এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) এক হাজার ৮০০ কোটি টাকার ঋণে বাস্তবায়নযোগ্য ‘টিভিইটি টিচার্স ফর দ্য ফিউচার (টিটিএফ) প্রোগ্রাম’ প্রকল্পটিকে ঘিরে উঠেছে নানা প্রশ্ন। কারিগরি শিক্ষকদের আধুনিক প্রশিক্ষণের নামে এই প্রকল্পে ভবন নির্মাণ, বিদেশভ্রমণ, পরামর্শক নিয়োগসহ বিভিন্ন খাতে অস্বাভাবিক ব্যয়ের অভিযোগ উঠেছে। প্রতি বর্গমিটারে ভবন নির্মাণে খরচ দেখানো হয়েছে ৬৮ হাজার টাকার বেশি, যা অন্যান্য সরকারি প্রকল্পের তুলনায় অনেক বেশি।
এ ছাড়া একজন কর্মকর্তার বিদেশে প্রশিক্ষণে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৭ লাখ টাকারও বেশি।
যদিও পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রকল্পটির বাস্তবায়ন এক হাজার ২০০ কোটি টাকায় সম্ভব ছিল। উদ্দেশ্য হচ্ছে পুরো এক হাজার ৮০০ কোটি টাকার এডিবি ঋণ ছাড় করানো।
এই বিতর্কিত প্রকল্পসহ আট হাজার ৯৭৪ কোটি টাকার মোট ১৭টি উন্নয়ন প্রকল্পের অনুমোদনের জন্য আজ মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় তোলা হচ্ছে। একনেক সভায় সভাপতিত্ব করবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
সূত্র অনুযায়ী, অনাবাসিক ভবন নির্মাণে প্রতি বর্গমিটারে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৮ হাজার ৯৮৫ টাকা এবং আবাসিক ভবনে ৬৭ হাজার ৫৭৪ টাকা, যেখানে সাধারণত এই খরচ ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকার মধ্যে সীমিত থাকে। শুধু তা-ই নয়, ৩৭৮ জনের বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৬৫ কোটি ৪১ লাখ টাকা, অর্থাৎ জনপ্রতি ১৭.৩০ লাখ টাকা। অথচ পরিকল্পনা কর্মকর্তাদের মতে, প্রকল্পটি এক হাজার ২০০ কোটি টাকায়ও বাস্তবায়ন করা সম্ভব ছিল। অতিরিক্ত খরচের খাত দেখিয়ে এডিবির সম্পূর্ণ ঋণ ছাড়ের অপচেষ্টা করা হয়েছে বলে অভিযোগ তাঁদের।
পরামর্শক খাতে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন পরিকল্পনাবিদরা। কারণ ভবন নির্মাণের দায়িত্বে থাকা শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের নিজস্ব জনবল দিয়েই এই কাজ সম্ভব ছিল।
প্রকল্পটিতে এত ব্যয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে এর আগে পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের প্রধান অতিরিক্ত সচিব আব্দুর রউফ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পিইসি সভায় প্রকল্পের অস্তাভাবিক ব্যয় কমানো হবে। ভবন নির্মাণে এত ব্যয় দেওয়া হবে না। পিইসি সভার পরে দেখবেন এই ব্যয় থাকবে না।
অথচ প্রকল্পটি পিইসি সভা পার করে বেশি ব্যয়েই অনুমোদন হতে চলেছে।’
এর আগে প্রকল্পটির ডিপিপি ভবন নির্মাণ অংশ তৈরির দায়িত্বে থাকা শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ডেস্ক-৪) নির্বাহী প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম জানান, এই ধরনের ভবন নির্মাণে প্রতি বর্গমিটারে ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়। পরে নিজের তৈরি প্রকল্পে বেশি ব্যয় দেখে নিজেই অবাক হন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, একদিকে রাষ্ট্রের সংকটময় অর্থনৈতিক বাস্তবতা, অন্যদিকে টিভিইটি প্রকল্পে এমন অস্বাভাবিক ব্যয় প্রশ্ন তোলে, আসলেই কি উন্নয়ন হচ্ছে, নাকি উন্নয়নের নামে আবারও চলছে লুটপাট? প্রকল্পগুলো অনুমোদন দেওয়া হলেও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি ছাড়া বাস্তবায়ন কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে জনমনে শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
একনেক সভায় অনুমোদন হতে যাওয়া প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দুটি প্রকল্প, উপজেলা কমপ্লেক্স সম্প্রসারণ প্রকল্প (দ্বিতীয় পর্যায়) (দ্বিতীয় সংশোধিত), বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এবং স্থানীয় জনসমাজের সমন্বিত সেবা ও জীবন-জীবিকা উন্নয়ন প্রকল্প। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প সাতটি বিভাগীয় শহরে ২০০ শয্যার মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র নির্মাণ। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প নবনির্মিত চারটি মেরিন একাডেমিতে সিমুলেটর ও সংশ্লিষ্ট সুবিধাদি স্থাপনের মাধ্যমে সক্ষমতা বৃদ্ধি। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে তৃতীয় সাবমেরিন কেবল স্থাপন (প্রস্তাবিত দ্বিতীয় সংশোধিত)। শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প সার সংরক্ষণ ও বিতরণ সুবিধার জন্য দেশের বিভিন্ন জেলায় ১৩টি নতুন বাফার গোডাউন নির্মাণ (তৃতীয় সংশোধিত চতুর্থবার বৃদ্ধি)। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দুটি প্রকল্প, কিশোর-কিশোরী ক্লাব স্থাপন (প্রথম সংশোধিত) প্রকল্প, নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিকার ও প্রতিরোধে সমন্বিত সেবা জোরদারকরণ এবং কুইক রেসপন্স টিমের কার্যক্রমসহ ১৭ প্রকল্প।