দেশে যখন জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে, কর্মসংস্থানের সুযোগ কমছে, তখন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে গরিবদের জন্য বরাদ্দ কমানো হয়েছে। এতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদ ও উন্নয়ন বিশ্লেষকরা।
বাজেটে দারিদ্র্য বিমোচন সংক্রান্ত খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে চার লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকা, যা গত বছরের তুলনায় ১২ হাজার ৯৯৪ কোটি টাকা কম। আগের অর্থবছরে এই খাতে বরাদ্দ ছিল চার লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা।
গত বছর বাজেটের ৫৭.৯ শতাংশ ব্যয় দারিদ্র্য হ্রাস করার কথা ছিল। এবার তা নেমে এসেছে ৫৬.৭৭ শতাংশে। অর্থাৎ দুই বছরের ব্যবধানে বাজেটের দারিদ্র্য নিরসন সংক্রান্ত বরাদ্দ প্রায় ৩.৯ শতাংশ কমেছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, মূল্যস্ফীতি, কর্মসংস্থানের ঘাটতি ও বিনিয়োগহীনতার এই সময়ে গরিবদের জন্য বরাদ্দ কমানো ‘অযৌক্তিক’।
বরং সরাসরি সহায়তা বাড়ানো দরকার ছিল।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. মোস্তফা কে মুজেরি বলেন, ‘এই বাজেট হতাশাজনক। বরাদ্দ কমানোর সিদ্ধান্ত দরিদ্র মানুষের জীবনে আরো চাপ তৈরি করবে।’ তিনি নগদ সহায়তা এবং কম দামে খাদ্য সরবরাহ বাড়ানোর তাগিদ দেন।
প্রস্তাবিত বাজেটে তিন লাখ এক হাজার কোটি টাকা (৩৮.১০ শতাংশ) ব্যয় করা হবে সরাসরি দারিদ্র্য হ্রাসে। আর এক লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা (১৮.৬৬ শতাংশ) খরচ হবে সেসব খাতে, যেগুলো পরোক্ষভাবে গরিবদের উপকারে আসবে।
অর্থ বিভাগ জানিয়েছে, পাঁচ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার পরিচালন ব্যয়ের মধ্যে ৫৩.০৬ শতাংশ দারিদ্র্য হ্রাসে ব্যবহারের পরিকল্পনা রয়েছে। উন্নয়ন বাজেটের ৬৬.৪৬ শতাংশও ব্যয় হবে দরিদ্রবান্ধব খাতে।
বরাদ্দের তথ্য বাস্তবতার সঙ্গে মিলছে না
প্রস্তাবিত বাজেটে বলা হয়েছে, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ৯৮ শতাংশ বরাদ্দ দারিদ্র্য নিরসনে ব্যয় করা হবে।
এরপর রয়েছে সেতু বিভাগ (৯৪%), পরিসংখ্যান বিভাগ (৯০%), দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা (৮৮%), রেলপথ (৮৭%) ও প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয় (৮৭%)।
অন্যদিকে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়, মহাহিসাব নিরীক্ষক কার্যালয় বা জাতীয় সংসদের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে দারিদ্র্য নিরসনে কোনো বরাদ্দ নেই বা একেবারেই নগণ্য। সংসদের জন্য এই খাতে বরাদ্দ মাত্র ০.২৫ শতাংশ।
বিতর্ক রয়েছে পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের বরাদ্দ নিয়েও। এ বিভাগে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪৬৭ কোটি টাকা। বাজেটে দাবি করা হয়েছে, এর ৯০.৪৪ শতাংশ দারিদ্র্য হ্রাসে ব্যয় হবে। কিন্তু বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, এর বড় অংশই খরচ হচ্ছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন, প্রশাসনিক খরচ, প্রশিক্ষণ ও যন্ত্রপাতি কেনায়। কেবল বেতন-ভাতার জন্য বরাদ্দ ১৬২ কোটি টাকা, যা পুরো বাজেটের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি।
এই বিভাগের কার্যপরিধিতে সরাসরি দারিদ্র্য হ্রাস নেই। বরং তারা সরকারের জন্য তথ্য সরবরাহ করে, যাতে কৌশল নির্ধারণে সহায়তা করা যায়। কিন্তু ২০২২ সালের পর থেকে বিবিএস নতুন করে দারিদ্র্য হারের তথ্য প্রকাশ করেনি। এতে দারিদ্র্য পর্যবেক্ষণ কার্যক্রমেই ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
অবকাঠামো উন্নয়নকে দারিদ্র্য নিরসনের খাতে দেখানোর প্রশ্ন
বাজেটে সেতু বিভাগের ছয় হাজার ২২ কোটি টাকার মধ্যে ৯৪ শতাংশ অর্থ দারিদ্র্য হ্রাসে ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে, সেতু নির্মাণে কর্মসংস্থান তৈরি হয়, যা দরিদ্রদের জন্য সুফল বয়ে আনে। উদাহরণ হিসেবে পদ্মা সেতুর মাধ্যমে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১.২৩ শতাংশ বাড়বে এবং দারিদ্র্য ০.৮৪ শতাংশ হারে কমবে—এমন দাবি করা হয়েছে।
তবে বাস্তবতা ভিন্ন। বিশ্লেষকদের মতে, পদ্মা সেতু বা কর্ণফুলী টানেলের সুবিধা মূলত উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভোগে এসেছে। গরিব মানুষের এ ধরনের অবকাঠামো থেকে প্রত্যক্ষ সুবিধা সীমিত।
এমনই আরেক প্রশ্ন উঠেছে রেল, সড়ক ও নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দের শ্রেণিবিন্যাস নিয়ে। রেল মন্ত্রণালয় যেখানে বরাদ্দের ৮৭.৬৬ শতাংশ দারিদ্র্য হ্রাসে দেখাচ্ছে, সেখানে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে এ হার মাত্র ৪৩.৬ শতাংশ। বিশ্লেষকদের মতে, এতে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে।
সব মিলিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দারিদ্র্য বিমোচনের নামে বরাদ্দের যেসব হিসাব বাজেট ডকুমেন্টে দেওয়া হয়েছে, তার বাস্তব প্রতিফলন কম। ফলে সরকারের দারিদ্র্য হ্রাসের অঙ্গীকার প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘যেসব খাতে দারিদ্র্য নিরসনের বরাদ্দ দেখানো হয়েছে, সেগুলোর অনেকটাই খাপছাড়া। বাজেটে বরাদ্দের চেয়ে বরং দরকার সঠিক বাস্তবায়ন এবং গরিবদের হাতে সরাসরি সহায়তা পৌঁছানো।’
ড. সেলিম রায়হানের মতে, ‘অর্থনীতি বড় হয়েছে ঠিকই, কিন্তু গরিব মানুষের আয় বাড়েনি। বাজেটের টাকা সঠিকভাবে খরচ না হলে দারিদ্র্য থেকে মুক্তি মিলবে না।’