১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের স্বনামধন্য মেধাবী শিক্ষক ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বুলেট ও বেয়নেটের আঘাতে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রক্রিয়ায় ১৯৬৯ সাল ছিল এক বিশাল গণ-আন্দোলনের বছর। ১৯৬৬ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রদত্ত ছয় দফা বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল দলিল হিসেবে প্রত্যেক বাঙালিকে উজ্জীবিত করেছিল এবং পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এই প্রায়-ভঙ্গুর রাষ্ট্রটিকে বিভিন্নভাবে টিকিয়ে রাখার কূটকৌশল হিসেবে তখন কাল্পনিক এক ‘আগরতলা মিথ্যা মামলা’র নামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তাঁর প্রিয় সংগঠন আওয়ামী লীগকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। অতীত ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে এটি স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যবহিত পর থেকেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নিষ্পেষণে বাঙালি জাতি এক চরম হতাশায় পতিত হয়।
স্মরণ
ড. শামসুজ্জোহার আত্মত্যাগ
- ড. এ এইচ এম জেহাদুল করিম
অন্যান্য

এই প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতেই ১৯৬৯ সালের ৮ জানুয়ারি তাঁর ৩২ নম্বরের বাড়িতে দেশের সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে ‘গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়েছিল। গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ অতি দ্রুত ১২ জানুয়ারি পল্টনে এক বিশাল জনসভার আয়োজন করে এবং এরই ধারাবাহিকতায় ১৭ জানুয়ারি সমগ্র দেশে এক দাবি দিবস পালন করা হয়।
ড. জোহার মৃত্যুর ঘটনা শুধু দেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তবর্তী বিভাগীয় শহর রাজশাহীর মধ্যেই আবদ্ধ থাকেনি, তাঁর মৃত্যু দেশের চলমান আন্দোলনকেও এক ভিন্নতর জঙ্গি-গতি এনে দেয়। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন সময়ের ছাত্ররা বিভিন্ন হল থেকে কারফিউ ভঙ্গ করে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ি। এরই মধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. জোহার মৃত্যুসংবাদ সমগ্র ঢাকা শহরের জনগণকে রাতের মধ্যেই উত্তাল করে তোলে এবং সব বাধা উপেক্ষা করে জনতার ঢল রাস্তায় নেমে পড়ে।
ড. জোহার মৃত্যু মূলত আইয়ুবের পতনকে ত্বরান্বিত করে এবং দেশময় সব সরকারি নিয়ন্ত্রণ ভেঙে যায়। বলা বাহুল্য, ড. জোহার মৃত্যুর মাত্র ৩৪ দিনের মধ্যেই জেনারেল আইয়ুব খান তাঁর পরবর্তী সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হন। এরই ধারাবাহিকতায় আমরাও ধীরে ধীরে স্বাধীনতাযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাই এবং এর পরবর্তী ইতিহাস সবারই জানা আছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এখনো ড. জোহাকে আঁকড়ে ধরে আছে শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের অন্য কোনো স্থানে ড. জোহাকে নিয়ে কোনো আলোচনা অনুষ্ঠান প্রচারিত হয় না। দেশে বর্তমানে এতগুলো টিভি চ্যানেল থাকলেও ড. জোহাকে নিয়ে কোথাও কোনো বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করতে দেখা যায় না বললেই চলে। এমনকি খোদ রাজশাহীতেই শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া আর কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও তাঁকে নিয়ে সেভাবে কোনো স্মরণানুষ্ঠান হয় না। দেশে এখন মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে উজ্জীবিত সরকার ক্ষমতায় রয়েছে। ড. জোহার স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য এই দিনটিকে জাতীয়ভাবে উদ্যাপনের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীকে বিনীতভাবে অনুরোধ করছি।
লেখক : জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক
সম্পর্কিত খবর