বাংলাদেশে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের (ওএইচসিএইচআর) মিশন মানবাধিকারের যেকোনো গুরুতর লঙ্ঘনের প্রতিরোধ ও প্রতিকার, বিগত সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য জবাবদিহি নিশ্চিত করার ওপর মনোনিবেশ করবে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং গতকাল শনিবার এক বিবৃতিতে এ কথা জানিয়েছে।
এর আগে গত শুক্রবার জেনেভায় ওএইচসিএইচআর জানায়, ওএইচসিএইচআর বাংলাদেশে মিশন খুলতে যাচ্ছে। গত সপ্তাহে এ বিষয়ে ওএইচসিএইচআর ও বাংলাদেশ সরকার তিন বছর মেয়াদি একটি সমঝোতা স্মারক সই করেছে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং বিবৃতিতে জানায়, মানবাধিকারের সুরক্ষা ও বিকাশে সহায়তা করার লক্ষ্যে একটি মিশন খোলার জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর এবং বাংলাদেশ সরকার তিন বছর মেয়াদি একটি সমঝোতা স্মারক সই করেছে। মিশনটির লক্ষ্য হচ্ছে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সংগঠনগুলোকে প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তা প্রদান। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে সক্ষমতা বৃদ্ধি, আইনি সহায়তা ও প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংক্রান্ত বাধ্যবাধকতা পূরণে বাংলাদেশকে সহায়তা করা।
প্রেস উইং জানায়, এই উদ্যোগটি ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে সংঘটিত গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের পটভূমিতে গৃহীত সংস্কার ও জবাবদিহির প্রতি বাংলাদেশের অব্যাহত প্রতিশ্রুতিই প্রতিফলিত করে।
বিবৃতিতে প্রেস উইং জানায়, ‘আমরা স্বীকার করি, জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থাগুলোর আদর্শিক অবস্থান নিয়ে সমাজের একটি অংশের উদ্বেগ রয়েছে। বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থা একটি শক্তিশালী সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।’
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘অনেক নাগরিক আমাদের জানিয়েছেন, যেকোনো আন্তর্জাতিক অংশীদারির ক্ষেত্রে এই মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত। এই পরিপ্রেক্ষিতে ওএইচসিএইচআর মিশন মানবাধিকারের যেকোনো গুরুতর লঙ্ঘনের প্রতিরোধ ও প্রতিকার, বিগত সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য জবাবদিহি নিশ্চিত করার ওপর মনোনিবেশ করবে।
এটি দেশের প্রতিষ্ঠিত আইনি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোর বাইরে থাকা কোনো সামাজিক এজেন্ডাকে উৎসাহিত করবে না।’
প্রেস উইং জানায়, ‘আমরা আশা করি যে মিশনটি সব সময় স্বচ্ছতা প্রদর্শন করবে এবং স্থানীয় অংশীদারদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা বজায় রাখবে। জাতিসংঘ আমাদের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বাস্তবতার প্রতি পূর্ণ সম্মান রেখে বাংলাদেশে কাজ করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
প্রেস উইংয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘যদি সরকার মনে করে যে এই অংশীদারি আর জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, তাহলে সরকার এই সমঝোতা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করার সার্বভৌম কর্তৃত্ব সংরক্ষণ করে।’
প্রেস উইং বলেছে, বিগত সরকারের সময় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গণহত্যার দায়মুক্তির যেসব ঘটনা ঘটেছে সে সময় যদি এই ধরনের একটি সংস্থার কার্যক্রম চলমান থাকত, তাহলে সেই অপরাধের অনেক ঘটনা হয়তো সঠিকভাবে তদন্ত, লিপিবদ্ধ ও বিচার করা হতো।
প্রেস উইং আরো বলেছে, ‘আজকের এই সময়ে মানবাধিকারের প্রতি আমাদের প্রতিশ্রুতি আদর্শের ওপর নয়, ন্যায়বিচারের ওপর ভিত্তি করে হওয়া উচিত। সরকার এই অংশীদারিকে আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করার এবং আমাদের নাগরিকদের সুরক্ষা বৃদ্ধির একটি সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করে, যা আমাদের আইনের মাধ্যমে গঠিত ও মূল্যবোধ দ্বারা পরিচালিত হবে এবং আমাদের জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে।’
মার্কিন স্বার্থে মানবাধিকার মিশন খুলতে দেওয়া হবে না : হেফাজত
এদিকে অন্তর্বর্তী সরকার ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর স্থাপন সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করায় তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী ও মহাসচিব সাজেদুর রহমান। তাঁরা বলেন, মার্কিন স্বার্থে এ দেশে মানবাধিকার মিশন খুলতে দেওয়া হবে না। গতকাল এক বিবৃতিতে তাঁরা এ কথা বলেন। বিবৃতিতে তাঁরা অবিলম্বে চুক্তি বাতিল না করলে কঠোর কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন।
হেফাজতের দুই নেতা বলেন, জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক দপ্তর সাধারণত যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোতেই দেখা যায়। সেই দপ্তর এখন আমাদের দেশে হওয়াটা সম্মানজনক নয়। বাংলাদেশ কোনো যুদ্ধপীড়িত দেশ না হওয়া সত্ত্বেও এখানে তাদের দপ্তর স্থাপন করতে চাওয়াটা রহস্যজনক। তা ছাড়া জুলাই বিপ্লবের দাবিগুলো বাস্তবায়িত হলে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের অফিস এ দেশে কোনো দরকার নেই।
তাঁরা বলেন, অতীতে বিভিন্ন দেশি-বিদেশি সংস্থা বাংলাদেশের মুসলিম পারিবারিক আইন, ইসলামী শরিয়াহ ও ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর হস্তক্ষেপের চেষ্টা করেছে। নারী সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনেও একই চিত্র দেখা গেছে। এ ছাড়া সমকামী তথা এলজিবিটি ইস্যুটি জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের মানবাধিকার দর্শন ও নীতিমালার অন্তর্ভুক্ত। সম্প্রতি বাংলাদেশের ধর্মীয়-সামাজিক মূল্যবোধ অবজ্ঞা করে একজন সমকামী ব্যক্তিকে বাংলাদেশে জাতিসংঘের নতুন দূত নিয়োগ দেওয়ার সংবাদ গণমাধ্যমে এসেছে।
হেফাজত নেতারা বলেন, আমাদের দেশে নারী ইস্যুর আড়ালে অভিশপ্ত এলজিবিটি সম্প্রদায় প্রকাশ্যে নানা অপতৎপরতা শুরু করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম ঘিরে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র আরো বিস্তৃত হচ্ছে। এ অবস্থায় এ দেশে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের অফিস খোলার পরিণতি আমাদের কাছে পরিষ্কার। দৃশ্যত আমাদের দেশের সার্বভৌমত্ব এবং ধর্মীয়-সামাজিক মূল্যবোধ রক্ষার দায় বোধ করছে না অন্তর্বর্তী সরকার। তাই বলে আমরা ওলামায়ে কেরাম চুপ করে বসে থাকতে পারি না।