আজ ৩ মার্চ। বিশ্ব বন্য প্রাণী দিবস। জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) আহ্বানে বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে দিনটি। ২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৮তম অধিবেশনে ৩ মার্চকে বন্য প্রাণী ও উদ্ভিদকুলের প্রতি জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিশ্ব বন্য প্রাণী দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
বন্য প্রাণীর জীবনধারণের সংকটে করণীয়
- ধরিত্রী সরকার সবুজ
অন্যান্য

ইউএনইপি বলছে, সাগরতলে এ পর্যন্ত প্রায় দুই লাখ প্রজাতি চিহ্নিত করা গেছে, তবে প্রকৃত প্রজাতির সংখ্যা পৌঁছবে প্রায় মিলিয়নে। সাগরতল এবং উপকূলীয় সম্পদের পরিমাণ প্রতিবছর প্রায় তিন ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার হবে, যা বিশ্বব্যাপী মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫ শতাংশ হবে। জীবিকার জন্য তিন বিলিয়নের বেশি মানুষ সাগরতল ও উপকূলীয় জীববৈচিত্র্যের ওপর নির্ভরশীল।
ইউএনইপি বলছে, অত্যাধিক আহরণ, দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আক্রান্ত হচ্ছে সাগরের ৪০ শতাংশ এলাকা, আক্রান্ত হচ্ছে সে অংশের জীববৈচিত্র্য। এ কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উপকূলীয় অঞ্চলের নারী ও পুরুষ। কারণ তাদের জীবিকা সরাসরি এ সম্পদের ওপর নির্ভরশীল। এবারের বিশ্ব বন্য প্রাণী দিবসটিতেই সর্বপ্রথম জলজ জীববৈচিত্র্যকে ফোকাস করা হয়েছে এবং এ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরিতে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
এবারের বিশ্ব বন্য প্রাণী দিবসের প্রতিপাদ্যটি সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি) বা টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের অভীষ্ট-১৪ ‘লাইফ বিলো ওয়াটার’-এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই নির্ধারণ করা হয়েছে। এসডিজির অভীষ্ট-১৪তে পানিতে থাকা উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতির উন্নয়নের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়নের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এবারের বিশ্ব বন্য প্রাণী দিবসটিতেও নদী, খাল-বিল, জলাভূমি ও সাগরতলের প্রাণবৈচিত্র্যের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এবং তারা কী প্রতিকূল অবস্থা মোকাবেলা করছে সেটি বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরা হচ্ছে।
জুওলজিক্যাল সোসাইটি অব লন্ডন (জেএসএল) ও ওয়ার্ল্ডওয়াইল্ড লাইফ ফাউন্ডেশন (ডাব্লিউডাব্লিউএফ) কর্তৃক ২০১৬ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত ‘লিভিং প্লানেট অ্যাসেসমেন্ট’ নামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলেছে, গত চার দশকে বিশ্বে বন্য প্রাণীর সংখ্যা ৫৮ শতাংশ কমেছে। তাদের গবেষণায় বন্য প্রাণীর তালিকায় জলাভূমি, মরুভূমি এবং স্থলে থাকা তিন হাজার ৭০০ প্রজাতির মেরুদণ্ডী প্রাণীকে ধরা হয়েছে বলে গবেষকরা উল্লেখ করেছেন।
আমরা জানি, বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্যের অনন্য আধার। এ দেশের পাহাড়, বনাঞ্চল, হাওর, সাগরে রয়েছে নানা বিচিত্র প্রাণীর বিচরণ। আমাদের বেশির ভাগ পর্যটনকেন্দ্রও গড়ে উঠেছে প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যকে কেন্দ্র করে। সুন্দরবন, বান্দরবান-খাগড়াছড়ি-রাঙামাটির বনাঞ্চল, লাউয়াছড়া সোয়াম্প ফরেস্ট, হাকালুকি, টাঙ্গুয়া ও হাইল হাওর, কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিনস, কুয়াকাটায় অজস্র প্রাণীর আবাস।
প্রবাল ও শৈবালের অপূর্ব লীলাভূমি সেন্ট মার্টিনস ও এর সংলগ্ন এলাকায় আছে ৬৮ প্রজাতির প্রবাল, ২৩৪ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ১৮৭ প্রজাতির শামুক ও ঝিনুক, ৪০ প্রজাতির কাঁকড়া, ২৯ প্রজাতির সরীসৃপ, ১২০ প্রজাতির পাখি, পাঁচ প্রজাতির কচ্ছপসহ আরো বিভিন্ন প্রজাতির জীব। ঢাকা থেকে প্রায় ১৬০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত লাউয়াছড়া বনে রয়েছে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, ২৪৬ প্রজাতির পাখি, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীসহ অগণিত পোকা-মাকড়।
