শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ সেদিন শেষ হয়ে গেলে কী হতো? নিঃসন্দেহে বলা যায়, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের প্রাণভোমরা ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি ও বাঙালি সংস্কৃতিভিত্তিক দর্শন আবার দীর্ঘ মেয়াদের জন্য স্তব্ধ হয়ে যেত। নামে বাংলাদেশ থাকলেও কার্যত আমরা এত দিনে একটি চরম সাম্প্রদায়িক ও ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বাসিন্দা হয়ে যেতাম। সেটা হতে পারেনি
বছর ঘুরে আবার ২১ আগস্ট এসেছে। ২০০৪ সালের এই দিনে ঢাকার সবচেয়ে ব্যস্ততম এলাকা গুলিস্তানে তত্কালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী, বর্তমানের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সন্ত্রাসবিরোধী জনসভার ওপর জঙ্গি আক্রমণ হয় এবং তাতে প্রখ্যাত নারী নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নারী-পুরুষ প্রাণ হারান।
এই ঘটনার ১২ বছর পর তার প্রধান টার্গেট শেখ হাসিনা যখন প্রধানমন্ত্রী তখন গত ১ জুলাই ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশানের একটি রেস্তোরাঁয় জঙ্গিরা আক্রমণ চালায় এবং তাতে দুজন পুলিশ সদস্যসহ পাঁচজন বাংলাদেশি ও ১৭ জন বিদেশি নাগরিক নিহত হন। দুটি ঘটনার মধ্যে সময়ের ব্যবধান ১২ বছর, দুই জায়গার অবস্থানগত দূরত্ব প্রায় ১০ কিলোমিটার এবং আক্রমণকারীদের আপাত টার্গেট ভিন্ন হলেও তাদের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যর মধ্যে কতখানি মিল-অমিল আছে তা বোঝানোর জন্যই আজকের এই লেখার অবতারণা।
আমাদের রাষ্ট্রের নাম বাংলাদেশ। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা পূর্ণ রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করেছি, যার প্রতিফলন রয়েছে আমাদের সংবিধানের একেবারে প্রথম পৃষ্ঠার প্রথম দুই লাইনে।
যদিও ঐতিহাসিকভাবে ১৯৪৭ সালেও আমরা একবার স্বাধীন হয়েছিলাম, আমাদের দেশের নাম ছিল পাকিস্তান। মানুষের মতো রাষ্ট্রের বেলায়ও স্বতন্ত্র নামের প্রয়োজন হয় প্রধানত আইডেন্টিফিকেশনের সুবিধার জন্য। বৈশিষ্ট্য, চিন্তা, চেতনা, আদর্শ-দর্শনের প্রতিফলনের মধ্য দিয়ে তার সঠিক পরিচয় পাওয়া যায়। তাই শুধু দেশের নাম পাল্টানোর জন্য এত ত্যাগ আর জীবন আমরা উত্সর্গ করিনি। বর্তমান সময়ের জঙ্গি তত্পরতা ও অন্যান্য ঘটনাপ্রবাহের সঠিক, নির্মোহ বিশ্লেষণ, কারণ উদ্ঘাটন ও প্রতিকারের পথ বের করতে হলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে প্রশ্নের উত্তর আমাদের খুঁজতে হবে তা হলো—কেন আমাদের দ্বিতীয়বার স্বাধীন হওয়ার প্রয়োজন পড়ল। একটি দেশের চালিকাশক্তি ও পরিচালনার মূলমন্ত্র নিহিত থাকে তার রাষ্ট্রীয় দর্শনের মধ্যে, যেখান থেকে সব চিন্তা-চেতনার উন্মেষ ঘটে, আইন প্রণীত হয়, শিক্ষা-দীক্ষাসহ পুরো জাতির মানুষ কাঠামো তৈরি হয়, সাংস্কৃতিক, ঐতিহ্যের লালনপালন ও সমৃদ্ধি ঘটে। এই জায়গায় পাকিস্তানি শাসকরা শুরুতেই সাম্প্রদায়িক ও ধর্মতন্ত্রের আশ্রয় নেয়, যা আধুনিক জগতে অচল। অচল দর্শনে রাষ্ট্র চালাতে গিয়ে তারা ধর্মের নামে মিথ্যাচার করে এবং বাঙালি জাতির সহজাত উদার ও গণতান্ত্রিক চেতনাকে দমন করার জন্য অস্ত্রের আশ্রয় নেয়। শুরু হয় বাঙালি ভার্সেস পাঞ্জাবি লড়াই। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালির রাজনৈতিক যুদ্ধের ধারাবাহিকতায় একাত্তরে এসে সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করি। ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করে রচিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের মূল দর্শন, রাষ্ট্রের প্রাণভোমরা। এই উপাদানের অনুপস্থিতি ঘটলে সেটা বাংলাদেশ থাকে না, অন্য কোনো রাষ্ট্র হয়ে যায়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যার মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা প্রথম সামরিক শাসক এই কাজটিই করলেন। আবার পাকিস্তানের মতো সাম্প্রদায়িক ও ধর্মভিত্তিক অচল ও প্রত্যাখ্যাত দর্শনকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করলেন, একাত্তরে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশের প্রায় আপাতমৃত্যু হয়ে গেল। কিন্তু এত ত্যাগ ও প্রাণের বিনিময়ে পাওয়া বাংলাদেশের প্রাণভোমরার মৃত্যু এ দেশের মানুষ মেনে নেয় না। ফলে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে শুরু হয় যুদ্ধ। যুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষে মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র অসাম্প্রদায়িক ও বাঙালি সংস্কৃতিভিত্তিক দর্শন ভার্সেস সাম্প্রদায়িক ও ধর্মভিত্তিক দর্শন। রাজনৈতিকভাবে প্রথম পক্ষের নেতৃত্বে রয়েছেন আওয়ামী লীগ ও তার নেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। দ্বিতীয় পক্ষে বিএনপি-জামায়াত ও তাদের অন্যান্য উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠী।
২০০৪ সালের ২১ আগস্টের ঘটনা যখন ঘটে তখন জামায়াত-বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এবং আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে, শেখ হাসিনা বিরোধী দলের নেত্রী। এ-সংক্রান্ত মামলা এখন বিচারিক আদালতে নিষ্পত্তি হওয়ার শেষ পর্যায়ে আছে বলে শুনেছি। অভিযুক্ত হিসেবে আছেন বিএনপির প্রধান কর্ণধার, অফিশিয়ালি লন্ডনে পলাতক তারেক রহমান, জামায়াত-বিএনপি সরকারের তত্কালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবরসহ ওই সময়ের আরো কয়েকজন নেতা-মন্ত্রী এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এ বিষয়ে চূড়ান্ত কথা আদালতই বলবেন। তবে তখন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবরের ‘লুকিং ফর শত্রুজ’ বিখ্যাত ডায়ালগ, জজ মিয়া নামক এক অসহায় দিনমজুরকে শত্রু হিসেবে আবিষ্কার, ঘটনার পরের দিনই সব আলামত মুছে ফেলা, ঘটনাস্থলে উপস্থিত শত শত পুলিশের রহস্যজনক আচরণ, ঘটনাস্থলে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ফ্যাক্টরিতে তৈরি গ্রেনেড পাওয়া, জেলের অভ্যন্তরে, যেখানে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা ছিলেন, সেখানে একই গ্রেনেড পাওয়া, জঙ্গি সংগঠন হুজির নেতা মুফতি হান্নানের স্বীকারোক্তিসহ অন্যান্য পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির বিশ্লেষণে মনে হয় তত্কালীন জামায়াত-বিএনপি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ধর্মান্ধ জঙ্গিগোষ্ঠী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের সব সিনিয়র নেতাকে হত্যা করার জন্যই ওই আক্রমণ চালানো হয়। রাষ্ট্রযন্ত্র ও সরকার সেদিন একাকার হয়ে যায়।
শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ সেদিন শেষ হয়ে গেলে কী হতো? নিঃসন্দেহে বলা যায়, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের প্রাণভোমরা ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি ও বাঙালি সংস্কৃতিভিত্তিক দর্শন আবার দীর্ঘ মেয়াদের জন্য স্তব্ধ হয়ে যেত। নামে বাংলাদেশ থাকলেও কার্যত আমরা এত দিনে একটি চরম সাম্প্রদায়িক ও ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বাসিন্দা হয়ে যেতাম। জেএমবি, হুজি, হিযবুত তাহ্রীরসহ অসংখ্য বাহারি নামের জঙ্গি সংগঠন ২০০৪-২০০৫ সময়ে যেভাবে রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানকে চ্যালেঞ্জ করেছিল, তা অব্যাহত থাকত এবং এত দিনে বাংলাদেশ আইএস, আল-কায়েদা ও পাকিস্তানি তালেবানদের আরেকটি ব্যাটল গ্রাউন্ডে পরিণত হতো। সেটা হতে পারেনি। একবিংশ শতাব্দীর সহজাত দৃষ্টিভঙ্গির কারণে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে ধর্মান্ধ উগ্রবাদী সাম্প্রদায়িক দর্শনের কোনো স্থান