সম্প্রতি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। তারা কেউই আমার সরাসরি শিক্ষার্থী নয়, তাই কাউকেই আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। কিন্তু মৃত্যুসংবাদ শোনার পর আমি তাদের ফেসবুক প্রফাইল ঘেঁটেছি এবং অদ্ভুত কিছু তথ্য আমি আবিষ্কার করেছি। আশ্চর্য হলেও সত্যি, তাদের প্রত্যেকেই নানাভাবে যোগাযোগমাধ্যমে তাদের জীবনের হতাশার বিষয়টি জানান দিয়েছে।
বয়ঃসন্ধিক্ষণের সমস্যা ও শিক্ষকের ভূমিকা
- জুরানা আজিজ
notdefined

কয়েক মাস আগে সিএনএনের প্রখ্যাত উপস্থাপক এহুনি বোরডাইন যখন আত্মহত্যা করেন তখন এক দল গবেষক চমৎকার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলেন, যেখানে বলা হয়েছিল আত্মহত্যার পরিকল্পনাকারীদের মাঝে আত্মহত্যা প্রচেষ্টার কিছুদিন আগে থেকে কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যাবে। এক. তারা প্রচুর সময় ঘুমাবে। দুই. তাদের আচরণগত পরিবর্তন দেখা দেবে এবং তারা নানা মাধ্যমে তাদের বিষণ্নতার বিষয়টি প্রকাশ করবে।
আমাদের জীবনটা দিন দিন জটিলতর হয়ে যাচ্ছে। কেউ স্বীকার করুক আর না-ই করুক তথ্য-প্রযুক্তির মাধ্যমগুলোর অত্যধিক ব্যবহার এই জটিলতাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। আমরা আজকাল এই প্রযুক্তির ব্যবহারে এতটাই ব্যস্ত থাকি যে আমাদের চারপাশের মানুষগুলোকে লক্ষ করার মতো সময় আমাদের অপ্রতুল।
আত্মহত্যার অনেক কারণ থাকলেও একটি কারণ সুস্পষ্ট—তীব্র হতাশাবোধ। নানা কারণে আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশাবোধ তৈরি হয়। আমার নাতিদীর্ঘ শিক্ষকজীবনে আমি যখনই হতাশাগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের দেখেছি, তাদের হতাশার অন্যতম কারণ ছিল সম্পর্কের টানাপড়েন, দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও অন্যান্য। আমরা শিক্ষকরাও অবশ্যই ব্যস্ত থাকি। কিন্তু এই ব্যস্ততার মাঝেও ক্লাসে পাঠদানের সময় আমাদের ছাত্রদের চোখের ভাষাগুলো যদি আমরা একটু পড়তে চেষ্টা করি, আমি নিশ্চিত আমরা সবাই তাদের বিষণ্নতার বিষয়টি ধরতে পারব। আমি আসলে এতক্ষণে এটিই বলার অবতারণা করছিলাম। হ্যাঁ, শিক্ষক হিসেবে আত্মহত্যা প্রতিরোধে আমরা কী করতে পারি। আমাদের ছাত্রদের জীবনের নানা রকম সমস্যা হয়তো আমরা সমাধান করতে পারি না; কিন্তু আমরা তাদের বুঝতে চেষ্টা করতে পারি, তাদের সংগ্রামের গল্পগুলো শুনতে পারি, তাদের চোখের বিষণ্নতার বিষয়টির কারণ জানতে চাইতে পারি কিংবা তাদের মন খারাপের বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিতে পারি—যেগুলো তাদের মনে দীর্ঘ ট্রমা তৈরি থেকে বাঁচতে সাহায্য করবে।
পাশ্চাত্যের অনেক দেশে বয়ঃসন্ধিক্ষণের শিক্ষার্থীদের নানা বিষয় সুন্দর করে ক্লাসে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয়, তাদের সাহিত্যের একটি বিশেষ শাখা শুধু এই শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে লক্ষ রেখে রচিত হয়। সেখানে শিক্ষার্থীদের নানা রকম সমস্যা তুলে ধরা হয়, সেগুলো খোলামেলা আলোচনা হয়, এগুলো নিয়ে সেমিনার আয়োজন করা হয় এবং ক্লাসে যখন পাঠ-পরিকল্পনা তৈরি করা হয় তখন শিক্ষক সচেতনভাবে তাদের ট্রমার বিষয়টি তুলে ধরেন এবং সেটির সম্ভাব্য সমাধানের আলোচনাও করেন। সব বিষয়ের শিক্ষক কাজটি না করতে পারলেও ভাষা শিক্ষা, সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন—এসব বিষয়ের শিক্ষকরা সহজেই এ বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে পারেন। যদি তা-ও না সম্ভব হয়—ক্লাস শেষে আলাদা সময়ে একজন শিক্ষক ছাত্রদের সমস্যাগুলো জানতে চাইতে পারেন।
আমাদের শিক্ষকদের মনে রাখা প্রয়োজন—বয়ঃসন্ধিতে শিক্ষার্থীদের সমস্যাগুলো তুচ্ছ ও ছোট হলেও তাদের মানসিক অপরিপক্বতার কারণে তাদের বিশেষ একটি আশ্রয় প্রয়োজন হয়। তুচ্ছ সমস্যাগুলো যখন প্রকট আকার ধারণ করে তখন তাদের একটি মহীরুহ প্রয়োজন হয়। আমাদের কি দায়িত্ব নয় তাদের জন্য তখন মহীরুহের ছায়া নিশ্চিত করা? ছাত্ররা সমস্যার
সমাধানের পথগুলো নিজেরাই জানে। কিন্তু তাদের সংকটকালীন সময়গুলো উত্তরণের জন্য শিক্ষকদের সহানুভূতির বড় প্রয়োজন। শিক্ষকতার অন্যতম উদ্দেশ্য শিক্ষার্থীদের নৈতিক শিক্ষা পরিবেশন। আমাদের দেশে ক্লাসরুমে এটি কতটা পরিবেশিত হচ্ছে বলা মুশকিল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অবশ্যই এটি করবেন—এটি কাম্য। আমার সব সময় মনে হয়েছে, বিপৎকালীন সময়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছাত্রটি আমাদের কাছে একটুখানি আশার বাণী শুনতে চায়। পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীরা যদি একটুখানি বেশি অনুপ্রেরণা পায়, তাদের পারফরম্যান্স বহুগুণে বৃদ্ধি পায়—এটি পরীক্ষিত। আমাদের অবশ্যই তাদের বুঝতে চেষ্টা করতে হবে। তাদের মনোজগতের কষ্ট-আনন্দ এগুলো পড়তে জানতে হবে, তাদের বিষণ্ন সময়গুলোতে তাদের বারবার মনে করিয়ে দিতে হবে—জীবন সুন্দর, তাদের অনেক কাজ বাকি জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমি বিশ্বাস করি, যারাই আত্মহত্যা করেছে, এ রকম একটুখানি বিশ্বাস তাদের প্রয়োজন ছিল। তাই আর কোনো মৃত্যু নয়। আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের বলতে চাই—তোমাদের জীবন আমাদের জন্য অনেক প্রয়োজনীয়, তোমরা অনেক প্রয়োজনীয়। প্রয়োজনীয় তোমাদের সুন্দরভাবে বেঁচে থাকা।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পর্কিত খবর