"এই সঞ্চয়িতা-সঙ্গে থাকলে আমি আর কিছুই চাই না। নাটক নয়, উপন্যাস নয়, কবিগুরুর গান ও কবিতাই আমার বেশি প্রিয়। সব মিলিয়ে এগার বছর কাটিয়েছি জেলে। আমার সব সময়ের সঙ্গী ছিল এই সঞ্চয়িতা।
সোনার বাংলা তোমায় ভালোবাসি
মুহম্মদ সবুর

সেই আটচল্লিশেই যখন জেলে গেলেন মাতৃভাষা বাংলাকে রক্ষার জন্য, তখনো রবীন্দ্রনাথ জুগিয়েছেন প্রেরণা। মায়ের ভাষার বিলুপ্তি মানেই জাতি হিসেবে বাঙালির বিলুপ্তি- এমনটা মেনে নিতে পারেননি শেখ মুজিব। তাই 'বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি বারে বারে হেলিস না' গেয়ে প্রতি পদক্ষেপেই বাঙালির স্বার্থরক্ষার আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়েছেন, 'জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য' বানিয়ে। বাঙালির স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের অগ্রদূত হয়ে জেগেছিলেন জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর সেই সংগ্রামের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ছিলেন যিনি পঞ্চাশ, ষাট ও মুক্তিযুদ্ধে- বাঙালির সমগ্র সংগ্রামেরই অংশবিশেষ।
১৯৫৬ সালে ঢাকায় পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশন বসেছিল। পাকিস্তানের পশ্চিমাংশ থেকে আসা সংসদ সদস্যদের সম্মানে কার্জন হলে আয়োজন করা হয়েছিল অনুষ্ঠানের। উদ্যোক্তা ছিলেন গণপরিষদ সদস্য শেখ মুজিবুর রহমান। অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু বাঙালি সংস্কৃতিকেই তুলে ধরেছিলেন। তাতে নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, ডি এল রায়, লোকগানও ছিল। ডি এল রায়ের 'ধন ধান্য পুষ্প ভরা' বঙ্গবন্ধুর প্রিয় গান বলেই গাওয়া হয়েছিল। অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসংগীতজ্ঞ সন্জীদা খাতুনও ছিলেন আমন্ত্রিত শিল্পী। তিনি মঞ্চে আসার আগে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে তাঁকে বলা হলো 'আমার সোনার বাংলা' গাইবার জন্য। কারণ তিনি চাইছেন পাকিস্তানিদের কাছে 'সোনার বাংলা'র প্রীতি ও ভালোবাসার জানান দিতে। কিন্তু সন্জীদা খাতুনের গানটি পুরো মুখস্থ ছিল না। "বেকায়দা হলো, কারণ অত লম্বা পাঁচ স্তবকের গানটি যে আমার মুখস্থ নেই। গীতবিতানের খোঁজ পড়ল। বই হাতে পেয়ে কোনোমতে অত বড় গানটি গেয়েছিলাম আমি। গানটি বাঙালিকে কতখানি আবেগতাড়িত করে, সেটি বোঝানোর জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের গানটি শোনাতে চেয়েছিলেন শেখ মুজিব। তখনো 'বঙ্গবন্ধু' নামটি দেওয়া হয়নি তাকে।" এরপর থেকে সন্জীদা খাতুনসহ অন্য শিল্পীরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে 'আমার সোনার বাংলা' গাইতে থাকেন। আর ১৯৬১ সাল থেকে একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরির অন্যতম গান হয়ে ওঠে আমার সোনার বাংলা। এ গানকে যেন বঙ্গবন্ধু আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত করে দিলেন।
সেই পঞ্চাশের দশকেই শেখ মুজিবের চেতনায় 'আমার সোনার বাংলা' আসন নেয়, আর এই গানকে বাংলার চিত্ররূপময় গান হিসেবে নিজেও আওড়াতেন। হয়তো তখনই ভেবেছিলেন বাংলা স্বাধীন হলে এই গানকে জাতীয় সংগীত করবেন। আরো একটি গান তিনি আওড়াতেন, দ্বিজেন্দ্র লাল রায়ের 'ধন ধান্য পুষ্প ভরা' গানটি। এই গানের মধ্যেও বাংলাকে পেতেন তিনি।
তারও আগে সেই পঞ্চাশ দশকে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা ভাষায় বক্তৃতা প্রদান, রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে সোচ্চার ছিলেন বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বরাবর বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানতে থাকে। আরবি ও রোমান হরফে বাংলা লেখা শুধু নয়, বাংলা ভাষায় উর্দু, আরবি, ফারসি শব্দের যথেচ্ছাচার ব্যবহার চালানোর অপচেষ্টা চলে। কিন্তু বাঙালি নিশ্চুপ থাকার নয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পঞ্চাশের দশকে যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী হওয়ার পর প্রথমেই ঢাকায় গড়ে তুললেন চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা। বাঙালির জীবন ধারায় নতুন সংযোজন ঘটল। পূর্ববঙ্গেও চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হলো। বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতিকে তুলে ধরে চলচ্চিত্র নির্মাণে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এমনকি ষাটের দশকে পূর্ববাংলায় উর্দু ছবির অত্যধিক প্রদর্শনের বিরুদ্ধে এবং বাংলা ছবির করুণ অবস্থায় ক্ষোভ প্রকাশও করেছিলেন।