নেই। গ্লোবাল কনসেপ্টে বাংলাদেশ এর বাইরে নয়। উপরন্তু বিশাল প্রতিবেশী ভারতের উপলব্ধিতে এসেছে তাদের ভূ-খণ্ডগত অখণ্ডতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে বাংলাদেশে একটি উদার, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় থাকা আবশ্যক। বাংলাদেশ যদি সাম্প্রদায়িক দর্শনপ্রসূত জঙ্গিবাদের কবলে পড়ে অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে, তাহলে পার্শ্ববর্তী দুই জায়ান্ট ভারত ও চীনের নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়বে। ভারত-চীন পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও এই জায়গায় তারা একমত। শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পররাষ্ট্রনীতির কারণে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর নীতি অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বাংলাদেশের জামায়াতিরা আজ আর সেখানে আগের মতো একতরফা সুবিধা পাচ্ছে না।
সুতরাং বিশ্ব ও আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতি এবং নিরাপত্তার সমীকরণের অনুকূল পরিবেশ ও বৃহত্তর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সহজাত উদার, অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে মুক্তিযুদ্ধের মূল দর্শনের রাজনীতি আজ বাংলাদেশে ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে। এর বিপরীত পক্ষ পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছে এবং এদের কেউ কেউ এখন অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে। ফলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আওতায় তৈরি সশস্ত্র সংগঠনগুলোকে তারা সাম্প্রতিক সময়ে নতুন কৌশলে মাঠে নামিয়েছে। পুরনো লড়াইয়ের নতুন রূপ, যার প্রথম শুরু পাকিস্তানি আমলে এবং আবার শুরু ১৯৭৫ সালের পর; যার প্রতিফলনে ২০১৫ সালে এসে আমরা দেখেছি জঙ্গিরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষ, ধর্মগুরু-যাজক ও বিদেশি নাগরিকদের আক্রমণ ও হত্যা করছে; যার উদাহরণ ১ জুলাই গুলশানের রেস্তোরাঁয় আহাররত বিদেশি নাগরিকদের ওপর আক্রমণ। জঙ্গিদের গৃহীত কৌশল ও উল্লিখিত শ্রেণির টার্গেট নির্ধারণের লক্ষ্য হলো—যাতে ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের চাপে বিজেপি সরকার বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে, জীবনের ভয়ে পশ্চিমা বিশ্বের উন্নয়ন সহযোগীরা বাংলাদেশ ত্যাগ করে, উন্নয়নযাত্রা থমকে যায়। এর পরিণতিতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলে সাধারণ মানুষ সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করলে জঙ্গি ও তাদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকদের বাংলাদেশে টিকে থাকার পথ সুগম হতো। গুলশান ঘটনার পর পশ্চিমা বিশ্বের প্রতিক্রিয়ায় জঙ্গিদের লক্ষ্য অর্জনের কিছুটা ইঙ্গিত প্রথম দিকে দেখা গেছে, যদিও ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। প্রাথমিক শক ওয়েভ প্রশমিত হওয়ার পর জাপানসহ পশ্চিমা বিশ্বও বাংলাদেশের পাশে আগের মতোই থাকার ঘোষণা দিয়েছে। সম্প্রতি সিঙ্গাপুরে ধৃত ও শাস্তি হওয়া জঙ্গি এবং ২০১৪ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের খাগড়াগড়ে গ্রেপ্তার হওয়া বাংলাদেশি জেএমবি সদস্যদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য মতে তাদের প্রস্তুতি ও জঙ্গি তত্পরতার মূল উদ্দেশ্য শেখ হাসিনাকে হত্যা করা এবং তাঁর সরকারকে উত্খাত করা। সুতরাং ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের ১২ বছর পর ২০১৬ সালের ১ জুলাই হত্যাকাণ্ডের মূল লক্ষ্য ও জায়গার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই, কোনো দূরত্ব নেই।
লেখক : কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
sikder52@gmail.com