই প্রতিযোগিতা হবে, কিন্তু সব সময়ই সেটি হবে নিজের সঙ্গে। আগেরবার যেটুকু করেছি এবার তার থেকে একটুখানি ভালো করার চেষ্টা। প্রতিযোগিতায় হেরে গেলে অবশ্য মন খারাপ হয়। শুধু নিজের কাছে হেরে গেলে কখনো মন খারাপ হয় না।’
শিশুদের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে আমাদের আসল উদ্দেশ্য কী? প্রচলিত মানদণ্ড দিয়ে কোনো উপায়ে একজন বা কিছু শিক্ষার্থীকে আলাদা করে ফেলা? একজন শিক্ষার্থী কিংবা এই কয়জন শিক্ষার্থী শ্রেণির সবার চেয়ে আলাদা? সব দিক দিয়ে সেরা? আর বাকিদের মধ্যে একদল মধ্যপন্থী আর একদল একেবারে পেছনের সারির বা ক্লাসে বোঝে না বা দুর্বলতম ইত্যাদি সিল মেরে দেওয়া? আসল ব্যাপার কিন্তু তা নয়। শিশুদের বয়স অনুযায়ী কিছু বিষয় তাদের জানাতে হবে। সেই জানার পদ্ধতিটি হতে হবে আকর্ষণীয়, আনন্দময় এবং ক্ষুধা উদ্রেককারী অর্থাৎ সে ক্লাসে আরো আসতে চাইবে, শিক্ষককে প্রশ্ন করে আরো কিছু জানতে চাইবে, জানার অন্য কৌশলগুলোতে সে অংশগ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করবে। একজন শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে এগুলো ঘটছে কি না শিক্ষক সেগুলো পর্যবেক্ষণ করবেন, পরিচর্যা করবেন চারাগাছের মতো। পানি দিতে হবে, নিড়ানি দিতে হবে, আলো-বাতাসের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তাদের সঠিক বৃদ্ধি ঘটে।
শিশুরা শিক্ষকের সঙ্গে কাজ করছে কি না, নাচছে কি না, মজা করছে কি না, অন্য বন্ধুদের সঙ্গে মিশছে কি না, খেলাধুলা বা শ্রেণিকক্ষের বিভিন্ন গেমসে অংশগ্রহণ করছে কি না—শিক্ষক দিনের পর দিন এগুলো লক্ষ করবেন এবং তার ডায়েরিতে লিখে রাখবেন। যেমন—‘ফজল’ প্রথম দিকে তার শ্রেণিকক্ষের বন্ধুদের সঙ্গে মিশত না, কথা বলত না। ১৫ দিন পর বা এক মাস পর সে তার বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলছে, মিশছে, খেলাধুলা করছে। এটি তার ব্যক্তিগত ডায়েরিতে লিখে রাখবেন।
ক্লাসের পাঠে মনোযোগী, প্রশ্ন করলে উত্তর দেয়, সে নিজে প্রশ্ন করে—এগুলো অভিভাবকসভায়, শিক্ষার্থী কার্ডে লেখা থাকবে। এটিই ধারাবাহিক মূল্যায়ন। যেসব বিষয় শিক্ষার্থীদের পাঠ্য বইয়ে আছে, সেগুলো নিয়ে আলোচনা, খেলা করা বা দলে কাজ করার পর সেগুলোর তথ্য প্রতিষ্ঠানের প্রধান, অন্যান্য শিক্ষক ও অভিভাবকদের জানাতে হবে। সেগুলো জেনেছে কি না হালকা প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে, কিংবা আনন্দপূর্ণ কোনো অ্যাক্টিভিটির মাধ্যমে পরীক্ষা করা যেতে পারে। যেমন—কিছু খাওয়ার আগে হাত ধুতে হয়। ‘তোমরা সবাই বাসায় হাত ধুয়ে খেতে বসো তো?’ বিষয়টি পরীক্ষা করার জন্য ক্লাসে এক দিন হালকা খাওয়ার আয়োজন করা যেতে পারে। শিক্ষক বলবেন, ‘আমরা এখন খাব। খাওয়া শুরু করা যাক।’ শিক্ষক লক্ষ করবেন কোন কোন শিক্ষার্থী বলছে, স্যার আগে আমাদের হাত ধুতে হবে। শিক্ষক বিষয়টি লক্ষ রেখে খাতায় লিপিবদ্ধ করবেন, যারা হাত ধোয়ার কথা বলেনি তাদের আবার স্মরণ করিয়ে দিতে হবে। তারা বাসায় বিষয়টি প্র্যাকটিস করছে কি করছে না, তা এখানে থেকে বোঝা যাবে। ঘড়িতে সময় চিনতে পারার ওপর ইংরেজি বইয়ে ছবিসহ চ্যাপ্টার আছে। ক্লাসের বা বিদ্যালয়ের ঘড়িতে কয়টা বাজে শিক্ষার্থীদের আলাদাভাবে কৌশলে ঘড়ির টাইম দেখে আসতে বলা যেতে পারে। এর দ্বারা অ্যাসেস করা যাবে সে ধারণাটি সঠিকভাবে পেয়েছে কি না, অর্থাৎ ঘড়ি দেখে সময় বুঝতে পারে কি না। শিক্ষক প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির বইয়ের গল্পগুলো সুন্দরভাবে পড়িয়ে শোনাতে পারেন এবং তার ওপর সহজ ও হালকা কয়েকটি প্রশ্ন করে তাদের অনুধাবন ও মনোযোগী হওয়ার বিষয় জানতে পারেন।
প্রচলিত নিয়মে অভিভাবকরা দেখতে চায় তার মেয়ে বা ছেলে বাংলায় বা ইংরেজিতে বা গণিতে কত নম্বর পেয়েছে। ছেলে বা মেয়ে যদি ৮০ নম্বর পায় বা তার চেয়ে বেশি পায় তাহলেই অভিভাবক খুশি, অভিভাবক কিন্তু কখনো জিজ্ঞেস করছে না যে তার মেয়ে সুন্দরভাবে বাংলা পড়তে পারে কি না, ইংরেজি পড়তে পারে কি না। সাধারণ যোগ-বিয়োগ তার শ্রেণি অনুযায়ী সে শিখেছে কি না, তার বাচ্চা ক্লাসের অন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিশে কি না। অভিভাবকরা যতটা না আগ্রহী তাদের বাচ্চারা কোন বিষয়ে কত নম্বর পেয়েছে, তার সিকিভাগ আগ্রহও তাদের নেই যে বাচ্চারা আসলে কী শিখেছে। উপরোক্ত বিষয়গুলোতে তাদের বাচ্চার অবস্থান কোথায়। এ জন্য শুধু অভিভাবকরা দায়ী নয়, কারণ নম্বর দেখে ভর্তি, নম্বর দেখে ‘ভালো’ শিক্ষার্থী ও দুর্বল শিক্ষার্থী বিচার করা প্রাতিষ্ঠানিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মূল্যায়নের অংশ। অভিভাবকদের বোঝাতে হবে যে প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতিতে একজন শিশু শিক্ষার্থীর প্রকৃত মেধার আবিষ্কার অনেকাংশেই সম্ভব হয় না। আর শিক্ষাব্যবস্থার সবচেয়ে স্ট্রেসফুল অংশ হচ্ছে পরীক্ষা, যা থেকে শিশুদের রেহাই দেওয়া এখন সময়ের দাবি। শিক্ষক যদি শিশু শিক্ষার্থীদের গ্র্যাজুয়াল ডেভেলপমেন্ট বা ধারাবাহিক উন্নয়ন কিভাবে ও কতটা ঘটছে, সেগুলো অভিভাবকদের জানাতে পারেন, তাহলে বিষয়টিতে তারাও ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হবে এবং শিশুরা রক্ষা পাবে পরীক্ষা নামক ভীতিপ্রদ ও জগদ্দল পাথরের কবল থেকে। আনন্দময় হবে তাদের শিশু শিক্ষাজীবন।
লেখক : ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত সাবেক ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজ শিক্ষক
masumbillah65@gmail.com
সম্পর্কিত খবর