সত্তর সালের গোড়ায় বঙ্গবন্ধু জাহিদুর রহিমকে দায়িত্ব দেন 'আমার সোনার বাংলা' গানের রেকর্ড প্রকাশের জন্য। কলিম শরাফী তখন ই এম আই গ্রামোফোন কম্পানির ঢাকার কর্ণধার। ১৯৬৯ ও ৭০ সালের মধ্যে এই কম্পানি রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীদের ২০০ গান রেকর্ডে ধারণ করে। প্রথম ১২টি গানের একটা গুচ্ছ গেয়েছিলেন সন্জীদা খাতুন, ফাহমিদা খাতুন, রাখী চক্রবর্তী, আফসারি খানম, বিলকিস নাসিরউদ্দিন ও কলিম শরাফী। 'আমার সোনার বাংলা' গানের রেকর্ড প্রকাশে ছায়ানটের শিল্পীরাও এগিয়ে আসেন। কলিম শরাফীর ব্যবস্থাপনায়, আবদুল আহাদের পরিচালনায়, সন্জীদা খাতুনের বাসায় তাঁরই যত্ন-আত্তিতে, খাটুনিতে তৈরি হয় গানটি। সম্মেলক কণ্ঠে ছিলেন জাহিদুর রহিম, অজিত রায়, ইকবাল আহমদ, ফাহমিদা খাতুন, জাহানারা ইসলাম, হামিদা আতিক, নাসরীন আহমদ প্রমুখ। সর্বত্র বাজতে থাকে এই রেকর্ড। অসহযোগ আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধকালে বিক্ষুব্ধ শিল্পীসমাজের কণ্ঠে এই গান ধ্বনিত হতো। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে শিল্পী কলিম শরাফী রমনা রেসকোর্সে লাখো লাখো জনতার উপস্থিতিতে সোনার বাংলাসহ রবীন্দ্রসংগীতের এক সেট গানের রেকর্ড উপহার দিয়েছিলেন সাড়ে সাত কোটি মানুষের বিজয়ী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে। ইস্ট পাকিস্তান গ্রামোফোন কম্পানি ভবিষ্যৎ জাতীয় সংগীতের আরেকটি ডিস্ক বের করেছিল একাত্তরের ফেব্রুয়ারিতে। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে বিক্ষুব্ধ শিল্পীসমাজের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুকেও এই রেকর্ড উপহার দেওয়া হয়েছিল। ১৯৭০ সালে জহির রায়হান তাঁর 'জীবন থেকে নেয়া' চলচ্চিত্রে 'আমার সোনার বাংলা' গানটি ব্যবহার করেন। অসহযোগ আন্দোলনের সময় দিকে দিকে বেজে ওঠে 'আমার সোনার বাংলা' গান। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই ভবিতব্য বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে জনগণ 'আমার সোনার বাংলা'কে নির্বাচন করেছিল। আর এই গ্রহণের ক্ষেত্রটি তৈরি করেছিলেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ৩ মার্চ গানটিকে জাতীয় সংগীত হিসেবে ঘোষণা দিয়ে গানের প্রচারপত্র বিলি করেছে। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে স্থানীয় মিশনারি স্কুলের শিক্ষার্থীরা 'আমার সোনার বাংলা' গেয়েছিল।
১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পর 'আমার সোনার বাংলা'র প্রথম ১০ চরণ বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতরূপে আর ডি এল রায়ের 'ধন ধান্য পুষ্প ভরা' জাতীয় গীত হিসেবে গৃহীত হয়। আর বঙ্গবন্ধু এভাবেই তাঁর স্বপ্নকে রূপ দিলেন মূর্ততায়।
মনে আছে, ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি। বাংলাদেশের জনক বঙ্গবন্ধু প্রথম আনুষ্ঠানিক সফরে গেলেন কলকাতা। যে কলকাতা তিনি ছেড়ে এসেছিলেন সাতচলি্লশের পর, ছাত্রনেতা যখন। আর এবার গেলেন বাঙালি জাতির জনক হিসেবে। ১০ ফেব্রুয়ারি প্যারেড ময়দানে বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন তিনি। জনসভার শুরুতে সুচিত্রা মিত্রের নেতৃত্বে শত শত শিল্পী মঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে সমবেত কণ্ঠে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত 'আমার সোনার বাংলা' পরিবেশন করেছিলেন। সেদিন অভিভূত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুসহ উপস্থিত জনসমুদ্র। স্বাধীনতার পর কেবিনেট ডিভিশনের সভায় বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ও জাতীয় গীত হিসেবে দুটি গান অনুমোদন করা হয়।
বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু ও রবীন্দ্রনাথকে প্রতিষ্ঠিত হতে হয়েছে অনেক ত্যাগ, তিতিক্ষা, সংগ্রাম-আন্দোলনের মাধ্যমে। দীর্ঘ পরাধীন একটি পশ্চাৎপদ জাতিকে তাঁরা আত্মবোধনে উদ্বোধন করেছিলেন। আর সেই জাতিকে তার ভাষা, সংস্কৃতিসহ একটি রাষ্ট্র উপহার দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর। 'বাঙালি' বলে যে জাতির কথা রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, বঙ্গবন্ধু সেই জাতিকেই আবিষ্কার করেন সোনার বাংলায়। এনে দেন আত্মমর্যাদা, স্বাধীন সত্তা। এই বাংলাকে ভালোবেসে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন 'আমার সোনার বাংলা' গান। আর বঙ্গবন্ধু তা একটি জাতির জাতীয় সংগীতে রূপান্তর করে চিরস্থায়ী করে দেন। সেই জাতীয় সংগীতের সঠিক সুর প্রয়োগ যদি না হয়, তবে বঙ্গবন্ধু বা রবীন্দ্রনাথের কাছে দায়বদ্ধতা শুধু নয়, একটি জাতির প্রতি অবহেলার নামান্তর হবে তা।
লেখক : কবি, গবেষক, প্রাবন্ধিক
masabur71@gmail.com
সম্পর্কিত খবর