২০১০ সালে রাশিয়ায় বিশ্ব বাঘ সম্মেলনে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, ২০২২ সালের মধ্যে বিশ্বে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করা হবে। সে লক্ষ্য সামনে নিয়ে গঠন করা হয় গ্লোবাল টাইগার ইনিশিয়েটিভ (জিটিআই)। বিশ্ব বন্য প্রাণী তহবিলের (ডাব্লিউডাব্লিউএফ) প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১১ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে বিশ্বে প্রথমবারের মতো বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১১ সালে বিশ্বে বাঘের সংখ্যা ছিল তিন হাজার ২০০ আর ২০১৬ সালে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় তিন হাজার ৮৯০-তে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারত, নেপাল ও রাশিয়ায় বাঘের সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধির কোনো সুসংবাদ পাওয়া যাচ্ছে না। ২০১৫ সালে বন বিভাগ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ১০৬। সুন্দরবনের বাঘের মল ও লোমের নমুনার জিনগত বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে যুক্তরাজ্যের কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদল তাদের সমীক্ষা থেকে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা পেয়েছে ১২১। এ দুটি গবেষণা থেকে ধারণা করা যায়, সুন্দরবনে ১০০ থেকে ১২০টি বাঘ রয়েছে।
সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য সরকারের চেষ্টা অব্যাহত আছে। রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত বাঘ সম্মেলনের পর থেকে সরকারের বন বিভাগ সুন্দরবন ও বন্য প্রাণী রক্ষায় অনেক বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। কারণ আমাদের গৌরবের প্রতীক রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্মান জড়িয়ে আছে। বাঘের সংখ্যার সঙ্গে সঙ্গে বাঘের খাবার কী পরিমাণ আছে, তা নিয়েও গবেষণা হওয়া দরকার। সুন্দরবনের আয়তন অনুযায়ী পর্যাপ্ত পরিমাণে হরিণ ও শূকরের মতো বাঘের শিকার প্রাণীর উপস্থিতি নিশ্চিত করা দরকার।
বাংলাদেশ বিশ্বে সর্বপ্রথম ডলফিনের অভয়ারণ্য ঘোষণা করেছে। সুন্দরবনের তিনটি এলাকাকে সরকার প্রথম অভয়ারণ্য ঘোষণা করে। বাংলাদেশের দেখাদেখি কম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, পাকিস্তান, ভারত ও নেপাল ডলফিনের জন্য তাদের নদীতে অভয়ারণ্য ঘোষণা করে। বাংলাদেশে এখন প্রায় সাত হাজার ডলফিন রয়েছে। দেশে থাকা ১২ প্রজাতির ডলফিনের মধ্যে স্বাদু পানির ডলফিন আছে দুই প্রজাতির। দেশে ডলফিনের বড় অংশের বাস সুন্দরবনে। সাত হাজারের মধ্যে প্রায় ছয় হাজারই আছে সুন্দরবনে। এর মধ্যে ইরাবতী ডলফিনই পাঁচ হাজার ৮০০টি। চট্টগ্রামের হালদা নদীতে আছে প্রায় ২০০ ইরাবতী ডলফিন। ডলফিন রক্ষার জন্য নেওয়া বাংলাদেশের উদ্যোগ সত্যি প্রশংসনীয়। তবে সুন্দরবনের বিভিন্ন নদীতে পেতে রাখা জেলেদের কারেন্ট জালে আটকা পড়ে এবং হালদা নদীতে ইঞ্জিন ট্রলারের আঘাতে কিছু ডলফিন মারা যায়। ডলফিনের বিচরণ এলাকায় এ ধরনের ট্রলারের চলাচল এখন নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
বিশ্ব বন্য প্রাণী দিবসটি পালন করা হয় জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে। বিভিন্ন দেশের সরকার এবং নানা সংগঠন দিবসটি উপলক্ষে আলোচনাসভা, শোভাযাত্রা ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণ মেলার আয়োজন করে। কিন্তু নানা প্রতিকূলতায় ক্রমেই বন্য প্রাণীর সংখ্যা কমছে। আমরা সমুদ্রসীমা জয় করেছি। এ অহংকার ও গৌরবে সিক্ত হয়ে সমুদ্রসীমা সুরক্ষা, সমুদ্রসম্পদ আহরণ, সমুদ্রের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং এ অফুরন্ত সম্পদ জনগণের কল্যাণে ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক : পরিবেশ বিষয়ের লেখক, ইংল্যান্ডের গ্রিনিচ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘এনভায়রনমেন্টাল কনজারভেশন’ বিষয়ে মাস্টার্স, পিএইচডি গবেষক
সম্পর্কিত খবর